কি বলব
ধর্মগ্রন্থে বর্ণনা করা কাহিনী, ইতিহাসের লিপি ও পুরা কাহিনী থেকে আমাদের জন্য কেবলই জানার নয়, শেখারও যে অনেক কিছু আছে, সে কথা আমাদের গুরুজন অবধারিতভাবেই শেখান। তা ছাড়াও কালে কালে ইতিহাসবেত্তারা, দার্শনিকরা ও ধর্মযাজকরাও তাদের নিজ নিজ সমাজ ও বিশ্বকে বারেবারে মনে করিয়ে দিয়েছেন। বর্তমান যুগের মনীষীরাও তাদের এই কর্তব্য পালন করছেন। আমরা যারা উল্লিখিত কোনো মহান শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অযোগ্য, তারাও কিন্তু অনেক সময় ওই গুরুত্বপূর্ণ কথাটি মনে করি। হাজার হলেও আমাদের তো নাতি-নাতনি আছে।
আর যাদের বয়স কম তাদের আছে ছোট ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাতিজি বা ভাগ্নে-ভাগ্নি। তাদের আমরা আদ্যিকালের কথা বা তুলনামূলকভাবে আধুনিক ইতিহাস থেকে অনেক কাহিনী শোনাই এবং তা থেকে কিছু শিখতে, কিছু মনে রাখতে, কিছু অনুসরণ করতে বলি। শিশু বা কিশোর-কিশোরীরা যে আমাদের উদ্দেশ্য বোঝে না, তা নয়। তাদের কেউ কেউ বেশ সুন্দরভাবে এসব নীতিকথা বা সত্ কথা আত্মস্থ করার চেষ্টা করে। গেল দুর্গা পূজার সময় ১০-১২ বছরের এক কিশোরী বিসর্জন নিয়ে প্রশ্ন করল, ‘এত সুন্দর প্রতিমা বানিয়ে তারপর তা নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয় কেন?’ তাকে শখন বলা হলো যে দেবীর কাজ সম্পন্ন হয়েছে, তিনি দুষ্ট অসূরকে দমন করেছেন।
এখন নিজের বাড়িতে ফিরে গেছেন। ছোট্ট মেয়েটি খানিকক্ষণ চিন্তা করে আবার প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা দেবী দুর্গা কি বারবার আসেন, নাকি পৃথিবীতে তার আসার কথা মনে করে আমরা প্রতিবছর প্রার্থনা ও উত্সব করি?’ তখন তাকেই প্রশ্ন করা হয়, ‘আমরা তার আগমনের কথা প্রত্যেক বছর মনে করতে যাব কেন?’ উত্তরে মেয়েটি বলে, 'ইবপধঁংব ঃযবত্ব ধত্ব নধফ ঢ়বড়ঢ়ষব ড়হ বধত্ঃয ধহফ ঃযবু ফড় নধফ ঃযরহমং. ঝড় বি ত্বসবসনবত্ মড়ফফবংং উঁত্মধ ঃড় মবঃ পড়ঁত্ধমব ধহফ ভরমযঃ ঃযব বারষ ঢ়বত্ংড়হং.' (কারণ, পৃথিবীতে আজও বদ লোকেরা আছে আর তারা খারাপ কাজ করে। তাই আমরা দেবী দুর্গাকে স্মরণ করে ঐসব খারাপ লোকদের সঙ্গে লড়াই করার মতো সাহস খুঁজি। ) বলা বাহুল্য, এই মেয়েটি প্রবাসী বাংলাদেশী। বালক হজরত দাউদ (আ.) ও দানবীয় গোলায়াথের লড়াইয়ের কাহিনী বর্ণনা করার পর আমি নিজেও একবার এক কিশোরের কাছ থেকে এমনই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলাম।
ছেলেটির প্রশ্ন ছিল, এটি কি নিছকই এক বালকের সাহসের কাহিনী, নাকি এ থেকে কিছু শেখার জন্য এই কাহিনী আজও বলা হয়ে থাকে। সে আরও ব্যাখ্যা করে বলেছিল, তার মনে হয়েছিল ভালো এবং মন্দের দ্বন্দ্বে ভালোর পক্ষ ছোট হলেও জয়ী হয়—এ কথা বোঝানোর জন্য এই কাহিনী পবিত্র ধর্মগ্রন্থে স্থান পেয়েছে। আধুনিককালের ছেলে, বুদ্ধি বেশি। সে কথায় কথায় আরও বলল, ‘দেখুন, এটা তো রূপকথার মতো নয়। এটা তো একটা প্রকৃত লড়াইয়ের কাহিনী।
এতে কোনো জাদুমন্ত্রের কথা নেই। হজরত দাউদ (আ.) তাঁর চেয়ে আকারে অনেক বড় ও শক্তিশালী শত্রুকে কৌশলে দূর থেকে একটি গুলতি দিয়ে পাথর ছুড়ে আঘাত করতে পেরেছিলেন বলেই জিতেছিলেন। ’ মনে হলো, ছেলেটা যদি আরেকটু বড় হতো তাহলে এও বলত যে, আল্লাহ সত্ লোকদের সুবুদ্ধি দেন আর অসত্ লোকদের বুদ্ধি একসময় কেড়ে নেন। গোলায়াথ নিজের শক্তি আর বিরাট আকারের ঢাল-তলোয়ারের ওপর এতটাই অন্ধ বিশ্বাস করা শুরু করেছিল যে, তার অস্ত্রের নাগালের বাইরে থেকেই যে কিশোর দাউদ তাকে ধরাশায়ী করবেন এ কথা সে চিন্তাই করতে পারেনি।
আজকে বেশ অবাক হয়ে ভাবছি, ছোটবেলার যেসব ধর্মীয় কাহিনী আর নানান উপকথা শুনেছি, জীবনের অস্তাচলে এসে সেগুলোর মাঝে তিনটি ঘুরে-ফিরে খুবই মনে পড়ে।
আর সেগুলোর স্মৃতি বেশি করে নড়েচড়ে ওঠে যখন ক্ষমতার দম্ভ, অন্যায় ও অবিচারের দ্বারা নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ঢাল ব্যবহার করে মিথ্যাচার করা আর ঘৃণা ছড়ানো এবং ধনদৌলতের অনাবশ্যক আড়ম্বর দেখি। কারণ, ওই প্রতিটি কাহিনীতেই দেখি যে ক্ষমতা, বাহুবল ও ঐশ্বর্যজাত দম্ভ সর্বশক্তিমান আল্লাহ অনায়াসে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। আর যাদের দম্ভ তিনি চূর্ণ করেছেন তাদের দুঃখজনক শেষ পরিণাম দেখা দেয়ার আগে তিনি তাদের ধন-দৌলত ও ক্ষমতা দিয়েছেন অকাতরে। আমার মনে ধরা কাহিনী তিনটি হচ্ছে নমরুদ, শাদ্দাদ ও ফেরাউনকে নিয়ে।
হজরত ইব্রাহীম আল্লাহ্র আনুগত্য স্বীকার করার কথা বলায় নমরুদ তাঁকে ধ্বংস করার জন্য বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে আসেন।
হজরত ইব্রাহীমের সাহায্যে আসে মশা বাহিনী। সেই মশার একটি নমরুদের নাক দিয়ে মাথায় ঢুকে তার মগজে এতই কামড়াতে থাকে যে সে পাগলের মতো হয়ে যায়। তখন নমরুদ তার এক কর্মচারীকে হাতুড়ি দিয়ে তার মাথায় ঠুকতে বলে। লোকটি অত্যাচারী রাজার মাথা ঠুকতে ঠুকতে একসময় বিরক্ত হয়ে এমন জোরে এক ঘা দেয় যে নমরুদ তার ফলে মারা যান। অর্থাত্ নমরুদ প্রকৃতপক্ষে একটা মশার হাতে মারা গেলেন।
শাদ্দাদের বেহেশত ছিল স্থাপত্যশৈলী ও নির্মাণ কৌশলের অনন্য উদাহরণ। এর ভেতরটা ছিল মণি-মাণিক্যখচিত। এটা বানাতে তিনশ’ বছর লেগেছিল। শাদ্দাদ নয়শ’ বছর বেঁচেছিলেন বলে কথিত আছে। তিনি আল্লাহর সমকক্ষ পরিগণিত হওয়ার লক্ষ্যে দুনিয়াতেই তার জন্য একটা ‘বেহেশত’ তৈরি করিয়ে ছিলেন।
কিন্তু তিনি তার নির্মিত বেহেশতে ঢুকতেই পারেননি। ওই ‘বেহেশতের’ পথে যাত্রা করে তার থেকে মাত্র এক দিনের পথ যখন বাকি তখন এক গগণবিদারী শব্দ হয় আর সেই আওয়াজেই রাজা শাদ্দাদ ও তার পারিষদরা মারা যান। আরেক কাহিনীতে আছে যে, শাদ্দাদের তৈরি বেহেশত-সম শহরটি এক ভয়ঙ্কর ঝড়ে ধূলিস্যাত্ হয়ে যায়। ফেরাউন তার সৈন্যদলসহ ধ্বংস হন হজরত মুসা (আ.)-এর পশ্চাদ্ধাবন করে লোহিত সাগর অতিক্রম করার সময়। ফেরাউনের হাত থেকে বাঁচার জন্য হজরত মুসা তাঁর ইসরাইলি অনুসারীদের নিয়ে যখন লোহিত সাগরের তীরে পৌঁছান তখন তিনি কী করবেন ভেবে দিশেহারা হয়ে যান।
আল্লাহ তাঁকে শান্ত হতে উপদেশ দিয়ে সাগরের পানিকে দুই ভাগ করে দেন, যার ফলে সমুদ্র তলদেশে একটি শুকনো পথ সৃষ্টি হয়। হজরত মুসা তাঁর সহচরদের নিয়ে ওই পথ দিয়ে হেঁটে সাগর পার হয়ে যান। একটু পর ফেরাউন সেখানে উপস্থিত হয়ে ওই রাস্তা দেখতে পেয়ে সেই পথে হজরত মুসাকে ধাওয়া করেন। তিনি ও তার বাহিনী সাগরের শুষ্ক তলদেশে নেমে পড়ার পরই দুই দিক থেকে পানি ফিরে এসে তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
এসব কাহিনী সবারই জানা আছে।
প্রতিটি কাহিনীরই উপসংহার হচ্ছে যে, আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলা উচিত। আল্লাহ অনেককেই অনেক কিছু ধন-দৌলত, ক্ষমতা, বিদ্যা দিতে পারেন; কিন্তু এসবের অধিকারী যারা হবেন তারা যেন সীমা লঙ্ঘন না করেন। তারা যেন লোভী ও লুণ্ঠনকারী না হন এবং তারা যেন অন্যায়কারী ও অত্যাচারী না হন। তা যদি হন তাহলে তারা এক সময় না এক সময় ধ্বংস হবেনই। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমরা যে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের কথা বলি এবং তা কায়েম করার জন্য আমরা যেসব অভিজ্ঞতা ও যুক্তির আলোকে সংবিধান, আইন, সরকার ও বিচারব্যবস্থা তৈরি করেছি তার ভিত্তি হচ্ছে—ন্যায়পরায়ণতা, ন্যায়বিচার, সততা, সহযোগিতা, পরমতসহিষ্ণুতা ও সহমর্মিতা।
মানবিকতাবোধ এসব কিছু প্রয়োগ বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব রাখবে। স্বাধীন ও সুন্দর দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখার সময় এই চেতনা আমাদের মধ্যে ছিল। আর ছিল সর্বশক্তিমান ও করুণাময় আল্লাহ্র ওপর বিশ্বাস। সেভাবে মনে করলে এই উপমাটা যুত্সই হয়ে দেখা দেয় যে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা ছিলাম বালক দাউদ (আ.)-এর ভূমিকায় আর হানাদার অত্যাচারী পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ছিল দানবাকৃতি পেশিবলে মহাশক্তিশালী গোলায়াথের চরিত্রে। আমরা জয়ী হয়েছি।
এখন যখন দেখি যে সরকার দেশের আইন মানছে না, আদালতে সঠিক বিচার হচ্ছে না, অত্যাচারীরা সাধারণ মানুষ ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিদের শাসাচ্ছে—এমনকি জেলে ঢুকাচ্ছে, দুর্নীতির ও অপরাধের পৃষ্ঠপোষকতা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এবং তার ফলে সাধারণ মানুষ অসহায়ভাবে মুনাফাখোরদের দ্বারা শোষিত হচ্ছে আর শাসক ও শোষকরা ক্ষমতা, শক্তি ও সম্পদের অহংকারে অহংকারী হয়ে যা খুশি তাই করছে এবং আমরা অসহায়ের মতো কাতরাচ্ছি আর ভাবছি—এই দুরবস্থা থেকে কবে ও কীভাবে পরিত্রাণ পাব; তখন ধর্মীয় ও পুরা কাহিনীগুলো মনে পড়ে বৈকি। একাত্তরে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে বেঁচে থাকার সাহস কেমনভাবে পেতাম সে-কথা তো মনে পড়েই; পরে স্বাধীন বাংলাদেশে অপহৃত ও বন্দি গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য বছরের পর বছর আন্দোলন করার কষ্টের দিনগুলোর কথাও মনে পড়ে। গণ-অভ্যুত্থানগুলোও স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। আমরা হয়তো বুড়ো হয়েছি, শারীরিক শক্তি হ্রাস পেয়েছে; কিন্তু আমাদের কালের ইতিহাস তো বর্তমান কালের জন্য ঐতিহ্য। এ ঐতিহ্যের ধারক উত্তরাধিকারীরা নিশ্চয়ই আছে।
তাদের আওয়াজ শোনার অপেক্ষায় আছি।
পুনশ্চ : এ কথাগুলো লেখার সময় গতকালের আমার দেশ পত্রিকায় ‘বন্দি নির্যাতনের নতুন কৌশল’ শিরোনামের প্রধান খবরটি চোখের সামনে ভেসে উঠেছে এ কথা অকাতরে স্বীকার করছি। তবে অনুরোধ করব, কারাবন্দি মাহমুদুর রহমান, এহছানুল হক মিলন ও লুত্ফুজ্জামান বাবরের কাহিনীগুলোকে কয়েকজন সাবেক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তির সমস্যা হিসেবে না দেখে সরকার কর্তৃক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে দেখতে। তাদের ভাগ্যে যদি এরকম অন্যায়-নিপীড়ন জুটতে পারে তাহলে অতি সাধারণ ও অপরিচিত লোকেরা বন্দি হলে তাদের যে কী অবস্থা হয়, তা তো কল্পনাও করা যায় না। তবে জানাজানি হয়ে গেছে, তাদের বেশ কয়েকজন অকাল মৃত্যুবরণ করেছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।