আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাজনীতিবিদ এবং সমাজসেবক, র‌্যাংলার আনন্দমোহন বসুর মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়

আমি সত্য জানতে চাই

বঙ্গীয় রেনেসাঁর অন্যতম স্থপতি, র‌্যাংলার আনন্দমোহন বসু । ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ভারতীয় উমহাদেশে ছাত্র রাজনীতির গোড়াপত্তনকারী, উনিশ শতকের নারী জাগরণের অগ্রদূত, উপমহাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ‘র‌্যাংলার’ হিসেবে তার ইতিহাসে একটা স্বতস্ত্র অথচ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে। ১৯০৬ সালের ২০ আগস্ট মাত্র ৫৯ বছর বয়সে পক্ষাঘাত রোগে ভুগে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। কীর্তিমান এ মানুষটির শারিরীক মৃত্যু ঘটলেও একজন প্রগতিশীল সমাজকর্মী, নিবেদিত প্রাণ শিক্ষানুরাগী, বিচক্ষণ কর্মযোগী, রাজনীতিবিদ হিসাবে বঙ্গীয় রেনেসাঁর উত্তরণে অবিষ্মরণীয় অবদান রেখেছেন যা তাঁকে অনাদিকাল বাঁচিয়ে রাখবে। র‌্যাংলার আনন্দমোহন বসুর আজ ১০৭তম মৃত্যুদিন।

স্মরণীয় কীর্তির বিস্মৃত পুরুষ আনন্দমোহন বসুর মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক আনন্দমোহন বসু ১৮৪৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার জয়সিদ্ধি গ্রামের এক ভূস্বামী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা পদ্মলোচন বসু ও মাতা উমা কিশোরী দেবী। তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় ময়মনসিংহেই। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে মেধা তালিকায় ৯ম স্থান অধিকার করে এনট্রান্স পরীক্ষা পাশ করেন।

এফএ এবং বিএ পরীক্ষা দেন প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে। উভয় পরীক্ষায়ই শীর্ষস্থান অধিকার করেন। আনন্দমোহন বসু ১৮৬৯ সালের ২২ আগস্ট কেশবচন্দ্র সেনের নিকট ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেন। এর পর ১৮৭০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে ইংল্যান্ড যান। সেখানে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজ থেকে উচ্চতর গণিত বিষয়ে পড়াশোনা করেন।

১৮৭৪ সাল। ইংরেজরা রাজার জাত আর ভারতীয়রা শ্লেভ্স অর্থাৎ দাস- এ ধারণাটা ছিল বদ্ধমূল। কিন্তু, সবাইকে অবাক করে দিয়ে খবরটা আসে খোদ ইংল্যান্ড থেকেই। ইংল্যান্ডের ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিষয়ক সর্বোচ্চ পরীক্ষা (অনার্সসহ ডিগ্রী পরীক্ষা) তথা ট্রাইপস অংশগ্রহণ করে তিনটি বিষয়ে প্রথম শ্রেণী অর্থাৎ সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ‘র‌্যাংলার’ উপাধী পেলেন একজন ভারতীয়, আনন্দমোহন বসু। এ বছরই বার-এট-ল ডিগ্রী লাভ করে দেশে ফিরে ১৮৭৪ সাল থেকে তিনি আইন ব্যবসা শুরু করেন।

অতঃপর দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ, ছাত্রদের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগ্রত করবার জন্য সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় ১৮৭৪ সালে স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন এবং সভাপতি নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনার জন্য সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে ‘ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন’ স্থাপন করেন। এর পূর্বে ছাত্রাবস্থায় তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ভগবান চন্দ্র বসু’র কন্যা অর্থাৎ বিজ্ঞানাচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু’র সহোদরা স্বর্ণপ্রভা দেবী’কে বিয়ে করেন। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা ও অগ্রদূত। ছাত্রদের মধ্যে স্বদেশপ্রীতি জাগানোর উদ্দেশ্যে ১৮৭৫ সলে গঠন করে ‘স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন’।

১৮৭৬ সালে তিনি গঠন করেন ভারতবর্ষের জাতীয় কংগ্রেস এর পূর্বসূরী সংগঠন ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন। ১৮৭৮ সালের ১৫ মে তিনি ‘সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। ‘সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ’ এর তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এর পূর্বে আনন্দমোহন বসু সস্ত্রীক ব্রহ্মানন্দ কেশব চন্দ্র সেনের কাছে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নেন। ১৮৭৯ সালে কলকাতায় ‘সিটি স্কুল’ স্থাপন করেন।

‘সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ’ এর নিজস্ব ভবন নির্মাণ এবং সমাজ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘সিটি কলেজ’ ও সিটি স্কুল স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এদেশে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে তিনি ময়মনসিংহের পৈত্রিক বাড়িটি দান করে ১৮৮৩ সালে ‘সিটি কলেজিয়েট স্কুল’ এর কার্যক্রম শুরু করেন। তখন এটির নাম ছিল ময়মনসিংহ ইন্সটিটিউশন উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকালে এ বিদ্যালয়ে শহরের সর্বাধিক ছয়শত নয়জন ছাত্র ছিল। তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো, সিনেট সদস্য এবং শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন।

পশ্চাদপদ নারীদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে কয়েকজন শিক্ষানুরাগীর সহযোগিতায় ১৯৭৬ সালে স্থাপন করেন ‘বঙ্গমহিলা মহাবিদ্যালয়’ যা পরে বেথুন স্কুলের সঙ্গে একীভূত হয়। আনন্দমোহন বসু ও দুর্গামোহন দাসের ঐকান্তিক চেষ্টায় বেথুন স্কুলের সর্বোচ্চ শ্রেণীর দু’ছাত্রী কাদম্বিনী বসু ও সরলা দাস কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ টেস্ট পরীক্ষায় অংশ নিয়ে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেবার উপযুক্ত বিবেচিত হন। এর ফলে ১৮৭৮ সালে কাদম্বিনী বসু প্রথম এন্ট্রান্স পাস মহিলা হবার গৌরব অর্জন করেন। ফলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারী শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হয়। কেবল তাই নয়, আনন্দমোহন বসু, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী, দুর্গামোহন দাস, শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমূখের আন্দোলনে ১৮৭৮ সালের ২৭ এপ্রিল কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট নারীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী লাভের দাবী মেনে নেয় এবং ১৮৮২ সালে কাদম্বিনী বসু ও চন্দ্রমূখী বসু প্রথম মহিলা স্নাতক হবার সম্মান অর্জন করেন।

এমনকি তিনি ‘বেঙ্গল প্রভিনসিয়াল কমিটি’র মাধ্যমে ১৮৮১-৮২ সালে ছাত্রীদের জন্য হোস্টেলের ব্যবস্থা করেন। আনন্দমোহন বসু ১৮৮৪, ১৮৯০ এবং ১৮৯৫ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং দু’দু-বার ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৮৫ সালে ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ এর প্রতিষ্ঠাকালে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখেন। সমাজে শিক্ষা বিস্তারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ময়মনসিংহে কোন কলেজ না থাকায় ১৮৯৯ সালে ‘ময়মনসিংহ সভা’ ও আঞ্জুমানিয়া ইসলামিয়া’ আনন্দমোহন বসুর কাছে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবী জানায়।

১৯০১ সালে তিনি ‘সিটি স্কুল’টিকে দ্বিতীয় শ্রেণীর কলেজে উন্নীত করেন এবং ১৯০৮ সালে এর নামকরণ করা হয় আনন্দমোহন কলেজ। এ দেশের শ্রেষ্ঠ একটি কলেজ ময়মনসিংহ, আনন্দ মোহন কলেজ। ময়মনসিংহ শহরের হামিদ উদ্দিন রোড, কলেজ রোড এবং কাচিঝুলী মহল্লার বিস্তৃত এলাকা জুড়ে কলেজটি প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শুরু হয় ১৯০১ সালে। সেসময় ছিলো ব্রিটিশ আর জমিদারদের দ্বৈত শাসন। কঠোর অনুশাসন।

কিন্তু, এরপরও শিক্ষা বিস্তারের কোন কমতি ছিলো না এ অঞ্চলে। আনন্দমোহন কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনে রাজা জমিদারদের পাশাপাশি দুই ব্যক্তি দুই বন্ধুর ঘামের ফোঁটা আজও আনন্দ মোহন কলেজের অট্টালিকার প্রতিটি ইটের পাঁজরে গ্রথিত হয়ে আছে। এক বন্ধু ব্যারিস্টার আনন্দ মোহন বসু। ওই সময়ের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শিক্ষাবিদ রাজনীতিক সমাজ সংস্কারক। আরেক বন্ধু, ময়মনসিংহ জেলার প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট শিক্ষানুরাগী মৌলভী হামিদ উদ্দিন আহমদ।

১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করেন আনন্দমোহন বসু। প্রথিতযশা এই শিক্ষাবিদ, কৃতিসন্তান ১৯০৬ সালের ২০ আগস্ট মৃত্যুবরন করেন। আজ মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরন করছি গভীর শ্রদ্ধায়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।