মানুষ মানুষের জন্যে
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের অভিযোগ অন্তহীন। বাংলাদেশ ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দিচ্ছে, আশ্রয় দিচ্ছে, সুবিধা দিচ্ছে। বাংলাদেশ ইসলামি জঙ্গিবাদীদের ঘাঁটি। বাংলাদেশের ভেতরে গিজগিজ করছে আলকায়েদা, হরকাতুল জিহাদ কিংবা জেএমবি। বাংলাদেশের মানুষ বিশেষত যারা মুসলমান তারা সবাই জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক।
বাংলাদেশ মাদক পাচারের আন্তর্জাতিক রুট। ভারতের এসব অভিযোগ পূর্ববর্তী সরকারগুলো বরাবরই অস্বীকার করেছে। সেই ১৯৭২ সাল থেকে ভারত দাবি করে আসছে, বাংলাদেশের ভেতরেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যের স্বাধীনতাকামীদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প রয়েছে। বাংলাদেশ যখন দাবি করেছে, কোথায় কোথায় আছে এসব প্রশিক্ষণ শিবির, তখন ভারত সব আজগুবি তালিকা হাজির করেছে। তার কোনো কোনোটা বিরান জনপদ।
কোনো কোনোটা নদী বা খাল। কোনো কোনোটা অতি সাধরাণ মানুষের বসতভিটা। বাংলাদেশ বলেছে, ভারতের যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে তারা এসে দেখিয়ে দিয়ে যাক যে, কোথায় কোথায় আছে ভারতীয় স্বাধীনতাকামীদের প্রশিক্ষণ শিবির। কিন্তু কোনো দিনই এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি ভারত। বেশি পীড়াপীড়ি করলে সাময়িকভাবে অভিযোগ তোলা বন্ধ করেছে।
আবার মওকা বুঝে দাবি করে বসেছে, বাংলাদেশের ভেতরে অমুক অমুক স্থানে ভারতীয় স্বাধীনতাকামীদের প্রশিক্ষণ চলছে।
বর্তমান সরকার এবং তাদের আঁচল বিছিয়ে ডেকে আনা মইনউদ্দিনের সামরিক সরকার এসে প্রথম ভারতীয় এসব অভিযোগ কবুল করে নিয়েছে। আর সেই কবুল করার অংশ হিসেবে তারা বহুবিধ পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে যেন নির্দেশ পালন মুখ্য হয়ে থেকেছে। নিজস্ব রাজনীতি-কূটনীতি কোন কিছুই এখানে গত সাড়ে তিন বছরে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না।
ভারত বলেছে, বাংলাদেশে হুজি আছে। আর মইন-হাসিনার সরকার হুজি আবিষ্কারের জন্য নিরীহ সাধারণ মুসল্লিদের ধরে ধরে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে হাজির করেছে। ভাবখানা এমন যে, দেখুন ভারতীয় দাদারা বলেছিল বাংলাদেশে হুজি আছে, এই যে হুজি পাওয়া গেছে, দেখুন, অবাক কাণ্ড। অর্থাৎ সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দেয়া যে, ভারত যা অভিযোগ করেছিল, সেটি সত্য। আর যায় কোথায়? ভারতও পেয়ে বসেছে।
যদি বলে হুজি আছে, বাংলাদেশ ‘জো হুকুম’ বলে নিরীহ নাগরিকদের ধরে টেলিভিশনের সামনে এনে বলে বান্দা হাজির। যদি বলে বাংলাদেশে ভারতীয় স্বাধীনতাকামীদের প্রশিক্ষণ শিবির আছে, অমনি সরকার লাফ দিয়ে বলে ইয়েস, প্রশিক্ষণ শিবির আছে। শিবিরে লোকজন পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে পরিত্যক্ত কুঁড়েঘর। ভারতীয় স্বাধীনতাকামীদের ফেলে যাওয়া পোশাক-আশাক।
কখনো বা দুয়েকটি বাতিল অস্ত্রের টুকরা-টাকরা। সরকার বগল বাজায়। ভারতও সারা পৃথিবীকে বলে বেড়ায়, দেখুন, বাংলাদেশে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ক্যাম্প রয়েছে। ভারত দাবি করল, দশ ট্রাক অস্ত্র ভারতে পাচারের জন্য আনা হয়েছিল। অমনি সরকার গ্রেফতার করে ফেলল, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের।
হঁ্যা, ভারত দাদা বলেছে, অস্ত্র ভারতে পাচারের জন্য আনা হয়েছিল। আর তাতে সহযোগী ছিল বিগত সরকারেরর আমলে নিয়োজিত সামরিক কর্মকর্তারা। দাদা, দেখুন, আমরা তাদের আটক করে ফেলেছি। ভারত যা বলে, পারিষদ দল বলে তার শত গুণ। সেভাবে সরকার আমাদের একটি ভারতীয় তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
সেভাবে ভারতের দরকার বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট-করিডোর। ভারতের দরকার বলে কথা। অমনি আমরা একেবারে লাফিয়ে পড়লাম। আসুন দাদা, কোন কোন রুটে আপনাদের ট্রানজিট-করিডোর চাই, বলুন এবং নিয়ে যান। বিনিময়ে কিছুই চাই না।
শুধুই ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাই। ক্ষমতার মসনদ থেকে আমাদের নামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবেন না। ক্ষমতায় এনেছেন। ক্ষমতায় রাখুন। ক্ষমতা ভারি মজা।
জনগণ কী ভাবল, সেটা আমাদের বিবেচ্য নয়। কারণ আমরা জানি, জনগণ আমাদের ক্ষমতায় আনার ব্যাপারে তেমন কোনো ভূমিকা রাখেনি। ফলে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা আমাদের কাছে অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই জো হুকুম। এই মনোভাব দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ সর্বক্ষেত্রে একটি ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে।
অর্থনীতির পুরোটাই এখন ভারতের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। বাংলাদেশের পাট শিল্পের বিনাশ ঘটেছে। আর সেই বিনাশের মধ্য দিয়ে ভারতের পাট শিল্পের ব্যাপক তরক্কি। মইন-হাসিনার সরকার একের পর এক পাটকল বন্ধ করেছে। আর বাংলাদেশের পাটের ওপর ভিত্তি করে ভারতে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন জুট মিল।
বাংলাদেশের বিনাশের ভেতর দিয়ে ভারতের তরক্কি।
বাংলাদেশে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ এখন ভারতের বাজারে পরিণত হতে বসেছে। ভারত এ রকম একটি স্বপ্নই ১৯৭২ সাল থেকে বাস্তবায়নের অভিপ্রায়ে ছিল। কিন্তু পূর্ববর্তী কোন সরকারই তাদের সে অভিপ্রায় বাস্তবায়নের সুযোগ দেয়নি।
বর্তমান সরকার একেবারে আগ বাড়িয়ে সে সুযোগ করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অর্থনীতি বহু ক্ষেত্রেই ভারতের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। ভারত সেটা কখনোই মেনে নেয়নি। ১৯৭২ সাল থেকেই তার চিল্লাচিল্লি করেছে, এটা বাংলাদেশ করতে পারবে না। বাংলাদেশের অর্থনীতি হতে হবে ভারতীয় অর্থনীতির পরিপূরক।
কিন্তু মইন-হাসিনা বাদে গত ৪০ বছরে কোনো সরকারই ভারতের এ ফাঁদে পা দেয়নি। এবার ভারতকে দাওয়াত দিয়ে এনে যেন বলা হলো, দাদা, আপনার ফাঁদ কোথায়, নিয়ে আসুন, এই যে পা বাড়িয়ে দিলাম।
সেভাবে এখন ফাঁদে বাঁধা সরকার। পাট শিল্প গেছে। জনশক্তি রফতানি খাত ভারত কৌশলে কব্জা করে নিয়েছে।
বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির প্রধান ক্ষেত্র ছিল মধ্যপ্রাচ্য। বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার, কুৎসা, ভণ্ডামির মাধ্যমে ক্রমেই মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে ভারত, যাতে ওসব দেশে বাংলাদেশী শ্রমিক সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হয়। যেকোনো অপরাধের জন্য ভারত বাংলাদেশী শ্রমিকদের দায়ী করে খবর ছেপেছে। ওয়েবসাইটে ছড়িয়ে দিয়েছে। লিফলেট বিলি করেছে।
সরকার চুপচাপ । দাদায় না হয় বাজারটাই নিচ্ছে। আমরা ক্ষমতায় যে আছি। কী মজা! প্রধানমন্ত্রী নিজে এসব দেশ সফরে গিয়েছেন। জোরালোভাবে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরতে পারেননি।
ফিরে এসে বলেছেন, সব মুশকিলের আসান হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখতে পেয়েছি, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো একযোগে বাংলাদেশের শ্রমিক ফেরত পাঠাচ্ছে। আর নিচ্ছে না কাউকে। সরকার মনে করেছে, দাদায়ই নিয়েছে। নিক।
আমরা পৃথিবীর অন্য কোথাও বাজার খঁুজে নেব। জেনারেল মইনউদ্দিন সরকারের মীরজাফর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বগল বাজিয়ে বলেছিল, মধ্যপ্রাচ্য বাজারের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলে চলবে না। পৃথিবীর অন্য কোনো স্থানে জনশক্তি রফতানির বাজার খুঁজে বের করতে হবে। কী এক রামছাগলীয় ধারণা! মইনউদ্দিন সরকারের উত্তরসূরি এ সরকার বলেই বসল, আমাদের লোক না নিলে আমরা আর কী করব? অন্য কোথাও বাজার খঁুজে দেখব। অর্থাৎ দাদাদের দিয়ে দিলাম মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার।
এর মধ্যে শত ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও টিকে ছিল গার্মেন্টস শিল্প। এখন সে শিল্প কফিনে বন্দী। কৃত্রিম গোলযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে এই শিল্পকে ধ্বংসের দ্বাড়প্রান্তে নিয়ে আসা হয়েছে। বীতশ্রদ্ধ ও নাচার হয়ে অনেক শিল্পোদ্যোক্তাই শিল্প বিক্রি করে দিয়েছেন, যেগুলো নামে-বেনামে কিনে নিচ্ছে ভারতীয়রাই। সরকার বুক ফুলিয়ে দু’হাতে মসনদ আঁকড়ে বসে আছে।
রাষ্ট্রের যা হোক, শিল্পের যা হোক, অর্থনীতির বাজুক বারোটা, ক্ষমতায় তো আছি। দাদারা যা খুশি করুক। আমার মসনদ রক্ষা করি।
বাংলাদেশ ভারতীয় স্বাধীনতাকামীদের মদদ দিচ্ছে বলে ভারতীয়দের প্রতিদিন কী যে হায় হায় রব, বাংলাদেশের ওপর কত ধরনের চাপ। সীমান্তে প্রতিদিন নরহত্যা, বাংলাদেশের ভূমি দখলের ধারাবাহিক পাঁয়তারা সব কিছুতেই এক নির্দয় নীরবতা অবলম্বন করে আছে সরকার।
শেখ হাসিনা তার মা, বাপ, ভাইয়ের মৃতুøর কথা বলে অনেক কেঁদেছেন। হয়তো দু-চারজনকে কাঁদিয়েছেনও। কিন্তু ভারতীয় বাহিনী প্রতিদিন সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা করে শত শত পরিবারে কান্নার রোল তুলেছে। গতকাল এক পত্রিকায় দেখলাম, জৈন্তাপুরে ২৪ জন বাংলাদেশীকে অপহরণ করেছে বিএসএফ। সরকারের কানে সে ক্রন্দন ধ্বনি কি পৌঁছায়? প্রধানমন্ত্রীর হৃদয় কি ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে? তা হলে প্রতিবাদ করেন না কেন? কেন রুখে ওঠেন না যে ভারত, নরহত্যা বন্ধ করো।
নাকি দু-চারটা লোক মেরেছে মারুক, ক্ষমতায় তো আছি।
এ রকম করতে করতে ভারত বাংলাদেশকেই খণ্ড-বিখণ্ড করার অপচেষ্টায় এখন মাতোয়ারা। গত ২২ জুলাই তেমনি একটি ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। বাংলাদেশের ১৯টি জেলা নিয়ে স্বাধীন বঙ্গভূমি গঠনের প্রকাশ্য আন্দোলন করছে ভারত ভূমিতে একদল লোক। তারা ইতিমধ্যেই সেখানে প্রবাসী সরকারও গঠন করেছে।
সে সরকারের রাষ্ট্রপতির নাম শিশির কুমার। তারা গত ২২ জুলাই গঙ্গা সীমান্তে এক সমাবেশ করেছে। সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হয়েছেন পঞ্চানন বিশ্বাস নামক এক লোক। তারা বনগাঁয়ে রীতিমতো এক আনুষ্ঠানিক সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। গার্ড অব অনার-ফনার এমন সব আনুষ্ঠাানিকতাও সম্পন্ন করেছে।
বনগাঁ স্টেশনে তারা সমাবেশ করে ঘোষণা দিয়েছে, আগামী ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে তারা খুলনার উপকণ্ঠে ‘সামন্ত নগরে’ স্বাধীন বঙ্গভূমির পতাকা উত্তোলন করবে। শুধু তাই নয়, ওই স্বাধীন বঙ্গভূমির রাষ্ট্রপতি শিশির কুমার জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ওই রাষ্ট্র স্থাপনের জন্য তারা ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। চব্বিশ পরগনার ঠাকুর নগরে ৮ জুলাই তাদের বিরাটসংখ্যক সেনা প্রথম দফার প্রশিক্ষণ শেষ করেছে।
অর্থাৎ বাংলাদেশকে বিখণ্ডিত করার জন্য ভারত তাদের ভূমিতে প্রকাশ্যে একদল লোককে সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং দিয়ে যাচ্ছে। তার পরও কানে তুলো ঢুকিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বাংলাদেশ সরকার কি চুপ করে বসে থাকবে? এরও কোনো প্রতিবাদ করবে না।
দেখা গেল করছে তো না। কিন্তু যদি এমন হতো, বাংলাদেশের ভেতরে একদল লোককে আসামের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রকাশ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং তারা আসাম সীমান্তের কাছে সমাবেশ করে ঘোষণা দিয়েছে, ১৫ আগস্ট তারা সেখানে স্বাধীনতার পতাকা তুলবে তাহলে কী হতো? ভারত সরকার কি চুপ করে বসে থাকত? নিশ্চয়ই নয়। তারা প্রতিবাদে সারা বিশ্ব কাঁপিয়ে তুলত। আর বাংলাদেশের মেরুদণ্ডহীন নতজানু সরকার টঁু শব্দটিও কি হারিয়ে ফেলেছে? দৃশ্যত তাই মনে হচ্ছে। জনসমর্থনহীন জনবিচ্ছিন্ন সরকারগুলো এ রকমই হয়।
রাষ্ট্রের চিন্তা নয়, প্রভুর মনোরঞ্জনেই তাদের অলস সময় কাটে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।