সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হওয়ায় '৭২-এর আদি সংবিধান পুনঃস্থাপিত হয়েছে উল্লেখ করে হাইকোর্ট বলেছে, বাংলাদেশ এখন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ২২ আগস্টের এক রিটের চূড়ান্ত রায়ে সোমবার এ অভিমত দেয়।
হাইকোর্ট বলেছে, "বাংলাদেশ এখন থেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বিষয়ে আপিল বিভাগের রায়ের সঙ্গে সঙ্গে '৭২ আদি সংবিধান পুনঃস্থপিত হয়ে গেছে। এতে ধর্মনিরপেক্ষতাও ফিরে এসেছে।
ওই সংবিধানের মূল চার নীতির অন্যতম ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। "
আদালত আরো বলেছে, '৭২-এর সংবিধান ফিরে আসায় তারা এখন সেই সংবিধান মানতেই বাধ্য, অন্য কোনো সংবিধান নয়। আর তাই ওই সংবিধান অনুযায়ী এই রায় দেয়া হয়েছে। ফলে প্রত্যেক নাগরিকের স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের অধিকার ফিরে এসেছে বলে মত দিয়েছে আদালত।
নাটোরের সরকারি রানী ভবানী কলেজের ছাত্রীদের বোরকা পরা বাধ্যতামূলক-গত ২২ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত খবরের পরিপ্রেক্ষিতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একই আদালত দেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা অফিসে নারীদের বোরকা পরতে বাধ্য না করতে নির্দেশ দেয়।
একইসঙ্গে বোরকা পরতে বাধ্য করা এবং খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেকে মেয়েদের বাদ রাখাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তার কারণ জানাতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ৩ সপ্তাহ সময় দেয় আদালত।
এ রুলের পূর্ণাঙ্গ শুনানি শেষে সোমবার দেয়া রায়ে হাইকোর্ট বলেছে, "ধর্মনিরপেক্ষ দেশে কোনো ব্যক্তিকে কোনো ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা যায় না। সব ধর্মের মানুষের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রয়েছে। কোনো ধর্মীয় পোশাক কারো ওপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না। "
রায়ে আরো বলা হয়েছে, "একই কারণে কাউকে কোনো ধর্মীয় পোশাক পরতে নিষেধও করা যাবে না।
প্রতিটি মানুষের শালীনতা বজায় রেখে তার পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরিধানের অধিকার রয়েছে। "
এর আগে গত ২ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ২০০৫ সালে পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে দুটি লিভ টু আপিল খারিজ করে দেয়। এরপর ২৭ জুলাই হাইকোর্টের রায়ের ওপর কিছু সংশোধনী ও পর্যবেক্ষণসহ আপিল বিভাগের বিস্তারিত রায় প্রকাশ করা হয়।
১৮৪ পৃষ্ঠার রায়ের সারাংশে বলা হয়, '৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে '৭৯-এর এপ্রিল পর্যন্ত অর্থাৎ খন্দকার মোশতাক, বিচারপতি সায়েম ও জিয়াউর রহমানের শাসনামলকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। একইসঙ্গে সংবিধানবহির্ভূত কর্মকাণ্ড বন্ধের জন্য সংসদকে আইন করার পরামর্শ দেয়া হয়।
২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের বেঞ্চ পুরনো ঢাকার মুন সিনেমা হলকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি ঘোষণা করে সরকারের জারি করা আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে আনা একটি রিট আবেদনের নিষ্পত্তি করতে গিয়ে সংবিধানের ৫ম সংশোধনী অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করে রায় দেয়। এতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ও জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। তবে আদালত উল্লেখিত সময়ে জনস্বার্থে করা সরকারের বেশকিছু কাজকে বৈধতা দেয়।
সে সময় শাসন ক্ষমতায় থাকা জিয়ার হাতে গড়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)'র নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের নির্দেশে রাতেই তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আলী চেম্বার জজ আমিরুল কবীর চৌধুরীর বাসায় গিয়ে রায় স্থগিত করার জন্য আপিলের অনুমতি চান। চেম্বার জজ প্রথমে পরদিন পর্যন্ত রায় স্থগিত করে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি হবে বলে জানিয়ে দেন।
২০০৫ সালের ৩১ আগস্ট তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জেআর মোদাচ্ছির হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ দুই মাসের জন্য রায় স্থগিত করে নিয়মিত বেঞ্চে আবেদন করার নির্দেশ দেয়। পরে এ স্থগিতাদেশ দফায় দফায় বাড়ানো হয়।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা আপিল প্রত্যাহারে তৎপর হন এবং অবশেষে ২০০৯ সালের ৩ মে আপিল প্রত্যাহারের আবেদন করেন।
গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের জামাতপন্থি তিন আইনজীবী-মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, মুন্সি আহসান কবির ও ভূঁইয়া এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল চালাতে পক্ষভুক্তির আবেদন করেন। এরপর ৩ মে বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনও একইরকম আবেদন পেশ করেন।
পরের দিন আপিল বিভাগ তাদেরকে এ অনুমতি দিলে পরে ২৫ মে তারা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল দায়ের করেন।
এরপর গত ৩ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চ হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের দাখিল করা লিভ টু আপিল প্রত্যাহারের আবেদন মঞ্জুর করে এবং হাইকোর্টের রায়ের ওপর দেয়া স্থগিতাদেশও প্রত্যাহারের আদেশ দেয়। আদালত একই আদেশে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের দায়ের করা একইরকম একটি আপিল প্রত্যাহারের অনুমতি দেয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।