আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অসুরের আস্ফালন ও দুর্গাপূজা

বসে আছি পথ চেয়ে.... হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। এবার দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে রামু-উখিয়ায় বৌদ্ধ মন্দির জ্বালিয়ে দেওয়ার দুঃসহ অভিজ্ঞতা সঙ্গে নিয়ে। এবছরও দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে মন্দিরে হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে। আমাদের দেশে মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এনিয়ে এখন আর কেউ তেমন উচ্চ-বাচ্য করে না।

পত্র-পত্রিকায়ও এ সংক্রান্ত খবর তেমন একটা গুরুত্ব পায় না। এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জানমালেরই যেখানে নিরাপত্তা নেই সেখানে মন্দির আর মূর্তির নিরাপত্তা নিয়ে কে মাথা ঘামায়? মাথা ঘামিয়ে লাভই বা হবে কি? সরকার-প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্যমূলক উদাসীনতা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ মদদে এক শ্রেণির দুর্বত্তের সাম্প্রদায়িক হিংস্রতার শিকার হচ্ছে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, তাদের উপাসনালয়, প্রতিমা মূর্তি। বর্তমানে দেশে উৎসব আছে, বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে, প্রতিমা আছে, একইসঙ্গে আছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জয়গান। শঙ্কা, ভয় নিয়ে তথাকথিত নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে নিরাপত্তাহীন সংখ্যালঘুরা তারপরও উৎসবের প্রহসনে শামিল হচ্ছে। দুর্গোৎসব হচ্ছে।

ভয়-ভীতি, শঙ্কা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেও বাঙালি হিন্দুরা দুর্গাপূজা করে। কারণ দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুর সবচেয়ে বড় উৎসব। আর্যরীতির সঙ্গে বাঙালির সৃজনশীলতা যুক্ত হয়ে দুর্গোৎসব বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। আমরা বর্তমানে যেমন পয়লা বৈশাখকে নববর্ষ হিসেবে পালন করি, শরৎ ঋতুর আরম্ভকে আর্যরা তেমনি নববর্ষ হিসেবে গণ্য করত। আর্যদের হিসাব অনুযায়ী আশ্বিন মাসের শুল্ক নবমীতে বর্ষা ঋতু পূর্ণ হয়।

দশমীতে শরৎ আরম্ভ। আর্যদের নববর্ষ আর বাঙালির দুর্গাপূজা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। নববর্ষে প্রবেশের আগে সবাই প্রত্যাশা করে নতুন বছরটি সুখে যাবে, সুখে কাটবে, অভীষ্ট সিদ্ধ হবে, মনস্কামনা পূর্ণ হবে। দুর্গাপূজা করা হয় এ কারণে যে, মা দুর্গার কৃপা হলে নববর্ষে আমাদের বিজয় হবে। এ কারণে দশমীর নাম বিজয়া দশমী হয়েছে।

এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে দুর্গাপূজার কারণ, উৎস ও ফলাফল সম্পর্কে সংক্ষেপে একটু আলোকপাত করা যাক। ******* দুর্গা কে? তিনি এক দেবী। দেবী কে? এক শক্তি। শক্তি কী? কর্ম বা কাজ করার ক্ষমতা। আমরা যে কথা বলি, কথা একটা কাজ।

দেখি, শুনি, বুঝি-এগুলোও কাজ। শক্তি ছাড়া কাজ হয় না। এ শক্তি কথন শক্তি, শ্রবণ শক্তি, দৃষ্টি শক্তি, বোধ শক্তি। একটি আমগাছের কথা চিন্তা করা যাক। গাছটি আগে ছিল না, নতুন জন্মেছে।

এক শক্তি গাছটিকে নির্মাণ করেছেন। সে শক্তি এক দেব। সে দেবের নাম ব্রহ্মা। গাছটি এতকাল বেঁচে আছে, বেড়েছে। যে শক্তি এ গাছটিকে এতকাল বাঁচিয়ে রেখেছেন, বাড়িয়েছেন তার নাম বিষ্ণু।

একদিন গাছটির ডালপালা-ফুল-ফল থাকবে না, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একাকার হয়ে যাবে, আমগাছ বলে আর তাকে চিনতে পারা যাবে না। তখন গাছটির লয় হয়ে যাবে। যে শক্তি এ লয় ঘটাবেন, তিনি মহেশ্বর। শক্তির আসলে কোন রূপ নেই। লিঙ্গভেদ নেই।

কাজের দ্বারা শক্তির পরিচয়। কর্মই তার রূপ। আমরা ভাষা ও ভাবের অনুরোধে কোন শক্তিকে দেব, কোন শক্তিকে দেবী বলি; কিন্তু বস্তুত এ ভেদ নেই। কর্ম দ্বারাই দেব-দেবীর পরিচয়। কর্ম দেখেই প্রতিমা কল্পনা।

তাহলে প্রশ্ন আসে, তবু কেন এত দেব-দেবী? এ প্রশ্নটিরও মীমাংসা হওয়া দরকার। প্রকৃতিতে আমরা নিয়মিত পরিবর্তন দেখি। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা এভাবে ছয় ঋতুর পরিবর্তন হচ্ছে। শক্তি ছাড়া এ পরিবর্তন হতে পারে না। সে শক্তি এক দেব।

নাম আদিত্য; কিন্তু শীত ঋতুর আদিত্য গ্রীষ্ম আনতে পারে না, গ্রীষ্ম ঋতুর আদিত্য শীত আনতে পারে না। এটা অনেকটা সরকারি দপ্তরের মতো। যদি ডাক বিভাগের প্রধানকে বলা হয় আমাদের গ্রামে একটি স্কুল বানিয়ে দিন; তিনি বলবেন, সে আমার কাজ নয়। যদি শিক্ষা বিভাগের দেবতাকে গ্রামে একটি নলকূপ বসানোর জন্য বলি; তিনি বলবেন, সে আমার কাজ নয়। সরস্বতীর কাছে ধন চাইলে পাওয়া যাবে না।

লক্ষ্মীর উপাসনা করে বিদ্যা চাইলে তিনিও স্রেফ না বলে দেবেন। তাহলে আমরা কী করব? যিনি পারবেন তার পূজা করব, উপাসনা করব। যিনি যাবতীয় শক্তির সম্মিলন, যিনি সব দেব-দেবীর মিলিত রূপ, তিনি বিশ্বশক্তি। ঋগবেদে এর নাম অগ্নি। আমরা বলি শক্তি।

অগ্নির এক প্রসিদ্ধ নাম জাতবেদ; যা কিছু জন্মেছে তিনি তার সব জানেন। কারণ বিনাশক্তিতে কিছুই জন্মাতে পারে না। তার আরেক নাম ‘বিশ্ববিদ’ যিনি সমস্ত জানেন। কারণ যা কিছু আছে, যা কিছু ঘটছে সবই শক্তির কর্ম। পুরাণে অগ্নির নাম ‘তেজ’।

আমরা যাকে শক্তি বলছি তিনি তেজঃ। দুর্গা অগ্নির মতো, বিশ্বশক্তি। বিশ্ব শব্দের অর্থ সমস্ত। অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো (আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় নয় কিন্তু), যেখানে সমস্ত বিদ্যা সম্মিলিত হয়েছে, সমলগ্ন কিংবা সংযুক্ত নয়, একেবারে সম্মিলিত একীভূত। দুর্গা বিশ্বশক্তি।

তিনি প্রসন্ন বা খুশি হলে আমাদের সব ইচ্ছাই পূর্ণ করতে পারেন। দুর্গা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় শক্তির সম্মিলন। এ প্রসঙ্গে মার্কণ্ডেয় পুরাণে এক উপাখ্যান আছে। একবার দেবাসুরে (দেব বনাম অসুর) তুমুল মারামারি বেধেছিল। অসুররা পরাক্রান্ত।

তারা নানা আকার ধারণ করতে পারত। এক অসুর বুনো মোষের আকার ধরে দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। একেক দেবতা যুদ্ধ করতে যান। পরাজিত হয়ে ফিরে আসেন। ইন্দ্র গেলেন, পরাজিত হয়ে ফিরে এলেন।

বরুণ গেলেন, তারও ওই দশা। যিনি যান তিনিই পরাজিত হন। দেবতারা ব্রহ্মাকে সঙ্গে নিয়ে বিষ্ণু ও মহেশ্বরের কাছে গিয়ে তাদের দুর্দশা বর্ণনা করলেন। বিষ্ণু ও মহেশ্বর ভয়ানক ক্রুদ্ধ হলেন। তাদের সব তেজ বাইরে বেরিয়ে এলো।

প্রত্যেক দেবতার তেজ বের হয়ে মিলিত হলো। এক বিশাল তেজরাজি একত্রিত হলো। সেই সম্মিলিত তেজ থেকে এক নারী আবির্ভূত হলেন। তার নাম চণ্ডী বা দুর্গা। তিনি সহজেই মহিষাসুরকে বধ করলেন।

আমরা যে দুর্গার পূজা করি, তিনি যে এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সম্মিলিত শক্তি, তা স্মরণ করার জন্য মহিষমর্দিনী রূপ কল্পিত হয়েছে। দুর্গার দশ হাত দেখেই বোঝা যায়, দুর্গা সম্মিলিত শক্তি। দশ হাতে দশ আয়ুধ। আয়ুধ মানে যুদ্ধাস্ত্র। এ আয়ুধ দেখলেই বোঝা যায় তিনি সব দেবতার সম্মিলন।

এক হাতে চক্র বা বিষ্ণুর আয়ুধ। অতএব তিনি বিষ্ণুশক্তি। এক হাতে শূল, যা মহেশ্বরের আয়ুধ। অতএব দুর্গা মহেশ্বরী। এক হাতে নাগপাশ, নাগপাশ বরুণের আয়ুধ।

অতএব দুর্গা বরুণানী, বরুণের শক্তি ইত্যাদি। মার্কণ্ডেয় পুরাণের আরেক আখ্যানে বলা হয়েছে, দুর্গা শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে দুই অসুরকে বধ করেছিলেন। অসুর দুটি নিহত হলে দেবতারা তার স্তব করেছিলেন। এ স্তবে বলা হয়েছে, যা দেবী সর্বভূতেষু সৃষ্টি রুপেণ সংস্থিতা/নমস্তস্যৈ, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ। অর্থাৎ তিনি যাবতীয় পঞ্চভৌতিক পদার্থে সৃষ্টিরূপে বিরাজমান, তাকে বারবার নমস্কার।

তিনি শক্তিরূপে, সৃষ্টিরূপে, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, ক্ষমা, দয়া-মায়ার আধার, তিনি বিশ্ব মা, দুর্গা। তিনি চৈতন্য। তিনিই বিশ্বরূপ। এভাবে অনুপ্রাণিত হয়েই বঙ্কিমচন্দ্র ‘বন্দে মাতরম’ রচনা করেছিলেন। প্রথমে তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের মধ্যে মাকে দেখেছেন।

তিনি জল, শ্যামল শস্য, সুশীতল বায়ু, বৃক্ষ, পুষ্প, কণ্ঠস্বর ইত্যাদির কথা বলেছেন। তারপর ইন্দ্রিয়ের অতীত বিষয়ে মাকে দেখেছেন। তুমি বিদ্যা, তুমি ধর্ম, তুমি হৃদি, তুমি মম/ত্বং, হি প্রাণা; শরীরে। বাহুতে তুমি মা শক্তি, হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি/তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে। বিশ্বশক্তির আধার যিনি, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে যার প্রকাশ তাকে আমরা পূজা করব কী দিয়ে? শক্তির পূজা মোটেও সহজ কাজ নয়।

শক্তি ৩ প্রকার : শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক। ভক্তিই তার পূজা, তার প্রিয় কর্ম করাও তার পূজা। আমরা তাকে মাতৃরূপে দেখতে ভালবাসি। তার পূজাই সার্থক যিনি বিশ্বজননীকে সত্যি সত্যি মা মনে করেন, মায়ের প্রিয় কাজ করেন, তার আজ্ঞা পালন করে সুখী হন। যিনি এ মাকে আনন্দময়ীরূপে দেখতে পান, তিনি ধন্য।

তার জন্ম সার্থক। দুর্গা তাই নিতান্তই বাঙালির দেবী। এ দেবতাকে বুঝতে হলে ভাবপ্রবণ বাঙালির নিজস্ব সংসার বেষ্টন ও অন্দরমহলকে অনুভব করতে হবে। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বাঙালির দুর্গোৎসব’ নিবন্ধে বলেছেন, ‘শক্তি সাধনা ভাবের ও ভক্তি সাধনা রসের ও প্রেমের নহে। আদ্যশক্তিকে মা বলিয়া, মেয়ে বলিয়া এমন বিকাশ কোন জাতির কোন সাহিত্যে হয় নাই।

বাঙালি যেমন গালভরা, বুকপোড়া মা নামে ডাকিয়া আব্রহ্ম, তৃণস্তম্ভ পর্যন্ত সকলকে মা বলিয়া মাধুরীমণ্ডিত করিয়া লয়; এমন মাতৃভাবের অভিব্যক্তি আর কোন জাতি করিতে পারে নাই। মায়ের ঘর-সংসার পাতাইয়া, মায়ের ছেলে হইয়া কেমন করিয়া থাকিতে হয়, তা বাঙালিই শিখিয়াছিল, বাঙালিই পারিয়াছিল। যে মায়ের স্নেহ পায় নাই, কন্যাকে আদর করে নাই, সে বাঙালির দুর্গোৎসব কেমন করে বুঝিবে। বাঙলার মায়ের স্নেহ বোঝা চাই, প্রাণে প্রাণে অনুভব করা চাই, বাঙালির গৃহের কুমারী কন্যার আদর- সোহাগ বোঝা চাই, যত-আবদার জানা চাই, তবে ইস্ট দেবতার ওপর সেই ভাবের আরোপের মহিমা বুঝিতে পারিবে। ’ আজকের ঘোর বস্তুগত যুগে এত ভাবময় কথা, এতটা ভাবালুতা বুঝি কিছুটা অলীক মনে হয়; কিন্তু দুর্গাপূজার মূল অনুভবে ও আচরণে খানিকটা ভাবাতিরেক রয়েছে নিশ্চিত।

দুর্গাপূজা পালনে বাঙালি হিন্দুর আড়ম্বর দেখে তা সহজেই বোঝা যায়। * * * * * মানুন আর না মানুন, বর্তমানে আমাদের দেশ অসুরকবলিত হয়ে পড়েছে। চারদিকে কেবল অসুরদেরই তাণ্ডব, তাদেরই বিকৃত উল্লাস। অসুরদের হাতে ‘দেবতা’রাও আজ রেহাই পাচ্ছেন না; কিন্তু আক্রান্ত হয়েও দেবতাদের কোন হুঁশ হচ্ছে না। যে যার মতো অসুর মোকাবেলার চেষ্টা করছে।

কিন্তু এভাবে একক কোনো শক্তিতে অসুর মোকাবেলা করা যায়না বা যাবে না, তা কেউ বুঝতে পারছেন না। পরাক্রান্ত মহিষাসুরকে বধ করার জন্য যেমন সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তি দুর্গার আবির্ভাবের প্রয়োজন হয়েছিল, আজও ঠিক তেমনি সম্মিলিত শক্তির উন্মেষ প্রয়োজন। অসুর নিধনে সম্মিলিত শক্তি দুর্গার কোনো বিকল্প নেই। অসংখ্য পূজারির আর্তনাদ কি এদেশের দেবকুলকে একটুও নাড়া দেবে না? কোথায় অসুর বধের সংকল্প, কোথায় প্রস্তুতি? কোথায় তাদের তেজ? নাকি এদেশের সবাই অসুরের কর্তৃত্বকেই বরণ করে নিয়েছেন? আমাদের ‘দেবতারা’ও যদি বিবেক বুদ্ধি শক্তিহীন ভাঁড়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তাহলে আমরা কার উপাসনা করব? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।