ঘসেটি বেগম সাহিত্য, চলচ্চিত্র বা নাটকপ্রসূত চরিত্র নয়। ঐতিহাসিক চরিত্র। কিন্তু নাটক, চলচ্চিত্র বা সাহিত্যে দাপটের সঙ্গেই নানা সময়ে নানাভাবে তিনি উপস্থিত এবং সুঅর্থে নয়, কুঅর্থেই। সাহিত্য বা ইতিহাসে খলচরিত্র অপ্রাসঙ্গিক নয়। সৎকে মজবুত ভিত দিতে অসতের উপস্থিতি শুধু বাংলা নয়, বিশ্বসাহিত্যেই অনিবার্য হয়েছে অসাধারণ সব সাহিত্যিকের সৃজনশীল রচনায়।
আর ইতিহাসে নিজ স্বার্থ জায়েজ করতে ব্যক্তি শুধু নয়, সমষ্টির পতনেও পিছপা হননি এমন ব্যক্তির নজির দুর্লভ নয়। তেমনই এক ব্যক্তি, একজন নারী ঘসেটি বেগম। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের, পলাশির আমবাগান ট্র্যাজেডির এক প্রভাবশালী খল চরিত্র তিনি। সিরাজের পরাজয়ের পেছনে ছিল যে ষড়যন্ত্র, তার একটা বড় অংশের হিস্যা ছিল তাঁর। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে মীর জাফর, রাজবল্লভ, জগৎ শেঠদের সঙ্গে ঘোট পাকিয়ে ঘসেটি পুরো বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতাটাই বিলিয়ে দিলেন ব্রিটিশ বেনিয়ার হাতে।
অথচ সম্পর্কে তিনি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার আপন বড় খালা!
সৃজনশীল নাট্যসাহিত্যে পলাশীর যুদ্ধটা এসেছিল সিরাজকে মূল চরিত্র করে। তার সঙ্গে আসে সে যুদ্ধের খল চরিত্রগুলো। বাংলা নাটক ও মঞ্চের অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিভা গিরিশচন্দ্র ঘোষ ১৯০৫-এ সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে নাটক লেখেন। ১৯৩৮ সালে শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তও লেখেন 'সিরাজদ্দৌলা'। বর্তমান আলোচনায় শচীন্দ্রনাথের নাটকটিকেই অবলম্বন করা হয়েছে।
তিনি এখানে সিরাজকে ট্র্যাজিক চরিত্র হিসেবেই শুধু দেখেননি, তাঁর মধ্যে জাতির ট্র্যাজেডি চিত্রটিও আঁকেন বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই। এ ক্ষেত্রে তিনি ইতিহাসের সঙ্গে মিশিয়েছেন কল্পনাকেও, কিন্তু সে কল্পনা ইতিহাসবিরোধী নয়। নাটকটির নিবেদন অংশে তাই নাট্যকার নিজেই লেখেন 'ইতিহাস ঘটনাপঞ্জি'। নাটক তা নয়। ঐতিহাসিক লোকের ঘটনাবহুল জীবনের মাত্র একটি ঘটনা অবলম্বন করেও একাধিক নাটক রচনা করা যায়।
যায় এ জন্যই যে ঘটনা নয়, ঘটনাটি ঘটার কারণই নাট্যকারের বিষয়বস্তু। সে 'ঘটার' কারণ অনুসন্ধান করতেই সিরাজের পাশাপাশি ঘসেটি চরিত্রটিও নাটকে উঠে এসেছে সমান গুরুত্বের সঙ্গেই। তাই নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যেই আমাদের দেখা হয় তাঁর রাজবল্লভের সঙ্গে কথোপকথনরত অবস্থায়। জানা হয়, তাঁর মতিঝিলের বাড়িটি সাজিয়ে দিয়ে গেছেন ইংরেজ বেনিয়া ওয়াটসের বউ। প্রকাশিত হয় তাঁর সিরাজবিরোধী ইংরেজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার বিষয়টিও।
তাঁর চেহারা-সুরতের কোনো বর্ণনা নাটক কি ইতিহাসগ্রন্থে সুলভ না হলেও তিনি সম্ভবত সুশ্রীই ছিলেন। নাটকের এ অংশে সাজগোজ করার পর তাঁকে কেমন লাগছে সে বিষয়েও তিনি জানতে চান রাজবল্লভের কাছে। তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়ের 'পলাশির যুদ্ধ' গ্রন্থে তাঁর ব্যক্তিচরিত্র সম্পর্কেও জানান এক চমকপ্রদ তথ্য, নবাব হওয়ার আগেই নাকি এক দিন প্রকাশ্য রাজপথে হোসেন কুলী খাঁ নামের এক ব্যক্তিকে সিরাজ খুন করেন; এ ব্যক্তির সঙ্গে ঘসেটির গুপ্ত প্রণয় ছিল বলে লোকের মধ্যে আলোচনা ছিল। ঘসেটির এ বিষয়ে দুর্নামও ছিল বেশ। এ নিয়েও হয়তো সিরাজের বিরুদ্ধে ঘসেটির অন্তরে ছিল চাপা এক প্রদাহ।
আলিবর্দী খাঁর কোনো ছেলে ছিল না, ছিল তিন মেয়ে। ছোট মেয়ে আমেনা বেগমের ছেলে সিরাজ। কিন্তু বড় মেয়ে ঘসেটি বেগম ছিলেন নিঃসন্তান। তাই সিরাজেরই ছোট ভাই আক্রামউদ্দৌল্লাকে পোষ্য নিয়েছিলেন। চেয়েছিলেন এ ছেলেই আলিবর্দীর পর হোক নবাব।
তা হলে হয়তো পর্দার আড়ালে বসে বাংলার শাসনযন্ত্রটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে তাঁর পক্ষে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অল্পবয়সেই বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় আক্রামের। তাই ওই ইচ্ছা তাঁর থেকে যায় অপূর্ণই। আক্রামের মৃত্যুশোকে ঘসেটি বেগমের স্বামী ঢাকার গভর্নর নোয়াজিশ খাঁও কিছুদিন পর মৃত্যুবরণ করেন। তার দুই মাস পর আলিবর্দীর মেজ জামাই সৈয়দ মোহাম্মদও মারা যান।
তখন ঘসেটির শেষ অবলম্বন মেজ বোনের ছেলে শওকত জঙ। কিন্তু বাবার জায়গায় শওকত পুর্নিয়ার নবাব হলে সিরাজের নবাব হওয়ার পথটা হয়ে যায় নিষ্কণ্টক। ঘসেটির রাজদ্রোহ তখন পায় এক গনগনে চেহারা। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। তাই রাজবল্লভের কাছেই তাঁকে আক্ষেপ করতে শোনা যায়, 'উঃ! আপনার কথায় বিশ্বাস করে কী নির্বোধের মতোই কাজ আমি করেছি।
সিংহাসনে সিরাজ সুপ্রতিষ্ঠিত হবে জানলে আমি আপনাদের দলে যোগ দিতাম না। সিরাজের প্রতি স্নেহ দেখিয়ে আমি সহজেই সিরাজের বিশ্বাসের পাত্রী হতে পারতাম! আপনাদের শক্তির ভরসায়, আপনাদের প্ররোচনায়, আমি সে পথেও কাঁটা দিয়ে রেখেছি। '
সিরাজও জানতেন তাঁর এসব দুরভিসন্ধির কথা। তাই সিংহাসনে বসেই প্রথম চোটটাই নিলেন ঘসেটির ওপর। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি ধনদৌলত-লোকলস্কর নিয়ে মুর্শিদাবাদের দক্ষিণে মতিঝিলের ওপর এক প্রকাণ্ড বাড়ি হাঁকিয়ে রাজার হালে বাস করছিলেন।
কিন্তু সিরাজ তাঁর ওপর প্রসন্ন ছিলেন না কখনোই। এত দিন আলিবর্দী খাঁ-ই ছিলেন বড় বাধা। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর সে বাধা আর থাকল না। সিরাজ জানতেন আক্রামউদ্দৌলাকে নবাব করতে আটঘাট বেঁধে লেগেছিলেন তিনি। এখন তাঁর চোখ পড়েছে শওকত জঙের ওপর।
তাঁকেই সিরাজের স্থলাভিষিক্ত করতে আঁটছেন ফন্দি। সে সুযোগ ঘসেটিকে তিনি আর দিতে চাইলেন না। আসলে আলিবর্দী খাঁর মৃত্যুর আগেই সিরাজবিরোধী দলটা যে তাঁকে কেন্দ্র করেই ডালপালা ছড়াচ্ছে, সে বিষয়েও অবগত ছিলেন সিরাজ। সেসবের বদলা নিতে এবং নিজ নবাবির ভিতটা পোক্ত করতে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো সিরাজ এবার চড়াও হলেন ঘসেটির মতিঝিলের বাড়িতে। তপনমোহনের ভাষ্যে, সৈন্যসামন্ত সব কয়েদ করে ধনসম্পত্তি সব নিলেন লুটে।
স্বামীর দীর্ঘদিনের সঞ্চিত অর্থ-ধনরত্ন সব চলে গেল নবাবের হাতে। ঘসেটির প্রাণ বাঁচলেও মান বাঁচল না। হলেন সিরাজের অন্তঃপুরে নজরবন্দি। তার ওপর নোয়াজিশ খাঁর মৃত্যুর পর ঘসেটি বেগমের ঢাকার দেওয়ান ছিলেন যে রাজবল্লভ, সে মুর্শিদাবাদ এলে সিরাজ কয়েদ করেন তাকেও। এসব ঘটনার অভিঘাত আরো উসকে দিল ঘসেটি বেগমকে।
খেপে হলেন আগুন।
এবার পেছন থেকে শওকত জঙকে উসকে দেওয়ার খেলায় নামলেন ঘসেটি। শওকতও বিশ্বাস করতেন নবাবি পদটা তাঁরই পাওনা। সিরাজকে তিনি যে নবাব বলে স্বীকার করেন না, এ বিষয়টা ছিল প্রকাশ্য। তাই ঘসেটিরই প্ররোচনায় ১৭৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর নবাবে-জঙে বাধে ঘোর যুদ্ধ।
বেদম ভাঙ খেয়ে হাতির পিঠে চড়ে যুদ্ধের ময়দানে এলেন শওকত। তারপর যা হওয়ার তাই_সিরাজের বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরার আগেই গোলার আঘাতে তাঁর মাথার খুলিটা গেল উড়ে। শওকতের নবাবির আশার এখানেই ইতি। কিন্তু হাল ছাড়লেন না ঘসেটি। তাঁর আঁতাত অটুট থাকল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মারফতে ইংরেজের সঙ্গে।
সিরাজের অন্তঃপুরে নজরবন্দি অবস্থায়ও ছড়াতে লাগলেন বিষবাষ্প।
তারই ছবিটা শচীন্দ্রনাথ এঁকেছেন নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে। সেখানে বসেও তিনি ভুলতে পারেন না মাতা হওয়ার অভিলাষটা। এবার সিরাজ, লুৎফা আর ঘসেটির কথোপকথন। ঘসেটিকে এখানে বলতে শুনি, 'অপরকে বঞ্চিত করে যে সিংহাসন পেয়েছ, সে সিংহাসন তোমাকে শান্তি দেবে ভেবেছ?' অথবা লুৎফাকে কাঁদতে দেখে, 'আজকের এ কান্না শুধু বিলাস।
চোখের জলে নবাব পথ দেখতে পাবেন না। বেগমকে আজীবন আমারই মতো কেঁদে কাটাতে হবে। আমিনা কেঁদে কেঁদে অন্ধ হবে। পলাশি-প্রান্তরে কোলাহল ছাপিয়ে উঠবে ক্রন্দন রোল। ' বিস্মিত, হতবিহ্বল সিরাজ প্রশ্ন করেন, 'ওই ঘসেটি বেগম মানবী না দানবী?' এর জবাবে লুৎফার মুখ দিয়েই যেন শচীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করেন ঘসেটি চরিত্রটা, 'ওর নিঃশ্বাসে বিষ, ওর দৃষ্টিতে আগুন, ওর অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ভূমিকম্প।
'
মোগল হেরেমের নারী-রাজদ্রোহের বল্গাহীন ঘোড়াটিই যেন ছুটে এসে ঢুকেছিল বাংলার নবাবের অন্তঃপুরেও। তার লাগাম টানতে পারেননি সিরাজও। তাই পলাশীতে জয় হয়েছিল খলেরই। সেই আম্রকাননে এক বিষবৃক্ষের মতোই যেন মীর জাফর, জগৎ শেঠদের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ঘসেটি বেগম। ইংরেজদের সব মিলিয়ে ছিল ৯৫০ গোরা আর ২১০০ সেপাই।
সঙ্গে মাত্র আটটি কামান আর দুটি বড় তোপ। অন্যদিকে সিরাজের ছিল জঙ্গি আর ঘোড়সওয়ার মিলে ৫০ হাজার সৈন্য এবং ৫৩টি বড় কামান। কিন্তু জয় হলো ঘসেটি গংয়েরই। ২৫ বছর বয়সে মাত্র ১৪ মাস নবাব ছিলেন সিরাজ। তারপর ঘসেটির ক্রোধ আর হিংসার দাবানলে পুড়েছেন তিনি।
তাই ঘসেটি বেগম আজ আর শুধু ব্যক্তিমাত্র নন। তার এ নাম আজ বিশেষ্য থেকে হয়েছে বিশেষণ। পরিণতি পেয়েছে এক ব্যক্তিক খল-মিথে। যুদ্ধ শেষে তার সাঙ্গাত মীর জাফর নবাব হয়েছিলেন ঠিকই; কিন্তু পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবেই কি (!), কুষ্ঠরোগে ১৭৬৫ সালে মারা যান তিনি। নবাবির লোভে মত্ত মীরন, সিরাজের বংশের একটি ছেলেকেও যে জ্যান্ত ছাড়েনি, তার মৃত্যু বজ্রাঘাতে।
কী দুঃখে কে জানে রবার্ট ক্লাইভ মরেছিলেন নিজের গলায় নিজেই ক্ষুর চালিয়ে। আর ঘসেটি বেগম? একদার দোসর মীর জাফরের ছেলে মীরনের কূটকৌশলে করুণ এক সলিল সমাধি হয়েছিল তার ঢাকার অদূরে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা আর ধলেশ্বরীর ত্রিমোহনায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।