লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। ছয়টি রুটি
মোহাম্মদ ইসহাক খান
সকালবেলায় সব খাবারের দোকান থাকে ভীষণ ব্যস্ত। এই রুটির দোকানটিও।
ভেতরে থাকে অসংখ্য খদ্দের, যারা এই ছোট্ট কুঠুরিতে ঢুকে কর্মস্থলে যাবার আগে ভুরিভোজটা সেরে নেয়। শুধু তারাই হলে একটা কথা ছিল, বাইরে থাকে অনেক অনেক খদ্দের, যারা হাঁকডাক করে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে দোকানের লোকজনকে, প্যাকেটে কিংবা টিফিনবক্সে ভরে যাদের তাজা রুটি আর সবজি কিংবা ডিমভাজা নিয়ে যাওয়া চাই।
সেদিনও তাই ছিল। গরম তন্দুরটি ভীষণ ব্যস্ত, ঘামতে ঘামতে ছেলেটি একের পর এক রুটি বেলে বিকট আওয়াজে তন্দুরে ঠেসে দিচ্ছে ময়দার তাল। একটু পরই শিকের ডগায় তুলে আনছে সুন্দর ফোলা ফোলা একটা সুগন্ধি রুটি।
অনেকক্ষণ ধরে প্রক্রিয়াটির দিকে তাকিয়ে থাকলে নেশা লেগে যায়, কিন্তু তাকাবার সময় নেই কারো। তেল-চকচকে শরীর হয়ে গেছে ছেলেটার, ঘাম মোছার সময় পাচ্ছে না। পাশে দাঁড়িয়েই আরেকটা ছেলে মারমুখী খদ্দেরদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছে রুটি।
এই যে, ছয়টা রুটি দিন তো! মৃদু গলার আওয়াজ পাওয়া গেল।
ছেলেটা ঠোঙার ভেতর কয়েকটা রুটি ভরে আগের খদ্দেরকে বুঝিয়ে দিয়ে তাকাবার অবসর পেলো।
কমবয়সী একটা মেয়ে, সে রুটি চেয়েছে। তাকাতেই আবার বলল, ছয়টা রুটি। একটু বিব্রত দেখায় তাকে, যেন ছ'টা রুটি চাওয়া খানিকটা অন্যায়।
ছেলেটার কী যেন হল, ছোঁ মেরে তুলে নিলো ছ'টা রুটি, তড়িৎগতিতে ঠোঙায় ভরে বাড়িয়ে দিলো মেয়েটির দিকে। মেয়েটির আগেও কয়েকজন খদ্দের এসে দাঁড়িয়ে আছে, তাঁদের দিকে ওর খেয়াল নেই।
অন্য সময় হলে এই অন্যায় সমাদরের জন্য খদ্দেররা ক্ষেপে উঠত, কিন্তু এবার কিছু বলল না।
মেয়েটি রুটি নিয়ে মৃদু হেসে চলে গেল। কে জানে, দোকানের ছেলেটা হয়তো এই ছোট্ট উপহারটা পাবার জন্যই সে অন্যায়টা করেছে। মানুষ তো সে, অন্যায় তো মানুষই করে।
সারাদিনে আরও হাজারখানেক রুটি ঠোঙায় ভরল সে, একসময় খদ্দেরদের আনাগোনা কমে গেল, দোকানের ছেলেটা বসে বসে মাছি মারছে, তখনও ওর কানে বেজে চলেছে, ছয়টা রুটি দিন তো।
ছয়টা রুটি দিন তো। ছয়টা রুটি দিন তো। যেন ছ'টা রুটির মধ্যেই কী লুকিয়ে আছে। এত সুন্দর করে আর কেউ তো ছ'টা রুটি চায় নি তার কাছে।
কেন মেয়েটিকে নিয়ে সে এত ভাবছে, জানে না দোকানের ছেলেটি।
চেনে না, জানে না, সম্পূর্ণ অপরিচিতা একটা মেয়ে। এমনও নয় যে দেখতে হুরপরী। নেহাত সাদাসিধে একটা মেয়ে। তারপরও? আরও মেয়ে তো রুটি নিতে আসে, কই, তাদেরকে তো মনে থাকে না।
পরদিন সকালেও এলো মেয়েটি।
ঠিক আগের দিনের মতোই মৃদু স্বরে বলল, ছ'টা রুটি দিন তো। মেয়েটার সবকিছুই মৃদু। চলনবলন মৃদু, গলার স্বর মৃদু, হাসির শব্দ মৃদু।
ছেলেটি আজও ছোঁ মেরে ছ'টা রুটি ভরে দিলো ঠোঙায়। হয়তো আগের দিনের চেয়েও দ্রুত।
কোন কারণ নেই, অজ্ঞাত কারণে অন্যদেরকে এড়িয়ে মেয়েটিকে রুটি দেয়ায় কেউ তাকে কিছু বলল না।
সারাদিন ছেলেটির কানে শুধু বাজে, ছ'টা রুটি দিন তো। জল্পনা কল্পনা করে সে, ছ'টা রুটির মধ্যে কী আছে? কেন পাঁচটা কিংবা দশটা রুটি নয়, কেন ছ'টা রুটি? মেয়েটির পরিবারে কি সদস্য তিনজন, যারা রোজ সকালে দুটো করে রুটি খায়? নাকি আর কারো জন্য নিয়ে যায়? নাকি একাই ছ'টা রুটি খায় সে? অসম্ভব, হালকা-পাতলা গড়নের মেয়েটি এতবড় তন্দুর রুটি ছ'টা খেয়ে ফেলবে? আচ্ছা, হয়তো মেয়েটার কুসংস্কার আছে, হয়তো সে মনে করে ছয় হল তার শুভসংখ্যা, তাই যা কেনে তাই ছ'টা করে কেনে!
নিজের মাথায় চাঁটি মেরে নিজেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে দোকানের ছেলেটা, একদিনে অনেক ভেবে ফেলেছে সে, আর নয়। ভাবার দরকার কী? অচেনা-অজানা একজনকে নিয়ে? তার অন্যমনস্কতা খেয়াল করে দোকানের মালিক, সে এক খদ্দেরকে চারটার জায়গায় ছ'টা রুটি দিয়ে দিয়েছে দেখেও কিছু বলে না। সবাই কি কিছু আঁচ করতে পেরেছে, বুঝতে পেরেছে কিছু, সরু চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে? ছেলেটা লজ্জা পায়, একটু একটু ভয় পায়, বুক ধুকধুক করে তার।
আনন্দ মেশানো লজ্জা আর ভয়। ভারী মজার অনুভূতি তো। একটু অপরাধবোধ হয় তার, একজন ক্রেতার প্রতি এত অনুরাগ? হয়তো ভাল হচ্ছে না, কাজটা খুব খারাপ হচ্ছে।
গত দশ দিন ধরে ছেলেটি কেন যেন অবচেতন মনেই একটি কণ্ঠ শোনার জন্য অপেক্ষা করে, যে কণ্ঠটি সকালবেলায় এসে বলবে, ছ'টা রুটি দিন তো। যখনই শুনতে পায়, তখনই সে পেছনে ফেরে, আকর্ণবিস্তৃত হাসি উপহার দেয় মেয়েটিকে, চিলের মতো ছোঁ মেরে ছ'টি রুটি ঠোঙায় ভরে ফেলে, কিছুক্ষণের জন্য যেন অন্য খদ্দেরদের অস্তিত্ব ভুলে যায়।
মেয়েটি হৃদয়হীনা নয়, নাক উঁচু নয়, সে-ও হাসিটি ফিরিয়ে দেয়। হাসিই শুধু, আর কিছু নয়। দোকানের একটা ছেলে সে, তার সাথে কী কথা বলবে সে? সে ক্রেতা, আর ছেলেটি বিক্রেতা, এর বেশী কিছু নয়। তবুও এই হাসিটি দেখার জন্য অধীর হয়ে থাকে দোকানের ছেলেটি। তন্দুরের কাছ থেকে সরে না সে, পুরো সকাল ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, যদি মেয়েটি এসে ফিরে যায়?
পনেরো দিন পর এক সকালে অপেক্ষা করছিলো ছেলেটি, কিন্তু মেয়েটা এলো না।
সকালের মৃদু রোদ চড়া হয়ে উঠলো, তবুও এলো না। দুপুর হয়ে এলো, তবুও না।
ছেলেটি বসে বসে ভাবে। তার মন খারাপ করার কী আছে? এক ক্রেতা আসে নি, কত ক্রেতা তো এসেছে। নিয়মিত অনিয়মিত ক্রেতা।
যারা ছ'টা রুটির চেয়েও বেশী রুটি কিনবে। হয়তো মেয়েটির অসুখ করেছে, হয়তো যার জন্য রুটি কিনত, তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে, হয়তো মেয়েটির আর রুটি খেতে ভাল লাগছে না, হয়তো সে দোকান বদলেছে। তারপরও ছেলেটিকে একটা বিষণ্ণতা পেয়ে বসে।
একটু বুক কাঁপে তার। আচ্ছা, নিজের অজান্তে মেয়েটির সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করে ফেলে নি তো, অশালীন কিংবা অশোভন কোন আচরণ করে ফেলে নি তো? হয়তো সে মেয়েটির দিকে খুব কুৎসিতভাবে তাকিয়েছে, হয়তো রুটির ঠোঙা দেয়ার সময় মেয়েটির হাতে হাতে লেগে গেছে।
হয়তো ভাল রুটির সাথে কয়েকটা পোড়া রুটিও চলে গিয়েছিলো, খেয়ে মেয়েটার খারাপ লেগেছে, তাই মেয়েটা আর আসবে না? কেন ঐ লোকটা রুটিগুলো যত্ন করে সেঁকে দেয় না, কেন কয়েকটা পুড়ে যায়?
কেন মেয়েটি আসে নি, ভেবে ভেবে তোলপাড় করে ফেললো দোকানের ছেলেটা, কিন্তু খুঁজে পেলো না। কাজে মনোযোগ নেই তার, খদ্দেরদের সামনে খুব রুক্ষভাবে রুটির ঠোঙা ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো সে। কয়েকজন খদ্দের ভীষণ ক্ষেপে উঠলো, গালাগালি করতে লাগলো, কিন্তু সে গায়ে মাখল না। নিজেও ভেবে পাচ্ছে না, তার রাগ করার কী আছে?
মেয়েটি আর আসে নি। যদি আসতো, দোকানের ছেলেটি সব ক্রেতাকে এড়িয়ে মেয়েটির জন্য ছোঁ মেরে ছ'টা রুটি ঠিকই তুলে দিত।
না, সে মেয়েটিকে ভালোবাসে না, সে দোকানের একটা ছেলে, অতি সামান্য কাজ করে। তবুও দিত।
(১৭ মে, ২০১৩)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।