রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া এখন মুখোমুখি। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে। দুই নেত্রীর বাগ্যুদ্ধ শুরু হয়েছে। চলছে জবাব-পাল্টা জবাব। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ।
রাজনীতি সরগরম। রবিবার গণভবনে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকার প্রসঙ্গে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, তিনি সংবিধান থেকে একচুলও নড়বেন না। জাতীয় নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ীই অনুষ্ঠিত হবে। ২৪ ঘণ্টা পার হতে না হতেই সোমবার বিকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া স্বেচ্ছাসেবক দলের বর্ণাঢ্য প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভায় এর জবাব দিলেন। পরিষ্কার বললেন, সংবিধান থেকে না নড়লে সব চুল তো উড়ে যাবেই, দিশাহারাও হয়ে যাবেন।
এমনকি অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি পড়বে। অবিলম্বে সংসদের আসন্ন অধিবেশনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের বিল এনে পাস করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, অন্যথায় একতরফা নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতির সৌন্দর্যই এটি যে জনগণের সামনে সরকারপ্রধান ও বিরোধীদলীয় নেতা একে-অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ আনবেন, অভিযোগ খণ্ডন করবেন এবং কে কী করেছেন, ক্ষমতায় গেলে কী করবেন তাও তুলে ধরবেন। দুই নেত্রীর বক্তৃতায় তাও ছিল। কিন্তু ছিল না সমঝোতার কোনো আভাস।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে যারা টানেলের শেষ প্রান্তে শেষ মুহূর্তে সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণে একটি জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখছিলেন তারা এখন হতাশ। রাজনৈতিক আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীতের রাজনৈতিক নানা ঘটনাপ্রবাহের তিক্ত অভিজ্ঞতা ও পরিণতি থেকে কেউ শিক্ষা নেননি। তাই যার যার অবস্থানে অনড়। দুই নেত্রী তাদের সিদ্ধান্ত থেকে যে সরবেন না তা-ই তাদের বক্তৃতায় উঠে এসেছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহল নতুন করে এই বার্তা পেয়েছে যে সরকার বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি মানবেই না।
অন্যদিকে বিরোধী দল নির্দলীয় সরকার ছাড়া শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবে না। বেগম খালেদা জিয়া আন্দোলনের মাধ্যমে তার দাবি আদায়ের কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দরজা দিয়ে ওয়ান-ইলেভেন নামের অগণতান্ত্রিক সরকারের আগমনের আশঙ্কা শোনালেও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া তাতে দমেননি। পাল্টা বলেছেন, চুরি করেছে সরকার, ভয় তাদের নেই। রাজনীতিতে দুই নেত্রী পরস্পরের পরিবারের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন।
এনেছেন পরস্পরের মন্ত্রী, উপদেষ্টা এবং নেতাদের বিরুদ্ধেও। প্রধানমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, সংবিধান অনুযায়ী তার সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন ফলাফল যাই হোক এমনকি পরাজয় হলেও তিনি মেনে নেবেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক ধারায় ছন্দপতন হতে তিনি দেবেন না। অন্যদিকে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, নামে কিছু আসে যায় না, অন্তর্বর্তী সরকার হলেও আপত্তি নেই, তবে তা হতে হবে নির্দলীয়। তার মানে আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ও উপদেষ্টামণ্ডলী শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে চাইলেও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া তা মানছেন না।
হরতালে না গিয়ে নির্বাচনমুখী প্রস্তুতি ও জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়ে আন্দোলনের পথটি খোলা রাখতে খালেদা জিয়া মাসব্যাপী গণসংযোগ, সভা-সমাবেশের যে কর্মসূচি দিয়েছেন জোটের পক্ষে তা প্রসংশিত হচ্ছে। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা বলছেন, হিসাবের খাতায় সবার দৃষ্টি। সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। সংলাপের পথেও সরকার হাঁটছে না। বিরোধী দল পর্দার অন্তরালে দুয়ারে দুয়ারে সংলাপের আকুতি জানালেও কাজ হয়নি।
তাদের সামনে আন্দোলনই দাবি আদায়ের একমাত্র পথ। নরমে-গরমে সরকার ও বিরোধী দলের চলমান রাজনীতি জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে অগি্নগর্ভ হয়ে উঠতে পারে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। সেনাশাসক এরশাদ '৮৮ সালে একতরফা নির্বাচন করে দুই বছর পুরো করতে পারেননি। '৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন করে খালেদা জিয়া ১৫ দিন থাকতে পারেননি। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন করতে গিয়ে বিএনপি নিজেদের কোমরই ভাঙেনি, জনসমর্থন নিয়ে আসা ওয়ান-ইলেভেন সরকার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের জেল-জুলুম, দেশত্যাগই দেয়নি ব্যবসায়ীদেরও হয়রানির চরম পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিয়েছিল।
সেই ইতিহাস কারও জন্য সুখকর হয়নি। তবুও একতরফা নির্বাচন হয়নি। দলকানাদের বাইরে থাকা রাজনীতিমনস্ক মানুষ প্রতিনিয়ত চাচ্ছে সরকার ও বিরোধী দলের সংলাপ এবং সমঝোতার মাধ্যমে সবার অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন। কিন্তু দুই নেত্রীর বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্য, চুলতত্ত্বের ঝড়ো হাওয়ায় উভয় পক্ষের নেতাদের মুখে এখন খই ফুটছে। কে কাকে কতটা ঘায়েল করবেন সেদিকেই গড়াচ্ছে রাজনীতি।
অনুসন্ধিৎসু মানুষের তৃষ্ণার্ত চোখ সামনে সমঝোতা নয়, সংঘাতের রাজনীতির কালো অাঁধার দেখছে। সংঘাতের রাজনীতি গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের জন্য শুভ না হলেও সরকার ও বিরোধী দল সেদিকেই হাঁটছে। জনমত যারা উপলব্ধি করছেন এবং এ দেশের মানুষের চেতনার জায়গাটি যারা জানেন ও বোঝেন তারা কোনোমতেই বিশ্বাস করেন না শেষ পর্যন্ত একটি একতরফা নির্বাচন হয়ে যাবে। মামলার ফাঁদে থাকা মহাজোটের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদও পরিষ্কার বলে দিয়েছেন শেষ বয়সে তার ললাটে কলঙ্কের তিলক এঁকে দিতে চান না। দালাল হয়ে মরতে চান না।
এখানে খালেদা জিয়াই নন, অনেকেরই প্রশ্ন- সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির পূর্বাভাস আমলে নিয়ে কারা হাঁটবেন একতরফা নির্বাচনের পথে? সর্বত্র জল্পনা-কল্পনা এখন তুঙ্গে। দুই নেত্রীর মুখোমুখি বাগ্যুদ্ধ ও দুই দলের নেতাদের বাহাসের পথে রাজনীতিতে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস ফুটে উঠেছে। সংসদের মেয়াদ শেষ হতে না হতেই তা দেখা দেবে, এমন ধারণা পর্যবেক্ষকদের। পশ্চিমাসহ বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দুনিয়ার কূটনীতিকরাও বসে নেই। পর্দার অন্তরালে সক্রিয় হয়ে উঠছেন।
সব মিলিয়ে অক্টোবর মাস থেকে রাজনীতি নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি করতে যাচ্ছে মানুষকে। সংঘাত, সহিংসতা কেউ চাচ্ছে না। কিন্তু আশঙ্কা উড়িয়েও দিতে পারছে না। বলাবলি হচ্ছে, ওয়ার্মআপ শুরু হয়েছে মাত্র, অক্টোবরে রাজনীতি কোন দিকে টার্ন নেয় তা-ই দেখার অপেক্ষায় সবাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।