আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হ্রেষাধ্বনি ও অন্যান্য কণ্ঠস্বর

শেষ বলে কিছু নেই

০১. জ্যোৎস্নায় একটি ঘোড়া ওদের সামনে নাতিদীর্ঘ জলাশয়। তারপর বিচারপতির মত গম্ভীর, জবুথবু এক বটগাছ। বটগাছের ওপাশে পয়মন্ত জঙ্গল। জঙ্গলের উপরের আকাশ ভরে আছে এক প্রকার জলজ অন্ধকারে; মেঘখণ্ডসদৃশ একখণ্ড গাঢ় অন্ধকার ঈষৎ ঝুঁকে বটের মাথা ছুঁয়েছে; মাথা থেকে খানিকটা তরল অন্ধকার বটের ডালপাতা চুঁইয়ে ঝুরি বেয়ে টাল খেয়ে নেমেছে মাটিতে, আর যেই ছুঁয়েছে মাটি অমনি সময়ের উজান বেয়ে পেয়ে গেছে আদিমতম এক মাত্রা। সেই অদিমতায় ওদের যৌথ দৃকপাত; ওদের মধ্যে একজন রমিজ- পোষাকে আচারে ব্যবহারে যার শহুরে পালিশ এবং অন্যজন ইদ্রিস- অবিমিশ্র গেঁয়ো চাষা।

হঠাৎ আদিম আদিম অন্ধকারের জালিকা ফুঁড়ে জলাশয়ের ওপাশে নেমে আসে এক প্রকাণ্ড ছায়া-জানোয়ার। রমিজের মনে হয় যেন রূপকথার গ্রাউন্ড থেকে বাস্তবের প্রান্তরে নেমে এসেছে পক্ষীরাজ; ম্যাজিক রিয়ালিজম নাকি? রমিজের এ ধরনের ভাবনার সাথে পাল্লা দিয়ে যেন চাঁদটা ওঠে। পশ্চিম দিগন্তে অন্ধগলির মুখে যৌনকর্মীর গলা বাড়ানোর মত করে ধায় করে গলা বাড়ায় চাঁদ। অন্ধকার পাঁক খেতে শুরু করে, যেন মন্থন দন্ডে মন্থিত হচ্ছে কালো দুধ। ক্রোধে জ্বলছিল ইদ্রিস, বুকে তার সূর্যের মত দাউ দাউ অগ্নি-তুফান; ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে, যেন ডাইনোসর; আধো আধো অন্ধকারে সদ্য পরিস্ফুটিত পক্ষীরাজের দিকে ছুটে যায় লিকলিকে নিঃশ্বাস।

‘শালা বাশারের ঘোড়া! পুন্নিমায় ডাক দিছে আর কামে অন্ধ হয়ে দড়ি ছিড়ে মাগি এখন বেদিশা... ঘোড়ার বাচ্চা ঘোড়া...’ কথাটা শেষ করে না ইদ্রিস, ওর গালে ছিল জংলী তৃণখণ্ড, দাঁতে দাঁত চাপায় তৃণ দ্বিখন্ডিত হয়। থুঃ করে একটা খণ্ড ছুড়ে দেয় সামনে। রমিজ বিস্মিত হয়। এত ঘৃণা? এই রাশিকৃত ঘৃণা কি শুধু ঐ ঘোড়ার ওপর? নাকি ঘোড়ার অতীত কোন ঘোড়া? রমিজ আশ্চর্য হয়ে বলে, ‘বাশারের ঘোড়া? এখনো বেঁচে আছে?’ ‘আছে মানে ! বহাল তবিয়তে। রীতিমতন এই অঞ্চলের হিরোইন... এখনো শালা রেসে ফার্স্ট হয়।

মাদি ঘোড়া তো-। ’ ইদ্রিস থামে, বড় করে শ্বাস নেয়, যেন হাঁপাচ্ছে, যেন ঘোড়া ছুটিয়ে ক্লান্ত, নাকি একটি জবরদস্ত মাদি ঘোড়া ওর বুকের ’পরে চেপে বসেছে? ইদ্রিস ছেড়ে দেয়া কথার বল্গা ফের টেনে ধরে বলে, ‘কৈ মাছের জান। শরীলে গোস্ত নেই অথচ দ্যাখো কলজেই আগুন জ্বলতিছে দাউ দাউ। এই জাতটারে আল্লা ক্যান দুনিয়ায় পাঠাইছে জানিস?..... পোড়াতি, বিশ্বযুদ্ধ লাগে না ওরা ইচ্ছে করলি তামাম দুনিয়াডা পুড়ায়ে তামা করে ফ্যালাতি পারে। ’ রমিজের মনে হয় ইদ্রিস এক জ্বলন্ত ভিসুভিয়াস।

ওর শরীরের পেশল দলা পাকানো মাংসের নিচে রাজ-অম্লের মত এই তীব্র ক্রোধ এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল? যে ইদ্রিস শিশু যে ইদ্রিস কিশোর যে ইদ্রিস যুবক যে ইদ্রিস পাথরের মত শীতল ঘাতসহ নির্ঝঞ্ঝাট- অনেক চেনা সেই ইদ্রিসের ভেতর এত আগুন কিভাবে এল? কিভাবে প্রবেশ করল এতটা গভীরে- মর্মমূলে? কোথায় এ আগুনের উৎস? শুধু ওর স্ত্রী কুলসুমের পলায়ন ? শুধু একটি নারী কর্তৃক একটি পুরুষকে অস্বীকার? ওদিকে বাশারের ঘোড়ার চঞ্চলতা বাড়ে। কয়েক বার ইতি উতি ঘড় ফেরায়। কামার্ত চোখে দৃশ্যগুলো সব বুঝি ঝাপসা। জলাশয়ের অপর পড়ে বসে থাকা দুই যুবককে সে দ্যাখে নি। অতঃপর সামনে ঝুঁকে গলা বাড়িয়ে দেয় জলাভূমিতে।

চুক্ চুক্ করে পানি খায়। এবার বুঝি সে বুঝতে পারে, পানিতে সব আগুন নেভে না। বুঝতে পেরে সামনের দু’পা আকাশের দিকে তুলে একবার হ্রেষাধ্বনি করে, তারপর পশ্চিম দিকে ঘুরে দৌড়ের ভঙ্গিতে হেঁটে যায়, যেন চাঁদের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। রমিজ ঘোড়ার হেঁটে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মৌনতায় ভরাট ওয়ে ওঠে। ইদ্রিস বেশ কিছুক্ষণ আগে রমিজের বর্ণনা করা একটি গল্পের খেই ধরে বলে, ‘তোর কথা যদি সত্যি হয় আমি কুলসুমরে খুন করব, ওর কলজে টেনে ছিড়ে আনব...।

’ ‘কী জন্যে? ও আরেকজনের সাথে চলে গেছে বলে ?’ অজান্তেই প্রশ্নটা বেরিয়ে যায় রমিজের মুখ থেকে। ‘না। ’ ইদ্রিসের কণ্ঠস্বরে একটা আলগা দৃঢ়তার হল্কা টের পায় রমিজ। ‘বেশ্যাপনা করার জন্যি। ’ রমিজ আবার প্রশ্ন করে, ‘তুই ওর নাগাল পাবি কিভাবে?’ এবার বিপক্ষ থেকে কোন উত্তর আসে না।

উত্তরের অপেক্ষাও করে না রমিজ। খানিকটা অন্যমনস্ক হযে ঘোড়ার চঞ্চল পায়ে হেঁটে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওদিকে খোলা বে-বহা প্রান্তর, শুরুতেই একটা পুরোন মন্দিরের ধবংস-স্তুপ; অকস্মাৎ সেখানে বাতি ঘরের মত জ্বলে ওঠে এক আলেয়া। নিবেও যায়; আর নিবে যাওয়া আলেয়ার আভাসের দিকে হেঁটে যেতে থাকে বাশারের ঘোড়া। চলবে...


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।