বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ আরবি-বাংলা অভিধানে ‘কামলিওয়ালা’ শব্দটির বানান দেখলাম ‘কমলিওয়ালা’ এবং ‘কমলিওয়ালে’। বাংলায় অবশ্য ‘কামলিওয়ালা’ রূপটিই প্রচলিত । আরবি-বাংলা অভিধানে কামলিওয়ালা শব্দটির দুটি অর্থ পেলাম: (১) কম্বল -আবৃত, কম্বল- পরিহিত।
(২) কম্বলধারী ব্যাক্তি। এক কথায় ‘কামলিওয়ালা’ শব্দের অর্থ সুফি। যিনি কামেল লোক, যিনি সাধনায় সিদ্ধ হয়েছেন এবং পরিপূর্ণতা লাভ করেছেন। পাঠ করুন:
The term sufi (Arabic, “man of wool”) was coined in the early 9th century as a name for mystics whose ascetic practices included wearing coarse woolen garments, or sufu; soon the term referred to all mystics, whether or not they followed ascetic practices. ("Sufism." Microsoft Encarta 2008 )
অনেকের মতে সুফিবাদের উদ্ভব ইসলামের অভ্যূদয়ের প্রথম শতকে। Sufism, Islamic mysticism that began to develop in the 7th century, the first century of Islam.( Microsoft Encarta) এ বিষয়ে নজরুল মনে হয় পুরোপুরি একমত নন।
নজরুল বিশ্বাস করতেন সুফিবাদের উদ্ভব হয়েছিল ইসলামের মহানবীর নবুয়াত প্রাপ্তির সঙ্গে-সঙ্গেই।
কেননা, তাঁর একটি জনপ্রিয় গানে নজরুল বলেছেন:
হেরা হতে হেলেদুলে নূরানী তনু ও কে আসে হায়
সারা দুনিয়ার হেরেমের পর্দা খুলে খুলে যায়
সে যে আমার কামলিওয়ালা
যিনি হেরা পর্বতের গুহা থেকে হেলেদুলে নেমে আসছেন,অর্থাৎ ইসলামের নবী- তিনি একজন কামলিওয়ালা অর্থাৎ সুফি। তা হলে বোঝা যায় নজরুলের চিন্তায় সুফিবাদের উদ্ভব ইসলামের মহানবীর নবুয়াত প্রাপ্তির সঙ্গে-সঙ্গেই। অনেক ইসলামী চিন্তাবিদই অবশ্য ঠিক এমনটিই ভেবেছিলেন। হুজউরি ছিলেন একাদশ শতকের গজনির একজন বিশিষ্ট সুফি।
( সুলতান মাহমুদের (৯৭১-১০৩০ খ্রিস্টাব্দ) গজনভি সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল গজনি। ) হুজউরির লেখা ‘কাশফ আল মাহজুব’ বা Revelation of the Veiled গ্রন্থটি সুফিবাদ সংক্রান্ত একটি আকর গ্রন্থ। সে বইয়ে হুজউরি দশম শতাব্দীর সুফি আবু আল হাসান ফুশহানজির এক রহস্যময় উক্তি উদ্বৃত করেছেন। ফুশহানজি মনে করতেন '...Today Sufism (taswwuf) is a name without a reality, but formerly it was a reality without a name.
বোঝা যায় নজরুল এই বিষয়টিই যথাযথভাবে উপলব্দি করতে পেরেছিলেন। এবং ‘হেরা হতে হেলেদুলে নূরানী-তনু ও কে আসে হায়’ গানটিতে কামলিওয়ালার স্বরূপ প্রকাশ করেছেন।
হেরা হতে হেলেদুলে নূরানী-তনু ও কে আসে হায়
সারা দুনিয়ার হেরেমের পর্দা খুলে খুলে যায়
সে যে আমার কামলিওয়ালা
হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যান সেরে আল্লাহর অস্বিত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে সাধনায় সিদ্ধ হয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করে হেলেদুলে মহানবী মক্কায় ফিরছেন । ‘হেলেদুলে’ শব্দটি লক্ষনীয়। তার মানে কামলিওয়ালা মহানবী relax মুডে আছেন। তাতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে নবীর দূরত্ব অনেক কমে যায়।
নূরানী-তনু শব্দবন্ধটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ন।
নূরানী শব্দটি ফারসি। এর মানে উজ্জ্বল, স্বর্গীয় আলোকপ্রাপ্ত। তনু মানে শরীর। (নজরুল তাঁর অপূর্ব প্রতিভায় বাংলা ভাষার সঙ্গে আরবি ফারসি শব্দের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। নূরানী-তনু শব্দবন্ধটি তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলে মনে করি।
) নূরানী-তনু মানে উজ্জ্বল, স্বর্গীয় আলোকপ্রাপ্ত। এভাবে নজরুল ইসলামী সৃষ্টিতত্ত্ব স্বীকার করে নিলেন। ইসলামী সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী আল্লাহ তালা সবার আগে মহনবীর নূর সৃষ্টি করেছেন। এ প্রসঙ্গে মাওলানা আবুল কালাম আযাদ লিখেছেন,‘হযরত ইমাম হুসাইন (রা) তাঁর পিতা হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, একদিন আমি রাসুলুল্লাহ (স) -এর নিকট বসা ছিলাম। এমন সময় হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (র) আগমন করে হযরত রাসূলে করীম (স) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমার পিাতা-মাতা আপনার জন্য কোরবান হোক।
আমাকে বলুন, সর্বাগ্রে আল্লাহ তালা কোন্ বস্তু সৃষ্টি করেছেন। রাসূলুল্লাহ (স) বললেন, আল্লাহ তালা সর্বাগ্রে এক সহস্র বছর ধরে আমার নূর সৃষ্টি করেছেন। (‘পবিত্র কোরআনে বর্ণিত পঁচিশ জন নবী ও রাসূল’। পৃষ্ঠা ১১)
এ বিষয়ে আমরা লালনের ভাবনাটিও পাই তাঁর এক গানে:
শুনি নবীর অঙ্গে জগৎ পয়দা হয়
সেই যে আকার কী হলো তার কে করে তার নির্নয়।
সারা দুনিয়ার হেরেমের পর্দা খুলে খুলে যায়
এই চরণটিও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ...হেরেম শব্দটি আরবি হরম শব্দটি থেকে উদ্ভূত।
আরবি-বাংলা অভিধানে হেরেম শব্দের মানে দেখলাম তিনটি। (ক) অন্দরমহল । (খ) পবিত্র স্থান। এবং (গ) নারী। অন্দরমহলের নারীদের অকারণে পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।
এখন সেই পর্দা সরে যাবে; মানে, খুলে খুলে যাবে। কেননা, আরব জাহানে অসাধারণ একজন সুফি এসেছেন। যাঁর আত্মিক বিকাশ হয়েছে, যিনি মুক্ত হয়েছেন। এবার অন্যদেরও মুক্ত করবেন। আমরা জানি মহনবী মেয়েশিশু হত্যা রোধ করেছিলেন।
লালন নিজেও বাউল ঘরানার অর্থাৎ সুফবাদী তরিকাভূক্ত (বাউল দর্শনের ওপর সুফিবাদের প্রভাব যেহেতু স্বীকার্য) লালন সুফবাদী তরিকাভূক্ত হওয়ায় জগতে মহানবীর আগমনের মরমী ব্যাখা তাঁর গানে পাওয়া যায়।
মদিনায় রাছুল নামে কে এলো ভাই
কায়াধারী হয়ে কেন তার ছায়া নাই।
অসাধারণ এই কায়াধারী ছায়াহীন কামলিওয়াকে আরবের প্রকৃতি স্বাগত জানাচ্ছে । হেরা হতে হেলেদুলে গানটিতে নজরুল সে আবেগময় বর্ননা দিয়েছেন :
তার (মহানবীর) ভাবে বিভোর রাঙা পায়ের তলে
পবর্ত জঙ্গম টলমল টলে ।
খোরমা খেজুর বাদাম জাফরানি ফুল
ঝরে ঝরে যায়
সে যে আমার কামলিওয়ালা কামলিওয়ালা।
আসমানে মেঘ জমে ছায়া দিতে
পাহাড়ের আসু গলে ঝরনার পানিতে ।
বিজলী চায় মালা হতে
পূর্ণিমার চাঁদ তার মুকুট হতে চায় ...
সে যে আমার কামলিওয়ালা কামলিওয়ালা।
আরবের কামলিওয়াকে বাংলাও যে বরণ করে নিয়েছে। নজরুলের এই গানটিই তার প্রমাণ। কামলিওয়ালা মানে যেহেতু সুফি- যিনি Ultimate Reality উপলব্দি করার জন্য ধ্যান করেন এবং বাংলার ভাবুকগন প্রাচীন কাল থেকে তাইই করে আসছে।
কাজেই তেরো শতকে বাংলার তত্ত্বজিজ্ঞাসু জনগন আরবের কামলিওয়ালাকে বরণ করতে দ্বিধা করেনি। (বাংলা কখনও অপর ভাষা ও সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করেনি। ) ... আর এ রকমই তো হওয়ার কথা।
অবশ্য কামলিওয়ালার দিব্য মতবাদ বা আসমানী বিধান বাংলায় একেক জন একেকভাবে উপলব্দি করেছেন। এ প্রসঙ্গে লালন লিখেছেন:
নবীর আইন বোঝার সাধ্য নাই
যার যেমন বুদ্ধিতে আসে বলে বুঝি তাই।
এর পরও বাংলার ইসলাম অনিবার্যভাবেই প্রেমময় সুফিবাদী ইসলাম। যার উর্বর ক্ষেত্রটি অনেক আগেই সৃজন করেছেন বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনের মহান সাধকগন। আরবের নবী যে কারণে বাংলা এসে হয়ে গেলেন লালনের ‘দয়াল নবী’ ...
যে আরবের নবী সম্বন্ধে নজরুল লিখেছেন,
বিজলী চায় মালা হতে
পূর্ণিমার চাঁদ তার মুকুট হতে চায় ...
আর ‘রসুলতত্ত্ব’ পর্যায়ে লালন লিখেছেন:
তোমার মতো দয়াল বন্ধু আর পাবো না
দেখা দিয়ে ওহে রাসুল ছেড়ে যেও না।
তুমি হও খোদার দোস্ত অপার কান্ডারী সত্য
তোমা বিনে পারের লক্ষ্য আর তো দেখি না।
আসমানী এক আইন দিয়ে আমাদের সব আনলেন রাহে
এখন মোদের ফাঁকি দিয়ে ছেড়ে যেও না।
আমরা সব মদিনাবাসী ছিলাম যেমন বনবাসী
তোমা হতে জ্ঞান পেয়েছি আছি সান্ত¦না।
তোমা বিনে এরূপ শাসন কে করবে আর দ্বীনের কারণ
লালন বলে আর তো এমন দ্বীনের বাতি জ্বলবে না।
তথ্যসূত্র:
কাজী রফিকুল হক সম্পাদিত ‘বাংলা ভাষায় আরবী ফারসী তুর্কী হিন্দী উর্দু শব্দের অভিধান’। (বাংলা একাডেমি)
মাওলানা আবুল কালাম আযাদ সম্পাদিত ‘পবিত্র কোরআনে বর্ণিত পঁচিশ জন নবী ও রাসূল’ (। নয়া দিগন্ত প্রকাশন, ৪৫ বাংলাবাজার)
আবদেল মাননান সম্পাদিত অখন্ড লালনসঙ্গীত।
আবু রুশদ-এর Songs of Lalon Shah
Sufism প্রসঙ্গে Microsoft Encarta 2008 এর একটি নিবন্ধ
ফাতেমা তুজ জোহরার কন্ঠে ‘হেরা হতে হেলেদুলে নূরানী তনু ও কে আসে হায়’ গানটির এমপি থ্রি ডাউনলোড লিঙ্ক
Click This Link
উৎসর্গ: কবীর চৌধুরী ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।