রাতের আকাশে বসে তারার মেলা। হাজার হাজার অগণিত তারা। দৃষ্টির সীমানা যতদূর ছুটতে পারে ততদূরেই যেন তাদের বাড়ি। কোথায় এর শেষ? কতদূরে শেষ এদের সীমানা? গুহাবাসী মানবের সরল মন কিম্বা আজকের হোমোসেপিয়েনস এর কমপ্লেক্স মন এখনো খুজেঁ বেড়ায় এই প্রশ্নের উত্তর। অনন্ত অসীম এই মহাবিশ্বের মাঝে আর কে কে আমাদের প্রতিবেশী? শত সহস্র তারার মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রহসমূহের মধ্যে কি কেউ নেই আমাদের পৃথিবীবাসীর সুখ, দু:খের সাথী হতে পারে? কেন আমাদের এই পৃথিবী সম্মানিত হলো জীবনকে ধারণ করে? একমাত্র সবুজ গ্রহ যে কিনা যোগ্যতার সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে লাভ করেছে দূলর্ভ এই সৌভাগ্য।
কি সেই যোগ্যতা? এমনি হাজারো প্রশ্নের উঁকি ঝুকি চলতে থাকে মানুষের মনে। জ্ঞানের স্বাভাবিক তাড়নায় উৎসুক মানুষ খুজেঁ ফিরেছে এই সব জিজ্ঞাসার জবাব। পিথাগোরাসের জিয়োসেন্ট্রক এবং কোপার্নিকাসের হোলিওসেন্ট্রক মহাবিশ্বের ধারণা থেকে বের হয়ে আধুনিক মানব আজ বিচরণ করছে সৌরজগতের দূরতম অঞ্চলে। প্রযুক্তির বিকাশে সভ্যতার ছাপ একেঁ দিচ্ছে গ্যালাক্সি হতে গ্যালাক্সিতে। খুজেঁ পেয়েছে অনেক অজানা কথার জবাব।
তেমনি কিছু অজানা রহস্য, পৃথিবী কেন একমাত্র গ্রহ যে ধারণ করে আছে প্রাণের স্পন্দন এই সীমাহীন শূণ্যতায়, এই প্রবন্ধে তুলে ধরা হলো।
১. নিঁখুত গাণিতিক ভারসাম্য
প্রকৃতি কি গণিত জানতো? মনে হয় না। কিন্তু এই প্রকৃতির যে স্রষ্ট্রা তিনি নি:সন্দেহে গাণিতিক পরিমাপ, বিধি সম্পর্কে পূর্ণ অবগত ছিলেন। নইলে সারা সৃষ্টিময় এক রহস্যজনক পরিমাত্রা এবং গণিতের চুলচেরা সূক্ষ্মতার বিধান ও সীমাবদ্ধতা এলো কি করে? এই সূক্ষ্মতার ব্যপ্তি ক্ষুদ্র প্রাণী কোষ থেকে শুরু করে ছড়িয়ে আছে সুবিশাল গ্যালাক্সিময়। বিখ্যাত বিজ্ঞানী ফ্রেহ হোয়েল এ পরিমাপমিতি এবং তাদের কাযোর্পযোগী বিধান-বিস্তুতিকে আলোকপাত করতে গিয়ে বলেছেন- “There is an enormous intelligence abroad in the universe………some supercalculating intellect must have designed the properties of……” (Annual Review of Astronomy and Astrophysics: Vol-20, 1982 USA).
পৃথিবীর বাহ্যিক সৃষ্টিতে দৃশ্য এমন কিছু ভারসাম্য নিয়ে আমরা আলোকপাত করি।
দেহজনিত আয়তনে পৃথিবী যদি বর্তমানে চেয়ে কম হতো, তবে এর মধ্যাকর্ষন শক্তিও হতো বর্তমানের চেয়ে কম। আর এমনি একটা মধ্যকর্ষণ শক্তির উপস্থিতিতে পৃথিবী এখন যেভাবে পানি এবং অন্যান্য বস্তুকে ধরে রাখতে পারছে, তখন এমনি ভাবে পারতো না। আর এ আয়তন যদি হতো চাঁদের আয়তনের সমান? তখন পৃথিবী মোটেই ধরে রাখতে পারতো না তার বায়ূমন্ডলীয় পানি সম্ভারকে। দ্রুত নি:শেষ হয়ে পড়তো পৃথিবী পৃষ্ঠের সমুদয় পানি মজুদ। বাতাসের জলীয় বাস্পমাত্রা বায়ূমন্ডলীয় বলয় হতে বিমুক্ত হওয়ার সাথে সাথে পৃথিবী হারিয়ে ফেলত তার তাপ নিয়ন্ত্রন ক্ষমতা।
পৃথিবী পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে পৌছুঁত এক অবিশ্বাস্য মাত্রায়। আবার যদি এই পৃথিবীর ব্যাস হতো বর্তমানের দ্বিগুন? তখন বর্ধিত পৃথিবীর উপরি ভাগের আয়তন বেড়ে যেত এবং মাধ্যকর্ষন বৃদ্ধি পেত বর্তমানের দ্বিগুন যা প্রতি ইঞ্চিতে সৃষ্টি করত ৩০ পাউন্ড চাপ। মারাত্মক ভাবে হ্রাস পেত বায়ুমন্ডলের উচ্চতা। অনিবার্য ধ্বংস নেমে আসত পৃথিবীর বুকে। কারণ তখন সে পৃথিবীকে লক্ষ্য করে ছুটে আসা প্রতিদিনের প্রায় ২০ লক্ষ উল্কপিন্ডকে কোন মতেই রুখে দিতে পারতো না।
আর যদি এই আয়তন হতো সূর্যের সমান, তবে মাধ্যকর্ষণ শক্তি হতো আজকের প্রায় ১৫০ গুণ বেশি। বায়ূমন্ডলের উচ্চতা নেমে আসতো চার মাইলের মধ্যে। বন্ধ হয়ে যেত সমস্ত বাষ্পীভবন এবং জলচক্রের স্বাভাবিক গতি প্রবাহ। প্রতি ইঞ্চিতে চাপ বৃদ্ধি পেয়ে দাড়াত ১৫ পাউন্ডের বদলে ২ টন। তখন মানুষের আকৃতি হতো সর্বোচ্চ একটা কাঠ বিড়ালির সমান বা তারচেয়ে ক্ষুদ্র।
বুদ্ধিমান জীবের উন্মেষ থাকতো চিরকালই এক কাঙ্খিত চাওয়া হয়ে।
পৃথিবী হতে সূর্যের দুরত্ব কত? আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু আমরা কি জানি এই দূরত্বের সামান্য হেরফের নষ্ট করে দিতে পারে এই সবুজ গ্রহের জীবন ধারণের সকল সম্ভাবনা? দূরত্বের পরিবর্তনে পরিবর্তন ঘটতো বার্ষিক গতির। এর ফলে হয় তাপমাত্রার হ্রাস ঘটতো নয়তো বৃদ্ধি পেত। ফলশ্রুতিতে শীত এবং গ্রীষ্ম কালের ব্যপ্তিতে আসতো পরিবর্তন।
ঋতুচক্রের এই পরিবর্তনজনিত কারণে সমগ্র উদ্ভিদকূলের জীবনচক্রে আসতো পরিবর্তন। মাসের এবং বছরের ব্যপ্তিও হতো পরিবর্তিত। স্বাভাবিক জীবন ধারণ হতো অনেক কঠিন। এই দূরত্বজনিত পরিবর্তন যতই বৃদ্ধি পেতে থাকবে ততই এই পরিবর্তন গুলোর মাত্রাও বাড়তে থাকবে। ফলে স্বাভাবিক জীবন ধারনও ততই কঠিন হতে থাকতো।
পৃথিবী যদি শুক্র গ্রহের অবস্থানে থাকতো, তবে তার সম্মুখ পৃষ্ঠের তাপমাত্রা হত ৪৮০ ডিগ্রি সেঃ আর পশ্চাৎ পৃষ্ঠের তাপমাত্রা হতো -৩৩ ডিগ্রি সেঃ। যদি মঙ্গলের স্থানে অবস্থিত থাকত, তবে সম্মুখ পৃষ্ঠে -৩১ ডিগ্রি এবং পশ্চাৎ পৃষ্ঠে তাপমাত্রা হত -৮৬ ডিগ্রি সেঃ। উল্লেখিত তথ্য গুলো আর কিছু না হোক, এটা বোঝায় যে পৃথিবীর বর্তমান অবস্থানই তার এবং আমাদের জন্য কল্যাণকর। বিজ্ঞানী রিক্ গৌর এর ভাষায়- We are very smart, we humans, but are we intelligent enough to absorb the lesson our grand glimpses of our sister planets have given us? - “ আমরা সুচতুর মানুষ কি বুঝতে পারি যা আমাদের প্রতিবেশী গ্রহগুলো শেখাতে চায়?”
ভূ-পৃষ্ঠের কেন্দ্রের তাপমাত্রা প্রায় ৪০০০ ডিগ্রি- ৫০০০ডিগ্রি সেঃ আর কেন্দ্রে হতে পৃষ্ঠের দূরত্ব প্রায় ৩৯৬৩.৫ মাইল। ভূ-ত্বক হতে যতই কেন্দ্রের দিকে যাওয়া যায়, ততই প্রতি ১০০০ ফুট গভীরতার জন্য ১৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
অথাৎ মাত্র ২.৪০ মাইল গভীরে পানির স্ফুটনাঙ্ক তাপমাত্রা পেয়ে যাবার কথা। (পানির স্ফুটনাঙ্ক তাপমাত্রা হলো, যে তাপমাত্রায় পানি ফুটতে থাকে এবং ভূ-পৃষ্টে এটি ১০০ডিগ্রি সেঃ। ) এর প্রমাণ মিলে বিভিন্ন উষ্ঞ পানির প্রসবনে, যাদের উৎপত্তি মাত্র কয়েক কয়েকশ গজ গভীরতায়। এভাবে দেখা যায় যে ভূ-পৃষ্ঠ হতে মাত্র দেড় মাইল গভীরতায় পানি বাস্পীভবন হচ্ছে। অথাৎ আমরা যে সবুজ, শ্যামল গ্রহের গর্বিত অধিবাসী, তার দেহের আকৃতি ব্যসার্ধে মাত্র দেড় মাইল ছোট হলে আমরা আর তার অধিবাসী হতাম না- জীবন টগবগ করে ফুটন্ত পানির বুদবুদের পরিহাসে তিরস্কৃত হত।
আবার যদি এর সমপরিমানে পুরত্ব প্রাপ্ত হতো, তাহলেও এর চেনা রুপটিকে কখনোই পেতাম না।
পৃথিবীর অন্যান্য অবস্থা এবং শতার্দি অপরিবতিত থেকে জলভাগের উন্মুক্ত তল যদি বর্তমানের দ্বিগুন হত, তবে বাষ্পীভবন বৃদ্ধি পেত দ্বিগুন। বায়ুতে জলীয় বাষ্পের এই বৃদ্ধি সূর্যের ইনফ্রারেড-রশ্মির জীবন রক্ষকারী মাত্রাকে কমিয়ে দিত আশঙ্কাজনকভাবে। পচনশীল রোগের প্রকোপ বেড়ে যেত তীব্রভাবে। মানুষ তার মধ্যে হয়ত বেচেঁ থাকতো, কিন্তু বুদ্ধির বিকাশ হতো অত্যন্ত নিম্নমানের।
আবার জলভাগরে উন্মুক্ত তলের পরিমান কমে গেলে জীবন রক্ষাকারী অতিবেগুনী রশ্মি হতো জীবন ধব্বংসকারী।
চাদেরঁ সাথে আমাদের সম্পর্ক একে বারে মামা ভাগ্নের মতো। কিন্তু এই চাদঁ মামার অভিকর্ষের অবদান না থাকলে পৃথিবীর মহাসমুদ্রের জলস্রোতধারা হতো আমাদের কাছে একেবারেই অপরিচিত কিছু। তখন সাগরে বাস করার মতো জীবের সংখ্যা হতো খুব কম। জোয়ার ভাটার পরিস্থিতি আজকের মতো করে দেখা হতো না।
এই চাদেঁর প্রভাব তার দূরত্বে সাথে হ্রাস বৃদ্ধি হয়। কিন্তু দূরত্বে যদি ঘটে যায় কোন অভাবনীয় পরিবর্তন? তখন এ সকল ঘটনার চাক্রিক আবর্তনে আসতো এমন কোন পরিবর্তন যা আজকের জীবনের রুপকে করে দিত বুদ্ধিমান জীবের জন্য অবোধগম্য। যদি চাদেঁর আকর্ষী প্রভাব কমপক্ষে বর্তমান অবস্থার দ্বিগুন হত? তখন লবণাক্ত এলাকার বৃদ্ধি হতো, আবাসযোগ্য ভূমি পরিমাণ হ্রাস পেত, আবাদের ক্ষেত্রে হতো ঘাটতি আর জলোচ্ছাসজনিত প্রাকৃতিক দূযোর্গের প্রকোক অনেক বেড়ে যেত।
এভাবে তথ্য-সমূহের বিচার-বিশ্লেষনে আমরা যে জ্ঞানটি লাভ করি তা এ্যলেন মাইকেল রবার্টের ভাষায়- “ It is as if the universe were deliberately designed for our benefit.” (Alan Mac Robert-Sky & Telescope May 1983)
এভাবে পৃথিবীতে আমাদের অবস্থানকে নিশ্চিত এবং সুখময় করবার জন্য, আমাদের কল্যাণকে সুপ্রশস্ত করবার জন্য এই মহাবিশ্বকে যেন কেউ গড়ে রেখেছেন আপন হাতের মহিমায়। আর পরিকল্পনা করেছিলেন হাজার-কোটি বছর পূর্বে।
নইলে এত হাজার সমন্বয়ের সম্ভাবনা আর সূক্ষ্ম পরিমাপ নির্ধারন কখনো সম্ভব হতো না। কোথা থেকে এলো এই নিভূর্ল পরিমিতি? কি এমন যোগ্যতা নিস্প্রান জড়বস্তুকে চালিত করেছে অবশেষে পরিণত হতে এক প্রাণের সম্ভারে? কখনো কি ভেবেছি আমরা? কখনকি অবনত মস্তকে স্মরণ করেছি সেই মহাপরিকল্পকের মহাপরিকল্পনার দান। কিন্তু জানা মহাবিশ্বের সীমানায় বাসরত একমাত্র বুদ্ধিমান জীবের কি মানায় অকৃতজ্ঞতার আবরণে নিজের বুদ্ধিমত্তাকে ঢাকা। মোটেই না।
তথ্য-সূত্র:
১.আল-কোরআন দ্যা চ্যালেঞ্জ পর্ব ১, মিয়া, কাজী জাহান।
২. The Evidence of God in Expanding universe. এ্যলেন, ফ্রাঙ্ক।
৩. জ্যোতিঃ পদার্থ বিজ্ঞান পরিচিতি, মোহাম্মদী, ফারসিম।
(লেখাটি জনপ্রিয় মাসিক ''বিপরীত" এর জন্য লেখা)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।