আমেরিকায় ইসলাম
ববি ঘোষ
[সাপ্তাহিক টাইম ম্যাগাজিনের ১৯ আগস্ট সংখ্যায় ববি ঘোষের এই লেখাটি ছাপা হয়েছে। বিভিন্ন জরিপসহ লেখাটিতে তিনি আমেরিকার মুসলিম সম্প্রদায়ের সাম্প্রতিক অবস্থাটি তুলে ধরেছেন। লেখাটি অনুবাদ করেছেন আজিজ হাসান। বি. স.]
আমেরিকার এখনকার একজন মুসলমানের অনুভূতি বুঝতে চাইলে আপনাকে উইসকনসিনের শেবোগান কাউন্টির ডাক্তার মনসুর মির্জার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে হবে। ফেব্রুয়ারির এক সন্ধ্যায় আপনি উইলসনের পরিকল্পনা কমিশনের এক বৈঠকে উপস্থিত।
ওস্টবার্গের নিকটবর্তী একটি গ্রামে একটি মসজিদ নির্মাণের অনুমতি চেয়ে করা আপনার আবেদনটি বিবেচনা করছে এ পরিকল্পনা কমিশন। বৈঠকে আপনি তার তেমন বিরোধিতা প্রত্যাশা করছেন না। মসজিদের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পত্তি ইতোমধ্যেই আপনি সংগ্রহ করেছেন এবং গত পাঁচ বছর ধরে আপনি নিকটবর্তী ম্যানিটোভোক হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন। আপনি এ শহরে কোনো আগন্তুকও নন। উপরন্তু বৈঠকে উপস্থিত রয়েছেন এমন কিছু মানুষ যারা আপনার বেশিরভাগ শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান রোগীর মতো ডাক্তারের কাছে তাদের অসুস্থতার কথা বলতে গেলে ডাক্তারের ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি বিষয়গুলো মনে রাখেন না।
কিন্তু বৈঠকের আলোচনা শুরু হলে আপনি এমন ধরনের কথা শুনতে পেলেন যেগুলো তারা আপনাকে কখনো বলেনি। এমনকি ব্যক্তিগত রোগনির্ণয় কক্ষেও তারা কখনো এ ধরনের কথা বলেনি। একের পর এক তারা আপনার প্রস্তাবের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখালেন ও তার বিরোধিতা করলেন। তাদের বেশিরভাগ বিরোধিতাই নগর পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গত নয়। সেগুলো আপনার ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে জড়িত।
তারা বলেন, ইসলাম একটি ঘৃণিত ধর্ম। ক্রিশ্চিয়ানিটি নিশ্চিহ্ন করতে মুসলমানরা উঠে পড়ে লেগেছে। আমেরিকার গ্রামাঞ্চলে ২০ টি গোপন জিহাদি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প রয়েছে। ভবিষ্যতে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানোর জন্য সেগুলো এখনো সন্ত্রাসী তৈরি করছে। মুসলমানরা তাদের সন্তানদের হত্যা করছে।
খ্রিস্টান ছেলে-মেয়েরা নেশা, অ্যালকোহল ও পর্নোগ্রাফী নিয়ে যথেষ্ট সমস্যায় রয়েছে এবং ইসলাম নিয়েও উদ্বিগ্নতা সৃষ্টি করা উচিত নয়। একজন বলেন, “আমি আমার আঙিনায় এটা চাই না। ” অন্য একজন বলেন, “আমি কেবল চিন্তা করি এটা কি আমেরিকা নয়। ” বৈঠকে শুধু এক দম্পতি একটু শান্তভাবে কথা বলেন। টাইম ম্যাগাজিনের পাওয়া বৈঠকের একটি অংশের আলোচনায় দেখা যায়, ঐ দম্পতির একজন বলেন, “আমি মনে করি না যে, সাধারণীকরণ করে আমাদের বিষয়টিকে এতো বড় করে দেখা উচিত।
” কিন্তু বৈঠকে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি অন্ধভাবে সন্দেহ ও বিদ্বেষ প্রকাশ থামাতে তা যথেষ্ট ছিলো না। মির্জা কথা বলার সময় তার কণ্ঠে চরম আঘাত ও কষ্টের সুর স্পষ্টত ফুটে ওঠে।
তিনি বলেন, “আমরা যদি সেখানে প্রার্থনা করি তাহলে কাউকে বিরক্ত করবো না। আমরা গোলমাল করবো না। আমরা শুধু সেখানে গিয়ে প্রার্থনা করবো এবং চলে আসব।
” মসজিদে কোনো অস্ত্র বা জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থাকবে কিনা–বলে একজন কমিশনার জানতে চাইলে তিনি চুপ থাকেন। কিন্তু পরক্ষণেই পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ৩৮ বছর বয়সী মির্জা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন, “যেসব মানুষ হাসপাতালে এসে শ্রদ্ধার সঙ্গে আমার কাছে চিকিৎসা নেয় তারা আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারবে তা আমি কখনো প্রত্যাশা করিনি। ” তখন তার আইনজীবী তাকে শান্ত করতে পার্শ্ববর্তী ক্যাফেতে নিয়ে যান।
শেবোগান কাউন্টিতে মির্জার কিছু মুসলমান অনুসারীর মতে, তিনি অত্যন্ত সহজ সরল মানুষ।
সেখানকার অধিকাংশ মুসলমান বসনিয়ান এবং আলবেনিয়ান যারা যুগোশ্লাভিয়া ভাঙার পর সার্বদের নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে আমেরিকায় পালিয়ে যান। স্বদেশের তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্য সেখানে যাতে আর ফিরতে না হয় সেজন্য তাদের অনেকে ধর্মীয় বিশ্বাস গোপন রাখে। একটি মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা তাদের কমিউনিটির দিকে নজরদারি সৃষ্টি করতে পারে বলে তাদের ভয় থাকে। তাদের আশঙ্কা একেবারে মিথ্যা ছিলো না। মসজিদ নিয়ে ঐ বৈঠকের পর ওস্টবার্গের গির্জার যাজকরা এ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে শুরু করে।
রেভারেন্ড ওয়েন ডেভ্রু নামের ওস্টবার্গের এক গির্জার যাজক বলেন, “ইসলামের রাজনৈতিক শিক্ষা হলো, বিশ্বে তার ধর্মীয় অনুশাসনের আধিপত্য বিস্তার এবং স্বৈরতান্ত্রিকভাবে অন্য সব ধর্মের ওপর আধিপত্য বজায় রাখা। ” নিউইয়র্কের গ্রাউন্ড জিরোর দুই ব্লক দূরে মুসলিম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও মসজিদ নির্মাণ পরিকল্পনার বিরোধিতায় নিউইয়র্কে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত উইলসনে মসজিদ নির্মাণের এ দ্বন্দ্ব আমেরিকাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো। সুফিবাদী ধারায় ইসলাম ধর্মীয় বাণী প্রচারের জন্য আমেরিকায় সুপরিচিত ইমাম ফয়সাল রউফ ও তার স্ত্রী ডেইজি খানের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ারে আল কায়েদার সন্ত্রাসী হামলাস্থলের কাছে এ মুসলিম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও মসজিদ নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি পার্ক৫১ নামে পরিচিত। তাদের পরিকল্পনা নিউইয়র্ক নগর কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিয়েছে এবং মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গও তাদের পরিকল্পনার পক্ষে রয়েছেন।
তবে সারা দেশে এ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে।
কিছু বিরোধিতাকারী দাবি করছে, গ্রাউন্ড জিরোর পাশে ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করলে তা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত প্রায় ৩ হাজার মানুষের পরিবারের সদস্যদের অনুভূতিতে আঘাত হানবে। সে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত মার্গারেটের ভাই পল উইলার যিনি পেশায় একজন আইনজীবী তিনি স্বীকার করেন যে, রউফ ও খানের সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে সেখানে ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও মসজিদ নির্মাণের। তবে তিনি আরো বলেন, “আমি মনে করি না যে, এটা সঠিক পদক্ষেপ। ” অনেক মার্কিনীর মতো গ্রাউন্ড জিরোর চারপাশের এলাকা পরম শ্রদ্ধেয় বিবেচনা করে ইসলামের বিরুদ্ধে মনোভাব থাকা উচিত নয়।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে রিপাবলিকান নেতা নিউট গিংগ্রিচ ও সারাহ পেলিনের কল্যাণে আগামী নভেম্বরে একটা গুরুত্বপূর্ণ কংগ্রেস নির্বাচনের আগ মুহূর্তে স্পর্শকাতর এ বিষয়টি একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। বিতর্ক বাড়তে থাকায় প্রকল্পটি একটি কঠিন পরীক্ষায় পরিণত হয়েছে। আর তা ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিকার থেকে ধর্মীয় সহনশীলতা সব বিষয় নিয়ে বিতর্ক তুলেছে। তবে পার্ক৫১’র অনেক বিরোধিতাকারী আবার উইসকনসিনের অনেক বিরোধিতাকারীর মতো ইসলাম ফোবিয়ায় ভোগা শুরু করেছে।
ইসলাম ও আমেরিকার মিলন
প্রস্তাবিত পার্ক৫১ স্থাপনা গ্রাউন্ড জিরোর সঙ্গে লাগোয়া নয়।
তাছাড়া লোয়ার ম্যানহাটনের অশালীন ক্লাবগুলো, মদের দোকান ও এ ধরনের অন্যান্য স্থাপনার বিরুদ্ধে তা কটাক্ষ করার মতো একটি স্থাপনা। স্থানীয় মুসলমানরা এখানে প্রায় এক বছর ধরে নামাজ পড়ছে। কিন্তু মসজিদ বিরোধী আন্দোলনের মুখে তা বন্ধ হয়ে গেছে। অগাস্টের প্রথমদিক থেকে এ স্থানটি অহরহ বিক্ষোভস্থলে পরিণত হয়েছে। “ইসলাম সম্পর্কে আমার যা জানার তা আমি ৯/১১ থেকে শিখেছি।
”–লেখা ব্যানার ফেস্টুন ও প্লাকার্ড নিয়ে তারা সেখানে বিক্ষোভ করছে। মির্জার মতো রউফ এবং খানও হতবাক হয়ে পড়েছেন। আল কায়েদা জঙ্গিদের প্রতি তারা সহানুভূতিশীল বলেও অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা। ওদিকে, তারাও সেভাবে প্রচার মাধ্যমের মুখোমুখি হচ্ছেন না। রউফ দীর্ঘদিন দেশের বাইরে রয়েছেন।
কিন্তু ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য তাদের ওপর চাপ বাড়ছে। এ বিতর্কের ফলে দেশব্যাপী ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী বিক্ষোভে আমেরিকায় আরো কিছু প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে, যুক্তরাষ্ট্র কি ইসলাম নিয়ে সমস্যায় আছে? ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলা ও তার পরবর্তী সন্ত্রাসী হামলা চেষ্টার কারণে মুসলমানরা কি আমেরিকার জীবনস্রোতের সঙ্গে একত্রিত হওয়া থেকে একেবারেই দূরে সরে গেছে। আমেরিকার মুসলমানদের বলার কিছু নেই। ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ইব্রাহিম মুসা বলেন, পার্ক৫১ স্থাপনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মুসলিমদের প্রতি অসহনশীলতার একটি ধরন।
৯/১১’র থেকে তা শুরু হয়েছে এবং গত কয়েক বছরে তা ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছে। তবে আমেরিকায় ইসলাম ভীতি বাড়লেও ঐতিহ্যগত ধর্মীয়
নির্যাতনের কিছু দিক সেখানে নেই। আমেরিকাজুড়ে ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী বিরুপ মন্তব্য খুব বেশি বাড়লেও সেখানে মুসলমানদের প্রতি সহিংসতার কোনো নজির এখনো নেই। মুসলিম-আমেরিকান লেখক ও ভাষ্যকর আরসালান ইফতিখার বলেন, “ইসলাম ভীতি আমেরিকায় বর্ণবাদের গ্রহণযোগ্য রূপে পরিণত হয়েছে। ” তিনি আরো বলেন, “আপনি সবসময় মুসলিম বা আরবদের সঙেগ বিরুপ আচরণ করতে পারবেন এবং সেখান থেকে সটকে পড়তে পারেন।
”
লোয়ার ম্যানহাটন ও শেবোগান কাউন্টিতে যে মনোভাব দেখা দিয়েছে তা বিচ্ছিন্ন নয় বলেও ভাবার কারণ রয়েছে। একটি নতুন টাইম-এবিটি এসআরবি জনমত জরিপে দেখা গেছে, অন্যান্য ধর্মের চেয়ে ইসলাম ধর্ম তার অনুসারীদেরকে ধর্ম অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় বেশি উৎসাহিত করে বলে মনে করেন ৬৪ শতাংশ আমেরিকান। কেবল ৩৭ শতাংশ একজন মুসলিম আমেরিকানকে চেনেন। প্রায় ৬১ শতাংশ পার্ক৫১ স্থাপনার বিরুদ্ধে যেখানে মাত্র ২৬ শতাংশ এর পক্ষে মতামত দিয়েছেন। মাত্র ২৩ শতাংশ বলেছেন, এটা হবে ধর্মীয় সহনশীলতার প্রতীক।
আর ৪৪ শতাংশ বলেছেন, এটা হবে ৯/১১’র হামলায় যারা মারা গেছেন তাদের প্রতি অবমাননা।
মুসলিম সংখ্যালঘু অন্যান্য দেশের তুলনায় আমেরিকায় ইসলাম ভীতি তুলনামূলক কম। ফ্রান্সে বোরকার ওপর নিষেধাজ্ঞা অথবা মিনার নির্মাণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সুইজারল্যান্ডের নতুন আইনের মতো আমেরিকায় তেমন কিছু নেই। জনমত জরিপে দেখা গেছে, পশ্চিমা বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় আমেরিকায় মুসলমানরা নিজেদের বেশি নিরাপদ ও মুক্ত মনে করেন। আমেরিকায় দুই জন মুসলমান কংগ্রেস সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং এ বছর রিমা ফাকিহ প্রথমবারের মতো কোনো মুসলমান নারী হিসেবে মিস ইউএসএ নির্বাচিত হয়েছেন।
আগামী মাসে ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলিতে দেশটির প্রথম মুসলিম কলেজ উদ্বোধন হবে। জয়তুনা কলেজের লক্ষ হচেছ: “যেখানে ইসলাম আমেরিকার সঙ্গে মিলিত হয়। ”
কিন্তু সাধারণ আমেরিকানরা কোথায় ইসলামের সঙ্গে মিলিত হচ্ছে? বরং সেখানে ইসলামের প্রতি সন্দেহ ও বিদ্বেষ বাড়ছে বলে প্রমাণ রয়েছে। আমেরিকার এখন একজন মুসলমান হলে আপনাকে ধর্মীয় অনুভূতির বিরুদ্ধে নানা কটাক্ষ ও বিরুপ মন্তব্য সহ্য করতে হবে এবং তা কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস আদালতে নয়, বরং আপনার প্রার্থনাস্থলের বাইরে ও প্রকাশ্য জনসমাগমস্থলে। কারণ সেখানে অনেক প্রভাবশালী ধর্মীয় ও রাজনীতিক নেতা চিন্তাভাবনা না করেই ইসলামকে সন্ত্রাস ও সহিংসতার সঙ্গে জড়িয়ে বক্তব্য দেন।
ফ্রান্স ও ব্রিটেনে খুচরা দলগুলোর সদস্যরা মুসলমানদের সম্পর্কে আতঙ্কের কথা বলেন। তবে ইসলামকে নাৎসীবাদের সঙ্গে এক করে দেখার মতো কোনো সাবেক জাতীয় সংসদের স্পিকার পুরো ইউরোপে নেই। সম্প্রতি কাজটি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক হাউজ স্পিকার গিংগ্রিচ। ওবামার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইবু প্যাটেল বলেন, “মসজিদ বিরোধী আন্দোলনে মূল বিষয় যেটা উঠে আসছে তাহলো, মুসলমানরা বর্তমান এবং ভবিষ্যত কখনোই পুরো আমেরিকান হতে পারবেন না। ” এটা পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দেয় যে, মসজিদ বিরোধী বিক্ষোভ কার্যকর হয়েছে।
ইউরোপের চেয়ে আমেরিকার মুসলমানরা দেশজুড়ে বেশি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। তাদের প্রার্থনাস্থল বেশিরভাগ সময়ই আমেরিকানদের ঘৃণার বস্তু হয়ে ওঠে। কেনটুকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্ট্যাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ইহসান বাগবির মতে, বর্তমানে আমেরিকায় ১ হাজার ৯ শ’ টি মসজিদ রয়েছে। ২০০১ সালের ১ হাজার ২ শ’ থেকে বেড়ে এখন এ সংখ্যায় দাঁড়িয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অনেক মসজিদ আবার অফিস বা দোকানের নামাজ পড়ার জায়গার চেয়ে তেমন বড় নয়।
মুসলমানরা আনুষ্ঠানিকভাবে মসজিদ নির্মাণ করতে গেলে তারা বিরোধিতার মুখে অসহায় হয়ে পড়ে।
এ বছর আমেরিকায় কমপক্ষে ৬ টি মসজিদ নির্মাণ প্রকল্প তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছে। গত জুলাইয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার টেমেকুলায় মুসলমানদের বিরোধিতা করে তাদের নামাজ পড়ার জায়গায় কুকুর নিয়ে যায় একটি গোষ্ঠী। ইসলামে কুকুরকে অপবিত্র বলে ধরা হয় জেনে তারা এ কাজ করেন। এবং মুসলমানদের প্রতি প্রচ- ক্রোধ থেকেই মসজিদ নির্মাণের প্রস্তাবে তারা বিরোধিতা করেন।
গেইনসভিলের এক যাজক ঘোষণা করেছেন, ৯/১১ হামলার বর্ষপূর্তিতে তিনি কোরানের কপি পোড়াবেন। ‘এটা পবিত্র নয়’ বলে যিশু থাকলে তিনি কোরান পোড়াতেন দাবি তুলে ঐ যাজক এ ঘোষণা দেন। ‘দ্য ফ্রিডম ডিফেন্স ইনিশিয়েটিভ অ্যান্ড স্টপ দ্য ইসলামাইজেশন ইন আমেরিকা’ নামের একটি গ্রুপ মুসলমানদের ইসলাম ত্যাগের নিরাপদ পথের প্রস্তাব দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করছে।
তবে সম্ভবত সবচেয়ে বিদ্বেষপূর্ণ আক্রমণ আসছে অনলাইনে। পামেলা গেলার যিনি ‘অ্যাটলাস শ্রাগস’ ওয়েবসাইটটি পরিচালনা করেন তিনি মূলধারার কনজারভেটিভরা হাল ছেড়ে দেওয়ার পরও পার্ক৫১ স্থাপনা প্রকল্পের বিরুদ্ধে জাতীয়ভাবে প্রতিবাদ হওয়ার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
স্থাপনাটির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালান ব্লগার গেলার। তিনি ব্লগে লেখেন, “এটা ইসলামের আধিপত্য ও প্রসারণবাদ। প্রস্তাবিত স্থাপনাটির অবস্থান কোনো দুর্ঘটনা নয়- জেরুজালেমের টেম্পলের (ইহুদি উপসনালয়) চূড়ায় যেভাবে আল-আকসা মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিলো এটা সেরকমই। ” অন্যান্য ব্লগাররা এ প্রচারণাকে লুফে নেয় এবং তা ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
বন্ধুদের ছেড়ে যাওয়া
ইসলামের নিন্দুকদের কল্যাণে ইসলাম বিরোধী প্রচারণা মানুষের কাছে খুব পরিচিত হয়ে গেছে।
ধর্মীয় বিশ্বাসের দোহাই দিয়ে মুসলমানরাই অধিকাংশ সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে জড়িত থাকায় ইসলাম অবশ্যই একটি সহিংস ধর্ম বলে প্রচারণা রয়েছে। কোরানের বাণী তুলে প্রমাণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে যে, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের হত্যা বা ধর্মান্তরিত করতে বিশ্বাসীদের উৎসাহিত করে ইসলাম। শরীয়া আইন অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের সম্পর্কের জন্য তাদের পাথর ছুড়ে হত্যা করা বা অন্য সব ভয়াবহ শাস্তি প্রমাণ করে যে, মুসলমানরা নিষ্ঠুর ও পশ্চাৎপদ। এসব লাইনের উপসংহার দাঁড়ায়, ইসলাম একটি মৃত ধর্ম, তা কোনো বাস্তব ধর্ম নয়। তাই সাংবিধানিক স্বাধীনতা এ ধর্মের জন্য প্রযোজ্য নয়।
ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ইসলামে সীমিত নয়। আবার একইভাবে ইহুদি, মর্মন ও অন্যান্য ধর্মে এখনো ঘৃণ্য বক্তব্য রয়েছে। তবে বেশিরভাগ বিষাক্ত রসই মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত থাকে আমেরিকায়। সুসমাচার মতবাদের অন্যতম পুরোধা বিলি গ্রাহামের ছেলে ফ্রাঙ্কলিন গ্রাহাম টাইমকে বলেন, ইসলাম এক “ঘৃণার ধর্ম, এটা যুদ্ধের ধর্ম। ” তিনি বলেন, পার্ক৫১ অনুমোদন দেওয়া ঠিক নয়।
কারণ মুসলমান প্রার্থনাকারীরা সেখানে হেটে যাবে এবং ‘যেটুকু পথ তারা পায়ে হেটে যাবে তার সবটুকুকে নিজেদের সীমানা বলে দাবি করবে। তারা এখন দাবি করবে যে, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ভূমিও ইসলামের। ”
নতুন মসজিদ পরিকল্পনার বিরোধিতাকারীরা সমতার প্রশ্নও তুলেছেন। তাদের বক্তব্য, সৌদি আরব গির্জা ও সিনাগগের অনুমোদন দেয় না। তাই যুক্তরাষ্ট্র কেন মসজিদের জন্য ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেবে।
কিন্তু তাদের একটি বিষয় মনে রাখা উচিত যে, সৌদি আরবের মতো যুক্তরাষ্ট্রের কোনো রাষ্ট্র ধর্ম নেই অথবা ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতার ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো।
বিরোধিতাকারীরা নগ্নভাবে ইসলাম বিরোধী হওয়ার বিষয়টি তেমন কোনো গুরুত্ব বহন করে না। অনেক খ্রিস্টান, ইহুদি ও অসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীও এটাকে প্রত্যাখান করেছেন। মুসলমানরা সব ভাবেই বন্ধুহীন। তবে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে যাদেরকে তারা মিত্র মনে করেছিলো তারাও তাদের ত্যাগ করেছে বলে মনে হচ্ছে।
পার্ক৫১ বিতর্কে বিশিষ্ট ডেমোক্র্যাটরা হয় নিশ্চুপ থাকছেন অথবা সিনেটর হ্যারি রেইডের সাম্প্রতিক অবস্থানের পক্ষ নিচ্ছেন। পার্ক৫১ স্থাপনাটি অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়ার পক্ষে তাদের অবস্থান। এমনকি ডেমোক্রেট পার্টির পক্ষে ইন্ডিয়ানা থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্য এবং কংগ্রেসের দ্বিতীয় মুসলমান সদস্য আন্দ্রে কারসনও প্রকল্পটির অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। টাইমকে তিনি বলেন,“এটা অবশ্যই একটা প্রশ্ন এবং আমার নিউ ইয়র্কের বন্ধুরা অবশ্যই তা তুলবে। ”
গত সপ্তাহে মুসলমানরা প্রথমে আশান্বিত এবং পরে হতাশ হয়।
১৩ অগাস্ট শুক্রবার হোয়াইট হাউসে মুসলিম নেতাদের সঙ্গে এক নৈশভোজে প্রেসিডেন্ট ওবামা কমিউনিটির সাংবিধানিক অধিকার চর্চা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করে বলেন, তাদের মসজিদ নির্মাণ আইনত বৈধ। কিন্তু পরের দিনই ওবামা তার বক্তব্যের সংশোধনী দিয়ে বলেন, “মসজিদটি ঐ স্থানেই নির্মাণের বিষয়ে তিনি কোনো সিদ্ধান্তের উল্লেখ করেননি। ” হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা শনিবারের পুনর্বিবৃতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, কৌশলগত এ সিদ্ধান্তটি প্রেসিডেন্ট উল্লেখ করেননি। পার্ক ৫১’র ঘটনায় মুসলমানরা নিজেদের অবস্থান বুঝতে পেরে সতর্ক হয়েছেন। রমজানের শুরুর দিন ১১ অগাস্ট একটি বেকারির ক্রেতাদের মধ্যে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে বিষয়টি নিয়ে।
কেউ কেউ বলেন, মুসলিম বিরোধী মনোভাব বাড়তে থাকায় পার্ক৫১ প্রকল্পটি বাতিল হওয়া উচিত। অন্যরা বলেন, এ জায়গা থেকে ফিরে যাওয়া বোকামি হবে। ইরাক থেকে গিয়ে সদ্য মার্কিন নাগরিকত্ব পাওয়া সামি বলেন, “তারা যদি এটা নির্মাণ না করেন তাহলে যারা মনে করে মুসলমানরা প্রকৃত আমেরিকান নন তাদের সঙ্গে একমত হবেন। ” তিনি আরো বলেন, “বিষয়টি যদি তাই হয় তাহলে আমি বাগদাদে ফিরে যাব। কারণ আমাকে কখনোই এখানে গ্রহণ করবে না।
” আমেরিকায় সুফিবাদের চর্চাকারী রউফের অবমূল্যায়ন হওয়ায় ডিয়ারবর্ন ও অন্য অনেক জায়গার আমেরিকান মুসলমান হতাশ হচ্ছেন। ডেট্রোয়েটের ওয়াইন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইদ খান বলেন, “একটি সম্প্রদায়গতভাবে মুসলমানদের বিবেচনা করা হচ্ছে একটি বড় ঝাড়ু হিসেবে। ” প্রকৃতপক্ষে অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় আমেরিকায় মুসলমানদের মধ্যে বৈচিত্র্য বেশি। আমেরিকান মুসলমানরা সব বর্ণের ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন।
ইসলাম ভীতি হঠাৎ করে এতো তীব্র হলো কেনো? অনেক আমেরিকান মুসলমানের মতে, বিষয়টি তা নয়।
তাদের মতে এ মনোভাব বেশ কয়েক বছর ধরে বর্তমান। অন্যরা বলেন, ৯/১১ হামলার পর মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ তীব্র হয়েছে। মুসলিম আমেরিকান ভাষ্যকর ইফতিখার মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রথম জনবিক্ষোভের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর প্যাট রবার্টসন ও জেরি ফলওয়েলের মতো খ্রিস্টান নেতারা যখন ইসলাম মোটের ওপর একটি ধর্ম কিনা তা নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তোলেন এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদকে একজন ডাকাত, দস্যু ও সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দেন তখন থেকেই মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ দেখা দিয়েছে। রাজনীতিক নেতারাও তখন মুসলমানদের সম্পর্কে তেমন সতর্ক বক্তব্য দেয়নি।
সেসময়ের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস’র সদস্য এবং বর্তমান সিনেটর স্যাক্সবি চাম্বলিস বলেন, “তার স্টেটের উচিত অনুপ্রবেশকারী সব মুসলমানকে গ্রেপ্তার করা।
”। পরে অবশ্য এ মন্তব্যের জন্য তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেন। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ তখন মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ কমাতে ভূমিকা রাখেন। ৯/১১ হামলার পরপরই তিনি ওয়াশিংটনের একটি ইসলামিক সেন্টার পরিদর্শন করে ঘোষণা দেন যে, মুসলমানদের প্রতি কোনো প্রতিহিংসামূলক কাজ করা যাবে না। তিনি বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম।
কন্ডোলিৎসা রাইস ও কলিন পাওয়েলের মতো শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও এ বার্তাকে বারবার তুলে ধরেন। ইরাক আক্রমণ ও যুদ্ধে সেখানে হাজার হাজার মুসলমানের মৃত্যুর কারণে আমেরিকার মুসলমানদের মধ্যে বুশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হতে পারে। কিন্তু তারপরেও সেখানে মুসলিম বিদ্বেষের লাগাম টেনে ধরার কৃতিত্ব অনেক মুসলিম বুদ্ধিজীবীই ওবামাকে দেবেন। প্যাটেল বলেন, “নিজের দেশের মধ্যে মুসলমানদের সমর্থনে ওবামা খুব শক্ত অবস্থান নিতেন। ” বুশ ওসামা বিন লাদেনের অনুসারী জঙ্গি মুসলমানদের সঙ্গে শান্তিপ্রিয় সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমানদের আলাদা করে দেখতেন।
বুশের পর ওবামাও এখন এ নীতিই অনুসরণ করছেন। বুশ অবশ্য পার্ক৫১ নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। কিন্তু তার মেয়াদের শেষদিকে কিছু রিপাবলিকান গ্রুপ হোয়াইট হাউসের নির্দেশনার বাইরে চলে যান। ২০০৭ সালে পিউ রিসার্চ সেন্টারের ‘মুসলিম আমেরিকান’ প্রতিবেনটি প্রকাশের মাধ্যমে সেখানকার সাধারণ জনগণের সঙ্গে মুসলমানদের বিভাজন আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে জরিপে আমেরিকায় মুসলমানদের সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ২৩ লাখ ৫০ হাজার।
এটাই প্রথম প্রকাশিত সুনির্দিষ্ট মুসলমানের সংখ্যা যা আগের সব হিসাবের চেয়ে অনেক কম। আগের সব হিসেবে মুসলমানদের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়, ৬০ লাখ থেকে ৮০ লাখের মধ্যে। মুসলমানদের সংখ্যা কমে যাওয়া এ হিসাব প্রকাশের ফলে সেখানে মুসলিম সম্প্রদায় রাজনৈতিক আক্রমণের মুখে অনেক বেশি অসহায় বোধ করছে। ওয়েন স্টেটস খান বলেন, “এটা মানুষের কাছে এ বার্তা দেয় যে, মুসলমানরা একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী এবং তাদেরকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। ” তারপর ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় ওবামাকে মুসলমানদের একজন ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা শুরু হয়।
আর তাতে রাজনৈতিক মঞ্চে আসে ইসলাম বিরোধী প্রচারণা। তবে স্মরণ রাখা দরকার যে, টাইমসের জনমত জরিপ অনুযায়ী আমেরিকার এক চতুথাংশ মানুষ এখনো মনে করেন যে, ওবামা একজন মুসলমান। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ইসলামিক বিশ্বের চোখে আমেরিকার ভাবমূর্তি উন্নত করার বিষয়টিকে ওবামা খুব গুরুত্বের সঙ্গে নেন। তবে আমেরিকান মুসলমানদের প্রতি তার মনোভাব অনেক শান্ত থাকে।
ওবামা এখনো যুক্তরাষ্ট্রের একটি মসজিদও পরিদর্শন করেননি।
গত দুই বছরে সেখানে মুসলমানদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি আরো খারাপ হয়েছে। আর এর পিছনে সম্ভবত আমেরিকান মুসলমানদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম দায়ী। ফোর্ট হুডে গুলি করে মেজর নিদালের মার্কিন সেনা হত্যা এবং নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে শাহজাদ ফয়সালের বোমা হামলার চেষ্টা ইত্যাদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সেখানে মুসলমানদের ভাবমূর্তি মানুষের কাছে আরো ভয়ানক করে তুলেছে। ডিয়ারবর্নে ইরাকি অভিবাসী সামি জানান, টাইমস স্কয়ারের ঘটনার পর তিনি প্রতিবেশীদের আচরণে পরিবর্তন লক্ষ করেন। তিনি বলেন, “দু’দিন পর আমি গাড়িতে কিছু ব্যাগ তুলছিলাম।
তখন একজন লোক এসে আমার কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে দেখলো। আমি তার দৃষ্টি দেখেছিলাম এবং আমি বুঝেছিলাম তিনি কি ভাবছিলেন। ”
এখন মূল বিষয় হচ্ছে, মসজিদ প্রকল্পের বিরোধিতা এবং মুসলমানরা যেভাবে রাজনীতিকদের মনযোগের কেন্দ্রে চলে এসেছেন তাতে সেখানে মূলধারার সঙ্গে ইসলাম ভীতি স্থায়ীভাবে দানা বাধে কিনা সে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইফতিখার বলেন, “এটা একটা স্থায়ী রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হতে পারে। ” ওদিকে, বিষয়গুলোতে মুসলমান সম্প্রদায় হা-হুতাশ করা ছাড়া তেমন কিছু করতে পারেনি।
সেখানকার মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেও ঐক্য নেই। এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, শুধু ধর্ম ছাড়া বর্ণ, ভাষা ও অন্য সব দিক দিয়ে পৃথক মানুষের মধ্যে ঐক্য খুব কঠিন। তাছাড়া আমেরিকার মুসলিম সম্প্রদায়ের কোনো নেতাও নেই।
ওদিকে, উদ্বিগ্নতার কারণে বাড়তে থাকা ইসলামের প্রতি অসন্তোষের ফলে মুসলমানদের মধ্যে বিশেষত তরুণদের মধ্যে সংগঠিত হওয়ার উৎসাহ হারিয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে বাড়ছে বিচ্ছিন্নতা বোধ।
এ সম্পর্কে ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুসা বলেন, “যখন আপনি দেখবেন একজন শীর্ষ রাজনীতিক ইসলামকে নাৎসীবাদের সঙ্গে তুলনা করছেন তখন আপনি কল্পনা করতে পারবেন যে, ভার্জিনিয়ার ১৭ বছরের এক মুসলমান তরুণ ভাবছে, হায় আল্লাহ! ঐ মানুষগুলো পুরোপুরি আমার ধর্ম বিরোধী। ” ইফতিখার মনে করেন, মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় সুযোগ হচ্ছে, আমেরিকার মানুষের বিবেকের কাছে ন্যায় বিচারের আবেদন করা।
এ আবেদন কাজে লাগতে পারে। উইলসনে নগর নির্বাহী পরিষদ মির্জার পক্ষে কাজ করেছে এবং শেবোগানের ইসলামিক সম্প্রদায় তার জমিতে মসজিদ নির্মাণ করেছে। মুসলিম সম্প্রদায় সেখানে ইতোমধ্যেই মোহাম্মদ হামাদকে তাদের ইমাম নির্বাচন করেছেন।
তবে সেখানে মুসলিম এবং অমুসলিমদের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠার বিষয়টি একটি ট্রাজেডির মধ্য দিয়ে হয়েছে। গত জুনে সোফিয়া খান নামের শিকাগোর এক মুসলমান বালিকা পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটানোর সময় ওস্টবার্গের কাছের লেক মিশিগান থেকে হারিয়ে যায়। তখন মসজিদ নির্মাণ পরিকল্পনার বিরোধিতাকারী গির্জার উপাসক নারী রিটা হার্মেলিং ইমামকে ডেকে এনে তাকে খান পরিবারের এ সমস্যা সমাধানের জন্য মন্ত্রির কাছে পাঠান। পরবর্তীতে বালিকাটিকে উদ্ধারের জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের ও উদ্ধারকর্মীদের সহায়তা করেন হার্মেলিং। অন্যরাও সে সময় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন।
সোফিয়ার মৃতদেহ পাওয়া গেলে মসজিদের পার্শ্ববর্তী বাড়ির মালিক তাদের বাড়ির আঙিনা মেয়েটির লাশ দাফনের জন্য ব্যবহারের প্রস্তাব দেন।
শেবোগান কাউন্টিতে মির্জা, হামাদ ও খান পরিবারের কারণে সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে মুসলমানসহ সবাই একটা সম্প্রদায়ের অংশ বলে মনোভাব বিকশিত হয়েছে। কিন্তু ইসলাম ও মুসলিম প্রসঙ্গ আসলে আমেরিকার একেবারে সজ্জনরাও সব সময় সহযোগিতার হাত বাড়ায় না।
পশ্চিমে মুসলমান ও মসজিদ
উপাত্ত আমেরিকা জার্মানি ফ্রান্স ব্রিটেন স্পেন কানাডা
মোট জনসংখ্যা ৩০ কোটি ৫৫ লাখ ৮ কোটি ২০ লাখ ৬ কোটি ৫০ লাখ ৬ কোটি ২০ লাখ ৪ কোটি ৬০ লাখ ৩ কোটি৪০ লাখ
মুসলমানের সংখ্যা ২৫ লাখ ৩২ থেকে ৩৪ লাখ ৫৫ লাখ ২৪ লাখ ৮ থেকে ১০ লাখ ১০ লাখ
মসজিদের সংখ্যা ১ হাজার ৯০০ ২ হাজার ৬০০ ২ হাজার ১০০ ১ হাজার ৫০০ ৪ শ’ ৫৪ ১ শ’ ৯৮
১৬৫৪
পিটার স্টিভেসান্ট,
ডাইরেক্টর জেনারেল অব নিউ নেদারল্যান্ড,
ইহুদিদের দেশ থেকে বিতাড়নের চেষ্টা করেন। ইহুদিদের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ ছিলো তারা উপনিবেশ ধ্বংস করবে।
১৭৩২
জর্জিয়া উপনিবেশের প্রতিষ্ঠাতা
জর্জিয়াকে ধর্মীয় স্বর্গরাজ্য করতে
ক্যাথোলিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
১৮৪৪
মর্মন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা জোসেফ স্মিথকে ইলিনয়ের এক কারাগারে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়।
তার বহু অনুসারী পরে উথাহ স্টেট-এ চলে যান।
১৮৫৪-৫৬
নোনাথিং পার্টির স্বদেশীরা অভিবাসনের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। বিশেষত ক্যাথোলিক দেশ থেকে আসা মানুষের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
১৮৮২
ক্যালিফোর্নিয়ায় চীন বিরোধী কঠোর মনোভাবের কারণে কেন্দ্রীয় সরকার ‘চাইনিজ এক্সক্লুশন অ্যাক্ট’ পাস করে। এ আইনে চীনা শ্রমিকদের অভিবাসন নিষিদ্ধ করা হয়।
১৮৮৩
ন্যাটিভ আমেরিকানদের ধর্মীয় আচার পালনকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেজন্য ৩০ বছর পর্যন্ত সাজা দেওয়ার আইন করা হয়।
১৯১৫
ইহুদিবাদ ও ক্যাথোলিকদের বিরুদ্ধে কু ক্লাক্স ক্লানদের (নাইট পার্টি) আবির্ভাব ঘটে।
সারা দেশে তাদের ৪০ লাখের বেশি সমর্থক হয়।
১৯২৮
নিউ ইয়র্কের গভর্নর আল স্মিথ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হন। ১৯৬০ সালে জেএফকের আগে কোনো ক্যাথোলিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন না।
১৯৩৮
২০ নভেম্বর ক্যাথোলিক যাজক ফাদার চার্লস কফলিন বেতারে ইহুদিবাদ বিরোধী বক্তব্য দেন। সেখানে তিনি নাৎসী সহিংসতাকে সমর্থন করেন।
১৯৪২
ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ‘এক্সক্লুশন জোনস’ আইনে সই করেন। এতে ১ লাখ ২০ হাজার জাপানি ও জাপানিজ-আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে আটকা পড়েন।
১৯৭০
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তরুণরা নানা ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্য হয়। যেমন, দ্য ইউনিফিকেশন চার্চ, দ্য চিলড্রেন অব গড এবং দ্য হরে কৃষ্ণা ইত্যাদি।
টাইমের জনমত জরিপ
মসজিদ, মুসলমান এবং আমেরিকায় ইসলাম সমন্ধে চিন্তাভাবনা
আপনি কি মনে করেন অধিকাংশ আমেরিকান মুসলমান দেশপ্রেমিক আমেরিকান
৫৫ শতাংশ ২৫ শতাংশ ২১ শতাংশ
হ্যা না জানি না/ কোনো উত্তর নেই
আপনি কি মনে করেন, অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় অন্য ধর্মের চেয়ে ইসলাম বেশি উৎসাহিত করে?
৪৬ শতাংশ ৬ শতাংশ ৩৯ শতাংশ ১০ শতাংশ
বেশি বলে মনে করে কম বলে মনে করে অন্য ধর্মগুলোর সমান মনে করে জানি না/উত্তর নেই
গ্রাউন্ড জিরোর কাছে মসজিদ নির্মাণ আপনি কি সমর্থন বা বিরোধিতা করেন?
২৬ শতাংশ ৬১ শতাংশ ১৩ শতাংশ
সমর্থন করে বিরোধিতা করে কোনো উত্তর নেই/জানি না
আপনি বাড়ির কাছাকাছি মসজিদ নির্মাণ সমর্থন বা বিরোধিতা করেন?
৫৫ শতাংশ ৩৪ শতাংশ ১০ শতাংশ
সমর্থন করে বিরোধিতা করে কোনো উত্তর নেই/ জানি না
আপনি কি মনে করেন প্রেসিডেন্ট ওবামা মুসলমান বা খ্রিস্টান?
২৪ শতাংশ ৪৭ শতাংশ ২৪ শতাংশ ৫ শতাংশ
মুসলিম খ্রিস্টান কোনো উত্তর নেই/জানি না অন্যান্য
(১৬-১৭ অগাস্ট সারা আমেরিকা জুড়ে ১৮ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সের ১ হাজার ২ জন মানুষের কাছ থেকে টেলিফোনে মতামত নিয়ে টাইম পত্রিকার এ জনমত জরিপটি করা হয়েছে।
)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।