আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সামরিক আইন জারির পথ রুদ্ধ হয়েছে পঁচিশ বছর আগেই ----সুনীল শুভরায়

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, সাবেক ফল রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও জাতীয় পার্টি

সামরিক আইন জারির পথ রুদ্ধ হয়েছে পঁচিশ বছর আগেই ----সুনীল শুভরায় আমাদের দেশে মাঝে মধ্যেই এক একটা ইস্যু নিয়ে ঢেউ সৃষ্টি হয়। তারপর কিছুদিন সেই ঢেউ চলতে থাকে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো আউটপুট ছাড়াই বিষয়টা অন্তরালে চলে যায়। কিছু দিন আগে ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গ। এ বিষয়টা অবশ্য ধামাচাপা পড়েনি, সংবিধানের সংশোধনী প্রসঙ্গের নিচে পড়েছে। যুদ্ধাপরাধী ধরা নিয়ে দেশজুড়ে গরম আলোচনা চলেছে বেশ কিছুদিন।

যুদ্ধাপরাধী বা স্বাধীনতা বিরোধী বলতে একবাক্যে জামাতকেই বোঝায়। এই জামাতের রয়েছে অর্থবল, অস্ত্রবল এবং ক্যাডারবল- এমন একটা ভীতি ছিল। জামাত-বাঘের লেজে টান দিলে দেশ তামা বানিয়ে ফেলবে, এরকমই ছিল একটা আতঙ্ক। কিন্তু বাঘ যখন বনে থাকে, তখনই সে ভীতিকর বাঘ, আর খাঁচায় ঢুকানো হলে সে বিড়াল। জামাতের শীর্ষ নেতাদের ধরে চৌদ্দশিকার মধ্যে ঢুকানোর পর সেটাই আবার প্রমাণ হলো।

কিছু দিন “ভয়ঙ্কর ক্যাডার” হিসেবে পরিচিত শিবির বাহিনী দেশকে তামা বানানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু জনগণের প্রতিরোধ এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ডান্ডা পিটুনিতে তারা এখন গা-ঢাকা দিয়েছে। অবশ্য এদের এক নেতা আতঙ্কটা বাঁচিয়ে রাখার জন্য বলেছে, “ফোর্স রেডি আছে, সময় মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে। ” তবে গোটা বিষয়টি এখন চাপা অবস্থায় আছে। আর এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে- “সংবিধান সংশোধন, সংশোধনী বাতিল এবং সুপ্রিম কোর্টের রায় প্রসঙ্গ।

” এই চলমান ঢেউ গোনার কাজে একটু অংশগ্রহণ না করেও পারছি না। আসলে হুজুগে রোগ তো আমাদের আছেই। হতাশা, ব্যর্থতা আমাদের নিত্যসঙ্গী। তাই কোনো একটা ইস্যু সৃষ্টি হলেই ভেবে বসি- এটার সমাধানেই বুঝি আমাদের বড় একটা অর্জন হয়ে যাবে। এখন যেহেতু সংবিধানের ঢেউ, তাই সেই ঢেউয়েই গা ভাসিয়ে দিয়েছি।

সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী উচ্চ আদালতের রায়ে বাতিল হয়েছে। আবার অনেকে অপেক্ষা করছেন, সপ্তম সংশোধনীও বাতিল হওয়ার দৃশ্য দেখার জন্য। বাতিল হলে কার কি হতে পারে, তা ভেবেও সুখবোধ করা হচ্ছে। এখন যদি আদালতের রায় বাস্তবায়িত করা হয়, মনে হচ্ছে তাহলেই যেনো আমাদের সব জাতীয় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলেন, তখনকার ঢেউ দেখেও মনে হয়েছিল, দেশে এবার দুধের নহর বয়ে যাবে।

কিন্তু বাস্তবে কিসের নহর বয়েছে, তা এদেশের মানুষ হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছে। এখন যে সংবিধানকে আদালত থেকে “পিউরিফাই” করে জাতির কাছে নতুনভাবে উপহার দেয়ার প্রচেষ্টা চলছে অতীতে এই সংবিধানকে সংরক্ষণ করার জন্য কে বেশি সচেষ্ট ছিলেন, তা কি কখনো ভেবে দেখা হয়েছে? নব্বই-এর অর্ধদশক জুড়েই তো চলেছে ‘এরশাদ-বিরোধী’ আন্দোলন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে- দাবি ছিল এই একটাই। এই এক দফা দাবিতেই চলেছে তথাকথিত গণআন্দোলন। এইচ এম এরশাদও দাবি মানতে রাজি হলেন।

কিন্তু কীভাবে ক্ষমতা ছাড়বেন, তার কোনো প্রস্তাব নেই। ক্ষমতা তো আর মাথায় বয়ে বেড়ানো বোঝা নয় যে, নামিয়ে রেখে হাঁটা দিলেই ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাওয়া হলো। অতপর বাংলাদেশের ইতিহাসে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদই প্রথম সংবিধানকে সম্মুন্নত রেখে সাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। তার পূর্বে যারা রাষ্ট্রমতায় ছিলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, তারা কেউ সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা ছাড়তে পারেননি। এইচ এম এরশাদের আগে বিয়োগান্তক, মর্মান্তিক কিংবা অসাংবিধানিক সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সাংবিধানিক পন্থায় একজন ভাইস প্রেসিডেন্টের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে আর একজন ভাইস প্রেসিডেন্টকে শপথ পড়িয়ে তার হাতেই পদত্যাগপত্র দিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু আন্দোলন করা রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা গ্রহণ করানোর লক্ষ্যে যাকে মনোনীত করেছিল, সেই ব্যক্তিটি তো তখন সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করার জন্য উপযুক্ত ছিলেন না। কারণ ওই ব্যক্তিটি তখন ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। তিনি রাষ্ট্রপতি এরশাদের কাছেই শপথ নিয়ে ওই পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সেই পদ থেকে পদত্যাগ না করে, একটি শপথ মাথায় রেখে তিনি আর একবার শপথ নিয়েছেন।

তর্কের স্বার্থে যদি ধরেও নেই যে, একটি শপথ নেওয়ার সাথে সাথে আগেকার শপথ বাতিল হয়ে গেছে, তাহলে দ্বিতীয়বার প্রধান বিচারপতির পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য তো তাকে শপথ গ্রহণ করতে হতো। তাতো করা হয়নি। আর এই কাজগুলো অবৈধ ছিলো বলেই তো সংবিধান সংশোধন করতে হয়েছে। সুতরাং এটা হিসেবের কথা হয়ে যায় যে, অবৈধভাবে ক্ষমতা গ্রহণের জন্য যদি কাউকে দায়ী করা হয়- তার জন্য ওই বিচারপতিকেও আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। সংবিধানের সংশোধনী বাতিলের যে ধুয়া উঠছে, তাতে ৫ নম্বর ৭ নম্বরের পর ১৪ নম্বর বাতিলেরও প্রসঙ্গ আসতে পারে।

আর সেটা বাতিল হলে ১৯৯১-এর নির্বাচন এবং সরকারও অবৈধ হয়ে যায়। আমি মনে করি, এসব বৈধ অবৈধ বিশ্লেষণ করা এখন অর্থহীন। কিন্তু এই বিতর্ক যখন এসেই গেছে, তখন হিসাবের কথা তো বলতেই হবে। যেমন, প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার ব্যবস্থায় তখন সংসদ ভেঙ্গে দেওয়ার মতা সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির ছিল। তবে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলেই সংসদ ভেঙ্গে যায় না।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যখন পদত্যাগ করেছিলেন তখন দেশে একটি নির্বাচিত সংসদ এবং তার মন্ত্রিপরিষদ ছিল। রাষ্ট্রপতি এরশাদ পদত্যাগের আগে তার মন্ত্রিপরিষদ এবং সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে যাননি। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন অ্যাকটিং প্রেসিডেন্ট হিসেবেও তৎকালীন পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেননি। তৎকালীন সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতিকে পার্লামেন্ট ও মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে একটি অন্তবর্তীকালীন মন্ত্রিসভা নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপরিচালনা করতে হতো। কিন্তু সেটা কি করা হয়েছে? এসব কি সংবিধান লঙ্ঘন নয়? এখন সংবিধানের সংশোধনী বাতিল করে ওই অসাংবিধানিক কাজগুলো যদি পুনরুজ্জিবিত দেখানো হয়, তাহলে তার ধারাবাহিকতায় তো সবকিছুই অবৈধ হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করাও অবৈধ হয়ে যাবে। জানি, এসব এখন অবান্তর কথা। কিন্তু পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করায় অন্য সংশোধনীকেও যদি তার আওতায় আনার কথা বলা হয়, তাহলে হিসাব মতো এসব কথা তো এসে যাবেই। কারণ আইন তো সবার জন্যই সমান। তারপর ২০০৭ সালে নির্দিষ্ট সময় ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতারইবা কী হবে? ওই সময়ের নির্বাচন ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ায় বিএনপির ক্ষমতায় ফিরে আসার সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে।

কিন্তু তারা কি জানে না যে, অসাংবিধানিকভাবে নতুন আর একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছে এবং তাদের কর্মকাণ্ড এখনো বৈধ করে নেয়া হয়নি। বিএনপি হলো ব্যারিস্টার নেতাসমৃদ্ধ একটি দল। তারা কী সংবিধান লঙ্ঘনের একটি মামলা করতে পারেন না? নিশ্চয় পারেন। কিন্তু সময় এখন তাদের জন্য উপযুক্ত নয়। তাই সময়ের অপেক্ষায় নিশ্চুপ থাকাই শ্রেয়।

ত্রিশ বছর পর যদি পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মামলা হতে পারে, তাহলে সুযোগ ও সময় মতো ওয়ান-ইলেভেনের সংবিধান বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও মামলা হতে পারে। সুতরাং আর কোনো সংশোধনী বাতিলের ধুম্রজাল সৃষ্টি না করে বরং পঞ্চদশ সংশোধনী আনার মাধ্যমে ভবিষ্যতের পথ মশৃণ রাখার ব্যবস্থা করাই শ্রেয়। আদালতে ভিন্ন প্রসঙ্গের একটি মামলায় সংবিধানের সংশোধনীর প্রসঙ্গ জড়িত হয়েছে। সে ব্যাপারে আইনের ফর্মুলায় যা হওয়ার আদালত সেই রায়ই দিয়েছেন। তা বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া সংসদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়।

কারণ আইন প্রণয়ন ও সংশোধনের দায়িত্ব সংসদের- আদালতের নয়। এ ক্ষেত্রে আদালতের চেয়ে সংসদই বেশি ক্ষমতাবান। উচ্চ আদালত পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। সেটা দেখে কেউ কেউ সপ্তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষিত হবে বিবেচনা করে ঘর পুড়ে আলু পোড়া খাওয়ার খোয়াব দেখতে শুরু করেছেন। কিন্তু তারা পঞ্চম সংশোধনীর কতটুকু অবৈধ হয়েছে, তা কি খতিয়ে দেখেছেন? রায় অনুসারে মানলাম, পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ।

কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অবৈধ পঞ্চম সংশোধনীর মধ্যে যে বৈধ চতুর্থ সংশোধনীকে বাতিল করার বিধান ছিল- সেটাকেই তো বৈধতা দেয়া হয়েছে। তা না হলে তো আবার একদলীয় ব্যবস্থা কায়েম হয়ে যায়। সুতরাং যে সংশোধনীর মধ্যে কিছু বৈধ আর কিছু অবৈধ থাকে, তাকে তো সম্পূর্ণ অবৈধ বলা যাবে না। সংবিধান সুপ্রিম কোর্টকে সংবিধান-পরিপন্থি কিংবা সংবিধানের মূলনীতি উপেক্ষিত কোনো সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার ক্ষমতা দিয়েছে। পঞ্চম সংশোধনীতে মূল নীতির পরিপন্থি ধারা রয়েছে বলে তার একটি অংশ অবৈধ ঘোষিত হয়েছে, আবার বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়ার প্রসঙ্গটি প্রসংশিত হয়েছে।

একইভাবে হুসেইন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত সংশোধনী এককেন্দ্রীক সরকার ব্যবস্থায় সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থি বিবেচনায় সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করেছিলেন। তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার তা মেনে নিয়েছেন। অবশ্য তখনও সংসদের এখতিয়ার ছিল, এ ব্যাপারে আইন পাস করে নেওয়ার। কারণ সে এখতিয়ার সংসদেও আছে। প্রতিবেশী ভারতে একটি আলোচিত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় অকার্যকর করার জন্য পার্লামেন্টে আইন প্রণয়ন করার দৃষ্টান্ত আছে।

সেটা ছিল বহুল আলোচিত শাহবানু মামলার রায়। ওই রায় অকার্যকর করতে ভারতের পার্লামেন্ট মুসলিম ওমেন অ্যাক্ট প্রণয়ন করেছিল। যাহোক, আমাদের সংবিধানে যেসব সংশোধনী যুক্ত আছে, তার মধ্যে পঞ্চম সংশোধনীর সাথে সপ্তম বা অন্য সংশোধনীর মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। মহামান্য উচ্চ আদালত পঞ্চম সংশোধনীর যেটুকুতে হাত দেয়া যায়- সে পর্যন্তই গেছেন। সপ্তমসহ অন্য যে কোনো সংশোধনীতে হাত দেয়া হলে শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে বড় বিপর্যয় নেমে আসবে।

সংবিধান কোনো ধর্মগ্রন্থ নয় যে, এটা পরিবর্তন করা যাবে না। এটা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য মানব-সৃষ্ট নিয়ম-নীতির দলিল। এটা এমন পবিত্র কিছু নয় যে, এর ধারা পাঠ করে পূণ্য অর্জন করা যাবে। আবার অপবিত্রও নয় যে, এটাকে অবজ্ঞা করা যাবে। সংবিধানকে মান্য করে চলতে হবে- এটাই বিধান।

এই বিধান দেশ ও মানুষের জন্য। তাই দেশ ও জনগণের স্বার্থেই যুগ ও প্রয়োজনের তাগিদেই এর পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। ১৯৭২ সালে যখন সংবিধান প্রণীত হয়েছিল, তখন দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতি বর্তমান সময়ের মত ছিল না। তখন দেশের লোক সংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। আর এখন ষোল কোটিরও ওপরে।

বর্তমান সময়ের প্রয়োজনীয় সংবিধান ৩৮ বছর পেছনে নিয়ে গেলে তা দিয়ে দেশ পরিচালনা কতটুকু সম্ভব হবে তা বাস্তবতাই বলতে পারে। তবে এই সময়ের প্রয়োজনীয়তায় বলতে পারি, বিদ্যমান সংবিধানকে যাদুঘরে রেখে দিয়ে নতুন করেই এককেন্দ্রীক সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে ফেডারেল পদ্ধতি সম্মলিত সংবিধান প্রণয়ন করা দরকার। সেখানে ১৯৭২-এর সংবিধানের চেতনা ও ভাবাদর্শের সমন্বয় ঘটানো যেতে পারে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত রায়ের পর এমন কথাও বলা হয়েছে যে, সংবিধান সংশোধন হয়েই গেছে। ধর্মনিরপেক্ষতাও কার্যকর হয়ে গেছে।

ফলে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এখন নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। এসব প্রচার করে মূলত একটি ধুম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা থাকলেও তার সাথে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কোনো সংঘাত থাকতে পারে না। ’৭২-এর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে একটি মূলনীতির মধ্যে রাখা হয়েছিল। তখনও কিন্তু ভারতের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযুক্ত ছিল না।

ভারতীয় সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ১৯৭৬ সালে। কিন্তু সেই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতেও বিজেপি, আরএসএস, জামায়াতে উলামায়ে ইসলাম, শিবসেনার মতো ধর্মভিত্তিক দল রয়েছে। অথচ বলা হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। আলোচিত এই মামলার রায়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হচ্ছে যে, এখানে বলা হয়ছে, ‘কোনো ভাবেই সামরিক আইন জারি এবং সংবিধান স্থগিত করা যাবে না। ” এখানে যাবে না বলতে নিশ্চিত যে, আগামীতে এই কাজ করা যাবে না।

কিন্তু কথা হচ্ছে, এটা কি অতীতেও করার বিধান ছিল? অবশ্যই নয়। সংবিধানের কোথাও উল্লেখ নেই যে, কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতেও সামরিক আইন জারি বা সংবিধান স্থগিত করা যাবে। কখনো কোনো সামরিক আইন অন্তত: আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তো বটেই, ইচ্ছা করলেই আসতে পারে না বা আসেওনি। এটা এসেছে শাসকদের ব্যর্থতার ফলে। তবে ’৭৫-এর ঘটনা ভিন্ন।

যদি সঠিকভাবে গণতন্ত্রের চর্চা হয়, তাহলে সামরিক আইন জারির সুযোগ কখনোই আসতে পারে না। সামরিক আইন কি কখনো কোনো আইন বা সংবিধানের মাধ্যমে জারি হয়? তবে আমাদের দেশে আর কোনো আইন করে নয়- সামরিক আইন জারির পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে পঁচিশ বছর আগেই। আর এই পথ রুদ্ধ করে দিয়েছেন- হুসেইন মুহম্মদ এরশাদই। তাঁর কথাটি কারো মনে আছে কি-না জানি না। তিনি ক্ষমতায় থাকাকালেই বলেছিলেন, “এই দেশে আর কখনো সামরিক আইন আসবে না।

সে সুযোগ আর থাকবে না। ” এ কথার যথার্থতা কী সে প্রসঙ্গেই ফিরে আসি। যদি সামরিক আইন আসার সুযোগ থাকত, তাহলে ওয়ান-ইলেভেনে দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়ে জেনারেল মঈন ক্ষমতাগ্রহণের লোভ ছাড়তে পারতেন না। তাকে একটি বেসামরিক সরকারের অধীনে থেকেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে নিজ কর্মস্থলে ফিরে যেতে হয়েছে। আমি অন্য এক নিবন্ধে বলেছি, সেনাপ্রধান হলেই তিনি যা ইচ্ছা তা করতে পারেন না।

এখন আর সামরিক আইন জারির সুযোগ নেই এই কারণে যে, সাধারণ জওয়ান বা সেনা কর্মকর্তারা কোনোভাবেই এই পথে যেতে চান না। এই ব্যবস্থাই করে দিয়েছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। কারণ তিনি এই দেশ থেকে জাতিসংঘের শান্তিরী বাহিনীতে সৈনিক প্রেরণ করেছিলেন। তার সেই প্রদর্শিত পথ ধরে এখনো শান্তিরী বাহিনীতে বিপুল সংখ্যক সৈনিক নিয়োজিত আছেন। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশের সৈনিক এবং সেনা কর্মকর্তা এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

সেনাবাহিনীর সদস্যরা পর্যায়ক্রমে শান্তি মিশনে যোগদানের সুযোগ পাচ্ছেন। তারা দেশে যে বেতন পান তারচেয়ে বহুগুণ বেতন পান শান্তি মিশনে। কিন্তু জাতিসংঘ যে কোনা দেশ থেকে তাদের মিশনে সৈনিক অন্তর্ভুক্ত করে না। যে দেশে সামরিক শাসন রয়েছে, সে দেশের বাহিনী শান্তি মিশনে যোগদানের সুযোগ পায় না। তাই বাংলাদেশে যদি কোনো কারণে বেসামরিক সরকার না থাকে বা সামরিক আইন জারি হয়, তাহলে শান্তি মিশনের জওয়ান ও অফিসারদের দেশে ফিরে আসতে হবে।

আর দেশ থেকেও কেউ মিশনে যোগদানের সুযোগ পাবে না। ফলে কারো সাধ থাকলেও কোনো অবস্থাতেই আর সাধ্য হবে না সামরিক আইন জারির কথা চিন্তা করারও। এখন বেনামী সামরিক শাসনের পথ যেটা মঈন-ফকরুদ্দিনরা দেখিয়ে গেছেন, সেটা রুদ্ধ করতে হলে- অতীতের বৈধতা-অবৈধতা ঘাঁটাঘাঁটি না করে যথার্থভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় রাখতে হবে। লেখক: সুনীল শুভ রায়, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.