পথের সন্ধানে পথে নেমেছি.........
ভালবাসার সুখ-দুখ! পর্ব ৯
মাগরিবের নামাজ পড়ে রাশেদ আহমেদ বারান্দায় বসে রাত-দিনের পার্থক্য নিরুপন করার চেষ্টা করছেন। এই সময়টা তিনি নামাজ পড়ে চুপচাপ বারান্দার ইজি চেয়ারটায় খানিকক্ষন বসে থাকেন। আলোটুকু কালোর মধ্যে হারিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। তখন কারো সাথে তেমন কোন কথা বলেন না। কেউ ডাকাডাকিও করতে পারে না তখন।
পুরোপুরি অন্ধকার নেমে আসলে তবেই উঠে গিয়ে দিনের সংবাদপত্রটা নিয়ে বসবেন। চা খেতে খেতেই নির্ধারিত কয়েকটা বিশ্লেষনী কলাম পড়বেন। এটা তার দীর্ঘদিনের অভ্যেস। নিত্যদিনকার মত আজও রাশেদ সাহেব চুপচাপ বসে আছেন।
ঘরে অনবরত তার সেলফোনটা বেজেই চলছে।
উনি শুনেও না শুনার একটা বান করে আছেন। এই অভ্যেসের কারনে তার মাশুলও গুনতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। তারপরও অভ্যেসটি ছাড়তে পারেননি তিনি।
দীর্ঘক্ষন রিং বাজতে থাকায় অনেকটা বিরক্ত হয়েই নীলা এসে ফোন রিসিভ করল। রিসিভ করতেই শুনতে পেল অত্যন্ত ত্যাক্ত বিরক্ত কন্ঠে খুব মেজাজ নিয়ে কথা বলে চলেছেন নীলার বড় মামা।
মেজাজের অনেকখানি হড়বড় করে ফোনেই দেখিয়ে গেলেন বিরতি না দিয়েই। তারপর একটু শান্ত হলে পরে, নীলা বলল-
আপনার কি হয়েছে মামা? আপনাকে এত অস্হির লাগছে কেন?
ও, নীলা মা! কেমন আছিসরে মা?
ভাল মামা, তবে আপনার কি কোন ঝামেলা হয়েছে মামা? আপনি এরকম ধড়ফড় করছেন কেন?
নীলার উৎকন্ঠিত কন্ঠস্বরেই যেন রায়হান সাহেবের চৈতন্য ফিরল। তারপর একটু দম নিয়ে বললেন, তোর বাবা কইরে মা? তোর বাবাকে একটু দে...
বাবা! বাবা বারান্দায় বসে সন্ধ্যা উপভোগ করছেন। একটু ধরো মামা, আমি বাবাকে দিচ্ছি
নীলা, ফোনটি নিয়ে ওর বাবার কাছে দিল, দিয়ে খানিক অপেক্ষা করতে লাগল এমনি। একটু পরেই রাশেদ সাহেব মেয়েকে বললেন, তোর মাকে আসতে বল।
নীলা চলে গেল মা'কে ডাকতে। একটু পরেই রাশেদ সাহেব বসা থেকে লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন। মুহুর্তেই তার সমস্ত প্রশান্তি উবে গিয়ে ভর করল রাজ্যের অস্হিরতা। অপেক্ষা না করে নিজেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলেন হামিদা বেগমের কাছে। হামিদা বেগম মাগরিবের নামাজ শেষ করে কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন।
নীলার ম্যাসেজ পেয়েই তা সংক্ষিপ্ত করে আনলেন। এখন আবার স্বামীর অস্হির ভাবে ছুটে আসায় তাড়াহুড়ো করেই বাকী কাজটুকু সারতে সারতেই বললেন,
কি হয়েছে? তোমাকে এত উৎকন্ঠিত লাগছে কেন?
অরচির আব্বা ফোন করেছিলেন, তুমি একটু রুমে আস। বলেই প্রায় ছুটে গেলেন নিজ কক্ষে।
পিছন পিছন ছুটে গেলেন হামিদা বেগমও। কিছুক্ষন কথা হল দুজনের মাঝে।
খবরের বিহবলতায় হামিদা বানু হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলেন স্বামীর মুখপানে। চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা অশ্র গড়িয়ে পড়ল তার।
তারপর দেরী না করে অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে স্বামী স্ত্রী দুজনেই তৈরী হয়ে নিলেন দ্রততার সহিত। এরই মধ্যে ছোট মেয়ে মীলাকে ডেকে কিছু কথা সংক্ষেপে সারলেন রাশেদ সাহেব।
দেখিস মিলু, তোর আপাকে এখনই কিছু বুঝতে দিস না।
আমরা গিয়ে দেখেশুনে তারপর তোকে ফোন করছি, ফোন হাতের কাছেই রাখিস। তারপর নীলাকে অনেকটা পাশ কাটিয়েই ক্ষিপ্র গতিতে বের হয়ে গেলেন হাসপাতালের উদ্যেশে।
নীলার মামার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর অক্লান্ত পরিশ্রমে এই যাত্রায় হয়ত সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায় বেচে আছে আকাশ। যে হারে রক্তক্ষরন হচ্ছিল তাতে আর কিছু সময় গেলে হয়ত বাচানো মুশকিল হয়ে উঠত। খোদার কি মহিমা! ঐ সময়টাতেই রায়হান সাহেব ঐ পথ দিয়ে ফিরছিলেন।
এ্যাকসিডেন্টটা দেখে অনেকটা কৌতহল বশতই গাড়ি থামিয়েছিলেন তিনি। অসংখ্য মানুষের ভীরে শুধু এক ঝলক দেখতে পেয়েছিলেন আকাশকে। আকাশের ঐ অবস্হা দেখে তখন তিনি খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। রক্তাক্ত হয়ে নিথর পড়ে থাকা আকাশকে স্বযত্নে তুলে নিয়ে ছুটে গিয়েছেন হাসপাতালে।
রায়হান সাহেব খুব পছন্দ করেন আকাশকে।
পছন্দ করার কিছু গুনাবলী অবশ্যই আকাশের মধ্যে আছে। আকাশের ব্যক্তিত্ব আর চারিত্রিক গুনাবলীতে রায়হান সাহেব খুবই মুগ্ধ। তাইতো নিজের মেয়ের জন্যে আকাশের মত একটি ছেলের আক্ষেপ তার মুখে মাঝেমাঝেই শুনা যায়। সেই দুর্বলতার কারনেই তিনি অতিমাত্রায় আবেগতাড়িত, বিচলিত হয়ে গিয়েছিলেন সেই মুহুর্তে।
অনেকটা আনমনে অনবরত টিভির চ্যানেল পাল্টিয়ে চলছে নীলা।
মনে মনে ভীষন অস্হিরতায় সময় পার করছে সে। বড় মামার ফোন,আব্বা আম্মার হুটহাট হন্যে হয়ে বের হয়ে যাওয়া তাছাড়া এখনও আকাশ এসে পৌছায়নি। সব গুলো বিষয় যতই একই সুত্রে গাথঁবার চেষ্টা করছে নীলা, ততই তার অস্হিরতা বাড়ছে। মা বাবার সাথে বেশ কয়েকবার ফোনে কথা বলেছে নীলা। জোড় করে উনারা কিছু একটা যেন পাশ কাঠিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন প্রতিবারই।
মীলাকেও ডেকে জিঙ্গেস করল, সে কিছু জানে কি না কিন্তু তার কাছ থেকে সদুত্তর পায়নি তেমন একটা। অস্হিরতা আর অজানা আশান্কায় বুক ধরফড় করতে লাগল। টিভি বন্ধ করে সারা ঘরময় পায়চারী করল কিছুক্ষন। এক সময় আর সইতে না পেরে বড় মামাকে ফোনেই চেপে ধরল নীলা। কেননা তার ফোন পেয়েই কোথায় যেন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেছেন মা বাবা।
নীলার চাপাচাপিতে না পেরে সংক্ষেপেই কিছু একটা বললেন রায়হান সাহেব। সংবাদটি শুনে নির্বাক হয়ে গেছে নীলা। থ' মেরে বসে পড়ল মেঝেতেই। দুহাতে মাথার চুল খামচে ধরল সজোরে। চোখ বেয়ে অঝর ধারায় অশ্রু গড়াতে লাগল তার।
বোনের এ অবস্হা দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল মীলা। জড়িয়ে ধরে বোনকে শান্ত রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। একসময় দুহাতে সজোড়ে বোনকে সরিয়ে এক ঝটকায় উঠে দাড়াল নীলা। কয়েক মিনিটের মধ্যে অনেকটা আগাছোলা অবস্হায় বেরিয়ে গেল ক্ষিপ্র গতিতে।
দীর্ঘ পৌনে তিন ঘন্টার সফল অস্ত্রোপাচারের পর আকাশকে রাখা হয়েছে পোষ্ট অপারেটিভে।
এখনও কাউকে কাছে যেতে দেওয়া হয়নি। তবে সে এখন আশান্কামুক্ত, জানিয়েছেন কর্তব্যরত ডাক্তাররা। ভয়ন্কর কোন জখম না হলেও প্রচুর রক্তক্ষরন হয়েছে। রায়হান সাহেব সময় মত ত্বরিত উদ্যোগ না নিলে হয়ত দুর্ঘটনা কিছু একটা ঘটে যেতে পারত। তাই তিনি ভীষন একটা পরিতৃপ্তি নিয়ে বাহিরে দাড়িয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে সিগারেট টানছেন আর নীলার জন্যে অপেক্ষা করছেন অধীর আগ্রহে।
নীলা উভ্রান্তের মত ঘর থেকে বের হয়ে গেছে, সেটা ফোন করে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল মীলা। মেয়ের খোজে রাশেদ সাহেব আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু রায়হান সাহেব তাকে দমিয়ে রেখে নিজেই এসে অপেক্ষা করছেন প্রিয় ভাগ্নির জন্যে।
হলুদ একটা ট্যাক্সিক্যাব থেকে উদভ্রান্ত চেহারা নিয়ে বের হয়ে আসল নীলা। দেখেই দৌড়ে গেলেন রায়হান সাহেব। তড়িগড়ি করে নিজেই ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন আদরের ভাগ্নিকে।
মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন পরম মমতায়। মমতার পরশ পেয়ে সজোড়ে আকড়ে ধরল রায়হান সাহেবকে। রায়হান সাহেবের কিছু কথাবার্তা আর পরম মমতায় ভিতরের জমে থাকা গুমোট ভাবটা কেটে যেতেই সন্দিগ্ধ চেহারায় শুধুই তাকিয়ে রইল নীলা। আর দুচোখে বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল অশ্রুধারা।
রায়হান সাহেব নীলাকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করেই যাচ্ছেন পরম স্নেহ ভরে।
মেয়েকে দেখে রাশেদ সাহেব, হামিদা বেগম দুজনেই দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরলেন মমতা ভরে। কারো সাথেই কোন কথা বলছেনা নীলা। শধুই অশ্রুধারা বয়ে যেতে লাগল নীরবে অনবরত।
খবর এসেছে ভিতর থেকে, সীমিত আকারে দুই একজন প্যাসেন্ট এর সাথে দেখা করতে যেতে পারবে। সবার মতামতের ভিত্তিতে হামিদা বেগম মেয়েকে নিয়ে দেখতে গেলেন আকাশকে।
মেয়েকে কাছে যেতে দিয়ে খানিক দুরে দাড়িয়ে রইলেন তিনি। স্তব্দ, বাকহীন নীলা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল আকাশের সন্নিকটে। অপলক চেয়ে রইল নিথর হয়ে পড়ে থাকা আকাশের মুখের দিকে। তারপর একসময় এগিয়ে গিয়ে আলতো করে ডান হাতটি তুলে নিল নিজের হাতে মধ্যে। গালে ঘষতে লাগল ভালবাসার আবেশে, আবেগে।
চুমুতে চুমতে জানিয়ে দিল ভালবাসার আকুতি।
উঞ্চ পরশ পেয়ে ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকাল আকাশ। অপলক ভাবে চেয়ে রইল নীলার পানে। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল কয়েকফোটা অশ্রু। ইশারায় নীলাকে বসতে বলে নীলার হাতখানি আকড়ে ধরল সজোড়ে।
একদৃষ্টিতে তন্ময় হয়ে দেখতে লাগল নীলাকে, তার ভালবাসার জানুকে। অনেকক্ষন অপলক চেয়ে থাকল দুজন দুজনের দিকে। কেউ কোন কথা বলছেনা, শুধুই চেয়ে আছে অপলক চোখে। দুজনের চোখের ভাষাই বুঝিয়ে দিচ্ছে ভালবাসার প্রখরতা। একসময় শরীরের ধকল আর ঘুমের অষুধের ক্রিয়ায় আপনা আপনি চোখ বুজে আসল আকাশের।
ঘুমিয়ে পড়ল অতল ঘুমে।
পাশে দাড়িয়ে থেকে নীলা আকাশের হাত দুটি আকড়ে ধরে আছে গভীর ভালবাসায়। এরকম থাকতে থাকতেই একসময় ঘুমন্ত আকাশের হাতখানি টেনে নিয়ে চেপে ধরল নিজের পেটের উপর। তারপর চোখ বুজে মনে মনেই বলতে লাগল নীলা, এখানে তোমার সন্তান এসেছে আকাশ, আমি তোমার সন্তানের মা হতে চলেছি। বিশাল একটা সুসংবাদ তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে জান।
হয়ত তার জন্যেই তুমি বেচে আছ, অবশ্যই বেচে থাকতে হবে। তোমার সন্তানের জন্যে, আমার জন্যে, আমাদের ভালবাসার জন্যে।
পরম খুশীতে,আনন্দে, নীলার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। সেই অশ্রু শুধুই আনন্দের আর তৃপ্তির।
(অসমাপ্ত....)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।