প্রশ্ন করেই যাব অবিরত
Dan Barker আমেরিকার মুক্তচিন্তা এবং সেক্যুলার আন্দোলনের অত্যন্ত পরিচিত মুখ। তিনি Freedom From Religion Foundation -এর Public Relation Director । একসময়কার খ্রিস্টান মিশনারিজের সদস্য (দীর্ঘ উনিশ বছর খ্রিস্টধর্ম প্রচারের কাজে নিয়োজিত), পরবর্তীতে অনেক ঘটনাবহুল পথ অতিক্রম করে মুক্তচিন্তা আর যুক্তির পতাকাতলে সহযাত্রী। তাঁর লেখা Losing Faith in Faith: From Preacher to Atheist গ্রন্থের পাতায় পাতায় সেই দুঃসাহসিক অভিযাত্রার কথাই বর্ণিত হয়েছে, জয়ধ্বনি করেছেন মানবতাবাদের।
ড্যান বার্কার
আলোচ্য প্রবন্ধটি Dan Barker -এর Losing Faith in Faith: From Preacher to Atheist (FFRF, Inc. Wisconsin, USA, 2003) গ্রন্থ থেকে অনুমতিক্রমে “Refuting God” পরিচ্ছেদের অনুবাদ।
উল্লেখ্য “Refuting God” পরিচ্ছেদটি লেখকের গোটা বইটিরই সারসংক্ষেপ। সংঙ্গতকারণেই এই পরিচ্ছেদে অনেক আলোচনা সংক্ষিপ্তাকারে বলা হয়েছে; এবং লেখক অন্য পরিচ্ছেদগুলিতে বিস্তৃত পরিসরে পেশ করেছেন। কিন্তু আলোচ্য প্রবন্ধটিকে পাঠকদের কাছে সহজবোধ্য-বোধগম্য করার জন্য প্রথম বন্ধনীর ভিতরে নিজস্ব মন্তব্য ও ব্যাখ্যা যোগ করা হয়েছে।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
ঈশ্বরবাদীরা বা আস্তিকরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব দাবি করেন। নাস্তিকরা তা করেন না।
ধর্মবাদীরা প্রায়ই নাস্তিকদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ে দেন ‘ঈশ্বর নেই’- প্রমাণ করার জন্য; কিন্তু এটা আলোচনার বিষয়বস্তুর বাইরে চলে যায়। নাস্তিকরা দাবি করেন ঈশ্বরের আস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না, তারা বলেন না যে ‘ঈশ্বরের অস্তিত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। ’ (যা প্রমাণিত-ই হয় নাই তাকে মিথ্যা প্রমাণের প্রয়োজন নেই, তা যে ‘প্রমাণিত নয়’ তা-ই এর অগ্রহণযোগ্যতার জন্য যথেষ্ট)। আর যে কোনো বিতর্কে “Burden of Proof” বা প্রমাণের দায়িত্ব এর নিয়মানুসারে যিনি কোনো কিছুর অস্তিত্ব দাবি করেন, প্রমাণের দায়িত্ব তার উপরই বর্তায়। (এবং কোন কিছুর অস্তিত্ব প্রমাণের পরই কেউ এর অনস্তিত্ব প্রমাণের জন্য চ্যালেঞ্জ করার অধিকার রাখেন)।
একজন লোক যদি দাবি করেন তিনি antigravity device বা অভিকর্ষ-বিরোধী যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন তবে ‘এর অস্তিত্ব বাস্তবে অসম্ভব’- তা প্রমাণের দায়িত্ব অন্য কারো উপর পড়ে না। (দাবিকারক নিজে যদি প্রথমে বিষয়টিকে প্রমাণ করতে না পারেন তবে তা-ই একে অগ্রহণযোগ্য করে তোলে)।
কিছু নাস্তিক বা নিরীশ্বরবাদী মনে করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ‘ঈশ্বর’ বিষয়টি প্রমাণিত বা বোধগম্য না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ নিয়ে বিতর্কের কোনো মানে হয় না। ‘আত্মা’ এবং ‘অতিপ্রাকৃত’ এগুলোর মত বিষয়গুলো বাস্তবে অর্থপূর্ণ কিছুই প্রকাশ করে না, এবং ‘সর্বজ্ঞানী’ ও ‘সর্বশক্তিমান’ ধারণাদ্বয় পরস্পরবিরোধী (অমূলক); কেন অর্থহীন বিষয় নিয়ে আলোচনা।
তথাপি আস্তিকতামূলক যুক্তি ও প্রমাণের উপর ভিত্তি করে অনেক লিখিত-অলিখিত বক্তব্য পাওয়া যায়।
নিন্মোক্ত বর্ণনায় ঐগুলোকে সংক্ষেপে উপস্থাপনপূর্বক খণ্ডন করা হয়েছে। নাস্তিকতা হল একটি নির্দিষ্ট অবস্থান যেখানে এ ধরনের আস্তিকতামূলক দাবি নাকচ হয়ে যায়।
ঐশ্বরিক পরিকল্পনা
“এগুলো সব কোথা থেকে এসেছে? আপনি কিভাবে মহাবিশ্বের এ জটিলতা ব্যাখ্যা করবেন? আমি বিশ্বাস করি না প্রকৃতির সৌন্দর্য শুধুমাত্র দুর্ঘটনার মাধ্যমে হতে পারে। শিল্পকর্মের জন্য একজন শিল্পীর প্রয়োজন। ”
এ ধরনের উক্তি থেকে অনুমান করা যায় বক্তা কী প্রমাণ করতে চাচ্ছেন।
কোনো কিছু প্রমাণের জন্য এর চেয়ে উচ্চতর সঙ্গতিপূর্ণ ‘বর্ণনা প্রসঙ্গ’ আনলে উক্ত বিষয়টি বোধগম্য হতে পারে; একটি মহাবিশ্বের ব্যাখ্যার জন্য একটি ‘উচ্চতর মহাবিশ্ব’ প্রয়োজন। কিন্তু মহাবিশ্ব হল সবকিছুর মিলিত রূপ যার চেয়ে উচ্চতর কিছু নাই। আর সমস্যার বিষয় হল, মহাবিশ্বের জন্য যদি একজন স্রষ্টা প্রয়োজন হয় তবে স্রষ্টার জন্যও অপর একজন স্রষ্টার প্রয়োজন হবে -যা এমনভাবে অনন্তকাল পর্যন্ত চলতে থাকবে। ঈশ্বরের মন অন্তত প্রকৃতির মত জটিল হতে হবে এবং তা কিছু প্রশ্নের উদ্রেক করে -যেহেতু যে কোনো জটিলতার জন্য একজন স্রষ্টা প্রয়োজন তাই ঈশ্বরের মন তথা ঈশ্বরেরও একজন স্রষ্টা প্রয়োজন। আর যদি ঈশ্বর অসৃষ্ট হতে পারেন তবে মহাবিশ্ব অসৃষ্ট হতে পারবে না কেন?
প্রকৃতিতে শিল্পকর্ম রয়েছে, কিন্তু যখন তা বলা হয় তখন আস্তিকরা বা ঈশ্বরবাদীরা ভিন্ন অর্থে এটি গ্রহণ করেন।
প্রকৃতিতে উপলব্ধ শিল্পকর্মের জন্য বুদ্ধিমান কিছুর অস্তিত্ব কল্পনা করার প্রয়োজন নেই। জীবন হল নির্জীব “Natural Selection” -এর ফসল; এর কোন উচ্চতর ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। (পৃথিবীর পরিবেশ জীবকূলের উৎপত্তি ও বিকাশের জন্য অত্যানুকূল হওয়ায় তা-ই ঘটেছে আবার কোন বিরূপ ঘটনায় তা সহজেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। প্রাণীকূলের উৎপত্তি, বিকাশ, ধ্বংস, বুদ্ধিমত্তা কোনোটাই চেতনাহীন প্রকৃতির কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। মানুষের বুদ্ধিমত্তা বা সভ্যতা নিজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, প্রকৃতির কাছে নয় -এটা স্মরণ রাখা প্রয়োজন।
আর মহাবিশ্বকে শৃঙ্খলাপূর্ণ বলা অজ্ঞতার পরিচায়ক। মহাবিশ্বে প্রচণ্ড বিশৃংখলা বিরাজমান আর এরকম বিশৃঙ্খলার মধ্যে কিছু শৃঙ্খলা এমনিতেই দেখা যেতে পারে যা ঐ বিশৃঙ্খলারই অংশ) ।
ঈশ্বরবাদী বা আস্তিকদের ‘শিল্পকর্ম বিতর্ক’টি দাঁড়িয়ে আছে অজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে, বাস্তবতার উপর নয়। প্রকৃতির কোনো জটিলতাকে ব্যাখ্যা করতে না পারার মানে এই নয় যে এর কোনো উত্তর নেই। হাজার বছর ধরে মানুষ বজ্র ও উর্বরতার রহস্য বর্ণনার জন্য পৌরাণিক বা কাল্পনিক ব্যাখ্যা তৈরি করেছে।
কিন্তু যত বেশি আমরা জানতে পারছি, ততই ঈশ্বরের প্রয়োজন কমে যাচ্ছে। (যেমন, ইদানীং ‘পানিচক্র’ ব্যাখ্যার জন্য এখন আর কেউ ঈশ্বরের শরণাপন্ন হন না)। ‘ঈশ্বর বিশ্বাস’ হলো একটি রহস্য ব্যাখ্যার জন্য আরেক রহস্যের অবতারণা, এবং তাতে কোনো রহস্যেরই সমাধান পাওয়া যায় না। (আমরা যদি প্রকৃতির কোনো ঘটনা না বুঝি তবে যথাযথ নিয়মানুসারে গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে অথবা অপেক্ষা করতে হবে, বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে কী বলেন। অবশ্য বিজ্ঞানীকেও বিজ্ঞানের নিয়মানুসারে গবেষণা ও তা ব্যাখ্যা করতে হবে।
যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো ঘটনার উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না পাওয়া যায় ততক্ষণই আমাদেরকে অপেক্ষায় থাকতে হবে, হতে পারে এ অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ আবার তা হতে পারে স্বল্প। কিন্তু পূর্বেই যদি কেউ ‘ঈশ্বর’ বা অনুরূপ কোনো অতিলৌকিক অনুকল্পের অবতারণা করে ব্যাখ্যা করতে চান তবে এই অতিলৌকিক অনুকল্পটি প্রমাণের দায়িত্ব তারই; আর যদি তিনি প্রমাণ করতে না পারেন তবে তা অগ্রহণযোগ্য এবং দাবিটি ভিত্তিহীন হয়ে দাঁড়ায়। বলা বাহুল্য এখনো কেউ ঈশ্বর বা অনুরূপ কিছুর অস্তিত্বের স্বপক্ষে কোনো নিখুঁত যুক্তি বা প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি। প্রমাণের নামে যা উপস্থাপিত হয়েছে তা শুধুই বাজে কথা)।
“এ মহাবিশ্ব প্রাকৃতিক বিধান দ্বারা পরিচালিত।
বিধানের জন্য প্রয়োজন একজন বিধান দাতা বা বিধাতা। তাই নিশ্চয়ই একজন ঐশ্বরিক নিয়ন্ত্রক রয়েছেন। ”
প্রাকৃতিক নিয়ম একটি বর্ণনা-মাত্র, তা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিধান বা নির্দেশ নয়। (A natural law is a description, not a prescription)। মহাবিশ্ব কোনোকিছু দ্বারা বা নির্দেশ অনুসারে পরিচালিত হচ্ছে না।
‘প্রাকৃতিক নিয়ম’ মানুষের তৈরি ধারণা মাত্র, যা প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনাবলী মানুষের কাছে বোধগম্য করে তুলে; এটি সামাজিক নিয়মকানুনের মত কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আচরণগত নির্দেশনা নয়। (আজকে কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা যেভাবে ঘটে থাকে, যেমন পৃথিবীর আহ্নিক গতি বা বার্ষিক গতি, ঐ ঘটনা যদি ভিন্নভাবেও ঘটতো - তবে আমরা তাকেও বলতাম ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’)। যদি ঐশ্বরিক পরিকল্পনা ধারণা সঠিক হয় তবে তা সমভাবে ঈশ্বরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ঈশ্বরকেও কারো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া প্রয়োজন। (তা না হলে ঈশ্বর একটি ‘বিশৃঙ্খল ধারণায়’ পতিত হবে)।
“এটি অপ্রমাণিত যে জীবনের জটিলতা দুর্ঘটনার মাধ্যমে উদ্ভূত; এবং তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রানুসারে সকল সিস্টেম বিশৃঙ্খলার দিকে ধাবিত হয় তা বিবর্তনকে অসম্ভব করে তুলে। তাই অবশ্যই স্রষ্টার অস্তিত্ব রয়েছে। ”
এই ছদ্ম-বৈজ্ঞানিক আপত্তি বিজ্ঞানের ভ্রান্ত ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করে বানানো হয়েছে। কোনো জীববিজ্ঞানীই দাবি করেননি, বর্তমানের প্রাণীগুলি হঠাৎ করে সংঘটিত এক ধাপ দুর্ঘটনাজনিত ‘মিউটেশন’-এর ফলে উদ্ভূত হয়েছে। বিবর্তন দীর্ঘ সময় ধরে ছোট ছোট ক্রমপরিবর্তনের ফসল, যার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ প্রজাতি পরিবেশের সাথে খাপ খেয়েছে; যেমন মানুষ বিকশিত না হয়ে অন্য সহস্র-কোটি সম্ভাবনার একটি হতে পারত যা প্রাকৃতিক নির্বাচনের নির্মমতার মধ্যে হয়ত টিকে থাকতে সমর্থ হত।
সম্ভাবনার নিয়মানুসারে এবং বাস্তবতার নিরিখে, ধর্মবাদীদের বিষয়টি এরকম -যেন কোনো লটারি বিজয়ী বলছে, ‘লটারি বিজয়ের সম্ভাব্যতা খুবই কম, তাই আমি তা জিততে পারি না। ’
সৃষ্টিবাদীরা প্রায়ই তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রটিকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করে থাকেন। এ সূত্রানুসারে ‘বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায় একটি বদ্ধ সিস্টেমের মধ্যে। ’ কিন্তু সাধারণভাবে পৃথিবী একটি মুক্ত ব্যবস্থা। তা সূর্য থেকে শক্তি পাচ্ছে।
পৃথিবীর ব্যবস্থাগুলো সৌরশক্তি দ্বারা চালিত হচ্ছে, শক্তির রূপান্তর হচ্ছে। শেষে আবার ঐ শক্তি ভিন্নরূপে পৃথিবী থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। (তাই পৃথিবীকে বদ্ধ সিস্টেম ভেবে একে তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের সাথে তুলনা করা সঙ্গতিপূর্ণ নয়)। আবার কখনো হয়তো সূর্য ঠাণ্ডা হবে এবং এতে বা অন্য কোনো কারণে পৃথিবীর জীবজগত বিলীন হয়ে যাবে।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
“লক্ষ লক্ষ লোক ব্যক্তিগতভাবে ঈশ্বরকে আত্মিক অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি দ্বারা জানে।
”
বেশিরভাগ ঈশ্বরবাদী দাবি করেন তাদের স্বতন্ত্র ঈশ্বরকে ধ্যান বা প্রার্থনা দ্বারা জানতে পারা যায়; কিন্তু এ ধরনের অভিজ্ঞতা মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া (বিভ্রম) ছাড়া আর কিছুই নয়। অতীন্দ্রিয়বাদকে জটিল করার প্রয়োজন নেই। অনেকে এমনিতেই গুজব তৈরি করতে পছন্দ করেন, অলীক শব্দ শুনতে পান, কল্পিত বস্তু দেখা অথবা কাল্পনিক কারো সাথে কথা বলার দাবি করেন। এগুলো বাস্তব কিছু নয়। ঈশ্বর-বিশ্বাসীর পরিমাণ অসংখ্য কিন্তু এটি মানুষের ব্যাপার, ঈশ্বরের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত নয়।
‘সত্য’ জনসমর্থন দ্বারা নির্ধারিত হয় না। ধর্মগুলো উদ্ভূত হয়েছে মৃত্যু, দুর্বলতা, স্বপ্ন এবং অজানার প্রতি ভয়কে কেন্দ্র করে।
“নাস্তিকদের আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টির অভাব রয়েছে তাই তাদের কাছে আস্তিকদের ঐশ্বরিক অনুভূতি বোধগম্য নয়। এটি একজন বর্ণান্ধ ব্যক্তির রঙের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার মত। ”
অনেক আস্তিক বা ঈশ্বরবাদী দাবি করেন ঈশ্বরকে বিশেষ ‘আধ্যাত্মিক’ উপলব্ধির দ্বারা জানা সম্ভব।
কিন্তু এ ধরনের উপলব্ধি কি ভিন্ন কোনো জগৎ হতে আসে কিংবা তা বোঝার জন্য ‘ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়’-এর প্রয়োজন? সংশয়বাদীরা এ ধরনের বিশ্বাসকে নাকচ করে দেন। বর্ণান্ধরা কখনো রঙের উপস্থিতিকে অস্বীকার করেন না তাই ধর্মবাদীদের তুলনাটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বর্ণান্ধ ও বর্ণদৃষ্টিক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা একই পৃথিবীতে বসবাস করে এবং উভয়ই প্রাকৃতিক নিয়মগুলোকে আয়ত্ব করে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও বর্ণালী দ্বারা দৃষ্টি ব্যতীতই ‘বর্ণ’ ব্যাখ্যা করা সম্ভব। (তাছাড়া দেখা যায়, অনেক নাস্তিক জীবনের প্রথমাংশে আস্তিক ছিলেন।
কোনো কোনো নাস্তিক তখন আস্তিকদের মতোই তথাকথিত আধ্যাত্মিক অনুভূতি উপলব্ধি করতেন। আস্তিক-নাস্তিক উভয়ের উপলব্ধি ক্ষমতা ও প্রক্রিয়া একই ধরনের এবং কারোই পঞ্চ ইন্দ্রিয় ব্যতীত অতিরিক্ত কোনো দৈহিক বা মানসিক ইন্দ্রিয় নেই। নাস্তিকরা যুক্তিবাদী আর আস্তিকরা পরিবার বা সমাজ তথা পরিবেশ থেকে ধর্মীয় অযৌক্তিক ধারণা পেয়ে থাকেন ও যাচাই-বাছাই না করেই তা গ্রহণ-পালন ও চর্চা করে থাকেন। বিধায় আস্তিকদের ‘বৌদ্ধিক অন্ধ’ বলা যায় - যে অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন মুক্তবুদ্ধির চর্চা। এছাড়া আস্তিকদের অভিযোগটি যদি ঠিকও হত তবে নাস্তিকদের কোনভাবেই অপরাধী বলা যেত না - যা ধর্মীয় ধারণার সাথে সংঘর্ষিক) ।
কোনো ধর্মবাদী ব্যক্তি আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টির কোনো নিরপেক্ষ ব্যাখ্যা প্রদান করেন না, ফলে তা প্রথমেই দার্শনিক বৈধতা হারায়। কোনো সংশয়বাদী ‘মানসিক ধর্মীয় অভিজ্ঞতাকে’ অস্বীকার করেন না কিন্তু তারা জানেন তা শুধু অতীন্দ্রিয় জগৎ সম্পর্কে গভীর বিশ্বাসের ফলেই ঘটেছে, যার ব্যাখ্যা মনোবিজ্ঞান দিতে পারে। আর আস্তিকরাই শুধু ‘সম্পূর্ণ মানুষ’ এ ধারণা অবৈজ্ঞানিক, উদ্ধতপূর্ণ ও হাস্যকর।
নৈতিকতা
“আমাদের সবারই ভালো ও মন্দের ধারণা তথা বিবেকবোধ আছে যা আমাদের উচ্চতর আইনের অধীন করে দেয়। বিশ্বজনীন নৈতিকতার আকাঙ্ক্ষা মানবতার ঊর্ধ্বে কিছু ইঙ্গিত করে।
এটি ঈশ্বরের সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ যা অদৈহিক এবং আমাদের ঐরকম মহিমান্বিত প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত করে। ”
আরেকটি ‘অজ্ঞতাভিত্তিক ভুল যুক্তি’। নৈতিক প্রক্রিয়া মানুষের জীবন ধারণের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে : যা জীবনকে সমৃদ্ধ করে তাই ভালো আর যা জীবনকে ব্যাহত করে তাই মন্দ। মিথ্যা বলা বা চুরি করা অপরাধ তা বোঝার জন্য দৈব নির্দেশের প্রয়োজন নেই। কোন আচরণ যৌক্তিক অথবা সদয়চিত্ত তা বোঝার ক্ষমতা মানুষের রয়েছে।
‘বিশ্বজনীন নৈতিকতা বোধ’ বলতে আসলে কিছু নেই এবং সব নৈতিকতা পরস্পরের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বহুবিবাহ, নরবলি, নরমাংসভোজন, স্ত্রী পেটানো, অঙ্গহানি করা, যুদ্ধ, খৎনা, খোজাকরণ এবং অজাচার অনেক জাতির সংস্কৃতিতে যথারীতি নৈতিক এবং প্রচলিত। তাহলে ঈশ্বর কি বিভ্রান্ত?
ঈশ্বরকে ‘অদৈহিক’ বলা অসঙ্গতিপূর্ণ। সময় এবং স্থানের মধ্যে যে কোনো কিছুকেই কোনো এক রূপে থাকতে হয়। (দৈহিক আকার ব্যতীত কোনো সচেতন সত্তা আমাদের ধারণায় অসম্ভব, তাই ঈশ্বরের এরূপ ধারণা আমাদের কাছে অমূলক এবং দার্শনিকভাবে অবাস্তব)।
নৈতিক মূল্যবোধ আমাদের দৈহিক মস্তিষ্কে নিরূপিত, তাই নৈতিকতা যদি ঈশ্বরকে ইঙ্গিত করে তবে আমরাই ‘ঈশ্বর’। ঈশ্বরের ধারণা কেবল একটি মানবিক প্রক্ষেপণ মাত্র।
“যদি কোনো পরম নৈতিক আদর্শ না থাকে তবে চূড়ান্ত অর্থে কোনো ন্যায় বা অন্যায় থাকবে না। ঈশ্বর ব্যতীত নৈতিক ভিত্তি ও সামাজিক শৃঙ্খলা দুর্বল হয়ে পড়বে। ”
এটি ঈশ্বরকে ‘বিশ্বাসের’ জন্য করা উক্তি, ঈশ্বরের ‘অস্তিত্ব’ প্রমাণের জন্য নয়।
পরম নৈতিকতার দাবি আসে বিপদজনক ধর্মবাদীদের কাছ থেকে। প্রাপ্তবয়ষ্ক সচেতন লোকেরা মানুষের জন্য যা কল্যাণকর তার প্রতি ঝোঁক প্রদর্শন করেন, কেননা এটাই সঙ্গতিপূর্ণ, যৌক্তিক এবং নৈতিক মানবিক গঠন কাঠামোর প্রতি দিক নির্দেশ করে, দৈব অস্তিত্ব ছাড়াই। (আর কোনো ভালো কাজ করার জন্য আমাদেরকে যদি স্বর্গের প্রলোভন এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য নরক বা ঈশ্বরভীতির প্রয়োজন হয় তবে আর কিসের মনুষ্যত্ব?)
কোনো ধর্মগ্রন্থ কোনো একটি ভালো আইনকে সমর্থন করতে পারে কারণ ঐ ধর্মগ্রন্থ তৈরির সময় অনেক মানবিক আইন ও মূল্যবোধের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে। এখানে বাইবেলের তথাকথিত দশটি আদেশের কথা বলা যায়। উন্নত দেশগুলোর আইন ও সংবিধান সংগত কারণেই ধর্মনিরপেক্ষ (এবং অনেক ধর্মের ধর্মীয়-বাণীর তুলনায় বেশি মানবিক)।
এমন কোনো প্রমাণ নেই যে আস্তিকরা নাস্তিকদের চেয়ে অধিক নৈতিক। বাস্তবিকপক্ষে এর উল্টোটাই বোধ হয় সঠিক; যা শতবর্ষ ধরে ধর্মীয় হিংস্রতা ও নাস্তিকদের মানবতাবোধ থেকে টের পাওয়া যায়। অধিকাংশ নাস্তিকই সুখী, সৃজনশীল ও নৈতিক ব্যক্তি। (সকল ধর্মের যেহেতু নিজস্ব ঈশ্বর রয়েছে এবং প্রতিটি ধর্মের বিভিন্ন শাখার মধ্যে ঈশ্বর বা ধর্মের ধারণা ভিন্ন তাই তা শৃঙ্খলার পরিবর্তে সমাজে শুধু বিশৃঙ্খলাই সৃষ্টি করে। )
আস্তিকদের দাবি যদি সঠিক হতো তারপরও তা খুব একটা প্রয়োগসিদ্ধ হত না।
ধর্মপ্রাণ শাস্ত্রবিশ্বাসীরা শাস্ত্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর একমত হন না। বিশ্বাসীরা প্রায়ই শান্তিবাদ, গর্ভনিরোধ, পশু অধিকার, পরিবেশ রক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমকামীদের অধিকার, নারী অধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলোর বিরোধিতা করেন। আস্তিকদের নৈতিকতার টানাপোড়ন দেখে এটাই মনে হয় হয়তো তাদের বহু সংখ্যক ঈশ্বর রয়েছেন যারা নৈতিক উপদেশ প্রদানের ব্যাপারে দ্বন্ধে রয়েছেন অথবা মাত্র একজন ঈশ্বর রয়েছেন যিনি নৈরাশ্যজনকভাবে বিভ্রান্ত।
আদি কারণ
“সব কিছুরই কারণ আছে এবং সব কারণ এর পূর্ব কারণেরই ফল, তাই সবকিছুর একটি আদিকারণ আছে। ঈশ্বর হলেন সেই আদি কারণ, বিশ্বের স্রষ্টা ও ধারক”।
বিতর্কের মূল ভিত্তি হল -‘সবকিছুর কারণ আছে’ এবং তা সিদ্ধান্ত বা ফলাফল - ‘ঈশ্বরের কোনো কারণ নেই’- এর সাথে সাংঘর্ষিক। বিতর্কের ভিত্তি থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না, কারণ সবকিছুর যদি কারণ থাকতেই হয় তবে অবশ্যই কোনো ‘আদিকারণ’ দাঁড় করানো যায় না। যদি ঈশ্বরের কোনো কারণ বা স্রষ্টা নেই ভাবা যায় তবে মহাবিশ্বের কোনো কারণ বা স্রষ্টা নেই ভাবতে সমস্যা কোথায়? (আমরা প্রতিটি ক্রিয়া বা ঘটনার অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন কারণ দেখতে পাই। একটি ঘটনার অনেকগুলো কারণ আমরা সচরাচর দেখতে পাই। তাহলে বহুসংখ্যক আদিকারণের ধারণা একইভাবে উত্থাপন করা যায়।
এছাড়া ‘মহাবিশ্বের কারণ’ বিষয়টি বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়। এ ব্যাপারে ভাবতে হলে মহাবিশ্ব সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখা প্রয়োজন। তাই বিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্বারা যখন যে সিদ্ধান্ত দিবেন আমাদেরকে তা-ই বুঝতে হবে)। এমন কোনো সত্তা আমাদের অভিজ্ঞতায় নেই যিনি ‘অকারণিত কারণ’ হতে পারেন। তাই আমরা ঈশ্বরের ব্যাপারে এমন সিদ্ধান্তে যেতে পারি না কারণ আমরা আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করেই সিদ্ধান্ত নেই বা নিতে পারি।
প্যাসকেলের বাজি
“ঈশ্বরকে প্রমাণ করা যায় না। কিন্তু যদি ঈশ্বর থাকে তাহলে বিশ্বাসীরা সব কিছু পেয়ে যাবেন (Heaven বা স্বর্গ) আর অবিশ্বাসীরা সব কিছু হারাবে (Hell বা নরক)। ঈশ্বর যদি না থাকেন তবে সেজন্য বিশ্বাসীরা কিছুই হারাবে না এবং অবিশ্বাসীরাও কিছু পাবে না। সুতরাং ঈশ্বরকে বিশ্বাসের মাধ্যমে সবকিছুই অর্জন করা যায় এবং তাতে কিছুই হারানোর নেই। ”
আর্গুমেন্টটি প্রথমে প্রদান করেছিলেন ফরাসি দার্শনিক ব্লেইস প্যাসকেল, যা কোনো যুক্তি নয়, স্রেফ হুমকি মাত্র।
এটি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য নয় বরং তার অস্তিত্বে বিশ্বাসের জন্য অযৌক্তিক ভয়ের উপর ভিত্তি করে গঠিত ভুল ধারণা। এ ধরনের উক্তি দ্বারা আমরা ধর্মকে শুধু ‘নরকের মন্দ ধারণা’র সাথে গুলিয়ে ফেলি।
এটি সত্য নয় যে বিশ্বাসীরা কিছুই হারায় না। প্রমাণের পূর্বেই বিশ্বাসের দ্বারা আমরা পরকালের মিথ্যাগুলোকে ধারণ করে জীবনকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিই, এবং মিথ্যাকে বজায় রাখার জন্য সত্যকে জলাঞ্জলি দিই। ধর্ম প্রচুর মূল্যবান সময়, শক্তি এবং অর্থ নষ্ট করে।
(একটিবার নির্মোহ হয়ে হিসেব করে দেখুন, মুসলমানরা মসজিদ বানাতে, অথবা প্রতি বছর হজের সময়, কোরবানি দিতে কিংবা হিন্দুরা মন্দির বানাতে, ঝাঁকঝমক করে দূর্গা পূজা করতে কি পরিমাণ অর্থের অপচয় ঘটিয়ে থাকেন। ভয়াবহ রকমের এত অর্থ খরচের কি বিকল্প পথ খোলা নেই? এই অর্থ কি নিজেদের মানবিক চাহিদা পূরণ, জ্ঞান চর্চা করা অথবা গরীবকে সহযোগিতা করার জন্য ব্যয় করা যেত না?)। ধর্মীয় জগতকে সমৃদ্ধ করার জন্য অনেক মূল্যবান জীবনের অপচয় ঘটে। ধর্মবিশ্বাস মানুষকে নিপীড়নের হাতিয়ার, ব্যক্তি-স্বাধীনতার প্রতি হুমকিস্বরুপ।
এটাও ঠিক নয় যে অবিশ্বাসীরা (তাদের অবিশ্বাসের জন্য) কিছুই অর্জন করেন না।
ধর্মকে প্রত্যাখানের মাধ্যমে তারা একটি ইতিবাচক উদার ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করেন এবং স্বাধীন অন্বেষণের সুযোগ পান। নাস্তিকেরা সামাজিক ও নৈতিক উন্নতির বিষয়ে সর্বদাই অগ্রবর্তী। (একজন নাস্তিক মনে করেন আমরা মানুষেরা এই পৃথিবীর বাসিন্দা, পৃথিবীতে বসবাসকারী আরো মিলিয়ন মিলিয়ন প্রাণীর মত আমরাও এই পৃথিবী থেকে রঙ, রূপ, রস, খাদ্য গ্রহণ করে বেঁচে আছি। এই পৃথিবী কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, এটা আমাদের সকলের। জন্মেছি এই সুজলা সফলা শস্য শ্যামলা এই ধরণীতে, মৃত্যুর পর অন্য কোনো স্থান নেই, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এখানেই জীবনের সমাপ্তি, তাই এই পৃথিবীকে আমাদের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুস্থ-সুন্দর করে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে আমাদেরই।
বলাবাহুল্য আস্তিকেরা এই চেতনার বিপরীতে অবস্থান করেন। )
কোন ধরনের মানুষ অনন্তকাল নরক ভোগের উপযুক্ত-একজন সত্যের পথের পথিক? ঈশ্বর যদি এমন অবিচারী-অবিবেচক হন তবে আস্তিকরাও এখানে নাস্তিকদের মতই বিপদের মধ্যে রয়েছেন। এমন কী হতে পারে না, ঈশ্বর সকলকে নরকে পাঠাতে চাচ্ছেন বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী নির্বিশেষে। অথবা ঈশ্বর শুধু তাদেরই রক্ষা করবেন যারা অবিশ্বাস করার মত সাহস রাখে।
প্যাসকেল একজন ক্যাথলিক খ্রিস্টান এবং অনুমান করেছিলেন যে ঈশ্বর বলতে শুধু খ্রিস্টানদের ‘ঈশ্বর’ বোঝায়।
তবে যদি অন্য কোনো ধর্মের ঈশ্বর সঠিক হয় তাহলে সুবিধা লাভের জন্য যে ঝুঁকি প্যাসকেলের বাজির মধ্যে রয়েছে তা আশাতীতভাবে ব্যর্থতায় প্রতিপন্ন হয়।
যে কোন দৈব বিশ্বাস যদি ভয়ের উপর নির্ভরশীল হয় তবে তা প্রকৃত ভক্তির উদয় করে না এবং এরকম একটি বিষয় উপাসনার যোগ্য হতে পারে না। (আর একজন ব্যক্তি যদি মুক্তভাবে গভীর চিন্তার পর ঈশ্বরকে অবিশ্বাস করেন তবে ঈশ্বর যদি থেকেও থাকেন তবুও তার কোনো অধিকার থাকবে না ঐ ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদানের, যদি তিনি ন্যায় বিচারক হন যেমনটি ধর্মগ্রন্থে বলা হয়। )
সত্তা সংক্রান্ত প্রমাণ
“ঈশ্বর হল এমন ধারণা, যার চেয়ে ঊর্ধ্বে আর কিছু কল্পনা করা যায় না। ঈশ্বর যদি বাস্তবে না থাকেন তাহলে তিনি হয়তো বিদ্যমান ধারণার ঊর্ধ্বে।
সুতরাং ঈশ্বর আছেন। ”
সত্তাসংক্রান্ত প্রমাণের ডজন খানেক রূপ আছে কিন্তু খ্রিস্ট পুরোহিত আনসেল্ম একে উপরোক্ত রূপ দিয়েছেন। এই যুক্তিবিন্যাসের ক্রটি হল তা বিমূর্ত গুণকে বাস্তবে আরোপিত করেছে। কোনো কিছুই অস্তিত্ব সম্পন্ন হওয়ার পূর্বেই ‘মহান’ বা ‘উৎকৃষ্ট’ হতে পারে না। কিন্তু এ যুক্তিতে তাই করা হয়েছে বা ধরা হয়েছে।
যে কোনো ‘অস্তিত্ব’কে ‘ঈশ্বর’- এ প্রতিস্থাপন হল এ ধরনের যুক্তিবিন্যাস প্রদর্শনের একটি উত্তম উপায়। আপনি এভাবে নিখুঁত শূন্যতাকেও প্রমাণ করতে পারেন যেখানে কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। যুক্তিটি নিজে নিজেই ভেঙ্গে পড়ে। কারণ ঈশ্বরকে সবদিক থেকে অসীম ধরা হয় যা আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতায় নেই; তাই এ রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ দার্শনিকভাবে ভুল। কোনো কাল্পনিক ধারণা পোষণ করার মানে এটা নয় যে বিষয়টির কোনো বাস্তবতা আছে।
ঈশ্বরের অস্তিত্বটি ধারণায় না হয়ে বাস্তবে হল কিভাবে? এটি আশ্চর্যের বিষয় নয় যে বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন সত্তাসংক্রান্ত প্রমাণটি ভুল ব্যাকরণের ফসল।
প্রত্যাদেশ
“আমাদের ধর্মগ্রন্থ ঐতিহাসিকভাবে নির্ভরযোগ্য। এবং বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণগুলোর উপর সন্দেহ পোষণ করা যায় না। ঈশ্বর বাস্তবে রয়েছেন কেননা তিনি এগুলোর মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছেন। ”
ধর্মগ্রন্থগুলো অন্যান্য গ্রন্থের তুলনায় একেবারেই সাধারণ, শুধু এটাই যে ধর্মগ্রন্থগুলোতে ‘অলৌকিকতা’ আরোপ করা হয় আর অন্যান্য গ্রন্থে তা করা হয় না।
শাস্ত্রগুলোকে বিশ্বাস করতে হলে অনেক অলৌকিক বিষয় চলে আসে; যেমন দেবদূত ঈশ্বরের কাছ থেকে তা নিয়ে এসে আরেকজনের কাছে তা পৌঁছে দিচ্ছেন যা একজন বাস্তববাদী মেনে নিতে পারেন না। টমাস পেন ‘দ্য এইজ অফ রিজন’-এ উল্লেখ করেছেন ধর্মশাস্ত্র প্রত্যাদেশ হতে পারে না। প্রত্যাদেশ (যদি বাস্তবে থাকত) কিছু মানুষের সাথে সরাসরি দৈব যোগাযোগ, যদি প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তা বর্ণনা করে তবে তারা এতে দ্বিতীয় ব্যক্তি বলে পরিগণিত হবেন। কেউই তা মানতে বাধ্য নন বিশেষত যদি তাতে উদ্ভট কাল্পনিক বিষয় যাকে। আর শাস্ত্রগুলো ঐতিহাসিকভাবে মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়।
কিছু কিছু শাস্ত্র ধর্মপ্রচারেকের মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল ধরে লিপিবদ্ধ হয়েছে, তখন তার নানা অংশ বাদ পড়েছে, নতুন অনেক কিছু সংযোজিত হয়েছে এবং অনেকাংশে পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়গুলো গোঁড়া ধমবিশ্বাসীরা মানতে নারাজ এমনকি এর ঐতিহাসিক দলিল থাকলেও। এছাড়া ধর্মশাস্ত্রগুলো তা তৈরি হওয়ার সময়কালীন প্রচলিত সমস্যা, কাহিনী ও গল্পে ভরপুর, আধুনিককালে যেগুলোর কোনো প্রয়োজনই নেই। ধর্মগ্রন্থের অনেক কথা পরস্পরবিরোধী এবং বিজ্ঞানবিরোধী-শাস্ত্রগুলোকে নির্ভুল দেখানোর জন্য ধর্মব্যবসায়ীরা নিত্যনতুন ব্যাখ্যা আবিষ্কারে সিদ্ধহস্ত। ধর্মগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত ‘অলৌকিকতা’ প্রকৃতির সাধারণ নিয়মকে লঙ্ঘন করে এবং এগুলো বাস্তবে অসম্ভব সুতরাং তা অগ্রহণযোগ্য।
ধর্মগুলোতে বর্ণিত কোনো জ্ঞান কিংবা বর্ণিত কোনো ইতিহাসকেও গ্রহণ করা যায় না কারণ এগুলোর স্বপক্ষে যথেষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। তাছাড়া শাস্ত্রগুলোতে অনেক ব্যাকরণগত ও তথ্যগত ভুল পরিলক্ষিত হয়।
বিজ্ঞান
“অনেক বিজ্ঞানীই ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। পৃথিবীর বেশিরভাগ ধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরা যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন তবে অবশ্যই ঈশ্বরে বিশ্বাস যুক্তিসম্মত। ”
এটি কর্তৃত্বের দোহাই মাত্র; নাস্তিকরা ঐ বিষয়ে তাদের চেয়ে ঊর্ধ্বে বলতে হয়।
বিদ্বান শ্রেণীর লোকেরা সাধারণ মানুষের চেয়ে সচরাসচর কম ধার্মিক হন। ঈশ্বর-বিশ্বাসী বিজ্ঞানী খোঁজে পাওয়া গেলেও তাদের কেউই তাদের বিশ্বাসকে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করতে পারেন না। বিশ্বাস (পেশা থেকে বিছিন্ন) একটি সাংস্কৃতিক বা ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং কেউই এমন কী একজন বিজ্ঞানীও ধর্মের অযৌক্তিক ও মায়াবী প্রলোভন থেকে সুরক্ষিত নন।
“কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানে দেখানো হয় যে বাস্তবতা অনিশ্চিত এবং কমই মূর্তমান। এখানে অলৌকিকতা চলে আসছে।
আস্তিকদের জগৎ বিজ্ঞানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। ”
এটি অর্থহীন কথাবার্তা। অলৌকিকতাকে ধরা হয় প্রকৃতির নিয়মের ব্যতিক্রম হিসাবে, যা অতীন্দ্রিয় জগতকে নির্দেশ করে। যদি নতুন বিজ্ঞান অলৌকিকতাকে প্রাকৃতিকভাবে সম্ভব করে ফেলে (একটি স্ববিরোধী ধারণা) তাহলে কোনো অতিপ্রাকৃত জগৎ বা ঈশ্বর নেই। কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানে ‘অনিশ্চিয়তা’কে বাস্তবে প্রয়োগ করা হয় না; বরং বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়।
আস্তিকতা অতীন্দ্রিয় জগতকে ইঙ্গিত করে আর বিজ্ঞান নিজেকে প্রাকৃতিক জগতে সীমাবদ্ধ করে। তাই আস্তিকতা কখনো বিজ্ঞানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে না - সংজ্ঞা অনুসারে।
বিশ্বাস
“ঈশ্বরে বিশ্বাস বুদ্ধিবৃত্তিক নয়; যুক্তির সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ঈশ্বরের সত্যতা শুধু বিশ্বাসের মাধ্যমে জানা সম্ভব, তা যুক্তিকেও ছাড়িয়ে যায়; তবে যুক্তির সাথে বিরোধ সৃষ্টি করে না। ”
এটি কোনো যুক্তি নয়।
এখানে স্বীকার করা হচ্ছে, যা বুদ্ধিবৃত্তিক নয় তা আলোচ্য জগৎ ছেড়ে ভিন্ন জগতে (নির্বুদ্ধিতায়) চলে যায়। আর ‘যুক্তি’ সীমাবদ্ধ; তা বাস্তবতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যদি বাস্তবতাকে অস্বীকার করেন তবে আপনি কল্পনা বা স্বপ্নচারিতার দ্বারাই প্রতারিত হবেন।
বিশ্বাস হল ‘অপর্যাপ্ত বা স্ববিরোধী’ প্রমাণ সত্ত্বেও কোনো কিছুর বিবরণ শুনেই তা গ্রহণ করা, যা বাস্তবতার সাথে কখনো সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে না। বিশ্বাসের সকল দোহাই সত্ত্বেও এটি পরিষ্কার যে ধর্মীয় দাবি কখনো নিজের দু’পায়ের উপর দাঁড়াতে পারে না।
ফরাসি অস্তিত্ববাদী দার্শনিক জ্যাঁ পল সার্ত্রে বলেছেন ‘বিশ্বাস হল এটা জানা যে আপনি বিশ্বাস করেন আর আপনি বিশ্বাস করেন এটা জানার মানে হল অবিশ্বাস করা। ’
যদি কখনো এমন হয় যে আস্তিকতার একটি সঙ্গতিপূর্ণ অনুকল্প রয়েছে (বস্তুত যা নেই এখনো) তাহলে এটা এখনো প্রমাণ হবার প্রয়োজন রয়েছে। তাই অধিকাংশ আস্তিক প্রমাণ ও যুক্তিকে দূরে রেখে বিশ্বাসের প্রতি জোর দেন।
আত্মিক ক্ষমতা
“আত্মিক ক্ষমতা, পুনর্জন্ম এবং এ রকম অনেক কিছুর দৃঢ় প্রমাণ রয়েছে। আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে এখানে ভিন্ন কিছু একটা রয়েছে।
”
অধিকাংশ বিজ্ঞানী (বা বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি) এরকম দাবির অনুকূলে কোন প্রমাণ রয়েছে বলে মনে করেন না। যখন সর্তকভাবে কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এগুলো পরীক্ষা করা হয় তখন এই ধরনের দাবি ভুল ব্যাখ্যা বা অবৈধ প্রতারণা বলে প্রতীয়মান হয়। (এ বিষয়ে প্রবীর ঘোষের ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’, চতুর্থ খণ্ডে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে)।
যদি তা ন্যায়সঙ্গত হয় তবে রহস্যময় ব্যাপারগুলোর নিখুঁত প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দিতে হবে। এ রকম বিষয়ে সংশয়বাদীরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সিদ্ধান্তে ঝাঁপ না দিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-পর্যবেক্ষণ-পরীক্ষণ অব্যাহত রাখেন এবং যৌক্তিকভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছেন।
উপসংহার
পরিশেষে বলা প্রয়োজন, যদি আস্তিকদের উপরোক্ত বক্তব্যগুলো এমনকি ঈশ্বরকে প্রমাণ করতো, তারপরও ঈশ্বরকে স্রষ্টা হিসেবে ব্যক্তিগত, মহোত্তম, সদয়, অথবা বর্তমানে জীবন্ত বা সক্রিয় প্রমাণ করা যায় না। এগুলোর কোনোটিই বিশৃঙ্খলা, কদর্যতা, দুঃখ, দুর্দশা, বেদনা ইত্যাদির ব্যাখ্যা দিতে পারে না বরং তার জন্য আরেকজন মন্দগুণসম্পন্ন সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রয়োজন হয়।
অধিকাংশ আস্তিক বা ঈশ্বরবাদীরা যখন উপলব্ধি করতে পারেন তাদের দার্শনিক সিদ্ধান্তগুলো ব্যর্থ; তখন তারা গৎবাঁধা আক্রমণের পথ বেছে নেন। নাস্তিকদের সম্পর্কে প্রচারণা চালানো হয়, তারা অসুখী, অনৈতিক, রাগী, খ্যাপাটে, দানবীয়, নির্দয় লোক, তাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজন নেই। এই ধরনের অভিযোগ সম্পূর্ণ অসত্য এবং অন্যায্য।
তবে, অভিযোগটি যদি সত্যিও হত, তাতেও কিন্তু আস্তিকদের দাবিগুলির কোনটিই সঠিক বলে প্রমাণিত হয় না।
এখন পর্যন্ত সর্তকতামূলক পরীক্ষণের মাধ্যমে দেখা গেছে ঈশ্বরবাদীদের দাবি সর্বৈব অসত্য, নাস্তিকতাই যৌক্তিক অবস্থানে বিদ্যমান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।