আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনার মতো ৭ নভেম্বরকে নিয়েও বিতর্ক শেষ হয়নি। বরং যত দিন যাচ্ছে ততই বিতর্ক বিস্তৃৃত হচ্ছে। পাখা মেলছে। স¤প্রতি আমাদের সময়ে ৭ নভেম্বর নিয়ে মীর শওকত ও হাসানুল হক ইনুর পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের পর নতুন করে আলোচনায় আসছে ৭ নভেম্বরের বিষয়টি। এই ঐতিহাসিক দিনের পটভূমিকা, প্রস্ততি ও চূড়ান্তপর্বের মূল সাক্ষী জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু।
৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় গণঅভ্যুত্থানের অপারেশনাল পরিকল্পনার শেষ মিটিং হয় কর্নেল তাহেরের বড় ভাই আবু ইউসুফ বীরবিক্রমের বন্ধু প্রকৌশলী আনোয়ার সিদ্দিকের গুলশানের বাসভবনে। সেখানে তাহেরের প্রধান সহযোগী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইনু। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে যখন নতুন ইতিহাসের গোড়াপত্তনের প্রস্ততি চলছে, টু ফিল্ড রেজিমেন্টের জওয়ানরা যখন উত্তেজিত তখন রাতের আঁধারে একটি সাদা জিপে চেপে কর্নেল তাহের সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে যান। তার জিপে ছিলেন গণবাহিনীর পলিটিক্যাল কমিশনার হাসানুল হক ইনু। ৭ নভেম্বর ভোরে রেডিও স্টেশনে বিপ্লবের ঘোষণা দেয়ার সময়ও উপস্থিত ছিলেন ইনু।
তিনিই পারেন ৭ নভেম্বরের ভেতরের ও বাইরের সকল তথ্য ও ঘটনার বিস্তৃৃত বিবরণ দিতে। জীবিতদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কাছে থেকে দেখেছেন সিপাহি বিপ্লবের মধ্যদিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে।
পীর হাবিবুর রহমানের সঙ্গে আলাপচারিতায় ইনু ৭ নভেম্বর বিষয়ে অনেক কথাই বলেছেন। কিন্তু তিনি খুব কৌশলে এড়িয়ে গেছেন একটি বিষয়। যা কেবলমাত্র ৭ নভেম্বরের পরিকল্পনাকেই পাল্টে দেয়নি গোটা দেশের ইতিহাসকেই প্রবাহিত করেছে ভিন্ন স্রোতে।
বিষয়টি হচ্ছে, জিয়াকে মুক্ত করার পর কর্নেল তাহের কেন তাকে সেনানিবাসের বাইরে আনতে চাইছিলেন? একপর্যায়ে তিনি জিয়াকে বাইরে আনার জন্য প্রবল চাপও সৃষ্টি করেন। নানা কৌশলও অবলম্বন করেন। কেন? জিয়া সেনানিবাস ছেড়ে বাইরে আসতে না চাইলে তাহেরের সঙ্গে তুমুল বাকবিতণ্ডাও হয়। তাহের চিৎকার করতে করতে ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। এখন প্রশ্ন উঠছে, তাহের কি জিয়াকে বাইরে এনে বন্দি করতে চেয়েছিলেন?
জাসদ যখন অভ্যুত্থানের প্রস্ততি নিচ্ছিল তখন একটি কৌশলগত প্রশ্ন ওঠে- ‘কে এই বিপ্লবের নেতা? কার নামে স্লোগান দিয়ে বিপ্লবী সিপাহিরা সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসবে?’ দলীয় সিদ্ধান্ত হয়, কর্নেল তাহেরের নামেই জিন্দাবাদ ধ্বনি উঠবে।
৬ নভেম্বর যখন শেষ মিটিং চলছিল তখন সেখানে উপস্থিত একজন সৈনিক প্রশ্ন করেন, কে আমাদের বিপ্লবের নেতা? তাহের দলীয় সিদ্ধান্ত সরাসরি উপস্থাপন না করে বলেন, আপনারাই ঠিক করুন কে আপনাদের নেতা। সৈনিকদের একজন বলে ওঠেন, জিয়াউর রহমান আমাদের নেতা। উপস্থিত অন্য সৈনিকরাও বলেন, হ্যাঁ, জিয়াউর রহমানই আমাদের নেতা। তাহের সৈনিকদের আবেগকে সমর্থন করলেও বুঝতে পারেন নেতৃত্ব ক্যান্টনমেন্টেই থেকে যাচ্ছে। দূরদর্শী তাহেরের বুঝতে বাকি থাকে না যে, জাসদের পরিকল্পিত বিপ্লবের সকল সুফল ভোগ করতে যাচ্ছে জিয়া।
তাকে ‘মাইনাস’ করতে না পারলে জাসদের পরিকল্পনা সফল হবে না।
তাহের জিয়াকে মুক্ত করে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নিয়ে আসার জন্য তার বিশ্বস্ত টু ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির মেজর মহিউদ্দিন, মেজর মোস্তফা ও সুবেদার মেজর আনিসুল হকের নেতৃত্বে একটি বিশেষ স্কোয়াড গঠন করেন। এরাই জিয়ার বাসভবনে গিয়ে জিয়াকে মুক্ত করেন। তখন সেখানে সাধারণ সিপাহিরা উপস্থিত হয়ে জিয়াকে কাঁধে তুলে স্লোগান দিতে থাকেন- আল্লাহু আকবর, জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ। মেজর মহিউদ্দিন জিয়াকে বলেন, স্যার, আপনাকে কর্নেল তােেহরর কাছে যেতে হবে।
পুরো পরিস্থিতি উপলব্ধি করে জিয়া বলেন, আমি টু ফিল্ডে যাচ্ছি। তাহেরকে সেখানে নিয়ে আস।
রাত ১টায় এলিফ্যান্ট রোডে নির্ধারিত বাসায় উপস্থিত হয়ে বিপ্লবী সেনা সংস্থার নেতা নায়েক সিদ্দিক তাহেরকে বলেন, স্যার, জিয়াউর রহমান আপনাকে টু ফিল্ডে যেতে বলেছেন। তাহের তখন বলে ওঠেন ডব ধৎব ফবধভবধঃবফ.
কর্নেল তাহের আরো ২ বার চেষ্টা করেন কৌশলে জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নিয়ে আসতে। ৬ নভেম্বর রাত ২টা ৩০ মিনিটে টু ফিল্ডে জিয়ার রুমে ঢুকে তাহের বেশ কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করেন।
তার মধ্যে অন্যতম ছিল- সকাল ১০টায় শহীদ মিনারে জনতার উদ্দেশ্যে তাহের ও জিয়া ভাষণ দেবেন। জিয়া এই প্রস্তাবে রাজি না হয়ে তাহেরকে বলেন, তুমি তো সিভিলিয়ান তোমার কোনো অসুবিধা নেই কিন্তু আমি এখনো ইউনিফর্ম পরা। প্লিজ তাহের, মিটিংয়ের ব্যাপারটা তুমি দেখো। ’ তাহেরের ২য় পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়। ওই সময়ই তাহের জিয়াকে আরেকটি প্রস্তাব দেন।
বলেন, আপনি রেডিও স্টেশনে গিয়ে জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণ দেন। তাতেও রাজি হন না জিয়া। তখন তাহের খুবই ক্ষিপ্ত হয়ে চিৎকার করতে থাকেন। উপস্থিত কর্নেল আমিন, মুনীর ও সুবেদার আনিস জিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, জিয়াকে বাইরে যেতে দেয়া হবে না। তার ভাষণ এখানেই রেকর্ড করা হোক।
কর্নেল তাহের তার ভাই আবু ইউসুফ ও অন্যদের নিয়ে রাগে চিৎকার করতে করতে টু ফিল্ড ত্যাগ করেন। জিয়া টু ফিল্ডে বসেই বেতার ভাষণ দেন।
খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, তাহের বারবার কেন জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে আনার জন্য চেষ্টা করছিলেন? এ প্রশ্নের জবাব সম্ভবত একমাত্র হাসানুল হক ইনুই দিতে পারবেন। কারণ তিনিই ছিলেন ওই ঐতিহাসিক কালপর্বের অন্যতম স্রষ্টা।
আকিদুল ইসলাম
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।