রাজনীতির আবর্জনাগুলো বাদ দিলে আপনার সাথে আমার দ্বিমত খুবই সামান্য।
২০০৭ সালের ১১ ই জানুয়ারি!সবার চোখ ছিল বঙ্গভবনের দিকে। কী ঘটেছিল সেদিন?কিভাবে জারি হলো জরুরি অবস্থা?নিজের চোখে দেখা সেই ঘটনা প্রবাহের বর্ণনা দিয়েছেন মোখলেসুর রহমান চৌধুরী
লেখক পরিচিতিঃ বিশিষ্ট সাংবাদিক মোখ্লেসুর রহমান চৌধুরী ২০০৬-০৭ মেয়াদকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের উপদেষ্টা ছিলেন। এর আগে তিনি ২০০৪ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ইতোপূর্বে পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বাংলাদেশের বৈদেশিক সাংবাদিক সংস্থা ওকাব-এর প্রেসিডেন্ট এবং কমনওলেথ জার্নালিস্টস্ এসোসিয়েনের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন।
তিনি এখন যুক্তরাজ্যে পি এইচ ডি করছেন গভার্নেন্স নিয়ে।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারী আমি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড: ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। সেদিনের বঙ্গভবনের ঘটনা সহ আগে পরের অনেক ঘটনাই আমার প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে। এ নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক পত্রিকা ও গণমাধ্যমে আমি ১১ জানুয়ারী ও তার পূর্ববর্তী ঘটনা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
জেনারেল মইন উ আহমেদ তার বইয়ে আমেরিকার সংঘটিত নাইন ইলেভেনের আদলে বাংলাদেশে ১১ জানুয়ারীকে ওয়ান-ইলেভেন হিসাবে আখ্যা দিয়ে এর বিশেষত্ব প্রকাশ করতে চেয়েছেন।
সেই তারিখে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড: ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ সেনাপ্রধানকে বঙ্গভবনে তলব করেননি। বঙ্গভবনে সশস্ত্রবাহিনীর কর্মকর্তাদের প্রবেশ ছিল আন কল্ড ফর। তাকে বঙ্গভবনের গেটে আটকে দেয়া হয়েছিল। সেই কারণে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের (পিজিআর) প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু মুহাম্মদ সোহাইলকে রাষ্ট্রপতির অনুমতি ছাড়াই তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল।
সেনা অভ্যূত্থানকে সমর্থন না করায় রাষ্ট্রপতির অনুমতি ছাড়াই এনএসআইর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল।
মেজর জেনারেল আকবর আকতার ও মেজর জেনারেল শরীফউদ্দিন আহমেদকে একইভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনে নবম পদাতিক ডিভিশনের তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল মাসুদউদ্দিন চৌধুরীর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ন। সশস্ত্র অবস্থায় অনেককে নিয়ে জেনারেল মইন বঙ্গভবনে প্রবেশ করেছিলেন। তিনি তার স্ত্রী ও সন্তানদের ভাইদের হাতে সঁপে দিয়ে বঙ্গভবনে এসেছিলেন।
আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের কমিটির বৈঠক চলাকালে দুপুর পৌনে দুইটায় রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব (এমএসপি) রাষ্ট্রপতিকে জানান যে, তিন বাহিনী প্রধান তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসছেন।
প্রটোকল হচ্ছে রাষ্ট্রপতি নির্দেশ দেবেন তারপরে সাক্ষাৎ হবে। আর এ ক্ষেত্রে এমএসপি রাষ্ট্রপতির ওপর চাপ দিয়ে বলছেন, মিটিংটি শর্ট করতে হবে। এ সময়ে আমি কয়েক মিনিটের জন্য আমার রুমে গিয়ে পরিস্থিতি অনুধাবনের জন্য দুএকটি গুরুত্বপূর্ন স্থানে এ বিষয়ে ফোন করে মিটিংয়ে ফেরত আসি। রাষ্ট্রপতি আমার সাথে আলাপ করে এমএসপিকে বললেন, এ বিষয়ে পরে কথা বলব। রাষ্ট্রপতি আইন শৃঙ্খলা কমিটির বৈঠক শেষ করে দুপুর ২ টায় আমাকে নিয়ে রাষ্ট্রপতির অফিস কক্ষে যান।
অন্যদিকে ওই সময় সেনাপ্রধান লে: জেনারেল মইন রাষ্ট্রপতির অনুমতি পাওয়ার আগেই বাকি দুই বাহিনী প্রধানকে নিয়ে বঙ্গভবনের গেটে হাজির হন এবং পিজিআর কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হন।
এরপর রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব মেজর জেনারেল আমিনুল করিমের সহযোগিতায় বঙ্গভবনে প্রবেশ করে এমএসপির রুমে আসন গ্রহণ করেন। সেখানে এমএসপি-র তত্ত্বাবধানে এসএসএফ কর্মকর্তার মাধ্যমে ট্রেতে করে স্যান্ডউইচের নামে তিনটি অস্ত্র সরবরাহ করা হয়। রাষ্ট্রপতির কক্ষে অবস্থানকালে রাষ্ট্রপতি ও আমি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করি। বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে ডাইনিং রুমে মধ্যাহ্ন ভোজে যাই।
খাওয়ার শেষে রাষ্ট্রপতির ইনস্যুলিন নেয়ার কথা ছিল। ইত্যবসরে ডাইনিং রুম থেকে আমি আমার রুমে যাই জরুরী কোনো সংবাদ আছে কি না জানার জন্য। এসময় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ টেলিফোন যোগাযোগ হয় । রাষ্ট্রপতি আমাকে দ্রুত তার কাছে ফেরত আসার জন্য বলেছিলেন । আমি ফিরে আসার আগেই রাষ্ট্রপতি বেডরুমে যাওয়ার পথে সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মো: আমিনুল করিম রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে সিটিং রুমে ঢুকান।
সেখানে সেনাপ্রধান তার সহযোগীদের নিয়ে সদলবলে নজিরবিহীনভাবে অনুপ্রবেশ করেন । কিছু সময়ের মধ্যে আমি ফিরে এসে রাষ্ট্রপতির নিকট যেতে চাইলে কর্তব্যরত এসএসএফ কর্মকর্তা আমাকে জানান, স্যার আপনার ঢুকতে মানা-----। কে মানা করেছে জিজ্ঞাসা করতেই অফিসারটি জানান, সেনাপ্রধান ও এমএসপি ।
ওই কক্ষে জেনারেল মইনের সাথে ছিলেন নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল হাসান আলী খান, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল ফখরুল আজম, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের পিএসও মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, এসএসএফ ডিজি মেজর জেনারেল সৈয়দ ফাতেমী আহমেদ রুমী, রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব মেজর জেনারেল আমিনুল করিম, ডিজিএফআই-র ভারপ্রাপ্ত ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল চৌধুরী ফজলুল বারী। তিন বাহিনী প্রধান ছাড়া বাকি কর্মকর্তারা আইন শৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভা উপলক্ষে আগেই বঙ্গভবনে এসেছিলেন।
রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করার সময় জেনারেল মইন সশস্ত্র অবস্থায় ছিলেন। রাষ্ট্রপতিকে ভয় দেখানোর জন্য জেনারেল মইনের অস্ত্র দৃশ্যমান অবস্থায় ছিল।
সেনাপ্রধান মইন বিভিন্ন বিষয়ে উপস্থাপনা দিয়ে ড: ইয়াজউদ্দিনকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশে জরুরী আইন জারির আদেশে সই করতে বলেন। রাষ্ট্রপতির ভাষণ, জরুরী অবস্থা জারির কাগজপত্র এবং প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগপত্র ইত্যাদি কাগজপত্র সেনাপ্রধান ও তার সহযোগীরা আগেই তৈরী করে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। চাপের মুখে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে না চাইলে সেনাপ্রধান মইন কলম এগিয়ে দেন।
লে: জেনারেল মইন রাষ্ট্রপতির সামনে থেকেই মেজর জেনারেল মাসুদকে বঙ্গভবনে আসার জন্য কয়েকবার নির্দেশ দেন। ঘন্টাখানেক পরে নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মাসুদ এ কক্ষে প্রবেশ করে মইনের সাথে যোগ দেন। এরপরে রাষ্ট্রপতি মইন ও তার সহযোগীদের সম্মিলিত চাপের মুখে তাদের দেয়া কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেন। রাষ্ট্রপতি এ বিষয় নিয়ে তার পত্নী ও আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। আমাকে তিনি তাদের উপস্থিতিতে ডেকেছিলেন।
কিন্তু আমাকে সেখানে যেতে দেয়া হয়নি। সই করার সময় আতংকে রাষ্ট্রপতির হাত কাঁপছিল।
পদত্যাগপত্র ও জরুরী অবস্থার অধ্যাদেশ ছাড়াও অনেকগুলো সাদা কাগজে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর নেয়া হয়। পরবর্তীতে এ সকল সইয়ের মাধ্যমে নানাবিধ অবৈধ কাজ হাসিল করা হয়। এ ঘটনার পরে বঙ্গভবনের ভেতরে ও বাইরে সর্বত্র সৈন্য,গোয়েন্দা ও সেনা কর্মকর্তার উপস্থিতি বাড়িয়ে দেয়া হয়।
সেনাপ্রধানের সরবরাহ করা জাতির উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতির ভাষনের কপি আমি আমার দায়িত্ব হিসাবে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরমর্শ করে সংশোধন করেছিলাম। কিছু আপত্তিকর লাইন কেটেছিলাম। এছাড়াও ভাষণে কিছু অসাংবিধানিক তথ্য লক্ষ্য করে সে বিষয়ে আমার কক্ষে উপস্থিত সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষন করলে তারা তখন বলেছিলেন, বিষয়টি সেনাপ্রধান করেছেন। তাই আপনি তাকে বলতে পারেন। তখন বঙ্গভবনে যুদ্ধংদেহী অবস্থা।
বিপুল সংখ্যক সেনা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা গিজগিজ করছে।
সেনা প্রধানের সঙ্গে রাত সাড়ে বারটায় এ নিয়ে আমার কথা হলে আমি তাকে বললাম, আপনাদের লেখা এ ভাষণে ৯ জন উপদেষ্টার কাছ থেকে পদত্যাগপত্র গ্রহণ এবং অপর উপদেষ্টা বিচারপতি ফজলুল হককে ভারপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব প্রদানের যে কথা বলা হযেছে তা মারাত্মক ভুল ও সংবিধান পরিপন্থি। তখন সেনা প্রধান আমাকে বলেন, ভাষণসহ অনেক ক্ষেত্রেই অনেক ভুল হয়ে গেছে। এগুলো নিয়ে এখন কথা না বলাই ভালো। সেনা প্রধানের সাথে কথা শেষ হওয়ার পরে শেখ হাসিনা ফোনে আমার কাছে জানতে চান, উপদেষ্টাদের কাছ থেকে পদত্যাগ পত্র নেয়া এবং বিচারপতি ফজলুল হককে ভারপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টা করার মতো ভুলগুলো কি করে হলো।
আমি তাকে জানাই যে, সেনাপ্রধান এগুলো করেছেন এবং এইমাত্র আমি এ বিষয়ে সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা বলেছি।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারী আসলে দেশে জরুরী অবস্থা জারি নয়, বরং মার্শাল ল জারির চেষ্টা করা হয়েছিল।
সেনাপ্রধান মইন জাতিসংঘের যে কর্মকর্তা মি.গুইগিনোর কথা উদ্ধৃত করেছেন তা সত্যের অপলাপ মাত্র এবং জাতিসংঘকে ব্ল্যাক মেইলিং করার নামান্তর। মি.গুইগিনো কেবলমাত্র জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন। সদস্য দেশের রাজণৈতিক বা নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয় ছিল তার এখতিয়ার বহির্ভু’ত।
জেনারেল মইন তার নিজ স্বার্থে মি.গুইহিনোকে আগের দিন ফোন করে পাননি। মি.গুইগিনো যখন ফোন ব্যাক করেছিলেন তখন আবার মইন অফিসে ছিলেন না। কিন্তু মইনের ফোনের জবাবে গুইগিনোর কলকেই মইন জাতিসংঘের থ্রেট বলে চালিয়ে দিয়েছেন তার বইয়ে। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনান, যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারী অব ষ্টেট নিকোলাস বার্নস ও সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিচার্ড বাউচার, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিসা রাইস, জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত ক্রেইগ ডেনেম এবং কমনওয়েলথ মহাসচিব ডন ম্যাককিননসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আমাদের প্রতিনিয়ত যোগাযোগ ছিল। ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্টদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিসও এ ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে অনেক বৈঠক করেছেন।
এসব ক’টনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র সেদিন মার্শাল ল বিরোধী অবস্থান নিলে জেনারেল মইনের মার্শাল ল জারীর চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ফলে জেনারেল মইন তার পরবর্তী অপশন জরুরি অবস্থা জারীর পরিকল্পনা ধরে আগান। জেনারেল মইন অবশ্য তার লেখায় স্বীকার করে নিয়েছেন, তাদের সামনে তখন তিনটি অপশন ছিল।
প্রথম, অপশন ২২ জানুয়ারী নির্বাচন করতে সহযোগিতা করা, দ্বিতীয়, বিকল্প মার্শাল ল’ জারি এবং
তৃতীয়, বিকল্প জরুরী অবস্থা জারি করা।
(চলবে)
লেখাটি কয়েক অনেক বড় তাই কয়েক পর্বে দিতে হবে।
সংগ্রিহীত: বাংলা টাইমস, লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।