শেষ বলে কিছু নেই
০৩. হ্রেষাধ্বনি ও অন্যান্য কণ্ঠস্বর
বাশারের ঘোড়া নেমে পড়েছে পশ্চিমের খোলা প্রান্তরে। প্রারম্ভে একটা মন্দিরের ধবংস-স্তুপ; একসময় মন্দিরটা ছিল- ঠিক কখন কোন আমলে ছিল তার কোন স্পষ্ট ইতিহাস নেই, তবে লোকমুখে শোনা যায় মন্দিরে একসময় বিগ্রহ ছিল, পুরুত ছিল, দিনে রাতে ঘন্টা বাজতো; তারপর কালস্রোতে সে সব আয়োজন ভেঙে গুড়িয়ে মিশে গেছে ভিটের ওপর; ভিটেটা শুধু আছে শাঁসহীন আমের আটির মত, বিস্মরীত ইতিহাসের মত এবং কিছুটা বা বেপরোয়া স্তনের মত উঁচু হয়ে আছে। ঘোড়াটা টিলার ওদিকে অদৃশ্য হয়ে গেল; পরক্ষণেই উল্টো দিক দিয়ে পাক খেয়ে এদিক দিয়ে ফের দৃশ্যমান হল; এদিকটা চক্কর দিয়ে আবার ওদিকে চলে গেল; এভাবে চলতে থাকল জ্যোৎস্নার তাপে আর অস্পষ্ট ইতিহাসের ওমে জাব ওয়ে ওঠা স্তনাকৃতির টিলাটাকে ঘিরে কামার্ত ঘোড়ার অবিরাম চক্কর। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে প্রান্তর; ঘোড়ার লেজ নিজ অক্ষের উপর ক্রমাগত ঘুরছে...
ইদ্রিস কোমর থেকে গামছাখানা খুলে নিয়ে দুই বগলের তল দিয়ে বুকের উপর বেঁধে নিল, তারপর একটা বিষম কোঁৎ দিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি বুকের পেশিতে সঞ্চালিত করল; গামছার বাঁধন ছিড়ে উন্মত্ত ক্রুদ্ধ ষাড়ের মত পাজরখানা যেন বেরিয়ে আসতে চাইল। এভাবে কি ক্রোধ দমন করা যায়? ভাবে রমিজ এবং পরক্ষণেই চূড়ান্ত প্রশ্নটি করে ফেলে ইদ্রিসকে, ‘আসলে তোদের সমস্যা কী ছিল?’
ইদ্রিস সাঁত্ করে রমিজের দিকে ফিরে বলল, ‘আল্লা মালুম’।
তারপর থুঃ করে একদলা থুথু সামনে জলাশয়ের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘ওর কলজেই আগুন জ্বলত দাউ দাউ, ও আগুন নিবাই কার সাধ্যি... সদর থেকে কোম্পানির এক শুয়োরের বাচ্চা ওষুধ বেচতি আসত বাজারে... টেরিকাটা মাথা, সাহেবি পোষাক, নজর গেল কুলসুমের... বউ আমার তারে ধর্মের ভাই পাতালো, সময় নেই অসময় নেই সুমুন্ধি আমার ঘরে আসতি লাগলো... আমি চাষা মানুষ ক্ষ্যাতে-মাঠে থাকি, মায় তো আবার অন্ধ, চোকি দ্যাখে না..., রাধাকিষ্ণ দিনির পর দিন লটর ফটর করে। একদিন, হ... একদিন হাতে নাতে ধরে ফ্যাললাম, সুমুন্ধির পুত পালায়ে গেল। আল্লার কসম! খুব মাইর দিছিলাম কুলসুমরে...। পর দিন বিয়ান হওয়ার আগেই হাওয়া...।
‘ঐ ছেলেটার সাথে?’
‘আমি কি করে কব? তয় ছ্যামরারে আর আমি খুঁজে পাই নি।
অনেক খুঁজিছি ওরে আমি, পালি ওর আমি কিছুই করতাম না, শুধু ওর ইয়ে ডা কাটে নিতাম। ’
অন্ধকার আর চাঁদের আলোর দ্রবনের ভেতর সিলুয়েট ঘোড়াটা এখন টিলার গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে।
কয়েকবার পেছনের একটা পা দিয়ে টিলার উপর আঘাত করল সে; তারপর নিতম্ব ঘষতে শুরু করল নিপাট শিলার উপর; ঘস্ ঘস্ আওয়াজ ওঠল; রিরংসাহত শব্দটা ছড়িয়ে পড়ল জ্যোৎস্নায়। রমিজ ভাবে, সমস্ত দুঃখ-কষ্ট-সুখের উৎস হচ্ছে লিবিডো- যা কাম জাগ্রত করে, এই লিবিডোর জন্য প্রাণী প্রাণীকে হত্যা পর্যন্ত করে, উল্টে যায় ভালবাসার সমীকরণ। কুলসুমের জীবনের পূর্ববর্তী অংশটুকু নিয়ে সমীকরণের ছাঁচে ফেলে পরবর্তী অংশটুকু ঢালাই করে নেয় রমিজ... তরপর সুখের আশায় কুলসুম সেই মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের হাত ধরে পালিয়ে যায় এবং তারপর পুনরায় প্রতারণা; ঢাকার কঠিন নির্মম স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে ছোকরা হাওয়া হয়ে যায়; তারপর রূপ-যৌবনে পরাক্রান্ত কুলসুম প্রবেশ করতে থাকে একের পর এক রহস্যময় গলিতে; সোনালী পর্দা ওঠে, রূপালী পর্দা ওঠে; লাল নীল কালো পর্দা ওঠে; চোখের সামনে নাচতে থাকে আলোর পতঙ্গ, অন্ধকারের পতঙ্গ, কুলসুম একবার আলোর পতঙ্গ ধরে একবার অন্ধকারের পতঙ্গ ধরে; তারপর আলো-আধারীর সীমান্তে কুলসুম ফের জীবনের উৎকর্ষের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে...
ঘোড়াটা হ্রেষাধ্বনি করল।
চাঁদ উঠে এসেছে কিছুটা উপরে। পশ্চিম দিগন্তরেখা ঘেষে একটা একলা তালগাছের আলগা শাখায় ঝুলে আছে। চন্দ্র থেকে রশ্মিমালা ঈষৎ তীর্যকভবে বিকীর্ণ হচ্ছে। চারদিকের দৃশ্যপট এখন অনেক বেশি স্পষ্ট। এত আলোতে সমস্যা হয়েছে রমিজের; ইদ্রিসের শ্বাপদের মত দুটো জ্বলজ্বলে ক্রোধতপ্ত চোখ ওকে দেখতে হচ্ছে, সইতে হচ্ছে।
অসহনীয় একজোড়া চোখ।
‘ঘোৎ’ করে একটা শব্দ করে ইদ্রিস, যেন কিছু বলতে চায়; কিন্তু বলে না, পাথরের মত নির্বাক আর ভারী হয়ে পর্বতের মত একটা অনঢ় অবস্থিতি নিয়ে বসে থাকে।
‘সব ভুলে যা ইদ্রিস। অতীত-ফতিত ছুড়ে ফেলে দিয়ে আরেকটা বিয়ে করে ফেল। সব ঠিক হয়ে যাবে।
’
নির্বাক পাথরটাকে যেন নাড়া দিতে চাইল রমিজ। পাথর নড়ল, কিন্তু স্থানচ্যুত হয়ে গেল; পাহাড়ের শিখর থেকে পাথরখণ্ড গড়িয়ে পড়লে যেমন ভীমকাণ্ড ঘটে তদ্রƒপ বিষম কণ্ঠে হুংকার ছাড়ল ইদ্রিস, ‘তোর বিয়ের মাইরে আমি....। মেয়ে মানুষরে আমি আর বিশ্বাস করি না। মেয়ে মানুষের ছায়া দেখলি আমার মাথায় খুন উঠে যায়....’
হিম হয়ে যায় রমিজ। নাড়া-খাওয়া পৌরুষের এ কোন ভয়ংকর সর্বনাশা প্রকাশ?
ঠিক তখন বটগাছের ওধারের জঙ্গলে একটা সোরগোল ওঠল।
কয়েকজন মানুষের মিলিত কণ্ঠস্বর। কণ্ঠস্বরের মিশেল ভেদ করে একটি পুরুষ কণ্ঠ হঠাৎ উচ্চগ্রামে উঠে গেল: শুয়োরের বাচ্চা আমি আজকে তোরে খুন করে ফ্যালবো। পাশাপাশি একটা মহিলা কণ্ঠের আভাস পাওয়া যায়: এহ্ রে আমার মুরোদ....।
রমিজ ইদ্রিসকে খোঁচা মারল। ‘কি হল ?’
ইদ্রিস কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল।
রমিজের একটু একটু ভয় করছে; কতদিন গ্রাম ছাড়া, গ্রামীণ মার-প্যাঁচে অনভ্যস্থ হয়ে পড়েছে, তথাপি ইদ্রিসের পিছু নিল ও।
বটগাছের ঝুরির মধ্যে দাঁড়িয়ে ওরা দৃশ্যটা দেখল। আলো অন্ধকারের কোলাজ; মূর্তি মূর্তি তিনজন মানুষ; দু’জন ধস্তাধস্তি করছে; তৃতীয় জন মহিলা, সে সঙ্ঘর্ষে লিপ্ত দুই যোদ্ধাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছে। রমিজ এসবের মর্ম সঠিক বুঝতে না পেরে ইদ্রিসের কানের কাছে ফিস ফিস করে বলল, ‘এই, কারা এরা ? কাউকে তো চিনতে পারছি না। ’
এবার ইদ্রিস কথা বলে- বেশ মজা পেয়েছে এমন ভঙ্গিতে ঠোঁটের কোলে খিক খিক ধরনের একটা কুৎসিত হাসি ঝুলিয়ে ফিস ফিস করে বলল, ‘ঐ যে কাছা মারা লিকলিকে- ওই তো বাশার... আরে বাশারের ঘোড়ার মালিক, আর ঐ টা হচ্ছে শফি চেয়ারম্যানের ভাগ্নে আক্কাস.. বহুৎ পুরোন ফ্যাসাদ...’
‘মহিলা?’
‘বাশারের বৌ, নার্গিস।
’
‘ফ্যাসাদটা কি ?’
‘রাধাকিষ্ণ ফ্যাসাদ। আক্কাস আর নার্গিসের লটরপটর...’
‘কিন্তু এখন কী হচ্ছে?”
খ্যাক্ খ্যাক্ করে হেসে উঠে ইদ্রিস বলল, ‘বুঝলি নে ? বাশার মিয়া ঘোড়া খুঁজতি আইসে হাতে-নাতে আসল ঘোড়া ধরে ফেলিছে...’
রমিজ এখন সবই বুঝতে পারছে, শুধু বুঝতে পারছে না কী তার কর্তব্য; অযাচীত হস্তক্ষেপ এখানে এই প্রেক্ষাপটে কতখানি যৌক্তিক ঠাওর করে উঠতে পারছে না ও; ঘোড়াটার কথা মনে হল; সে এখন টিলার নিপাট শিলায় উদ্দাম হয়ে পাছা ঘষছে...।
‘ও বাশার মিয়া, ঐ ছ্যামরারে মারে কোন লাভ নেই, তারচে তোমার বউ’র ফুটানি জম্মের মত থামায়ে দাও। ’ ইদ্রিস হঠাৎ চীৎকার করে বলল এবং এই হঠাৎ উদ্ভুত নাটকের আবছায়া দৃশ্যপটে ইদ্রিসের আকস্মিক প্রবেশে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল রমিজ আর ওদিকে ইদ্রিস নেপথ্য থেকে ডায়লগটা ছুড়ে দিয়েই এক লাফে ঢুকে পড়ল মঞ্চে । আর এদিকে ইদ্রিস যখন গতির মধ্যে, রমিজ তখন একটা আপাদমস্তক অনুসন্ধানী ক্যামেরায় পরিণত হল; ক্যামেরার লেন্সে দৃশ্যটা নিমেষে একটা স্টিল ছবি হয়ে গেল, কিন্তু পরক্ষণেই টিলার কাছে বাশারের ঘোড়াটা ‘চি হি হি হি’ করে ডেকে ওঠায় স্টিল ছবিটা ভেঙে খান খান হয়ে ঝরে পড়তে লাগল জঙ্গলের অদ্ভূত আলো-আঁধারিতে।
------------
২য় পর্বের লিঙ্ক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।