বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
সূর্যদহ গ্রামের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে অনেক দিনের পুরনো একটি মজা খাল। সে খালের ধারে গাব গাছের সারি, চালতা গাছের সারি এবং খালের পশ্চিম পাশে ঘন বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড়ের ভিতরে অন্ধকার এবং সে অন্ধকারে একটি পাতায় ভরা সবজে রঙের পরিত্যক্ত পুকুর।
পুকুর পাড়ে ঘন ছায়ার আড়ালে সার সার প্রাচীন কবর । খাল পাড়ের এ দিকটায় গভীর নির্জনতা বিরাজ করে ও বাতাসে সারাক্ষন কচুরি পানার গন্ধ ভাসে ।
বাঁশঝাড়ের ছায়া বিছানো পথের ওপর দিয়ে নাচতে নাচতে যেতে দেখা যায় সূর্যদহ গ্রামেরই এক কিশোরীকে। নাম তার বাসনা। বাসনার পিছু পিছু যায় একটি লালচে বর্ণের নেড়ি কুকুর- নাম তার লাল ; হয়তো সূর্যদহ গাঁয়েরই কোথাও তার জন্ম।
তবে কুকুরটির নাম কে লাল রেখেছে -বাসনা জানে না। বালিকা বয়েস থেকেই এ পাড়া ও পাড়া ঘুরে বেড়ায় বাসনা ; দরগা পাড়ায় সখী মিতালিদের বাড়ি, পুব পাড়ায় প্রতিমা মাসীর বাড়ি, রোজ একবার বেনী দুলিয়ে সবুজ শাড়ি পরে নাচতে নাচতে ওদিকটায় একবার যাওয়া চাই।
লাল একদিন বালিকার সঙ্গী হল।
বাসনা যে লাল রঙের রোঁয়া-ওঠা দিশি কুকুরটিকে বিশেষ ভাবে লক্ষ করল, তাও না। তবে লাল কী কারণে ওর পিছু পিছু ঘুরতে থাকে।
একটা সংযোগ স্থাপন করতে চায়। এই লক্ষ্যে বাসনার সঙ্গে পাড়া বেড়ায়। তবে পাড়া বেড়ানো ছাড়াও লাল বাসনাদের বাড়ির উঠানে ঘুরঘুর করে, ঘুমায় বাসনাদের বাড়ির দাওয়ায়।
সূর্যদহ গ্রাম আর পুব পাড়ার মাঝখানে ছোট গরু-চরা ঘাসের মাঠ, তারই মাঝখান দিয়ে মেঠোপথ, বাঁ দিকে একটা তালগাছে ঘেরা পানা পুকুর, এদিকটায় কিছু ঝোপঝাড় । মাঠ পেরিয়ে মন্ডলবাড়ির সীমানা।
পুব পাড়া যাওয়ার পথে মাঝেমাঝেই মন্ডল বাড়ির মেজো ছেলে ইলিয়াস মন্ডলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় । যেতে যেতে বাসনা থমকে যায়। লালও থেমে অর্ধবৃত্তাকারে ঘোরে-কেউ কেউ করে। ফিনফিনে সাদা পাঞ্জাবি পরা বাবরী চুলের দীর্ঘকায় বলিষ্ট ফরসা যুবক ইলিয়াস মন্ডল, গলায় সোনার সরু চেইন, ফরিদ গঞ্জের উঠতি ধনবান ব্যাপারী সে, গোপালপুরে মমতা ‘স’ মিলের মালিক; ঠিকাদারীও করে। বাসনাকে দেখে ইলিয়াস ব্যাপারীর চোখ দুটি সরু হয়ে যায়।
কথা বলার চেষ্টা করে সে। ইদিকে কোথায় যাস রে বাসনা?
বাসনা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আড়ষ্ট বোধ করে। সে আড়ষ্টতা বোধহয় লালের সীমাবদ্ধ চেতনায় সঞ্চারিত হয়। সে ইলিয়াস ব্যাপারীর ওপর রাগ ঝাড়তেই বুঝি অদূরের রাজহাঁসটির দিকে তেড়ে যায়।
বাসনার শাড়ির আঁচলের তলায় একটা বাটিতে কতবেল ভর্তা, ওখান থেকে টক টক গন্ধ ছড়ায়। চারি দিকে ধবধবে সাদা রোদের আলো...আষাঢ় মাস। লালের তাড়া খেয়ে আতঙ্কিত রাজহাঁসটি বেলগাছের ওদিকে চলে যায়। বেলগাছে কাকের মেলা বসেছে। কা কা ডাকের চিৎকারে কান পাতা দায়।
বেলগাছের নিচে খুঁটিতে বাঁধা একটা কালো রঙের ছাগল। ওখানে একটি দশ-এগারো বছরের বালক দাঁড়িয়ে। বালকটির নাম ছায়েদ। সে খালি গায়ে থাকলেও কালো রঙের হাফপ্যান্ট পরে আছে। ছায়েদ মন্ডলবাড়ি মেজো বউ মায়মুনার মেজো ছেলে।
বাসনা পা বাড়ায়।
শোন।
বাসনা থমকে যায়।
আজ বিকালে সুতীর হাটে যামু। তোর জইন্যে কি আনব রে বাসনা?
কিছু আনতে হবে না।
(ইস্, কথাটা আমি বললাম কেন? কথাটা আমি বলতে চাইনি। )
লাল ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। বেলগাছের কাকেরা উড়াল দেয়। দূর থেকে সাইকেল ঘন্টি বাজিয়ে আশরাফ মাস্টারকে আসতে দেখা যায়।
পুব পাড়ার দিকে পা বাড়ায় বাসনা ।
শোন।
বাসনা থামে না। একটু আগে রোদ মুছে গেছে। কখন আবার মেঘ জমে; এইসব আষাঢ়ের দিনে বিশ্বাস কি! হুট করে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করবে। ক’দিন অবশ্য বৃষ্টি-টিস্টি হয়নি।
বাসনা বৃষ্টির অপেক্ষা করে অছে। বৃষ্টি এলেই ভিজবে। সেই সঙ্গে লালও ভিজবে। বৃষ্টিতে ভিজতে ওর ভালো লাগে। সম্ভবত লালেরও।
বৃষ্টিতে ভিজলে ওকে কেউই বারণ করে না। ও মনের সাধ মিটিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে। এই দেশে এতই সুখ। তবে ঐ ইলিয়াস মন্ডলরাই যা সুখের দেশের কাঁটা।
পুব পাড়ায় প্রতিমা মাসী বাসনার মা রওশন আরার সই-অনেক দিনের সম্পর্ক।
প্রতিমা মাসী বিধবা। তবে অবস্থা একেবারে মন্দ না। প্রতিমা মাসীর স্বামী গৌড়াঙ্গ হালদার সুতীর হাটের জনতা ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার ছিলেন। একটাই ছেলে প্রতিমা মাসীর। অরুন ভাই রূপগঞ্জে ‘বাটা’-র দোকানের কর্মচারী।
অরুন ভাইয়ের বউ ললিতা বউদিদিও অনেক ভালো। ভালো আর সুন্দরী। বাসনার মনের অনেক কথা জানে ।
জোছনা মাসী ঘরের মেঝেয় বসে চাল বাছছিলেন। মাঝবয়েসি সুন্দরী মহিলা।
গায়ের রং ফরসা । কাটা- কাটা চোখ নাকমুখ। পরনে সাদা শাড়ি। মাথার চুলে অবশ্য পাক ধরেছে। এ ঘরে জানালা দিয়ে অনেক রোদ ঢুকেছে।
দরজায় শব্দ হতেই প্রতিমা মাসী মুখ তুলে হাসেন। বলেন, আয় রে তিলোত্তমা। মাঝে মাঝে প্রতিমা মাসী বাসনাকে তিলোত্তমা বলে ডাকেন। বাসনা ধপ করে মেঝের ওপর বসে। তারপর আঁচলের তল থেকে কতবেল ভর্তার বাটি বের করে মেঝের ওপরে রাখে।
বলে, খাও গো মাসি।
আমি এখন খাব না রে।
ক্যান? উপাস দিচ্ছ?
না রে। একটু আগে ভাত খাইছি।
কি রানলা আজ?
বাইলা মাছ।
যাওয়ার সময় তর মায়ের জন্য নিয়া যাস। শুনলাম তোর দাদী আইছে রে বাসনা?
হ।
তোর মায়ে তোর দাদীর লগে কথা কয়?
না। বাসনা মাথা নাড়ে।
হিন্দু মাইয়াগো রাগ বেশি।
হইব না? বিয়ার পর দাদী মায়রে খাইতে দেয় নাই। বাসনা ফস করে ওঠে ।
তোর বাপের ওপর তোর দাদীর বড় রাগ হইছিল।
ক্যান?
তোর দাদীর ইচ্ছা ছিল তোর বাপের লগে তোর দাদীর খালাতো ভাই শমশের আলী পান্নার মেজ মেয়ের হাসনার বিয়া দিব। শমশের আলী পান্নার কাছে এক লাখ টাকা কর্জ নিসিল।
উত্তরপাড়ায় জমি কিনব।
দাদীর যেমন বুদ্ধি! বলে বাসনা মুখ বাঁকায়।
হ । তোর মায়ে যাত্রা করত। ফরিদগঞ্জের মেয়ে।
যৌবনকালে ফুটফুটে রূপসী ছিল দেখতে। এই জন্য তুই রূপসী
হইছস। বলে বাসনার থুতনি নেড়ে দেন প্রতিমা।
বাসনা লজ্জা পায়। ওর ইলিয়াস ব্যাপারীর ফরসা বসন্ত খাওয়া মুখটি মনে পড়ল।
ও আজ ইলিয়াস ব্যাপারীর চোখে লোভ দেখেছে। কথাটা মাসীকে বলা যায় না। ললিতা বউদিদি থাকলে বলা যেত। তো ললিতা বউদিদি তো বাসায় নেই। বউদিদির বাচ্চা হবে।
দু’মাস ধরে বাপের বাড়ি গেছে।
তোর বাপে রাইতবিরাইতে সুতীর হাটে গেছিল যাত্রা দেখতে। প্রতিমা মাসী বলেন। ‘বিরহী সীতার পালা’। গিয়া তোর মায়েরে দেখল।
মনে ধরল, বিয়ার প্রস্তাব দিল। তোর মা হিন্দুর মেয়ে। নাম বাসনা পাল। তারপরেও তোর বাপরে মনে ধরল। তারা দুইজনে যুক্তি কইরা পলাইল।
তোর বাপ আর তোর দাদীর বাড়ি উঠে নাই। বিয়ার আগে তোর মায়ে মুসলমান হইল, তবে হিন্দুয়ানি যায় নাই। বিয়ার দশ বছর পর তুই হইলি। তখন তোর নাম রাখল বাসনা।
শুনতে শুনতে আনমনা হয়ে যায় বাসনা।
কী কারণে ওর কাঁদতে ইচ্ছে করে।
কাল রাইতে খারাপ স্বপ্ন দেখছি। প্রতিমা মাসী বলেন।
কি দেখলা মাসী? বাসনা বিষন্নতা টের পায়।
দেখলাম, ... থাক সে কথায় কাম নাই।
তুই আমার লগে আয়। বলে উঠে পড়েন প্রতিমা । তারপর ঠাকুরঘরের দিকে যেতে থাকেন। ঠাকুরের সামনে থেকে বেলাপাতা তুলে নেন। আঙুলে লিখলেন ‘শিব’।
তারপর লাল রঙের সুতলিতে বাসনার বাহুতে বেঁধে দিলেন। ততক্ষণে বিকেল গড়িয়ে আসে। আকাশে মেঘ জমে ওঠে। বাতাস অস্থির হয়ে ওঠে।
আমি যাই গো মাসী।
বৃষ্টি আসতেছে। বলে বাসনা উঠানে এসে দাঁড়াল। উঠানে কালো ছায়া জমে আছে। বাতাসে সজনে গাছের ডালপালা নড়ছিল সরসর করে। লাল কে কোথাও দেখল না।
মাঝে মাঝে লাল এমন করে উধাও হয়ে যায়। তখন কই যে যায় কে জানে!
বৃষ্টি শুরুর আগেই ইলিয়াস ব্যাপারী সুতীর হাটের নূরীবালার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। নূরীবালার ঘরটি দোতলায়। একতলায় জনতা ব্যাঙ্কের লোকাল শাখা। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির কাছে কালো রং করা কালেপসআবল গেইট।
তার সামনে পাটল রঙের উর্দি পরা দারোয়ান। জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ।
ইলিয়াস ব্যাপারী অবশ্যি আমজনতার একজন নয়।
এ অঞ্চলে পল্লী বিদ্যুৎ দিনের বেলাতেও ঝামেলা করে। ঝড়বৃষ্টির সময় তো কথাই নেই।
আজ দুপুরের পর থেকেই বিদ্যুৎ ছিল না। বিকেলের দিকে আকাশে মেঘ জমে উঠলে বিরক্ত হয়ে মোম জ্বালায় নূরীবালা। ড্রেসিংটেবিলের সামনে ঘিয়ে রঙের লাল পাড় গরদের শাড়ি পরে বসেছিল মাঝবয়েসী বিগত যৌবনা নূরীবালা । তবে অতিথি অভ্যাগতদের আগমনে এখনও তেমন ভাঁটা পরেনি। ফরসা ছড়ানো কপালে লাল টিপ আঁকছিল।
ঝকঝকে আয়নায় ভরাট মুখটি দেখে আপনমনে হাসল। ড্রেসিংটেবিলটিও খানদানী, মূল্যবান - সদ্য প্রয়াত উপজেলা চেয়ারম্যান শমশের আলী পান্নার শেষ উপহার। জীবদ্দশায় তিনি নিয়মিতই নূরীবালার ঘরে আসতেন, মদ্য পান করতেন, ম্যাসেজ করিয়ে নিতেন। বর্তমানে ইলিয়াস ব্যাপারী ও আসে। এসব ব্যাপারে জুনিয়ার -সিনিয়ার বলে কিছু নেই।
এসব ব্যাপারে একমাত্র যোগ্যতা হল- তাকৎ। আর মাসওয়ারি কে কত ‘মাল’ কামায় তার ওপর।
ঘরের দেওয়াল সাদা চুনকাম করা। এক বাংলা ক্যালেন্ডার বাদেও পুব পাশের দেওয়ালে ঝুলছে বিদ্রোহ কবির ঝাঁকড়া চুলের সেই বিখ্যাত ছবিটি। এ ছবি এ রকম ক্রাইম জোনে কেমন করে এল তা গবেষনার বিষয়।
খুক খুক করে কেশে ইলিয়াস ব্যাপারী ঘরে ঢুকল। নূরীবালা মুখ টিপে হাসে। ছোকড়া কখনও শরীর ছোঁয় না, ছোকড়া যত টান কম বয়েসী বালিকাদের প্রতি, মন্ডলের পো শুধু পান করতে আসে।
এদিকে কালো রঙের ঢাউশ পুরনো একটি ডবল সোফা। (স্থানীয় এক প্রভাবশালী সংসদসদস্যের উপহার।
ঢাকার গুলশান ২-এর একটি পুরনো ফর্নিচারের দোকান থেকে কেনা। ট্রাকে করে তিনিই পাঠিয়ে দিয়েছিলে। ) সোফায় ধপ করে বসে ইলিয়াস ব্যাপারী জিগ্যেস করে, আছে নাকি রাই?
নূরীবালার উচুঁদরের সমঝদারদের মধ্যে নূরীবালার অপর নাম: ‘রাই। ’
নাই আবার। কন্ঠে গভীর অনুরাগ ঢেলে বলে নূরীবালা।
তারপর উঠে ওপাশের কাঠের আলমারীর কাছে যায়। আলমারীটি উপহার দিয়েছিল গোপালপুরের ইঁট ভাঁটার মালিক নিবারন চন্দ্র রায়। বুকে আঁচল সরালে লাল ব্লাউজ ভারী স্তনের আভাস ফুটে ওঠে। ওদিকে চোখ যেতেই ইলিয়াস ব্যাপারী চোখ চকচক করে ওঠে। তবে নূরবালার জন্য নয়, বাসনার জন্য।
বাসনার স্তন দুটি পিষ্ট করার ভয়ঙ্কর ইচ্ছে জাগে। আলমারীর পাল্লা খুলে পাঁইট বার করে নূরবালা। ভারতীয় লাল মদ। সীমান্তের এদিক-ওদিক ঘুষ দিয়ে জিনিসটা নূরীবালা নিজেই ইমপোর্ট করে। বোতলের অর্ধেকটা ড্রামে ফেলে পানি মেশায়, তারপর আবার বোতলে ভরে।
উচুঁদরের সমঝদারদের চড়া দামে বেচে। এসব ছাড়াও আরও দু' নম্বরী ধান্ধা আছে মহিলার।
ঝকঝকে গেলাসে ঢেলে দেয় মধুবর্ণের তরল।
ইলিয়াস ব্যাপারী চুমুক দেয়। আহ্ ।
কন্ঠনালী ও অন্ননালী দিয়ে জ্বলতে জ্বলতে নেমে যায় ঝাঁঝালোতরল। বলে, কাজ কামের ঠেলায় অনেক দিন তুমার এখানে আসা হয় না রাই । তোমার দিন কেমন যায় গো?
ব্যবসাপাতি খারাপ। বলে মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে নূরবালা। নবীগঞ্জে নতুন মেয়ে এসেছে।
সবাই এখন তার পানে ছুইটছে।
কে? কার কথা বল?
রেশমী না কি নাম-
অ।
ওখানে যাওয়া হয়েছে নাকি? নূরবালা মুখ টিপে হাসে।
হ্যাঁ। নিবারনদা একবার নিয়ে গেছিলেন।
তা কেমন লাগল শুনি?
ভালো না। মাইয়াটা নাকি ফিলমের এক্সটা ছিল ।
নূরীবালার মোবাইলটা বাজে। ফোনটা তুলে কার সঙ্গে হেসে কথা বলে। কথা শেষ করে ফোন অফ করে দেয়।
তারপর ইলিয়াস ব্যাপারীর দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বলে, এবার আমারে মাফ করতি হয়। পান্নাবাবুর বড় ছেলে আইসতেছেন ইয়ার দোস্তদের নিয়া।
ইলিয়াস ব্যাপারী তাকৎ আছে বটে। তবে সে এখনও পান্নাবাবুর বড় ছেলের মত রুই-কাতলা হয়ে ওঠেনি। পান্নাবাবুর বড় ছেলে মানে আরমান বাবু... তেরো খুনের আসামী, লেটেস্ট মডেলের পাজেরো নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
খুন না করলে আজকাল জাতে ওঠা যায় না, থানার ওসি বেটাও সালাম দেয় না। ইলিয়াস ব্যাপারী ‘স’ মিলের ব্যবসার আড়ালে ভারত থেকে ফেনসিডিল চোরাচালান করে বটে-তবে এখনও পর্যন্ত সে খুনখারাপি করেনি বলে অনেকটা পিছিয়ে আছে। গাঁয়েগঞ্জে সম্মান পেতে হলে অতি সত্ত্বর একটা খুন-টুন করতে হবে।
বাকি তরল দ্রুত গলায় ঢালে ইলিয়াস ব্যাপারী । তারপর ৫০০ টাকার একটা নোট ফেলে উঠে দাঁড়ায়।
ইলিয়াস ব্যাপারী যখন টলতে টলতে নীচে নেমে এল ততক্ষনে সন্ধ্যা উৎরে গেছে। আলোও এসে পড়েছে। তার পা দু’খানি টলছিল। গুনগুন করে গাইছিল: “আমার বুকের মইধ্যে খানে / মন যেখানে হৃদয় সেখানে। ”
ঠিক তখনই কাদেরের চায়ের দোকানের সামনে লালকে দেখে ইলিয়াস ব্যাপারী শরীর জুড়ে এক শিহরণস্রোত টের পায়।
এক বিকেলে খালপাড়ের বাঁশঝাড়ের ভিতরে পরিত্যক্ত সেই পুকুরটির পাশে বাসনার ক্ষতবিক্ষত লাশ আবিস্কার করে সূর্যদহের গ্রামবাসী শোকে দুঃখে ডুকরে কেঁদে ওঠে।
কে এমন কাজ করল!
মেয়েটির লাশটা বৃষ্টিতে ভিজছিল।
বাসনার মৃত্যুর পর লালকেও মুষড়ে পড়তে দেখা যায়। সারাক্ষন বাসনার কবরের আশেপাশে ঘুরঘুর করে। খালপাড়ের বাঁশঝাড়ের আশেপাশেও অবিরাম ঘোরঘুরি করতে দেখা যায়।
মধ্যরাত অবধি বাসনাদের বাড়ির সামনে বিষন্ন সুরে কাঁদে।
ক’দিন পর।
তখন বিকেল: শেষ বেলার নম্র মনোরম আলো ছড়িয়ে ছিল সুতীর হাটের দোকানপাট, টিনের চালা, গাছপালা ও হাটের ধূসর জনমানুষের ওপরে। কাদেরের চায়ের দোকানে চা খেয়ে ইলিয়াস ব্যাপারী বেড়িয়ে এসে আড়মোড়া ভাঙল। মুখখানা ঝকঝক করছে তার।
শেষ বেলার আলোয় চিকিয়ে ওঠে কন্ঠেরগলার সোনার চেইন, ফিনফিনে সাদা পাঞ্জাবিতে তাকে বাংলা সিনেমার এক উঠতি নায়কের মতো মনে হয়। একটা বেনসন লাইটস ধরাল লোকটা। ঘটনাটা তখনই ঘটল। হঠাৎই ইলিয়াস ব্যাপারীর ওপর ক্ষিপ্রগতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে লাল । বিপদের আশঙ্কায় হাটের লোকজন থমকে যায়।
কেউ কেউ এগিয়ে আসতে চায় ...ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এক হাট লোকের সামনে সৌখিন যুবকটিকে তীক্ষ্ম দাঁতে ও নখে আছড়ে কামড়ে রক্তাক্ত করে ফেলতে থাকে বাসনার কুকুর...
কাছেই দোতলা একটি দালানের গ্রিলে ঘেরা বারান্দার আড়াল থেকে মর্মান্তিক দৃশ্যটি দেখে আতঙ্কে হিম হয়ে যায় নূরবালা ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।