সকাল আর আসেনা গোলাপ হয়ে ফোটেনা কিশোরীর হাতে
আকাশে একবিন্দু মেঘ নেই। মাঠ ঘাট শুকিয়ে একাকার। আগুণ ঝরা রোদে একটা কুকুর জিহবা বের করে ক্রমাগত হাপাচ্ছে। এক বাড়ির উঠানে ভিড়। মানুষ গিজগিজ করছে।
চৈত্রমাসের প্রখর রোদ। টিনের চালা তেতে আগুণ হয়ে আছে। সেই চালায় শুয়ে আছে ইমন। শরীর একদম উদোম। পরণে গামছা।
অর্ধ নগ্ন। পিঠের উপর ফোস্কা পড়ে গেছে। এবার উপুড় হয়ে শুয়েছে। একদল লোক চালার নিচে দাঁড়িয়ে চুপচাপ উপভোগ করছে সে দৃশ্য।
আপন মনে কথা বলে চলেছে পাগলা।
নিজে প্রশ্ন করে আবার নিজেই উত্তর দিচ্ছে। যেন সেকেণ্ড পারসন আর ফাস্র্ট পারসনের কথোপথন।
-কিরে কেমন লাগে?
-অনেক কষ্ট বাপজান অনেক কষ্ট।
-ঐ হালা বাপ ডাকিস না দুলা ভাই ডাক। বাইনচোদ।
তোর পেনের পেনের ঘ্যানের ঘ্যানের আমারে পুরা পাগল বাইনায়া দিছে। এখন ক আর কোনদিন কইবিনি শইল্যে রইদ লাগে?
-না বাপ আর কমুনা। এবার মাফ কইরা দ্যাও।
-আবার বাপ ?হালা শুইয়া থাক আরো এক ঘন্টা। তাপ একপ্রকার শক্তি বুঝলি?খাওন খাইলে হেইগুলা হজম হইয়া শইল্যে তাপ উৎপাদন করে।
হেই তাপ তোরে ডাইরেক্ট ঢুকাইদিতাছি। শুইয়া থাক আরো এক ঘন্টা।
মানুষের মধ্যে গুঞ্জণ -হ সাধন ভজন এত সহজ না গো। এই রহম না পুড়লে সাধন হয় না। কয়জন পারে এই রহম পুড়তে?নিজেরে না পুড়ালে কি আর নূরের রুশনি মিলব?নূর পাইতে হইলে নিজেরে জ্বালান লাগবো পোড়ান লাগব।
তয়লে মিলব তারে।
ইমন শহরে পড়ালেখা করা এক শিক্ষিত ছেলে। একদিন চাকরি বাকরি ছেড়ে গ্রামে চলে আসে।
বাড়িতে সবাই জানতো শহরে কোন এক মেয়ের সাথে সম্পর্কের কথা। তারা বিয়ে দেবার জন্য প্রস্তুতি ও নিচ্ছিল।
কিন্ত্ত হঠাৎ কি হলো ইমন বাড়ি চলে আসে । কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে চুপচাপ থাকে। বড়জোর বলতো ভাল লাগেনা। দূরে যাও। আস্তে আস্তে পাগলামি বাড়তে থাকে।
কিন্ত্ত মানুষের ক্ষতি করে না।
মানুষ প্রথম প্রথম তাকে পাগল ভাবত। এখন আর সেরকম ভাবে না। এখন সব ছেলে মেয়ে বুড়ো তার পিছনে লাইন ধরে থাকে। সেবা দেবার চেষ্টা করে।
পাগল মানুষ মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে দুই হাতে কিল ঘুষি লাথি মারতে থাকে। তাও কেউ টু শব্দটি করে না। যাকে মারে সেই নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে। অন্যরা এতে ঈর্ষাণ্বিত হয়।
-তোর কপাল তো খুইলা গেছেরে মফিজ।
যা যা এই মাইরে তোর কাম হইব। বাবারে সেলামডা কইরা গোসল দে গা যা।
নিশি রাতে প্রায়ই পাগলা গান গায়
কুত্তার জ্বালায় মইরা গেলাম
কুত্তা তুই জ্বালাইস না আমারে
আমি পাগল মইরা গেলাম তোর কামড়ে।
ও তুই জ্বালাইস না আমারে।
মন মর্জি ভাল থাকলে সে ভাল মানুষের মত কথা বলে।
কথা শুনে কেউ বুঝতেই পারেনা তার আরেক রূপ। তখন আপনজন কিংবা কাছের মানুষ সুযোগে বলে পাগলামী ছেড়ে দিতে। ভাল হয়ে যেতে। সে সেসব কথার উত্তরে বলে তোমরা এসব বুঝবা না আমি ভালই আছি। মানুষ তার গূঢ় কথার অর্থ বুঝতে পারেনা।
-ও মলা ভাই কেমন আছো?
মলা ফিরে তাকায়। খুশি হয়। ইমনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। তার হাতে কনুই জাল আর মাছের ঝুড়ি।
-ভাল আছি ভাই আপনে কিমুন আছেন।
-ঝুড়িতে কি মাছ ধরলা মলা ভাই?
-ঝুড়িতে কৈ মাছ ইমন ভাই অনেক বড় বড় কৈ মাছ। খাইবেন?আপনের ভাবি পিয়াজ দিয়া ভালা কইরা রাইন্ধা দিব।
-কৈ মাছ অনেক মজা না?
-হ ভাই আপনের ভাবি খুব সুন্দর কইরা রানতে পারে। আপনে আইজ দুপরে আমার ঘরে খাইবেন। আপনের দাওয়াত।
ইমন চুপচাপ বসে থাকে। মলা মিতিগতি বুঝতে না পেরে ভয়ে ভয়ে চলে যায়। যেতে যেতে বলে দুপরে আফনের ভাতিঝিরে পাডামু আফনেরে নিতে। আইসেন কিন্ত্তক। তারে আবার মাইরেন না।
দুপুর বেলা কাঁঠাল গাছের নিচে বসে বসে ইমন মাটিতে আঁকাআঁকি করছে। কাছেই একটা ছাগল।
সে একটু পরপর ঝরে যাওয়া হলুদ কাঁঠাল পাতা এগিয়ে দেয়। আর বলে কাঁঠাল পাতা খুব মজা নারে?মজা হইব না মানে গাছের পাকনা পাতা । পাইক্কা হলুদ হইয়া গাছ থাইক্কা পড়ছে।
একদম গাছ পাকনা।
লোকজন আজকাল তাকে কোন কিছু দিতে চায়না। তার পরিবারের আপন জন যারা আছে তারা একটা ব্যাপার লক্ষ করে যে মানুষ তার কাছে এলে কোন কিছু নিয়ে আসলে সে রেগে যায় তেড়ে ফুড়ে ষাড়ের মত মারতে যায়। অনেক ভাঙচুর করে। সেজন্য তারা অনুরোধ করেছে যাতে কেউ কোন কিছু না আনে।
এতে করে পাগল কিছুটা শান্ত্ব থাকে।
-আব্বায় আফনেরে যাইতে কইছে।
মর্জিনা ভয়ে ভয়ে বলে।
-ডরাইছ না আমি তোরে মারব না। কাছে আয় দেখি।
মর্জিনা ভয়ে ভয়ে কাছে যায়। ইমন পাগলা আবল তাবল কথা বলতে থাকে। আর মর্জিনা ফিকফিক করে হাসতে থাকে।
-ও মর্জিনা তোরে না কইলাম তোর চাচারে বাড়িত লইয়া যাইতে। আইয়েন ভাই আফনের
ভাবি ভাত বাইড়া পাটি পাইত্তা বয়া রইছে আফনে না গেলে আমরা কেউ খাইমু না।
হাত ধরে মলা ইমনকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। পেছনে পেছনে মর্জিনা।
বাড়িতে গেলে পাটিতে বসিয়ে হাত ধুইয়ে সুন্দর কারূকাজ শোভিত বাসনে ভাজা কৈ মাছ দিয়ে ভাত সামনে এগিয়ে দেয় মর্জিনার মা। ইমন টানটান চোখে তাকিয়ে থাকে থালার দিকে। হাত দিয়ে আস্ত কৈ মাছটাকে ধরে প্রবল শক্তিতে কচলাতে থাকে।
-ও ভাইজান করেন কি?
-খা শালা কৈ মাছ খা। তোর কৈ মাছ খাইতে মনে চাইছে না?কৈ মাছ তোর গোয়া দিয়া হান্দামু। কুত্তার জ্বালায় মইরা গেলাম। কুত্তার জ্বালায় মইরা গেলাম।
সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
কৈ মাছের বড় বড় কাঁটা হাতে বিদ্ধ হয়ে রক্ত ঝরতে থাকে।
সময় গড়িয়ে চলে। মানুষ শেষমেষ চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসে এই পাগল ভবের পাগল না ভাবের পাগল।
এলাকার মানুষ যেকোন কাজে তার কাছে দোয়া নিতে আসে। আসে মেম্বার চেয়ারম্যান।
বিদেশ গামী লোক।
চেয়ারম্যান সভা ডেকেছেন। সামনে নির্বাচন। সরকারি দলের সাপোর্ট থাকায় এলাকায় তার প্রভাব অনেক। সংখ্যালঘুর জমি জিরাত দখল করে বিশাল দিঘি দিয়ে বাড়ি নির্মাল করেছে।
১৯৭১ সালে দেশছেড়ে চলে যাওয়া হিন্দুদের জায়গা তার বাবা দখল নিয়ে নেয়। সে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান দাবি করে। লোক মুখে শোনা যায় তার বাবা অস্ত্রজমা দেয়নি। সেই অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ডাকাতি খুন রাহাজনি করে বেরিয়েছে। শ্যামল দত্ত,সুধাস,গোবিন্দ দাস এমন অসংখ্য লোককে ঘরছাড়া করেছে।
রাতের আঁধারে তারা পালিয়ে গেছে প্রাণের ভয়ে। এ জনপদে তাদের আর দেখা যায়না। স্বাধীন বাংলাদেশে যারা অসংখ্য হিন্দু লোকের সম্পদ দখল করেছে এই চেয়ার ম্যানের বাপ মনসুর মেম্বর তাদের একজন। পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের পরও যারা বেঁচেছিলেন,এই দেশের মাটি আঁকড়ে পড়েছিলেন তাদেরকে ঘরছাড়া করার শেষ কাজটি করে মনসুর মেম্বর। অবশ্য কেউ কেউ বলে এসব নাকি দুষ্টলোকের অপপ্রচার।
বিগত তত্বাবধায়ক সরকারের সময় সরকারি গম,চাল আত্বসাতের জন্য তাকে হাট ভর্তি মানুষের সামনে কান ধরে উঠবস করতে হয়েছে।
হাজার হাজার মানুষ। এক আগুন ঝরা বক্তব্য। চেয়ারম্যানের লোকজন জোর জবরদস্তি করে ইমনকে। যেহেতু এলাকার লোকজনের মধ্যে একটা বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে যে ইমনের একটা আধ্যাত্বিকতা আছে।
চেয়ারম্যানকে সাপোর্ট দিতে বড় বড় নেতারা এসেছে শহর থেকে। একের পর এক আগুন ঝরা বক্তব্য । সবশেষে উঠলেন চেয়ারম্যান। কান্না কান্না কণ্ঠে বলতে থাকেন
-আপনারা জানেন বিগত তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমার নামে মিথ্যা চুরির অপবাদ দেওয়া হয়েছিল। আমি ......।
......।
হঠাৎ গামছা পড়া ইমন পাগলা উঠে আসে বসা থেকে। চেয়ারম্যানের মুখ থেকে মাইক সরিয়ে কসিয়ে মারে একটা চর। চিৎকার করে বলতে থাকে শালা কুত্তা। কুত্তার মেল।
কুত্তার হাট বসাইছস?সকলে অনভিপ্রেত ঘটনায় থ মেরে যায়। গামছা খুলে উলঙ্গ হয়ে নেতানেত্রীদের সামনে দিয়ে একচক্কর দিয়ে কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই ভু দৌড়। জনগণের ভেতর ফিসফাস গুঞ্জণ আরম্ভ হয়। ইমন আগে কখনো এমন আচরণ করেনি। সবাই তাকে সাধু সন্ত্ত টাইপের ভেবে এসেছে।
এ ঘটনা সবাইকে ভাবিয়ে তুলল।
শীতকাল । ইমনের পাগলামী বাড়তে থাকে। আগে রাতে ঘরে ঘুমাত এখন রাস্তা ঘাটে এখানে সেখানে শুয়ে থাকে। রাতবিরাতে ঠান্ডায় জমে যাওয়া পানিতে নেমে দাঁড়িয়ে থাকে আকণ্ঠ।
পড়ন্ত বিকেল। কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। আবহাওয়া গুমোট বাঁধা। যেন পূরবী রাগ ঝরে পরছে ক্রমশ নিষ্প্রভ হয়ে আসা সূর্য হতে। দিন বিদায়ের সুর।
দূরের গ্রাম আবছা দেখা যায়। বাতাসে কেমন একটা ফুরফুরে গন্ধ। ঘাসের। মাটির। কুয়াশার।
দূরে তালগাছটার উপর অনেক বাবুই বাসা বেঁধেছে। চারদিক কিচির মিচির শব্দে মুখরিত। আকাশে তাড়াহুড়ো করে ঘরে ফিরছে কাক, বক,পানকৌড়ি,চিল। মৌন প্রকৃতি। ঘাস ফড়িং লাফালাফি করছে।
দূর হতে দেখা যায় একটি ছায়া মত প্রতিমূর্তি। একা । ঝাপসা। লোকে তাকে বলে ইমন শাহ।
অটঃভূল ত্রটির জন্য কোন মার্জনা চাইনা।
সমালোচনা গ্রহণীয়
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।