my country creat me a ginipig
ভয়াবহ জঙ্গীবাদ চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশের ওপর (এক)
মেহেদী হাসান পলাশ
এক.
স্থান, কাল স্মরণ না থাকলেও কথাটি স্পষ্ট মনে আছে। ১/১১ এরপর সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম বলেছিলেন, বাংলাদেশের সামনে এখন দুটি লক্ষ্য: এক. পাকিস্তান/আফগানিস্তান, দুই. তুরস্ক; বাংলাদেশকে বেছে নিতে হবে সে কোন পথে যাবে।
এ যেন ডাঙায় বাঘ, পানিতে কুমির অবস্থা। অর্থাৎ বেঁচে থাকার রাস্তা নেই, তবে মৃত্যুর চয়েস বা অপসন আছে। তৎকালীন ফখরুদ্দীন সরকার ও তার পেছনের ক্ষমতাধর সামরিক কর্তাব্যক্তিরা তুর্কি মডেলটা বেছে নিয়েছিলেন।
সে কারণে সে তৎকালীন সরকারের ক্ষমতাধর লোকেরা গোপনে প্রকাশ্যে বহুবার তুরস্ক সফর করেছিলেন। তারা তুর্কি সরকার, গণতন্ত্র ও সংবিধানের ধারা উপধারাগুলো পরীক্ষা করে দেখেছেন। কিন্তু ১/১১ কার্যত আনফিনিশড রেভ্যুলেশন বা অসমাপ্ত বিপ্লব অথবা ব্যর্থ বিপ্লব হওয়ায় তুর্কি মডেলের পরীক্ষা বাংলাদেশে থেমে যায়। বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদল হয়। সেই সাথে বদলে যায় ডেসটিনেশনও।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের বেশ কিছু মন্ত্রী, এমপি ও নেতার কথা ও কাজে এ কথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, বাংলাদেশের টার্গেট পরিবর্তিত হয়ে হয়ে তুর্কির পরিবর্তে আফগানিস্তান- পাকিস্তান নির্ধারিত হয়েছে। স¤প্রতি নিউইয়র্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক রাষ্ট্রদূত রিচার্ড হলব্রুক বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সাথে সাক্ষাৎ করে আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর যুদ্ধে বাংলাদেশের সৈন্য পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই মার্কিন অনুরোধ বিবেচনার আশ্বাস দিলে আফগানিস্তানের তালেবানদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে এ কাজের পরিণতি সম্পর্কে হুশিঁয়ার করে হুমকি দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে, পিপিপি নেত্রী বেনজির ভুট্টোকে নির্বাসন দানকারী সামরিক শাসক পারভেজ মোশারফের বিরুদ্ধে একটি মামলাও দায়ের করেনি বেনজিরের ক্ষমতাসীন দল ও তার স্বামী প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারী। ফলে বেশ কিছুদিন চুপ থাকার পর পারভেজ মোশাররফ নতুন রাজনৈতিক দল খুলে বসেছেন।
একইভাবে প্রবল দাবী সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘মাইনাস’ করার চেষ্টাকারী, দেশে আসতে বাধা দানকারী, জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি ঘোষণাকারী ও ‘স্লো পয়জন দিয়ে হত্যার চেষ্টাকারী’ সেনাব্যাক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল নায়ক জেনারেল মইনের বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের করেনি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় শোনা যাচ্ছে, জেনারেল মইন রাজনীতিতে নামবেন শুধু মোশাররফের মতো অনুকুল সময়ের অপেক্ষা। অর্থাৎ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের রাজনীতি চলছে পায়ে পায়ে পা মিলিয়ে।
এদিকে হিরন্ময় কারলেকার বাবুরা তো পরিস্কার ভাষায় বাংলাদেশের ডেসটিনেশন নির্ধারণ করেছেন এ বলে যে, ‘ইধহমষধফবংয রিষষ নব ঃযব হবীঃ অভমধহরংঃধহ’. আর বাংলাদেশকে তারা ঘবীঃ অভমধহরংঃধহ বানাতে চায় এদেশের নিরীহ আলেম সমাজের ঘাড়ে বন্দুক রেখে। কিন্তু সে বন্দুকটি রাখার জন্য আগে বাংলাদেশকে জঙ্গীবাদী দেশ হিসাবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
বর্তমান বাংলাদেশ চলছে ‘জঙ্গীবাদী রাষ্ট্র’ নাটক মঞ্চস্থ হবার পুর্বের গ্রীনরুম প্রস্তুতিতে। সেটা কিভাবে তা বলার পূর্বে বিশ্বব্যাপী জঙ্গীবাদের উত্থানের কারণ ও উৎস সম্পর্কে সংক্ষেপে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন।
দুই.
জঙ্গীবাদের উত্থান
জঙ্গীবাদের উত্থানের কারণ সম্পর্কে পাশ্চাত্য আমাদের সামনে কয়েকটি সূচক তুলে ধরেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: বেকারত্ব, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, দারিদ্র এবং আমাদের আইনমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও তাদের দেশী বিদেশী অনুসারীদের মতে মাদ্রাসা শিক্ষা প্রভৃতি। প্রকৃতপক্ষে জঙ্গীবাদ বা সন্ত্রাসবাদের মূল কারণ এর কোনোটিই নয়।
বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গীবাদের প্রধান কারণ শোষণ, বঞ্চনা ও অধিকারহরণ। শোষিত, বঞ্চিত ও অধিকারহারা মানুষই বিশ্বে যুগে যুগে বিদ্রোহী, বিপ্লবী হয়েছে আর শোষকেরা তাদের নাম দিয়েছে সন্ত্রাসী। অধিকারহারা তিতুমীর, হাজী শরীয়তুল্লাহ ব্রিটিশদের চোখে সন্ত্রাসী ছিল আর তাদের মুক্তির সংগ্রাম ছিল সন্ত্রাস। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারাও পাকিস্তানীদের চোখে সন্ত্রাসী ভিন্ন অন্য ছিল না, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামকেও তারা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সন্ত্রাস বলে আখ্যা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বেও কাশ্মীর, ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়া, ভারত ও নেপালের মাওবাদীÑ সব অধিকার হারানো মানুষের বিক্ষোভ, বিদ্রোহ দখলদারদের দৃষ্টিতে টেরোরিজম বলে বিবেচিত হয়েছে।
কিন্তু আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি, কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবী যদি মেনে নেয়া হয়; ইরাক, আফগানিস্তান থেকে যদি ন্যাটো বাহিনী চলে যায় তাহলে কেউ কি আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী হবে? অন্যদিকে ধর্মীয়(রাজনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি) অধিকার হারানো বিক্ষুব্ধ মুসলমানদের গোপনে প্রশিক্ষণ দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে, রসদ দিয়ে আল কায়েদা, তালেবান, হামাস বানিয়েছে দখলদাররাই; আবার প্রকাশ্যে তাদের অভিহিত করেছে জঙ্গীবাদী বা টেরোরিস্ট বলে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সমগ্র বিশ্ব থেকে ২৫ হাজার আলকায়েদা ও তালেবান সদস্যকে জড়ো করেছিল। কিন্তু রাশিয়া আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়ার পর এই বিপুল পরিমাণ উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জেহাদীদের কোনো পূনর্বাসন ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র ফেলে যায় পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে। আজ তাদের ফেলে যাওয়া জেহাদীদের কারণেই এই দুটি দেশকে বলা হচ্ছে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র।
পাশ্চাত্যের মতে, জঙ্গীবাদের আরেকটি বড় কারণ ওয়াহাবীজম বা ওয়াহাবী মতবাদ।
কিন্তু আমরা যদি একটু ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে দেখি তাহলে সহজেই চোখে পড়বে, এই ওয়াহাবী মতবাদের পৃষ্ঠপোষক পাশ্চাত্যের ইসলাম বিরোধী শক্তি ছাড়া আর কেউ নয়। ওয়াহাবী মতবাদে বিশ্বাসী আরবের যাযাবর জনগোষ্ঠীকে ক্ষমতায় বসিয়ে প্রায় শতাব্দীকাল ধরে তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে এই পাশ্চাত্য শক্তিই। সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের কথা বললেও মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াহাবী মতবাদে বিশ্বাসী রাজতন্ত্র ও রাজবংশের ব্যাপারে তারা একেবারেই নিশ্চুপ। আবার এই রাজবংশই মধ্যপ্রাচ্যের বিপুল সম্পদ করায়ত্ত করে জমা রেখেছে পাশ্চাত্যের ব্যাংকগুলোতে।
জঙ্গীবাদের আরো একটি বড় কারণ হচ্ছে, পাশ্চাত্যের নিজেদের পরিচালিত জঙ্গী কার্যক্রম।
পাশ্চাত্যের ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলো তাদের সামরিক ও গোয়েন্দা বাহিনীকে ব্যবহার করে এমনভাবে বোমা হামলা চালায় যাতে তা সহজেই ইসলামী চরমপন্থী গ্রুপগুলোর কাজ বলে চালিয়ে দেয়া যায়। ৯/১১-এ নিউইয়র্কে বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রে হামলার জন্য আল কায়েদা দায়ীÑ এ কথা এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র প্রমাণ করতে পারেনি। বরং যুক্তরাষ্ট্রেরই অনেক নিরোপেক্ষ গবেষক নানা তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ কথা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন যে, ৯/১১ যুক্তরাষ্ট্রের তৈরী ষড়যন্ত্র। তাদের লেখা অনেক গ্রন্থ ও ডকুমেন্টারী ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। স¤প্রতি কিউবান নেতা ফিডেল ক্যাস্ট্রো ওসামা বিন লাদেনকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের বন্ধুৃ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, বুশ বিপদে পড়লেই বন্ধু লাদেন একটি উগ্র বিবৃতি বা অডিও হুমকি নিয়ে দৃশ্যপটে হাজির হতেন।
তাজমহল হোটেলে হামলার ঘটনায় নিহত ভারতীয় এন্টি টেরোরিজম স্কোয়াডের প্রধান হেমন্ত কারকারে তার তদন্তে জানিয়েছিলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি অংশ কর্তৃক বাংলাদেশী হিন্দু নাগরিকদের কয়েকটি গ্রুপকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে যাদের কাজ হবে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এমনভাবে জঙ্গী কার্যক্রম পরিচালিত করা যাতে তা মুসলিম চরমপন্থীদের কাজ বলে মনে হয়। তাজ হোটেল আক্রমণের ঘটনায় সর্বাগ্রে এই সাহসী সত্যবাদী কর্মকর্তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সে তদন্তকাজ চাপা পড়ে গিয়েছে। কিন্তু মি. কারকারের মৃত্যুর পর পেছন থেকে গুলি খেয়ে তিনি মারা গেছেন বলে ভারতীয় পার্লামেন্টে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোকে হত্যার জন্য সেদেশের সন্ত্রাসী সংগঠন তেহরিকে তালেবানকে অভিযুক্ত করা হয় আর এ কথা সবাই জানে সংগঠনটি মার্কিন মদদপুষ্ট। আদালতে নাজেহাল হয়ে সেনাশাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ তলানীতে ঠেকে যাওয়া ভাবমূর্তি উদ্ধার করতে সিআইএ লাল মসজিদের নাটক সাজিয়েছিল বলে পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক বিশ্বাস করেন।
তাছাড়া পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সরকারী কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় সে দেশের অভ্যন্তরে বহু নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছে। ইরাক ও আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর নিযুক্ত এ ধরণের অনেক ছদ্মবেশী সন্ত্রাসী ধরা পড়েছে মুসলিম যোদ্ধাদের হাতে। সে বিষয়ে অন্য আরেকদিন তথ্য প্রমাণসহ বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে। কিন্তু এটা ধ্রুব সত্য যে, বিশ্বব্যাপী পরিচালিত জঙ্গীবাদের শতকরা ৯৫ ভাগই সংঘটিত হয় এই তিন কারণে। কাজেই এককথায় বলা যায়, টেরোরিজম বাই দ্যা ওয়েস্টার্ন, অফ দ্যা ওয়েস্টার্ন, ফর দ্যা ওয়েস্টার্ন।
টার্গেট শুধু ইসলাম ও মুসলমান।
হিরন্ময় কারলেকার কিম্বা কার্ল সিওভাক্কো ও তাদের পেছনের সাম্রাজ্যবাদী ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলো বাংলাদেশকে ঘবীঃ অভমধহরংঃধহ বানাতে তাদের প্রচলিত পথেই হাটছেন। আর তার প্রথম পর্ব বাংলাদেশের মুসলমানকে বিুদ্ধ করার কাজ বর্তমানে বাস্তবায়িত হচ্ছে। কাজেই বর্তমানে দেশে ইসলাম বিরোধী যে সমস্ত কার্যকলাপ চলছে তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
তিন.
বাংলাদেশকে জঙ্গীবাদী রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করার প্রথম ধাপটি শুরু হয়েছে বিগত শতাব্দীর শেষ দশকের মধ্যভাগ থেকে।
তবে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সরকারের কিছু মন্ত্রী, এমপি, নেতা, একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যম এমন আস্ফালন ও প্রচার চালাতে থাকে যেন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ থেকে ইসলামের নাম নিশানা মুছে দিতে ক্ষমতায় এসেছে। এদের একজন হচ্ছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে স্পেশাল এসিস্ট্যান্ট হওয়ার জন্য ক্যান্টমেন্টে দৌড়ঝাঁপকারী এই এনজিও কর্মী বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মার্কিন গবেষণা জার্নাল হার্ভার্ড ইন্টারন্যাশনাল রিভিউ থেকে তথ্য ধার করে জানালেন, বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর পঁয়ত্রিশ ভাগ সদস্য কওমী মাদ্রাসা থেকে পাশ করা। এ তথ্য দিয়ে জনাব ওয়ালিউর রহমান বোঝাতে চাইলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে জঙ্গী বা জঙ্গীবাদ অনুপ্রবেশের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান বললেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সাথে জঙ্গীরা জড়িত বলে তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এরপর পরই কয়েক কাঠি এগিয়ে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বললেন, মাদ্রাসা হচ্ছে জঙ্গীবাদের প্রজনন তন্ত্র। সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের এ ধরণের কথায় দেশের আলেম সমাজ বিুদ্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। কারণ তারা বিশ্বাস করেছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগ আলেম সমাজের কাছে কুরআন সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন করবে না বলে যে লিখিত চুক্তি করেছিল তাতে। সে কারণেই তারা নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে বিপুল বিজয়ী হতে সাহায্য করেছিল। যাই হোক আলেম সমাজের সে বিক্ষোভ নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়।
তার ধমক খেয়ে দুই মন্ত্রী মিডিয়ার কাছে তাদের আগের বক্তব্য অস্বীকার করেন।
এরপর আসে শিক্ষানীতি প্রণয়ন। শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান প্রফেসর কবীর চৌধুরী ও তাদের সাগরেদগণ একমুখী শিক্ষানীতির নামে মাদ্রাসা শিক্ষা বাতিল এবং ধর্মনিরোপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর পক্ষে প্রচারণা শুরু করলে আলেম সমাজ আবারো বিুব্ধ হয়ে ওঠে। যদিও শিক্ষানীতিতে মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে অনেক ইতিবাচক পলিসি গ্রহণ করা হয়েছে। এফিলিটিং ক্ষমতা সম্পন্ন স্বতন্ত্র আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে, কওমী মাদ্রাসা সনদের স্বীকৃতির কথা বলা হয়েছেÑ যা এদেশর আলেম সমাজের দীর্ঘদিনের দাবী ছিল; কিন্তু সরকারী দলের ও সরকারপন্থী বাম সমর্থক রাজনৈতিক দলের কিছু নেতার বিরূপ প্রচারণার ফলে দেশের আলেম সমাজের মহাজোট সরকার সম্পর্কে মোহো কাটতে শুরু করে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সরকার দলীয় এবং বামপন্থী ও নাস্তিক নেতা ও বুদ্ধিজীবীমহল সংবিধান থেকে বিসমিল্লাহ, আল্লাহর উপর আস্থা, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রভৃতি বাতিলের জিগির তুলতে থাকে এমন ভাবে যেন, একমাত্র এগুলো করার জন্যই আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেছে। উল্লিখিত গোষ্ঠীর এ ধরণের প্রচারণার ফলে আর যাই হোক দেশের আলেম সমাজ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি যে আস্থা রেখেছিল তা ুণœ হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
এরই মধ্যে গত ২ ফেব্রুয়ারী সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগ সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বাতিল করে দেয়। এর ফলে ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানে সংযুক্ত বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস, সংবিধানের অষ্টম অনুচ্ছেদ, ইসলামী রাজনীতি করার অধিকার, মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্কে বিশেষ প্রধান্য সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোর বৈধতা বাতিল হয়ে যায়।
গত ৮ জুলাই বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের হাইকোর্টের বেঞ্চ কুরআনের বিচার ব্যবস্থা ফতোয়ার মাধ্যমে শাস্তি প্রদান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন।
২৫ জুলাই ২০১০ হাইকোর্ট কুরআনের শুদ্ধতা নিয়ে দেব নারায়ণ মহেশ্বর নামে এক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর করা চরম ধৃষ্টতা মূলক রীট গ্রহণ করেনÑ যা ধর্মনিরোপেক্ষ ভারতে করা হয়নি। অবশ্য ৫ আগস্ট আদালত দীর্ঘ শুনানীর পর দেব বাবুকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করে রীটটি খারিজ করে দিয়েছেন। প্রশ্ন হলো: যদি ভারতে কোনো মুসলমান মামলা করতো রামের অস্তিত্ব নিয়ে, বৃটেন কিম্বা আমেরিকায় মামলা করতো যিশু ঈশ্বরের সন্তান কিনা এ বিষয়ে; তাহলে ভারতীয় জনতা পার্টি, হিন্দু মহাসভা, শিব সেনা কিম্বা ভারতের ব্রাহ্মণ স¤প্রদায়ের লোকেরা ঐ মুসলামানের জান মালের অবস্থা কি করে ছাড়তো? ব্রিটেন কিম্বা আমেরিকার খ্রিস্টানরা কি প্রতিক্রিয়া দেখাতো? পুরোনো ইতিহাস থেকে দৃষ্টান্ত তুলে আনার প্রয়োজন নেই, দেবদেবীদের নগ্ন ছবি আঁকায় পৃথিবীর বিখ্যাত ভারতীয় চিত্রকর মকবুল ফিদা হোসেনের বিরুদ্ধে কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল বিশ্ববাসী তা দেখেছে, নির্মাণাধীন দেবী মূর্তি নিয়ে মন্তব্য করায় কোলকাতায় সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ক্ষমা চাইতে হয়েছে, সা¤প্রতিককালে মাই নেম ইজ খান নামে মুক্তিপ্রাপ্ত বলিউডের সিনেমা নিয়ে ভারতীয় হিন্দুদের প্রতিক্রয়া কারো অজানা নয়। এমনকি বাবরী মসজিদ মামলায় এলাহাবাদের হাইকোর্ট উগ্র হিন্দুদের হুমকির মুখে ইতিহাসের অমোঘ সত্যকে অস্বীকার করে বানরের পিঠা ভাগের কায়দায় একটি ভাগাভাগি ফর্মূলা দিয়ে মুসলমানদের বঞ্চিত করে হিন্দুদের দুই তৃতীয়াংশ জমির মালিকানা দিয়ে সমস্যাকে ধামাচাপা দেয়ার যে অপচেষ্টা করেছেন তাতেই ভারতীয় হিন্দু মনের পরিচয়ই স্পষ্ট।
অন্যদিকে, গ্রাউন্ড জিরোতে মসজিদ নির্মাণ নিয়ে স¤প্রতিকালের আমেরিকান খ্রিস্টানদের প্রতিক্রিয়া দেখলেও সহজেই অনুমান করা যায়Ñ এ ধরণের ঘটনা ঐসব দেশে ঘটলে কি প্রতিক্রিয়া হতো।
বিশেষ করে এ মসজিদ নির্মাণ কার্য বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের আধা ধর্মযাজক টেরি জোনস মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআন পোড়ানোর যে কর্মসূচী ঘোষণা করে তার প্রতিবাদে বাংলাদেশসহ বিশ্বের কোনো মুসলিম দেশে একটি গির্জা নির্মাণ বা সংস্কার কাজ বন্ধ করার হুমকি দেয়া হয়নি। কিম্বা মুসলমানদের ঘৃণার আগুনেও কোথাও একটি বাইবেল দগ্ধ হয়নি। মার্কিন সরকারের শত অনুরোধের পরও ঐ ধর্মযাজক কোরআন পোড়ানো কর্মসূচী বাতিল করেনি। অবশেষে মার্কিন মুসলমাদেরই গ্রাউন্ড জিরোতে মসজিদ না নির্মাণ করার বিষয়ে আলোচনায় বসতে রাজি হওয়ার শর্তে কোরআন পোড়ানো কর্মসূচী স্থগিত করা গেছে। তারপরও ৯/১১-এর নবম বার্ষিকীর দিন গ্রাউন্ড জিরোর সন্নিকটে ডেরেক ফেন্টন নামে এক মার্কিন নাগরিক পবিত্র কুরআনের কয়েকটি পাতা ছিঁড়ে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
এহেনো ঘটনার পরও পাশ্চাত্যের চোখে ইসলামই মৌলবাদী, জঙ্গীবাদী, সা¤প্রদায়িক ধর্ম আর কেবলমাত্র মুসলমানরাই সন্ত্রাসী।
বাংলাদেশের মুসলমানরা কিছুই করেনি কোরআনের শুদ্ধতা চ্যালেঞ্জকারী দেব নারায়ণের। তবে তার ধৃষ্টতা সহ্য করতে পারেনি আদালতের কালো গাউনপরা আইনজীবীরা। তারা ধাওয়া দিয়েছে দেব নারায়ণ মহেশ্বরকে। কিন্তু এদেশের ওলামা মাশায়েখগণ তাও করেননি।
১৪ কোটি মুসলমানের এই দেশে তারা তাদের একান্ত ভুবনে কয়েকটি অহিংস প্রতিবাদ মিছিল করেছে আর নিয়মতান্ত্রিকভাবে আদালতে মামলা করেছে দেব বাবুর বিচার চেয়ে।
বাংলাদেশের লক্ষাধিক গ্রামে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান শত শত বছর ধরে পাশাপাশি বসবাস করে আসছে। তাদের মধ্যে দৈনন্দিন জীবনযাপন, উৎসব-পার্বনে পারস্পারিক লেনদেন, যাতায়াত নিবিড়, গভীরে প্রোথিত। গত কয়েক বছর ধরে রমজান মাসে দূর্গা পূজা হয়েছে, এবার হলো জন্মাষ্টমী। বাংলাদেশের বহু মসজিদ, মাদ্রাসা ও মন্দির পাশাপাশি অবস্থান করছে বহু বছর ধরে।
কোনো মসজিদের আজানে কোনো হিন্দুর পূজা ভাঙেনি আবার কোনো হিন্দুর ঢোল, শঙ্খের আওয়াজে নষ্ট হয়নি কোনো মুসলমানের নামাজ। সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির এত বড় দৃষ্টান্ত বিশ্বের ইতিহাসে খুব বেশী পাওয়া যাবে না। তারপরও এদেশের আলেম সমাজকে বলা হচ্ছে মৌলবাদী, জঙ্গীবাদী, সন্ত্রাসী, তালেবান...। শুধু পাশ্চাত্যের ইসলাম বিরোধী শক্তিই নয় তাদের সাথে এই সুরে সুর মিলিয়েছে এদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যম ও ‘সুশীল’ শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীগণ।
গত ৪ আক্টোবর হাইকোর্টের এক রায়ে বলা হয়েছে, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী সংক্রান্ত আপীল বিভাগের রায়ের সঙ্গে সঙ্গে ১৯৭২ সালের আদি সংবিধান পুনঃস্থাপিত হয়ে গেছে।
কাজেই ধর্ম নিরোপেক্ষতা ফিরে এসেছে। বাংলাদেশ আজ ধর্ম নিরোপেক্ষ রাষ্ট্র্। তাই কোনো ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা যাবে না। রায়ে আদালত বলেছেন, ধর্ম নিরোপেক্ষ দেশে কাউকে ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা যায় না। সকল ধর্মের মানুষের নিজ নিজ ধর্ম পালন করার অধিকার রয়েছে।
কাজেই কোনো ধর্মীয় পোশাক কারো উপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না। এ ছাড়া ১৯৭২ সালের সংবিধানের আলোকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতে ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা না হয় তা সংশ্লিষ্টদের জানাতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। এর আগে গত ২২ আগস্ট হাইকোর্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিস আদালতে বোরখা কিম্বা ধর্মীয় পোশাক পরতে কাউকে বাধ্য না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিচারপতি এ এইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মোহাম্মদ জাকির হোসেনের বেঞ্চ স্বত:প্রণোদিত হয়ে এসব আদেশ দিয়েছিলেন। তারও আগে গত ২ মার্চ হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চ বোরখা না পরার কারণে কোনো মহিলা বা বালিকাকে গ্রেফতার বা নির্যাতন বা হয়রানী না করতে সরকার ও পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
বোরখা নিয়ে রীটকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক আদালতে বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বাস করে। এ কারণেই সরকারী বেসরকারী অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা ধর্মের লোক কর্মরত থাকেন। সেখানে বিশেষ ধর্মের পোশাক পরতে বাধ্য করা হলে অন্য ধর্মের যারা আছেন তাদের ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত করা হয়। তাছাড়া মুসলিমদের মধ্যে যারা ধর্মীয় পোশাক পরতে ইচ্ছুক নন, তাদেরও ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করা হয়। তিনি বলেন, সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য দেখাতে পারবে না ( কালের কণ্ঠ ২৩-০৮-১০ দ্রষ্টব্য)।
মাদ্রাসাকে জঙ্গীবাদের প্রজননতন্ত্র আখ্যা দানকারী আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সুযোগ্য পুত্র ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক কি কখনো ভারতেশ্বরী হোমসের মুসলিম তরুণী মেয়েদের যখন উরু বের করা মিনি স্কার্ট পরতে বাধ্য করা হয় এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তাদের স্টেডিয়ামে এনে সরাসরি ও টিভির মাধ্যমে কোটি কোটি দেশবাসীর সামনে ফিজিক্যাল ডিসপ্লে করানো হয়, তখন তাদের কতজন ইচ্ছায় আর কতজন বাধ্য হয়ে করে তার খবর নেয়ার চেষ্টা করেছেন?
অপরদিকে দৈনিক সমকালের ২৫ আগস্ট ২০১০ তারিখের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, “সরকারী অথবা বেসরকারী কেনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের বোরখা পরতে বাধ্য করা ও খেলাধুলা- সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়া যাবে না। কোনো প্রতিষ্ঠানে বোরখা না পরার কারণে কোনো ছাত্রীকে নির্যাতন, হয়রানী ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে তা সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের অসদাচরণ বলে গণ্য হবে।
শিক্ষাসচিব সৈয়দ আতাউর রহমান জানান, গতকালের এ পরিপত্রের মাধ্যমে সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মানবাধিকার সংরক্ষণের প্রচেষ্টা থেকে মূলত চারদফা নির্দেশনার কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো ছাত্রীকে বোরখা অথবা ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা যাবে না। ছাত্রীদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়া যাবে না।
বোরখা না পরলে কোনো ছাত্রীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যাবে না এবং বোরখা ও ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা হলে তা অসদাচরণ বলে গণ্য হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আইন সেল থেকে জারী করা এ পরিপত্র সব ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য হবে। আইন সেলের একজন কর্মকর্তা বলেন, এখানে নির্দিষ্ট কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়নি বরং সব ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা বোঝানো হয়েছে। সে হিসাবে মাদ্রাসাগুলোও কোনো ছাত্রীকে জোর করে বোরখা পরাতে পারবে না। ”
সরকারের এই বোরখা ভীতি নতুন কিছু নয়।
নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালের ১৯ নভেম্বর ইরাকে ও আফগানিস্তানে দায়িত্ব পালনকারী মার্কিন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক কার্ল সিওভাক্কোর হার্ভার্ড ইন্টারন্যাশনাল রিভিউ সাময়িকীতে যৌথভাবে একটি নিবন্ধ লেখেন। নিবন্ধে বলা হয়, "...As the country was founded on a secular system of governance, the entire political system is now vulnerable. Can the Awami League stop the growing tide of Islamism in a country that has seen the sale of burkas rise nearly 500 percent in the last five years? The answer is yes if it implements the following secular renewal plan..."
গত ২৯ আগস্ট বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন আয়োজিত ইফতার মাহফিলে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, হাইকোর্টের একটি রায় বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ধর্মীয় পোশাকের ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা আরোপ সংক্রান্ত পরিপত্র জারী করেছে। শিক্ষামন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, শুধু হাইকোর্ট নির্দেশ নয় আপীলেট ডিভিশনের রায় থাকার পরও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাদ্রাসা ছাত্রদের ভর্তির বাধা নিরসনে আজ পর্যন্ত শিক্ষামন্ত্রণালয় কোনো পরিপত্র জারী করেনি। আশা করি শিক্ষামন্ত্রী মাদ্রাসা ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে আদালতের নির্দেশ অনুসারে অতিদ্রুত একটি পরিপত্র জারী করে প্রমাণ করবেন তার কোনো নিজস্ব পিক এন্ড চুজ নেই, আদালতের রায়ই শেষ কথা।
আদালতের রায় এবং মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে শুধু বোরখা নয় সব ধরণের ধর্মীয় পোশাকের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
অর্থাৎ শুধু বোরখা নয় এ পরিপত্রের ফলে হিজাব, টুপিও নিষিদ্ধ হলো এবং তা শুধু সাধারণ স্কুল নয় মাদ্রাসাতেও। অর্থাৎ এখন থেকে কোনো ছাত্রী যদি মাদ্রাসায় টপস, জিন্স পরে যায়, কিম্বা মাদ্রাসার পুকুরে কোনো ছাত্রী যদি সুইমিং কস্টিউম পরে সাঁতার শিখতে নামে তাহলে কোনো শিক্ষক যদি তাকে নিষেধ করেন তবে তিনি অসদাচরণের দায়ে অভিযুক্ত হবেন। এককথায় আদালতের রায়ের টার্গেট ইসলামের অপরিহার্য অনুষঙ্গ পর্দা ও ইসলামী সংস্কৃতি। পর্দা আল্লাহর নির্দেশ হওয়ায় এই রায় ও পরিপত্র সরাসরি আল্লাহর বিরোধিতা বলে আলেম সমাজ দাবী করেছেন।
আমাদের দেশের অনেক স্কুল আছে যেখানে কিশোরী ও তরুণী মেয়েদের উরু পর্যন্ত খোলা মিনি স্কার্ট পরতে হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে কোনো ছাত্রী যদি ঐ স্কুলে বোরখা পরতে চায় তাহলে কি তা সাংবিধানিক অধিকার বলে গ্রহণ করা হবে? সংবিধানের ২৮ ধারায় তো বলা হয়েছে, নারী পুরুষ ভেদে রাষ্ট্র কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য দেখাতে পারবে না। তাহলে পুরুষরা খালি গায়ে যদি রাস্তায় নামে আর তা দেখে মেয়েরাও যদি খালি গায়ে রাস্তায় বেরোয় তবে কি রাষ্ট্র ও সরকার সংবিধান দেখিয়ে নীরবতা পালন করবে? সংবিধানের এই ভুল ব্যাখা বন্ধ করতে হবে। কারণ ২৮ ধারায় বলা হয়েছে ধর্মীয় কারণে কারো প্রতি বৈষম্য করা যাবে না। অথচ আদালতের রায় ঠিক তার উল্টো। এখানে ধর্মীয় পোশাককেই টার্গেট করা হয়েছে।
পুলিশ, সশস্ত্রবাহিনীসহ সরকারী বিভিন্ন সার্ভিসের নিজস্ব ইউনিফর্ম রয়েছে, প্রশ্ন হচ্ছে সেখানে যদি কেউ বোরখা পরতে চায় তাদের কি বোরখা পরতে দেয়া হবে? আদালতে যদি কেউ কালো গাউন না পরতে চায় তাহলে কি তাকে প্রাকটিস করতে দেয়া হবে? হয়তো বলা হবে, যারা বোরখা পরতে চায় না তারা ঐসব সার্ভিসে যাবে না। সেটা মেনে নেয়া যায় যদি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা অফিস যদি বোরখাকে ইউনিফর্ম ঘোষণা করে এবং যারা এ পোশাক পরতে চাইবে না তারা বিনাবাক্য ব্যয়ে ঐ প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া বা চাকরী করার অধিকার হারাবেনÑ এ মর্মে শর্তটি সরকার মেনে নেয়। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও সশস্ত্র বাহিনীর অনুষ্ঠান, ঢাকা কাব, চট্টগ্রাম কাবসহ বিভিন্ন অঙ্গনে প্রবেশে ড্রেসকোড দিয়ে নির্দিষ্ট পোশাক পরতে বাধ্য করা হলে যদি সংবিধান লঙ্ঘন না হয় তাহলে তাহলে ধর্মীয় পোশাক ড্রেস কোড হলে সংবিধান লঙ্ঘন হবে কেন? সকলের ইউনিফর্ম, ড্রেস কোড জায়েজ কেবল ধর্মের টাই না জায়েজÑ আসলে এরই নাম সেকুলারিজম বা ধর্মনিরোপেক্ষতা!
কিন্তু এই পরিপত্র জারী করার আগে মন্ত্রণালয় বোধ হয় আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পোশাক খেয়াল করেননি। ফুল হাতা ব্লাউজ ও ঘোমটার মাধ্যমে তিনি যে হেজাব রক্ষার চেষ্টা করেন তা বোধ হয় মন্ত্রণালয় ভুলে গেছে। নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীয় হজ্বব্রত পালনের পর পূর্ণ পর্দা পালনের কথাও বোধ করি স্মরণে নেই।
থাকলে পরিপত্র জারি করার আগে একবার প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনার প্রয়োজন বোধ করতো।
এদিকে গত ২৬ আগস্ট হাইকোর্ট সংবিধানের ৭ম সংশোধনী বাতিল করেছেন। ফলে এরশাদের ক্ষমতাগ্রহণ অবৈধ হয়ে গেছে। এতে করে সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম থাকার বৈধতা প্রশ্নের সম্মুখীন। অবশ্য ৫ম সংশোধনী বাতিল মামলার রায়ে সংবিধানের মূল নীতিতে ধর্ম নিরোপেক্ষতা সংযোজন করায় আগেই রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম সংক্রান্ত ২(ক) অনুচ্ছেদটির বৈধতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল।
আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় পোশাক সংক্রান্ত রীটের রায়ে ৮ম সংশোধনী বহাল থাকার পরও আদালত বাংলাদেশকে ধর্ম নিরোপেক্ষ রাষ্ট্র বলে উল্লেখ করেছে।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর শপথ নেয়ার পর সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতি সম্বর্ধনা সভায় প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেন, ‘এই(পঞ্চম সংশোধনী) রায়ের মাধ্যমে বেআইনী ও অবৈধবাবে পরিবর্তিত বিভিন্ন অনুচ্ছেদ বেআইনী ঘোষণা করে মূল সংবিধানে বর্ণিত দফাগুলো পুণঃস্থাপিত করতে সক্ষম হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের সঙ্গে সঙ্গেই মূল সংবিধানের অনুচ্ছেদগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। আমরা সরকারের আইন মন্ত্রণালয়কে সর্বোচ্চ আদালাতের রায়ের মাধ্যমে ওইরূপ স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিস্থাপিত সংশ্লিষ্ট দফাগুলোসহ সংবিধানটি পুণর্মুদ্রণ করতে আহ্বান জানাচ্ছি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে পুণর্মুদ্রণ হোক বা না হোক, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের সঙ্গে সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট মূলদফাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিস্থাপিত হয়ে গেছে।
প্রতিস্থাপিত অনুচ্ছেদগুলো পুনরায় প্রতিস্থাপিত করার কোনো অবকাশ নেই’। অবশ্য সুপ্রীম কোর্টের রায়ের পর থেকেই আইনমন্ত্রী বিভিন্ন সময় সরাসরি বলে আসছিলেন, আদালতের রায়েই সংবিধান সংশোধিত হয়ে গেছে। কাজেই তারা রায় অনুযায়ী সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করবেন। এদিকে প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্যের পর গত ১৩ অক্টোবর সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত সংসদীয় বিশেষ কমিটিও আদালতের রায় অনুযায়ী সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে। আইনমন্ত্রীর বক্তব্য মতে, তার মন্ত্রণালয়ের ড্রাফটিং শাখা বর্তমানে আদালতের রায় অনুযায়ী নতুন সংবিধানের খসড়া তৈরী করছে এবং এ সপ্তাহে তা ছাপার জন্য বিজি প্রেসে দেয়ার কথা।
প্রশ্ন হচ্ছে, যদি আদালতের রায় অনুযায়ী সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করা হয় তাহলে সংবিধানে আল্লাহর উপর আস্থা বা বিশ্বাস, ধর্মীয় রাজনীতি করার অধিকার, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপনে বিশেষ গুরুত্বসহ এ ধরণের সকল ধারা বাতিল হয়ে সেখানে ধর্মনিরোপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র যুক্ত হবে। ফলে ইতোপূর্বে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ সংবিধান সংশোধন করা হলেও ইসলামী রাজনৈতিক দল করার অধিকার, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রভৃতি বাতিল করা হবে না বলে যেকথা বলে আসছিলেন তা শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকে না। আবার গত ১৮ অক্টোবর মন্ত্রীসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সংবিধানে বিসমিল্লাহ থাকবে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলও নিষিদ্ধ করা হবে না। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও থাকবে।
ধর্মীয় রাজনীতিসহ স্পর্শকাতর বিষয়ে আঘাত করার মতো কিছু সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। এসব বষযে বিভ্রান্তি কাটাতে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকার আলোচনা করবে’ ( দৈনিক সমকাল: ১৯-১০-২০১০)। পরের দিনই আইনমন্ত্রী একই পত্রিকাকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল থাকছে জানিয়ে আগের দিনের প্রকাশিত সংবাদকে সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন। আইনমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর বরাতে আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী যদি কোনো নির্দেশ দেন তাহলে তা আমাকেই দিয়েছেন। তিনি বলেন, সুপ্রীমকোর্টের রায়ের আলোকেই সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
এর বাইরে তিনি কিছু বলেননি। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের মানুষ কার কথা বিশ্বাস করবে? প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্রের কথা নাকি আইনমন্ত্রীল কথা?
চার.
জেএমবি নেতা শায়খ আবদুর রহমান ও তার অনুসারীরা দেশের বিচার ব্যবস্থাকে তাগুতি বলে তার উপর হামলা চালিয়েছিল। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী বোমা হামলার সময় জেএমবি জনগণের উদ্দেশ্যে একটি প্রচার পত্র ছড়িয়ে দেয়। জেএমবি’র ঐ প্রচারপত্রে বলা হয়: “...প্রিয় দেশবাসী মুসলিম ভাই ও বোনেরা, আসসালামু আলাইকুম। আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীতে তার প্রতিনিধি রূপে এবং শুধুই তার ইবাদতের জন্য যাতে থাকবে না কোনো অংশীদার।
আমাদের মাঝে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সা. কে প্রেরণ করেছেন এই শিক্ষা দেয়ার জন্য যে, আমরা কিভাবে আমাদের কাজে ও কর্মে তাগুতকে বর্জন করতে পারি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, -----
সূত্র: দৈনিক ইনকিলাব, আদিগন্ত, ২৫-১০-২০১০ইং।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।