আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সমুদ্রে জীবন - ১৩

Real knowledge is the knowledge about "The Real", or at least, that which leads to "The Real" - rest is just conjecture!

এই সিরিজের লেখাগুলো লিখতে গিয়ে চেস্টা করি, নিজের একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য বা গাল-গপ্প যেন উঠে না আসে - তথাপি কিছু চলেই আসে! ভ্রমন বা জীবনের কথা যেখানে থাকবে, তা তো কোন না কোন ব্যক্তি-আশ্রিতই হবে! এ পর্যন্ত কারো কাছ থেকে তেমন কোন আপত্তির আভাষ পাই নি - তবু, কারো বিরক্তি লাগলে নিঃসঙ্কোচে জানাবেন - ইনশাল্লাহ্, তখন আরো নৈর্ব্যক্তিক করার চেষ্টা করবো! আমি চেস্টা করছি একজন নাবিকের জীবনটা সমুদ্রে কেমন কাটে/কাটলো - চড়াই-উৎরাই পার হয়ে একজন মানুষ হিসাবে তার জীবন কি ভাবে evolve করে - সে সম্বন্ধে একটা ধারণা দিতে - লেখার পেছনে কলম (বা কী-বোর্ড) হাতে মানুষটা ঠিক কে - irrespective of that যেন ব্যাপারগুলো বোধগম্য হয় বা উপস্থাপনযোগ্য হয়! যাহোক, "সমুদ্রে জীবন -১২" পর্বে এক "আত্মীয় পরিবারের" সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হবার বর্ণনা দিয়েছিলাম। তাদের "আবার আসিব ফিরে" বলে বিদায় নেবার আগে, ঐ পরিবারের কয়েকজনকে নিয়ে আমার স্বভাবসুলভভাবেই বইয়ের দোকানে গিয়েছিলাম - মধ্য লন্ডনে বৃটিশ বইয়ের চেইন Waterstones-এর একটা দোকানে। ওখান থেকে অন্যান্য বইয়ের ভিতর, আমার আগের পড়া একটা বই কিনলাম - Daughters of Another Path। উদ্দেশ্য - মামাতো বোনদের বইখানি উপহার দেয়া। আমার ঐ মামাতো বোনেরা, ইংল্যান্ডের সমাজের পশুসুলভ ভোগবাদ, ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিকূল পরিবেশে যেভাবে হিজাব-নিক্বাব সমেত নিজেদের, আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালনা করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল - সেটা দুর্লভ ও অভাবনীয়! তাদের খানিকটা সাহস যোগাতে ও appreciate করতে আমার মাথায় চিন্তাটা আসলো।

আমি যখন তাদের হাতে বইটা তুলে দিলাম, তখন তাদের সবার ছোট বোনটা আমাকে ইসলামী লেকচারের একটা ক্যাসেট উপহার দিল - যার একপাশে ইউসুফ ইসলামের একটা লেকচার ছিল - আর অপর পাশে ছিল হামযা ইউসুফের একটি লেকচার। ইউসুফ ইসলাম সম্বন্ধে আগে থেকে জানলেও - হামযা ইউসুফের ব্যাপারে সেই প্রথম জানলাম। তার লেকচারটা খুবই ভালো লাগলো এবং জাহাজ থেকেই আমি আমার মামাতো বোনদের একজনকে ফরমায়েশ দিলাম, সে (যে আমার খালাতো ভাইয়ের স্ত্রীও) যেন UK-তে পাওয়া যায় - হামযা ইউসুফের এমন সকল অডিও ক্যাসেট আমার জন্য কিনে রাখে - ৫৬ দিন পরে যখন "আবার আসিব ফিরে", তখন যেন আমার জন্য সেগুলো রেডি থাকে। আপনাদের অন্য একটা পর্বে আগেও বলেছি, আমি তখন - জাপান - - দঃ কোরিয়া (Pusan) - - তাইওয়ান (Kaohsiung) - - হং কং - - সিঙ্গাপুর - - সুয়েজ খাল - - হল্যান্ড (Rotterdam) - - জার্মানী(Hamburg) - - ইংল্যান্ড(Felixstowe) - - ফ্রান্স (Le Havre) - - সুয়েজ খাল - - সিঙ্গাপুর - - হং কং - - জাপান -এরকম একটা লুপে ছিলাম - যাতে ৫৬দিন পর পর ঘুরে ঘুরে সপ্তাহের একই বারে একই বন্দরে থাকার কথা!। এখানে জ্ঞাতব্য বিষয় হচ্ছে, জাহাজ UK-র Felixstowe-তে ভিড়লেই, কন্টেইনার জাহাজের একজন সিনিয়র অফিসারের, ১৩৫ কিলোমিটার দূরে লন্ডনে যেতে পারাটা যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বা এমনি এমনিই নিশ্চিত - তা কিন্তু নয়! অনেক কয়টা ফ্যাক্টর একত্রিত হলে, তবেই কিন্তু যাওয়াটা সম্ভব হয়।

উদাহরণস্বরূপ, আপনি তড়িঘড়ি করে Hamburg থেকে Felixstowe-র বহির্নোঙরে এসে দেখলেন যে, আপনার যে বার্থে যাবার কথা, সেই বার্থটা এখনো খালি হয় নি - সেখানে আগে থেকে যে জাহাজটা ছিল, কোন কারণবশত সেটার cargo work শেষ হয়নি। যখন শেষপর্যন্ত বার্থে গেলেন - তখন হয়তো Felixstowe থেকে Ipswich তথা London যাবার শেষ ট্রেনটা আর ধরার উপায় নেই। ব্যস, আপনার মত accidental tourist-এর ৫৬ দিন ধরে প্ল্যান করা ভ্রমণ ভন্ডুল হয়ে গেলো। আলহামদুলিল্লাহ্, ২/১ বার ছাড়া আমাকে তেমন দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থতির সম্মুখীন হতে হয় নি! তবে এভাবে প্ল্যান ভন্ডুল হলে, দুঃখে কাঁদতে বসার উপক্রম হয়! যাহোক, এরপরের বার যথারীতি আমার ঐ "আত্মীয় পরিবারের" কাছে লন্ডন যাওয়া হলো এবং আরো বেশী সময় থাকার সুযোগও হলো! আমার সেই মামাতো বোন (তথা খালাতো ভাইয়ের স্ত্রী) আগে থেকেই ক্যাসেটগুলো ও কিছু বই ডাক যোগে (আহমাদ দীদাত প্রতিষ্ঠিত) IPCI থেকে আনিয়ে রেখেছিলো। সেবার আমি London-এ মুসলিমদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু জায়গায় যাবার সুযোগ পেলাম - যার ভিতর Regents Park মসজিদ এবং বেকার স্ট্রীটে (তথা ম্যালকম্ব স্ট্রীটে) অবস্থিত ইসলামী বইয়ের দোকান Dar al-Taqwa অন্যতম।

এছাড়া ইউসুফ ইসলাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ইসলামী স্কুলটা দেখারও সুযোগ হলো! জাহাজে ফিরে এসে, হামযা ইউসুফের লেকচারের অডিও ক্যাসেটগুলো এক এক করে শুনতে থাকলাম। যতদূর মনে পড়ে, খুব সম্ভব ২১টা ক্যাসেট ছিল। ঐ ক্যাসেটগুলোর মাধ্যমে ইসলামের একটা নতুন দিগন্ত আমার সামনে উন্মোচিত হলো । আমি জানলাম হামযা ইউসুফ নামের একজন ধর্মান্তরিত সাদা-চামড়া মুসলিম দীর্ঘ ৬ বছর সাহারা সংলগ্ন মৌরিতানিয়ার মরু-ভূমিতে থেকে কিভাবে দ্বীন ইসলাম শিক্ষা করেছেন এবং পরবর্তীতে কিভাবে নিজে যা জেনেছেন, তা অন্যকে জানানোর প্রচেষ্টায় এবং দ্বীন ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য - পশ্চিমা বিশ্ব তথা মধ্য-প্রাচ্যের শহরগুলোতে প্রোগ্রাম করে বেড়াচ্ছেন। ঐ সব ক্যাসেট থেকেই জানলাম যে, তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার San Francisco Bay Area-তে বসবাস করেন এবং ওখানে Zaytuna Institute বলে একটা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত।

অডিও ক্যাসেটগুলো শুনতে শুনতে ভাবতাম - ইশ! যদি কখনো San Francisco Bay Area-তে যেতে পারতাম - তা হলে হয়তো হামযা ইউসুফের সাথে দেখা হতো বা তার Zaytuna Institute দেখে আসতে পারতাম। আমি তখনো কল্পনাও করতে পারিনি যে, আমার অদৃস্টে তখন এমন একটা জাহাজে পরর্তীতে যাবার কথা লেখা হচ্ছে, যার পথ ধরে আমার San Francisco Bay Area-তে যাবার পথ খুলে যাবে এবং সেই সূত্র ধরে পরর্বতী কয়েক বছর আমি ঐ এলাকায় এত যাতায়াত করবো যে, ঐ জায়গাগুলো আমার একধরনের বাড়ীঘরে পরিণত হবে। এখানে আরেকটু বলেই আজকের পর্ব শেষ করবো ইনশা'আল্লাহ্ - ঐ সময়টায় এবং ঐ জাহাজে থাকা অবস্থায়ই আমি একটা বই পড়ি - যা, একজন মুসলিম হিসাবে, জীবন সম্বন্ধে আমার ধ্যান-ধারণাকে আমূল বদলে দেয়। ঐ বইটাও একজন ধর্মান্তরিত মুসলিম আহমাদ থমসনের লেখা: Dajjal The Anti-Christ । ঐ বইটা পড়ে আমি অনুধাবন করি যে ৫ ওয়াক্ত নামায পড়ে, নিয়মিত রমযানের রোজা রেখে বা হজ্জ সহ অন্যান্য আপাত অবশ্যকরণীয় করেও, মানুষ কিভাবে ইসলাম তথা ইসলামী world-view বিবর্জিত হতে পারে! ঐ বইখানি পড়ার পরে, আজ পর্যন্তও, নিজের মুসলিম সত্তা নিয়ে আমি আর পরিতৃপ্ত, সুখী বা complacent হতে পারি নি।

তাছাড়া ঐ জাহাজে থাকা অবস্থায় ইসলাম নিয়ে "পড়া" ও "শোনা" থেকে আমি বুঝি যে, আমিও আসলে একরকমের "ধর্মান্তরিত" - আমি যে ইসলামে জন্মগ্রহণ করেছিলাম, আর আমি যে ইসলামকে জীবনে ধারণ করা জরুরী মনে করতে শিখছি - দু'টো একেবারেই ভিন্ন! সেজন্যই গত সংখ্যায় বলেছিলাম: "ঐ পরিবারের সাথে জাহাজী জীবনে আবার নতুন করে পরিচিত হওয়াটা আমার জীবনের একটা turning point হয়ে যায়!" [যে জাহাজটির গল্প বললাম এতক্ষণ - গত সংখ্যায়ও যেটার ছবি দিয়েছিলাম - আমার নাবিক জীবনের সবচেয়ে বড় কন্টেইনার জাহাজটিকে Hamburg-এর বার্থ সংলগ্ন দেখা যাচ্ছে। এই জাহাজে ঠিক এই বার্থে আমি একাধিকবার গিয়েছি!] [একই জাহাজকে সিঙ্গাপুরের জেটিতে দেখা যাচ্ছে]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।