বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় হঠাৎই আজ অনেক দিন পর মাথার ভিতরে সাইরেনের একটানা শব্দ বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীর জমে হিম হয়ে যায়। কানের কাছে বাজছে ঝিঝিঁর তীব্র ডাক ।
সেই সঙ্গে হৃৎপিন্ডের ঢিব ঢিব, ঢিব ঢিব শব্দ । মাথা টলছে, চোখের দৃষ্টির সামনে কেবলি কুয়াশা ছড়িয়ে আছে; সিঁড়িতে আলো জ্বলে আছে। একটু পর বিপন্ন অবস্থা সামলে নিয়ে শেষ ক’টা সিঁড়ি ধীরে ধীরে উঠতে লাগল সাঈদ।
কলিংবেল চাপার পর যেন অনন্তকাল কেটে গেল।
সম্বিৎ ফিরে পেলে দেখল দরজার কাছে মা দাঁড়িয়ে।
মাকে পাশ কাটিয়ে ঝড়ের গতিতে ভিতরে ঢোকে সাঈদ । তারপর সোজা বাথরুমে। শরীর থেকে ঘঁষে ঘঁষে ঘাম আর ডিজেলের গন্ধ তুলে ফেলে, মাথার ভিতর থেকে ঘঁষে ঘঁষে তুলে ফেলে সাইরেনের কর্কস শব্দ আর ঝিঝিঁর ডাক ... বুকের ভিতরটা খুবই কাঁপছিল তখন।
খাওয়ার ঘরে টিউবলাইট জ্বলছিল। আজ যে কারেন্ট গেল না? এখন রাত প্রায় সাড়ে দশটার মতো বাজে।
হঠাৎই মনে পড়ল আজ শুক্রবার। আজকাল নিয়মমাফিক শুক্রবারে লোডশেডিং হয় না। আজ দুপুর অবধি ঘরেই ছিল সাঈদ, তারপর সুমনাকে দেখতে গেল পুরনো ঢাকার হাজী ওসমান গনি রোডে ।
খাওয়ার ইচ্ছে নেই। মার জন্যই বসতে হল।
না-খেলে হাজারটা প্রশ্ন করবে। খাওয়ার টেবিলে মা কথাটা আবার তুলল। তোর মঞ্জু খালা বলল, মেয়েটা নাকি ভালোই; ফরসা আর নামাজী। ইংরেজি অনার্স পড়ে লালমাটিয়ায় ।
সাঈদ মাথা নীচু করে খেয়ে যাচ্ছে।
মা আজ দুপুরে সর্ষে ইলিশ রেঁধেছিল । এখন সেটাই গরম করে দিয়েছে। জিভে স্বাদহীন ঠেকছে। মায়ের রান্না অসাধারণ। তা হলে? ইদানীং হাতের তালু ঘেমে যায়।
হাতের তালু ঘেমে যাওয়া নাকি ভালো না। হৃদরোগের লক্ষণ?
একদিন মেয়েটাকে দেখে আসব? মায়ের কন্ঠস্বর কেমন করুণ শোনালো।
সাঈদের খাওয়া শেষ হয়নি। মাথা টলে উঠতেই উঠে দাঁড়াল। প্রথমে বাথরুমে ঢুকল হাত ধুতে, তারপরে নিজের ঘরে চলে এল।
মা সম্ভবত এখনও বসে আছে খাওয়ার টেবিলে। এক্ষুনি কানাডায় ফোন করে তানিয়া আপাকে ইনিয়ে-বিনিয়ে যা বলার বলবে। যা ইচ্ছে করুক মা!
ঘরে এসে একটা সিগারেট ধরালো সাঈদ। তারপর ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে বিছানার ওপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। শরীর অল্প অল্প কাঁপছে।
মা কি অবুঝ? বারবার অস্বস্তিকর প্রসঙ্গটি তুলছে। আজও সকালে নাস্তার টেবিলে বলল, নভেম্বরে তানিয়ারা সব আসছে । এর মধ্যে মেয়ে দেখে রাখলে সুবিধা হয় । ওরা অত দূরে থাকে ... বারবার তো আসতে পারে না।
ঠিক!
ঠিক সেই মুহূর্তে অন্ধকারে কে যেন গান গেয়ে ওঠে ...
যদি তারে নাই চিনি গো সে কি আমায় নেবে চিনে
এই নব ফাল্গুনের দিনে, জানি নে, জানি নে।
।
কথাগুলি কেন লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
মনে হয় আরেক জন্মের কথা লিখেছেন কবি। আরেক জন্মে কেউ ফিরে যাবে। আরেক জন্মে ফিরে যাওয়া যায় ? ফিরে যাওয়া কি সম্ভব? আরেকটি জীবন কি কোথাও রয়েছে? নিখুঁত, সুন্দর ও অমলিন জীবন? অন্ধকারে সিগারেটের লাল আগুন ঘুরছে। সিঁড়িতে আজ অনেক দিন পর সেই অসহায় অনুভূতিটা ফিরে এল।
কেন?
সিগারেটের লাল আগুন ঘুরছে। আর কিছু প্রশ্ন ঘুরছে সাঈদের করোটির কোষে। কেন আমি বেঁচে আছি? কি দরকার ছিল এই জীবনের? আমার বেঁচে থাকায় কার কী লাভ- আমার বেঁচে থাকায় কোন্ অদৃশ্য শক্তির সুখ-শিহরণ অনুভব হয়... অদৃশ্য শক্তি বলে সত্যিই কিছু আছে? আকাশের দিকে তাকালে নিজেকে কত ক্ষুদ্র মনে হয় ... রাত্রির নক্ষত্রময় মহাকাশের দিকে চাইলে নিজেকে কত ক্ষুদ্র মনে হয়। মহাবিশ্বের এত বিরাট আয়োজন তো আমার জন্য নয়। তা হলে? আমার এই দুঃখে কার প্রয়োজন সিদ্ধ হয়? আমার এই একাকীত্বে কার মনে শিহরণ জাগায়? ... এতসব শূন্য আর দুঃখি প্রশ্নের পরও মনে হয় ... আনন্দময় আরেক জন্ম যেন ওর জন্য অপেক্ষা করে আছে।
সেই জন্মজন্মান্তরের ওপারে জেগে উঠবে সাঈদ। দুঃখশূন্য, একাকীত্বহীন আরেক জন্মে; ... যে জন্মের পাখি-ডাকা সবুজ অরণ্যের ধারে, জলভরা ছলছল ছলছল নদীর পাড়ে, নিবিড় আমলকি গাছে ঘেরা নিকনো উঠোনের পারে একটি শান্ত কুঁড়ে ঘরে, হরিণ-দৌড়নো ঘন ঝোপের পাড়ে, মহিষ-চরা বিরল ঘাসের মাঠে, জ্বলজ্বলে সূর্য আর ফিরোজা রঙের আকাশের নীচে, সোনাবর্ণা রোদের ভিতরে হলদে প্রজাপতির পিছনে ধাওয়া করা সে এক নবীন কিশোর। সহসা এক কিশোরীকে দেখে সে থমকে যাবে। দীঘল চুলের শ্যামবর্ণা কিশোরীর মিষ্টি মুখ, ডাগর- ডাগর চোখ, আর দীর্ঘ আঁখি পল্লব ...
সত্যিই কি আমি জন্মজন্মান্তরের ওপারে কোনওদিন জেগে উঠব?
বালিশে পাশে অ্যাশট্রে ছিল। অ্যাশট্রেতে সিগারেট গুঁজে রাখে সাঈদ।
বালিশের পাশে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ঢাউশ অ্যাকাউন্টিং বইটাও রাখা ছিল। বইয়ের ভিতরে একটি ময়ূরের পালক। সে পালক ছুঁলেই আজও নরম মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে । অবিকল সুমনার শরীরের মিষ্টি গন্ধের মতো। সুগন্ধরা কি দীর্ঘজীবি হয়? হতে পারে? এত বছর পরও কি করে মিষ্টি গন্ধ অবিকল রয়েছে? নাকি এসবই আমার মনের অলীক কল্পনা? অথচ, আমার মনে হয় জন্মজন্মান্তরের ওপারে সোনাবর্ণা রোদের ভিতরে হলদে প্রজাপতির পিছনে ধাওয়া করা যে নবীন কিশোর সহসা যে কিশোরীকে দেখে থমকে যায় ... সেই কিশোরীটি অবিকল সুমনার মতো দেখতে।
সেই একই মিষ্টি মুখ, ডাগর- ডাগর চোখ, দীর্ঘ আঁখি পল্লব। ... সুমনা একবার সাঈদকে রায় সাহেব বাজারে স্বরসতী পূজায় নিয়ে গিয়েছিল । মন্ডপের ভিড়ের মধ্যে দেবীর চোখের দিকে তাকাতেই সাঈদের মাথা কেমন টলে উঠেছিল। ক’দিন পর ঢাউশ অ্যাকাউন্টিং বইয়ের ভিতরের ময়ূরের পালক পেয়ে চমকে উঠেছিল সাঈদ। এসব কবেকার কথা।
অন্ধকারে কে যেন গেয়ে উঠল:
সে কি আপন রঙে ফুল রাঙাবে।
সে কি মর্মে এসে ঘুম ভাঙাবে।
ঘোমটা আমার নতুন পাতার হঠাৎ দোলা পাবে কি তার,
গোপন কথা নেবে জেনে এই নব ফাল্গুনের দিনে
জানি নে, জানি নে। ।
কথাগুলি কেন লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে নিউজিল্যান্ড থেকে তানিয়া আপারা এল।
সাঈদকে খোঁচা মেরে তানিয়া আপা বলল, ভালো ইনকাম করছিস যখন, বিয়ে করছিস না যে, সমস্যা থাকলে ডাক্তার দেখা .. তোর দুলাভাই একজন নামকরা সাইক্রিয়াটিস্টকে চেনে ...
সাঈদ যা কখনও করে না, তাই করল, তানিয়া আপার সামনেই সিগারেট ধরাল। তারপর চোখে চোখ রাখল।
তানিয়া আপা উঠে চলে যায়।
রাকিব দুলাভাই বললেন, সাঈদ, তুমি সারাক্ষণ ঘরের দরজা বন্ধ করে থাক কেন বল তো? আমাদের সঙ্গে ড্রইংরূমে এসে গল্প করতে পার না?
সাঈদ ফ্যাকাশে হাসে। ঢোক গিলে।
তানিয়া আপারা মাকে নিউজিল্যান্ড নিয়ে যায় । শীঘ্রি নাকি মা দেশে ফিরবে না; যাওয়ার আগে এমনই ইঙ্গিত দিল। এই তোর শাস্তি! চিবিয়ে চিবিয়ে বলল তানিয়া আপা। এখন একা-একা থাক।
সাঈদ ম্লান হাসে।
যাওয়ার আগে মা গম্ভীরকন্ঠে জিগ্যেস করল, সেই মেয়েটার কি বিয়ে হয়ে গেছে?
কোন্ মেয়েটার?
ওই যে জগন্নাথে পড়ার সময় একদিন নিয়ে এলি না- ওই যে হিন্দু মেয়েটা, কী যেন নাম, হিন্দু দেবীর মতন সুন্দর দেখতে।
ওহ্ । সাঈদ চুপ করে থাকে। রায় সাহেব বাজারে স্বরসতী পূজার সময় দেবীদর্শনের ক’দিন পর অ্যাকাউন্টিং বইয়ের ভিতরে ময়ূরের পালক পাওয়ার কথাটা সুমনাকে বলেছিল সাঈদ ...কথাটা বলতেই সুমনা হেসে ফেলেছিল ... এসব কবেকার কথা ...
মা কানাডায় চলে গেলে ওয়ারির ফ্ল্যাটটা অসম্ভব ফাঁকা হয়ে যায়। শীতের দিনে ছুটির দিনগুলোয় আরও ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
একা একা এ ঘর - সে ঘর ঘুরে বেড়ায় সাঈদ। পুরনো আলমারী খুলে জিনিসপত্র নাড়ে, ন্যাপথলিনের গন্ধ নেয়। আলমারীর ভিতরে বাবার অনেকগুলি টাই; টাইয়ের ভিতর মুখ রাখে। মায়ের শাড়িতে আমলকি-আমলকি গন্ধ- সে গন্ধ নেয়।
কখনও ঘরে পাহাড় ও ঝর্নাসমেত একটি প্রাচীন অরণ্য ঢুকে পড়ে।
সে অরণ্যের প্রান্তে দাঁড়িয়ে হু হু করে কাঁদে সাঈদ।
আজকাল অনেক রাত অবধি বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে থাকে সাঈদ । বসে থেকে একটার পর একটা সিগারেট টানে আর এ শহরের ঝাপসা ম্লান আলো দেখে, নক্ষত্রশূন্য ফ্যাকাশে একটা আকাশ দেখে। অনেক রাতে ঘুমিয়ে পড়ে সাঈদ -স্বপ্ন দেখবে বলে ...স্বপ্নে সুমনার সুন্দর অক্ষত মুখটি দেখবে বলে।
দেখতে দেখতে শীত শেষ হয়ে যায়।
পোড়া ডিজেলের গন্ধে ডুবে থাকা ঢাকা শহরটিতে তবুও বসন্ত আসে। পেট্রলপাম্পের পাশে অটল দাঁড়িয়ে থাকা ধূলি ধূসরিত নিমগাছটির কচি-কচি পাতা চোখে পড়ে। বড় রাস্তায় ‘নিপাত যাও’ ধ্বনি তোলা সরকারবিরোধী দীর্ঘ মিছিল, সেই দীর্ঘ মিছিলের সামনে-পিছনে দীর্ঘ যানযট, তারি ফাঁকে বিশাল ইলেকট্রনিক বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন-সুন্দরীর নির্মল হাসিতে সুন্দর জীবনের আশ্বাস ...
অফিসেও আজকাল উদ্বেগ বোধ করে সাঈদ।
কয়েক সপ্তাহ আগে ডিএসইতে ২০০০ কোটি টাকার মতো লেনদেন কমেছে । উদ্বেগের মূল কারণ এটাই ।
উদ্বেগের আরও একটি কারণও আছে। অনেক ক’টি দু’নম্বর কোম্পানি ১৯৯৬ সাল থেকে ফাটকা বাজারে চলে এসে লগ্নী করতে থাকে। এসব টো টো কোম্পানিগুলি এখন জেড গ্র“পের পর্যায়ভূক্ত হয়ে ধুঁকছে। সাঈদদের টিম এসব অসাধু কোম্পানির তালিকা করার দায়িত্ব পেয়েছে । সমস্যা এখানেই, এই কাজে যেমন ঝুঁকি আছে, তেমনি মন্ত্রী-মিনিস্টারের প্রচ্ছন্ন হুমকিও আছে, ঘন ঘন টেলিফোন আসছে ... এসবই ভেবে ভেবেই আজকাল বড় অস্থির লাগে ওর।
এক বিকেলে অফিস থেকে বলতে গেলে একরকম পালিয়ে আসে সাঈদ। ফেব্র“য়ারি মাসের মাঝামাঝি। শহরময় ঝলমলে রোদের ভিতর শীতমাখা বাতাসের কাঁপন। একটা সি এন জি নিয়ে পুরনো ঢাকার হাজী ওসমান গনি রোডে চলে এসে সরু একটি গলির মুখে নামল । জ্যামে দেরি হয়েছিল।
গলির মুখে ফলের দোকান। বেছে -বেছে কয়েক কেজি আপেল, কমলা ও আঙুড় কিনল। তারপর গলির ভিতরে হাঁটতে থাকে। ফেব্র“য়ারি বিকেলের শীতমাখা রোদ ততক্ষণে অনেকটাই ম্লান হয়ে উঠেছে।
হাতের বাঁয়ে একটি আস্তরহীন তিনতলা বাড়ি।
বাড়িটির চলটা ওঠা রুখু সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে খয়েরি রঙের একটি জীর্ণ দরজায় নক করল সাঈদ। দরজা খুলে দিল একটি নীল ফ্রক পরা অল্প বয়েসি মেয়ে । মেয়েটিকে ফলের ঠোঙাগুলি দিয়ে ভিতরে ঢোকে সাঈদ। বসার ঘরটি ছোট এবং বড় অগোছালো। আগে এরকম ছিল না ...সুমনার এক্সিডেন্টের পর থেকেই সংসারটি কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে।
এক পাশে বিছানা, তাতে তোশক গোটানো, বেতের সোফার কাভার ময়লা হয়ে গেছে, মনে হয় অনেকদিন ধোওয়া হয় না । এক কোণে একটি পুরনো মডেলের ন্যাশনাল টিভি, তার পাশে ছোট টেবিলের ওপর একটি হারমোনিয়াম। সুমনা ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইত। জগন্নাথ কলেজের ফাংশনে প্রায়ই গাইত: যদি তারে নাই চিনি গো সে কি ... ময়লা হয়ে যাওয়া চুনকাম করা দেয়ালে সাদা ময়ূরের পালক, সম্ভবত আঠা দিয়ে লাগানো ...বাঁ পাশের জানালায় শেষ বেলার ম্লান রোদ থমকে আছে।
পর্দা সরিয়ে একজন মধ্যবয়েসী মহিলা ঘরে ঢুকলেন।
সাঈদকে দেখে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বললেন, ও, বাবা তুমি! আস, ভিতরে আস। সুমনায় ঘুমায়া আছে। দুপুরে ভাত খাওনের পর অষুদ খায়, সেই অষুদ খাইয়া সেই সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমায়। নাইলে ব্যাথ্যায় ছটফট করে।
সাঈদের বুক কাঁপছিল।
ও ভদ্রমহিলার পিছন পিছন ভিতরে ঢোকে। ভিতরে খাওয়ার ঘর। বাঁ পাশে দরজা। আধো-অন্ধকার ঘরটায় ফিনাইলের গন্ধ ভাসছে । জানালার কাছে রোদ আটকে আছে।
এ দিককার বাড়িগুলি সব গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে বলেই পাশের বাড়ি শিশুর কান্না শুনতে পেল সাঈদ। ঘরের এক পাশে জানালা ঘেঁষে একটা খাট, খাটের উপর মশারি টাঙানো। ভিতরে সুমনা পাশ ফিরে শুয়ে । ওর দগ্ধ মুখটা দেখা গেল না। সুমনার শুয়ে থাকার ভঙ্গিটা যেন চলচ্চিত্র থেকে উঠে আসা ... যেন ও শরবিদ্ধ ... যেন প্রাচীন অরণ্যে একটা হরীতকী গাছের নীচে ওর প্রাণহীন দেহটি পড়ে আছে ....সাঈদ দিশেহারা বোধ করে ... জন্মজন্মান্তরের ওপারে সোনাবর্ণা রোদের ভিতরে হলদে প্রজাপতির পিছনে ধাওয়া করতে করতে নবীন বয়েসে সে একটি শ্যামবর্ণের মিষ্টি চেহারার কিশোরীকে দেখেছিল ...হায় সেই কিশোরী এখন শরবিদ্ধ! শরবিদ্ধ! শরবিদ্ধ!
ময়ূর শিকারী লোভী ব্যাধ শ্যামবর্ণের কিশোরীকে শরবিদ্ধ করেছে...
এই শিউলী, যা চা বানা।
না থাক। সাঈদ বলে।
থাকব ক্যান, থাকব ক্যান। শিউলী, যা কইতাছি ...
বুকের ভিতর ভীষণ তোলপাড় টের পায় সাঈদ। পা কাঁপছে।
ফিনাইলের গন্ধ তীব্র হয়ে উঠেছে । সাঈদ কোনওমতে বলে, আজ আমি আসি মাসী। সুমনা এখন ঘুমাক। পরে আমি আবার আসব। বলে ঘুরে দাঁড়ায় সাঈদ।
তারপর প্রাণহীন কিশোরীর দেহ পাজকোলা করে নদীর কিনারে নিয়ে আসে। তারপর নদীর পাড়ে শুইয়ে দিয়ে বাহু থেকে টান মেরে তুলে ফেলে তীর । শ্যামবর্ণের বাহুটি তরল ঘন লাল উষ্ণ রক্তে ভরে ওঠে। তীরের ডগায় বিষমাখানো ছিল। হায়।
নদীর জলে ভাসিয়ে দেয় কিশোরীর প্রাণহীন দেহ ...তারপর নদীর কিনারে বসে হুহু করে কাঁদতে থাকে।
বসবা না বাবা? সুমনার বাবার আসনের সময় হইছে। দেখা কইরা যাইবা না?
আমি পরে আরেক দিন আসব মাসি। সাঈদের কন্ঠস্বর কাঁপছিল।
আচ্ছা, আইস তাইলে।
দরজার কাছে পৌঁছে গেছে সাঈদ। দরজা খুলে পকেট থেকে একটা খয়েরি রঙের খাম বের করে সুমনার মায়ের হাতে দেয়। খামটি নিয়ে মহিলা গভীর কৃতজ্ঞতার সুরে বলেন, তোমার ঋণ আমরা কুনুদিন শোধ করতে পারুম না বাবা। তুমি মানুষ না বাবা, তুমি হইলা গিয়া দেবতা।
থাক।
না বাবা, থাকব ক্যান। বলে সুমনার মা বহুবার বলা একটি ঘটনা পুর্নবার বলেন, বংশালের নন্দীগো পোলা সুরঞ্জন ওরে বিয়া করতে চাইছিল। সুমনায় রাজি হয় নাই বইলা অ্যাসিড মইরা মাইয়াটার দেবীর মতন মুখখান ... বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে ওঠেন ভদ্রমহিলা।
সাঈদের মাথায় কে যেন ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে। কানের কাছে তীব্র ঝিঝিঁর ডাক শুনতে পায়।
মাথা টলে ওঠার আগেই সে চট করে সামলে নিয়ে সিঁড়ির কাছে চলে আসে। তারপর দ্রুত নীচে নেমে আসে।
গলিতে পা রাখতেই মাগরিবের আজান শুনতে পেল সে । আশ্চর্য! কখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে উঠল? শীতের বেলা বলেই হয়তো টের পাইনি ... গলিতে হাঁটতে-হাঁটতে ধূপের গাঢ় গন্ধ পেল। গলির দু’পাশে দোকান আর বাড়িতে আলো জ্বলে উঠেছে।
... ধীরে ধীরে সে আলো মুছে যেতে থাকে। সাঈদের মাথার ভিতরে একটানা সাইরেনের শব্দ বাজতে থাকে। জন্মজন্মান্তরের ওপারে পাখিডাকা একটি সবুজ অরণ্যের ধারে সন্ধ্যায় জলভরা ছলছল ছলছল নদীর জলে স্নান সেরে এইমাত্র যেন ঘাটে উঠে এল, তারপর ভেজা শরীরে হরিণ-দৌড়নো ঘন ঝোপের পাশ দিয়ে নিবিড় আমলকি গাছে ঘেরা নিকনো উঠোনের পারে একটি শান্ত কুঁড়ে ঘরের দিকে যেতে থাকে, যেখানে দীঘল চুলের শ্যামবর্ণা এক কিশোরী অন্ন-ব্যাঞ্জন নিয়ে অপেক্ষায় ... যে ডাগর- ডাগর চোখের মিষ্টি চেহারার কিশোরীকে দেখে মহিষ-চরা বিরল ঘাসের মাঠে ফিরোজা রঙের আকাশের নীচে সোনাবর্ণা রোদের ভিতরে হলদে প্রজাপতির পিছনে ধাওয়া করতে করতে এক নবীন কিশোর সহসা দেখে থমকে গিয়েছিল ... কতকাল আগে যেন ... জন্মজন্মান্তরের ওপারে ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।