সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............
চীন থেকে ফিরেঃ ওয়ার্ল্ড এক্সপো সাংহাই-২০১০ (১ম পর্ব)
চীনের ২য় বৃহত্তম বানিজ্যিক নগর সাংহাইতে গত ৩০ এপ্রিল মধ্য রাতে এক ঐতিহাসিক এবং ব্যয়বহুল ফায়ার ওয়ার্ক্সের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্ববোধন করা হয় "ওয়ার্ল্ড এক্সপো-২০১০"। রাজকীয়ভাবেই প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও যখন মেলার উদ্বোধন করেন তখন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ডি লুলাসহ বিভিন্ন দেশের আরো ১২ জন সরকার এবং রাস্ট্র প্রধান এবং বিশ্বের অনেক দেশের নেতা ও প্রতিনিধিরা। জমকালো ঐ উদ্ববোধনী অনুষ্ঠানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ৫০ হাজার আমন্ত্রিত অতিথি এবং ৩২ লক্ষ দর্শক উপস্থিত ছিলেন। পরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রায় আড়াই হাজার শিল্পীর একটি দল সংগীত পরিবেশন করে। এরপর শুরু হয় আতশবাজির খেলা।
পোড়ানো হয় লাখ লাখ আতশবাজি। বেইজিং অলিম্পিকের পুর্বে-পরে এমন জমকালো কোনো অনুষ্ঠান চীনে আর কনোদিন, কোনো সময় অনুষ্ঠিত হয়নি।
১৯৪৯ সালে মাও সে তুংয়ের হাতে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন গঠিত হওয়ার পর কয়েক দশক বহির্বিশ্বের কাছে একরকম নিষিদ্ধ ছিল দেশের অন্যতম বৃহত্তম নগর সাংহাই। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েক বছরে এই শহর আর নিষিদ্ধ নেই বরং আলোকিত হয়েছে বিশ্ব মানচিত্রে। এখন কর্ম মুখর সদাব্যস্ত সাংহাই নগরী ২৪ ঘন্টাই জেগে থাকে, মুহুর্তের জন্যও ঘুমায়না।
সাংহাই এখন শুধু চীন নয়, বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম নগর। কেবল এক কোটি ৯০ লাখ জনসংখ্যার জন্য নয়, বিশ্ব বাণিজ্য ও সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে এই সাংহাই মহানগর। সাড়ে সাতশর বেশি বহুজাতিক কোম্পানির অফিস আছে সাংহাইতে। আছে গগনচুম্বী অসংখ্য অট্টালিকা। ৬০-৮০ তলা তথা ৬০০-৮০০ ফুটের বেশি উঁচু ভবনই আছে ৩০টির বেশি।
শহরের মধ্য দিয়ে হাঁটার সময় মনে হতেই পারে এশিয়ার কোনো বর্ধিষ্ণু দেশ নয়, বুঝি নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে আছি।
বিশ্বমেলার আনুষ্ঠানিক নাম ‘ইউনিভার্সাল এক্সপোজিশন’। শুরু থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্দেশ্য সাধন করেছে এই প্রদর্শনী। প্রথম বিশ্বমেলাটি হয় ১৮৫১ সালে লন্ডনের হাইড পার্কে। এর গালভরা এক নামও ছিল—‘দ্য গ্রেট এক্সিবিশন অব দ্য ওয়ার্কস অব ইন্ডাস্ট্রি অব অল কন্টিনেন্টস’ অর্থাৎ “মহাদেশগুলোর উৎপন্ন শিল্পপণ্যের বিশাল প্রদর্শনী”।
এতে প্রদর্শিত বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল প্রথম পাবলিক টয়লেট ও আধুনিক ফ্যাক্স মেশিনের আদি সংস্করণসহ অনেক কিছু। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল ক্রিস্টাল প্যালেস। এটি ছিল ঢালাই লোহা ও কাচে তৈরি গ্রিনহাউসের মতো দেখতে একটি কাঠামো। প্রদর্শনীটি হয়েছিল এরই ভেতর।
“ওয়ার্ল্ড এক্সপো-২০১০” –নামে বানিজ্যমেলা হলেও এই মেলায় কিন্তু কোনো দেশ তাদের উদপাদিত পণ্যের পশরা সাজিয়ে বসেনা বিক্রয়ের জন্য।
এই মেলায় মুলত বিভিন্ন দেশ তাদের রাস্ট্রীয় ব্রান্ডিং/থীম প্রচারের সাথে সাথে তাদের দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা তুলে ধরে। আরো তুলে ধরে নিজ নিজ দেশের বিভিন্ন রপ্তানী/আমদানী দ্রব্যের বিষয়াবলী। এই মেলায় আগত ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন দেশের ব্যবসার নানা সুযোগ সুবিধা জেনে নেয়। এই মেলা শুধু দেখার নয়-এই মেলা মুলত দ্বিপাক্ষিক/বহুপাক্ষিক আলোচনা/মতবিনিময়ের মাধ্যমে একটা যোগসুত্র প্রতিষ্ঠিত করা। সাংহাই নগরে শুরু হওয়া “ওয়ার্ল্ড এক্সপো-২০১০” নামে বিশাল বিশ্বমেলা দেখার জন্য ভিন্ন ভিন্ন ট্রেডের ব্যবসায়ী দল এখন সাংহাই নগরীতে।
গত ১ আগস্ট আমরা একসাথে ১৪ সদস্যের একটি ব্যবাসায়ী দল গিয়েছিলাম সাংহাইতে। আমাদের দলের ব্যবসায়ীরা মুলত ইম্পোর্টার-এক্সপোর্টার। আমরা এসেছি-নতুন নতুন আমদানী যোগ্য পণ্যের সন্ধানে, নতুন নতুন দেশে অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানীর বাজার খুঁজতে। এবারের বিশ্বমেলার স্লোগান “বেটার সিটি, বেটার লাইফ"। ১ মে থেকে শুরু হয়েছে এ এলাহি মেলা।
চলবে পাক্কা ছয় মাস। ১৯২টি দেশ এবং ৫৭ টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে এই মেলায়। বলা হচ্ছে, এ যাবত সবচেয়ে বড় বিশ্বমেলা বা “ওয়ার্ল্ড এক্সপো” এটি। আয়োজকেরা আশা করছেন, প্রায় সাত কোটি দর্শনার্থী আসবে এ মেলায়। প্রথম তিন দিনেই মেলায় দর্শনার্থী ছিল চার লাখ ৩৩ হাজার।
চীন এখন যাকিছু করে তা বিশাল আকারেই করে। ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিক আয়োজনের মাধ্যমে তা তারা দেখিয়ে দিয়েছে। বিশ্বমেলার আয়োজকেরা জানিয়েছেন, এই মেলার আয়োজন সেবারের অলিম্পিক আয়োজনের চেয়েও বড়। খরচ হবে প্রায় ৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। খরচ করতে একটুও কার্পণ্য নেই চীনাদের।
কেননা গণচীন এখন বিশ্বকে দেখাতে চায়, আগামী দিনে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতেই তৈরি হচ্ছে তারা।
নিরাপত্তার দিক দিয়েও আছে বেজায় কড়াকড়ি। শুধু মেলার নিরাপত্তায় নিয়োজিত সাংহাইয়ের নিজেরই পুলিশ আছে ৪৬ হাজার। তার পরও বাইরে থেকে আনা হয়েছে আরও আট হাজার চৌকস পুলিশ সদস্য যারা কমান্ডো ট্রেনিং প্রাপ্ত। এ ছাড়া অবসরে গেছে এমন এক হাজার পুলিশকে মেলা উপলক্ষে দায়িত্বে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
পুরো নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে শহরটি। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে নগরের বাসিন্দারা অভিযোগ করছে তারা কার্যত গৃহবন্দী হয়ে পড়েছে। ছয় হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে স্থানীয় পত্রপত্রিকা জানিয়েছে।
শহরের কেন্দ্রস্থলে হুয়াংপু নদীর দুই পাশে ৫ দশমিক ৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসেছে এই মেলা। শুধু মেলা উপলক্ষেই শহরের হংকাইয়ো বিমানবন্দরে তৈরি করা হয়েছে বিশাল এক টার্মিনাল।
অনেক দূর প্রসারিত করা হয়েছে পাতাল রেলপথ। এ ছাড়া নির্মিত হয়েছে নতুন নতুন সড়ক ও পার্ক। তিন বছর ধরে নেওয়া হয়েছে এই প্রস্তুতি।
মেলার প্রতিটি প্যাভিলিয়নই বিশাল। প্রতিটির রয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট্য।
প্রতিটি দেশ নিজ নিজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে প্যাভিলিয়নের মাধ্যমে। এ মেলার মাধ্যমে অন্যরা উদীয়মান বিশ্বশক্তি চীনের সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধন জোরদার করতে চাইছে। অস্ট্রেলিয়ার প্যাভিলিয়নের দেখভালের দায়িত্বে থাকা কূটনীতিক লিনডাল শস যেমনটা বলছিলেন, “আমরা চীনের কাছে একটি বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছি। দুই দেশের সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেওয়াটা নিশ্চিত করতে চেয়েছি আমরা। “
কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, ইন্টারনেটের এ রমরমার যুগে এক ক্লিকেই যখন সমগ্র বিশ্ব হাতের মুঠোয় পাওয়া যায়, তখন এত কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে এমন মেলা আয়োজনের কী-ই বা অর্থ।
মেলার মুখপাত্র জু ওয়েইয়ের কাছেই শুনুন, “এটা একটা বড় প্ল্যাটফর্ম, সাংস্কৃতিক বিনিময়ের একটি বড় আয়োজন। আমরা চেয়েছি, ভিন্ন দেশ ভিন্ন মানুষের সমগ্র বিশ্বকে একত্র করতে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুখোমুখি হওয়ার জন্য চীনাদের জন্য এটি একটি বড় সুযোগ”। মুখপাত্রের এ কথার মধ্য দিয়েই আসল বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে। তিনি যা বোঝাতে চেয়েছেন তা হলো চীন দেশবাসীকেও দেখাতে চাইছে, বোঝাতে চাইছে বিশ্ব দরবারে তাদের দেশ কতটা গুরুত্বপূর্ণ, কতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে।
বহির্বিশ্বকে চমকে দেওয়া তো আছেই।
পরের পর্বের জন্য চোখ রাখুন.........
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।