মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে একটা লেখা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। যশোরে যেদিন চারুবালা নিহত হলেন সারাদেশের মানুষ তখনও স্বাধীনতার দাবীর প্রতি সে ভাবে উচ্চকিত হয়নি। সত্তরের নির্বাচন আওয়ামীলীগ কে দেশ শাসনের ম্যান্ডেট দিয়েছিল। বাঙালিদের মনে হয়েছিল এতদিনে তাদের নিজেদের লোক ক্ষমতায় আসীন হতে যাচ্ছে হয়তো তাদের ক্ষমতায়নের মধ্যে দিয়েই পাকিস্তানের পূর্ব অর্ধের সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা আকাঙ্খার বাস্তবায়ন ঘটবে। ঢাকা থেকে দেড়শ' মাইল দূরের ছোট্ট শহর যশোরেও দোলা লেগেছিল এই স্বপ্নের।
আমি তখন মোটে ক্লাশ টু তে পড়ি। কিছু না বুঝেই বড়দের কথা কান পেতে শুনি। মনে হয় ভালো কিছু হতে যাচ্ছে। এর মধ্যেই একদিন খবর আসে পান্জাবীরা বাঙালিদের এই বিজয় মেনে নেবেনা। যশোরের ছাত্র জনতা ফুঁসে ওঠে এই অন্যায় সিদ্ধান্তে।
এসময়ই ঘটে চারুবালা হত্যাকান্ড। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন কেশবলাল রোডের নিরীহ গৃহবধু চারুবালা। তখন থেকে কেশবলাল রোডের নাম শহীদ সড়ক। সেটা মার্চের ৩ তারিখ বঙ্গবন্ধু তখনও তাঁর শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দেন নি। কিন্তু যশোরের জনতা বুঝে যায়, পাকিস্তানিদের হাতে আর কেউই নিরাপদ নয়।
চারুবালার লাশ নীলগন্জের শ্মসানে দাহ করে সারা শহরের মানুষ যখন ফিরে এলো তখন তাদের সকলকে অচেনা লাগছিল। শোক আর ক্ষোভ তাদের চেহারায় যে প্রত্যয় এনেদিয়েছিল এখনও সেকথা ভাবলে মনে হয় তখন আমার বয়স আর একটু বেশি কেন ছিলনা!
মুক্তিযুদ্ধ আমার কাছে দারুন আবেগের একটি ঘটনা। অত্যন্ত গৌরবময় এই ঘটনাটিকে তাচ্ছিল্য করতে গিয়ে গত মাসের ২২ তারিখ ব্যরিষ্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া একটি গর্হিত অপরাধ করেছেন। রফিকুল ইসলামের কারনে আমার লিখতে হচ্ছে শেষ দৃশ্য থেকে। চারুবালা, শহীদ তোজা, সহ অসংখ্য বীরের আখ্যানের বদলে প্রথমেই লিখতে হচ্ছে নিয়াজী, যৌথ বাহিনী আর রেইস কোর্সের কথা।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন যৌথ বাহিনীর কাছে আত্ম সমর্পণ করছে রফিক মিয়া তখন বিলাতে ব্যরিষ্টারি পড়ে জাতে উঠছেন। মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে স্পর্শ করেনি । করলে ,তিনি অন্য অনেকের মত দেশে ফিরে আসতেন অথবা বিদেশের মাটিতে বসেই মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে ভূমিকা রাখতেন যেমন গণ স্বাস্থের জাফরুল্লাহ চৌধুরি, ডঃ ইউনুস , আবুসাঈদ চৌধুররিরা করেছিলেন।
২২ তারিখে রফিক যা বললেন কিছুদিন আগে আর একজন ব্যরিষ্টার সেই একই কথা বলেছিলেন। দেলোয়ার হোসেইন সাঈদীর আইনজীবি সেই ব্যারিষ্টারের বক্তব্যে আমি বিষ্মিত হইনি।
সাঈদীর মত ঘৃণ্য অপরাধীর রক্ষকের কাছে অন্য কিছু আশা করাও ঠিক নয়। সাঈদীরা একাত্তরের নয় মাস জনতার সাথে যে প্রতারণা এবং বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে ব্যারিষ্টার ফখরুলের বক্তৃতা তার চেয়ে আলাদা হবে এটা আশা করা যায়না। তবে ব্যারিষ্টার রফিকের মুখে জামাতি বুলি আমাকে প্রথমে হতবাক করেছে। সেই বিহ্বলতা ক্রমে হতাশা এবং শেষ পর্যন্ত ক্রোধে পরিণত হয়েছে। এধরনের কুলাঙ্গার যে দলে থাকে আর যাই হোক সে দল গণমুখী হতে পারেনা।
ব্যরিষ্টার রফিকের এই বক্তব্যে তাঁর দলের কতটুকু সায় আছে জানি না। এই বক্তব্যের সাথে একাত্তরের পাকিস্তানি জেনারেলদের মানসিকতার মিল প্রায় শতভাগ।
২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে পাশবিকতার শুরু করে ১৬ডিসেম্বর তার সমাপ্তি ঘটে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর অপারেশন লাইটেনিং ক্যাম্পেইনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানি বাহীনির অতর্কিত আক্রমনের প্রায় সাথে সাথে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই বাঙালি তার জবাব দিতে শুরু করে। ৭ই মার্চের ভাষণ সেখানে যতটা না প্রেরণা হিসাবে কাজ করে, বাঙালির আত্মরক্ষার মরীয়া চেষ্টা তারচে' বড় অনুঘটক হিসাবে প্রতিভাত হয়।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় সেই লগ্নেই। পাকস্তানি বাহিনী নিজেদের আত্মশ্লাঘার কারণে তাকে যুদ্ধ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে যত গড়িমসিই করুক এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় সেই মুক্তি বাহিনীর কাছেই তাকে নতজানু হতে হয়। এপ্রিলের শেষ ভাগ থেকে পরবর্তী প্রায় আড়াই মাস পূর্ণ শক্তির পাকিস্তানি বাহিনীর সমন্বিত অভিযানের কারণে মুক্তি বাহিনী তেমন কোন সাফল্য না পেলেও হতদ্যম না হয়ে প্রশিক্ষণ এবং অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেদের কে সু সংগঠিত করে তোলে। জূলাই মাসে কোলকাতায় সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলনের পর যুদ্ধের গতিবেগ বৃদ্ধিপায়। এ মাসেই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম নিয়মিত ব্রিগেড জেড ফোর্স গঠিত হয়।
সেপ্টেম্বরে কে ফোর্স এবং অক্টোবরে এস ফোর্স গঠনের পর মুক্তি যুদ্ধ আর শুধু মাত্র চোরা গুপ্তা গেরিলা অপারেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ইতি মধ্যে নৌ ও বিমান বাহিনী গঠিত হওয়ায় মার্চের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ যুদ্ধ রূপ নিয়েছে প্রথাগত যুদ্ধে। দেশের ভিতরে মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসাহসকি তৎপরতার মুখে পাকস্তানি বাহিনীর অবস্থা যখন ক্রমশঃ খারাপের দিকে যাচ্ছে তখন পাকিস্তানি বাহিনীর থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ভারতকে যুদ্ধের ময়দানে টেনে আনার মাধ্যমে বাঙালির মুক্তি যুদ্ধকে স্তিমিত করে দেবার চেষ্টা করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতের সরাসরি যুদ্ধে অংশ গ্রহনকে পাকিস্তান নিজেদের অভ্যান্তরীন বিষয়ে ভারতরে অযাচিত হস্তক্ষেপ হিসেবে চাউর করে জাতি সংঘের মধ্যস্ততা এবং আমেরিকার মোড়লীতে স্থিতাবস্থায় ফিরে যাওয়া। ভারতীয় সেনা বাহিনী তখন পর্যন্ত পাকিস্তানের সাথে সরাসরি যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত ছিলনা।
এদিকে প্রধান মন্ত্রী তাজ উদ্দিন, তার সমমনা নেতৃবৃন্দ এবং সমগ্র মুক্তি বাহিনী লড়াইএর মাধ্যমে পাকিস্তানকে পরাজিত করে বিজয় অর্জনের পক্ষপাতি থাকলেও এক শ্রেণীর নেতা দীর্ঘ দিন ব্যাপি মুক্তি যুদ্ধের বদলে ভারতীয় বাহিনীকে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সম্পৃক্ত করার জন্যে তাজউদ্দিনের উপর চাপ অব্যাহত রাখে।
সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে পাকস্তানি সেনাবাহিনীর মনোবলে চিড় ধর। তারা বুঝে যায় হতদ্যম সেনাবাহিনী আর স্বল্প প্রশিক্ষিত ইপিসিএএফ( ইষ্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস; রাজাকার, আলবদর ইত্যাদি) দিয়ে মুক্তি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করা সম্ভব নয়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় তারা যে ফোর্ট্রেস ডিফেন্স বা দূর্গ প্রতিরক্ষা ( সীমান্তে অপেক্ষাকৃত হালকা প্রতিরক্ষা অবস্থান নিযে দেশের বিভিন্ন গুরুত্ব পূর্ণ স্থানে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা, মূল উদ্দেশ্য ঢাকার পতন রোধ করা। ) পরিকলাপনা করেছিল মুক্তি বাহিনীর ক্রমাগত আক্রমনের কারনে তা আর তেমন কার্য করী নয়।
এই অবস্থায় একমাত্র বিকল্প ছিল ভারতকে যুদ্ধের ময়দানে টেনে এনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দারস্থ হওয়া।
অন্যদিকে মুক্তি বাহিনী তখন উদ্দীপ্ত। অক্টোবর পর্যন্ত তারা বিলোনিয়া, কামালপুর, আখাউড়া,ধালাই,মুকুন্দপুর সহ বিভিন্ন যুদ্ধে পাকিস্তানিদের পদানত করেছে। এসব যুদ্ধে ভারতীয় সেনা বাহিনী সীমান্তের ওপার থেকে সহযোগিতাও করেছে। তবে এর ফলে মাঝে মধ্যে বোঝা পড়া সহ সমন্বযের অভাব প্রকট হযে উঠেছে।
এই সমন্বয়হীনতা দূর করার লক্ষে অক্টোবরের শুরু থেকেই ভারত বাংরাদেশ যৌথ বাহিনী গড়ে তোলা আবশ্যক হযে পড়ে। শুধু যুদ্ধের ময়দানেই নয় কূটনৈতিক ভাবেও বাংরাদেশ সফল হয়ে উঠতে শুরু কর। নিরাপত্তা পরিষদেও আলোচিত হয় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ।
২১-২২ নভেম্বর বয়রা চৌগাছা যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর চুড়ান্ত অভিযান শুরু হয়। ২৩ নভেম্বর এক বেতার ভাষণে তাজউদ্দিন বলেন "আমাদের মুক্তি বাহিনী এখন যে কোন ধরনের লড়াইএর জন্য প্রস্তুত।
ইয়াহিয়া খানও ভারত আক্রমনের হুমকি দেন। এর ঠিক ১০ দিন পর পশ্চিম ফ্রন্টে ভারতের উপর বোমা বর্ষণ করে পাকিস্তান ভারতকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলে। পূর্ব ফ্রন্টে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে চুড়ান্ত ভাবে পরাজিত করার লক্ষে সূচিত হয় ভারত - বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর লাইটনিঙ ক্যাম্পেইন। এই যুদ্ধের মূল লক্ষ দ্রুততম সময়ে ঢাকা পৌছানো এবং ঢাকা দূর্গের পতন ঘটানো। ১৬ ডিসেম্বর এসফোর্সের ২য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যৌথবাহিনীর শরিক হিসাবে ঢাকায় প্রবেশ করে।
একই সাথে ঢাকায় পৌছে যায় কাদেরিয়া বাহিনী। মুক্তি বাহিনীর প্রধান ওসমানী মুক্তি যোদ্ধাদের মনোবল বাড়ানোর জন্যে ১১ ডিসেম্বর থেকে বিভিন্ন সেক্টর পরিদর্শণ শুরু করেন। ১৬ ডিসেম্বর তাঁকে বহনকারী হেলিকপ্টার টি সিলেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে ভূপতিত হয়। জেনারেল ওসমানী কোন মতে রক্ষা পেলেও পাকিস্তানিদের আত্ম সমর্পনের অনুষ্ঠানে তার পক্ষে উপস্থিত থাকা সম্ভব হয়নি। তবে ওসমানী না থাকলেও তার ডেপুটি গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খোন্দকার ঠিকই উপস্থিত ছিলেন।
তার উপস্থিতির ছবি খুব দুর্লভ নয়। ইন্টারনেটে সার্চ দিলেই পাওয়া যায়।
এই ঘটনাটি ৭১ পরবর্তী প্রজন্মের নাও জানা থাকতে পারে তবে রফিক মিয়ার মত শিক্ষিত ব্যরিষ্টার এটা জানেন না মানতে কষ্ট হয়। ২২ তারিখে রফিক যখন ৭১ মুক্তি যুদ্ধ হয়নি বলে দাবি করেছিল তখন ৭১ এর পাকিস্তানি জেনারেলদের কথা মনে হযেছে। তারা শত চেষ্টা করেও যে যুদ্ধ কে পাক- ভারত যুদ্ধ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি রফিকরা আজ অবলীলায় তাকে পাক ভারত যুদ্ধ বলে চিন্হিত করছে।
তার কারন এই নয়
যে তিনি জানেন না আত্ম সমর্পনের দলিলের প্রথম অনু্চ্ছেদেই লেখা আছে বাংলাদেশ -ভারত যৌথ বাহীনীর কাছে পাকিস্তান সেনা বাহিনী আত্ম সমর্পণ করে। এই মিথ্যাচারের কারনে ব্যারিষ্টার রফিক ধিকৃত হযেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বিপর্যস্ত জোটের বড় শরিক বিএনপির কাছথেকেও বলার মত সমর্থন না পেয়ে তিনি সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে তার কথা শুনে পরানো একটি প্রবাদের কথা মনে পড়েছে। চোরের এক কান কাটলে চুল দিয়ে ঢেকে রাখে আর যার দু'কানই কাটা সে হাটে মাঝরাস্তা দিয়ে।
সম্ভবত এ কারনেই রফিক মিয়া এখনও নির্লজ্বের মত মিথ্যাচার করে যাচ্ছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।