বৌমাটি ভারী লক্ষী। সে আমাকে এনেছিল তার শশুর মশায়ের খেদমত করবার জন্য। সে যেখানে ঝিয়ের কাজ করে, আমি আগে সেই বাসায় ছিলাম। ওবাড়ীর বৃদ্ধাটি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধাশ্রমে নতুন কোন দর্শনার্থী এলে মনে করবে বাংলাদেশের গড় আয়ু বুঝি অনেক বেশী।
আশেপাশে যাদের দেখা যায় তাদের বেশীর ভাগই বেশ বয়স্ক। ওরা তাঁকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে খুবই উপকার করেছে। পাইল্সের অপারেশানের পর থেকে স্বেচ্ছায় আর বেগ নিয়ন্ত্রন করতে পারতেন না তিনি। সময়ে অসময়ে বিছানা নষ্ট হলে প্রচন্ড দুর্গন্ধ ছড়াত। কাজের মেয়েটা ফাজিলের ফাজিল, কাছে আসতে চাইতো না।
ব্যস্ত ছেলের ব্যস্ত বউ সারাদিন পরিশ্রম করে। সংগঠনের প্রায় সব দায়িত্ব তার কাঁধে। সমাজের আনাচে কানাচে কত রকমের সমস্যা! আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সঙ্গীর কোন অভাব নেই বৃদ্ধাশ্রমে। কিন্তু কতক্ষণ ইবাদত করা যায়, কতক্ষণ আর গল্পগুজব করে সময় কাটানো যায়? তবে এই বয়সে এসে সমবয়সী’র চেয়ে অসমবয়সীদের সঙ্গে গল্প করতেই মনটা বেশী আকুলি বিকুলি করে। তিন বছরের নাতনীটার কথা মনে পড়ে প্রায়।
মাথা আঁচড়ে দেবে বলে প্রায় চিরুনী নিয়ে তার পেছনে ঘুরঘুর করত। ঈশ্ ওদের সকলকে নিয়ে যদি এক সাথে থাকা যেত! কাজের মেয়েটার জন্যেও তো একটি রুম বরাদ্দ আছে, আছে না? তার চাহিদা তো কাজের মেয়েটার চাইতে বেশী নয়। বরং এখানেই কি তার জন্য বেশী খরচ বহন করতে হচ্ছে না? অবশ্য এই খরচা বহন করতে ছেলে বা ছেলের বউয়ের নিশ্চয় তেমন কষ্ট হয় না। তারা খুব ভাল রোজগার করে। রাতদিন এই সব চিন্তা বৃদ্ধার মনে।
দুপুর বেলায় ভাত ঘুমের সময় মনটা বেশী বাঁধনহারা হয়ে ওঠে। কত কি ভাবতে চায়। ভাবতে চায়, নাতনীটা বাবা মাকে সাথে নিয়ে হঠাৎ তার সামনে এসে হাজির। অবশ্য ফোনে প্রায় প্রতিদিনই সবার সাথে কথা হয়। পাকা বুড়িটা যখন যন্ত্রের ভেতর দিয়ে তুলতুলে গলায় চুমু দেয় ‘আ.....প্পা’ তখন ক্ষুধাটা হাজার গুণ বেড়ে গিয়ে চোখের কোণে এসে জমা হয়।
তেমনি এক গ্রীষ্মের দুপুরে যখন চারিদিক সুনসান, যখন গির্জার ঘন্টাটা ঢং ঢং করে একাকীত্ম আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিল, ঠিক তখনই বৃদ্ধার প্রাণবায়ু হুট করে উবে যায় মুচকি হেসে। আশেপাশে কেউ নেই, একা আমি ছাড়া। খবর পেয়ে রক্তীয়রা সবাই ছুটে এসেছিলেন ফোঁপতে ফোঁপাতে। তবে এ কথা সত্য, কারো কান্নাই মেকী ছিল না। মানুষতো বটেই বাড়ীর সেই পুরনো আসবাবের জন্যেও অনেক সময় বুকের ভেতর হাহাকার জাগে।
ছেলে, মেয়ে, ছেলের বউ আমাকে জড়িয়ে ধরেও কান্নাকাটি করেছিল। এরপরও বেশ কিছুদিন আমি ওবাড়ীতে ছিলাম।
বৌমা আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় হারুন মিস্ত্রি’র বয়স ছিল ঊনষাট। তবে প্রথম দিকে প্রয়োজনের চাইতে সঙ্গটাই ছিল প্রধান। প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠার পর থেকে উনি আমাকে শরীরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলেই মনে করতেন।
স্কুল কমিটি’র লোকেরা হারুন মিস্ত্রিকে শেষ বয়সে দারোয়ানীর চাকরিটি জুটিয়ে দিয়েছিল। এতে করে চাকরির সাথে সাথে মাথা গোঁজার ঠাঁইটাও জুটে গিয়েছিল। চাকরিটা তেমন কঠিন না। টিফিনের সময় গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা, স্কুল ছুটির পর ছেলে মেয়েদের বড় রাস্তাটি পার করিয়ে দেয়া, আর মাঝে মাঝে কিছু ফাইলপত্র এখান থেকে সেখানে আনা নেয়া করা। প্রাইমারী স্কুলের ছোট ছোট ফুলকলিদের সাথে সময় কাটাতে ভালই লাগে।
বারান্দায় বসে মাঝে মাঝেই তার স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ে যায়। বহু বছর আগে ফেলে আসা বিহার অঞ্চলের রুক্ষ কষ্টকর সময়গুলো এখনও তাকে টানতে থাকে পরম মমতায়। ছেলেবেলার ধূলোবালি কি অত সহজে ভোলা যায়? সাতচল্লিশের দেশভাগের সময়কার কথা, তারা ক’জন দ্বি জাতী তত্বের ঘেরাটোপে পড়ে ছুটে এসেছিল বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলের এই এলাকায়। ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে এইখানে যারা জড়ো হয়েছিল, তাদের মধ্যে বেশীর ভাগই ছিল নির্মাণ শ্রমিক। হারুন এই পেশার লোক না হলেও, যুবা বয়সের নতুন স্বপ্নে বিভোর হয়ে সেও সঙ্গীদের সাথে মিশে গিয়ে একই পেশা বেছে নেয়।
আহা, আজ কতকাল গত হয়ে গেল!
স্কুল মাঠের পেছন দিকে বন্ধ্যা কাঁঠাল গাছটির গা ঘেঁষে একটি ঘর তুলেছে মিস্ত্রি। সেখানে সে তার স্ত্রীকে নিয়ে নতুন করে সংসার পেতেছে। সদা হাস্যময় প্রাণবন্ত স্ত্রীটি একদিন হঠাৎ করে নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। ক’দিন আগে ছেলেটি তার বাবার উপর রেগে গিয়ে আমাকে ঘাড় ধরে উঠোনে ছুঁড়ে মেরেছিল। আমার অবশ্য তেমন কিছু হয়নি, শুধু এক জায়গায় একটু থেঁতলে গিয়েছিল।
হারুন মিস্ত্রির স্ত্রী চিৎকার করে মূর্চ্ছা যান। আচ্ছা, তিনি কি সেদিন স্বামীকে অপমানিত হতে দেখে মূর্চ্ছা গিয়েছিলেন নাকি আমাকে অবহেলিত হতে দেখে? হয়তো ভেবেছিলেন, আমার গায়ে হাত তোলা মানে তো তার স্বামীর গায়েই হাত তোলা। তারপর দু’দিন ধরে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক’দিন বিছানায় কাটিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেও বাকরুদ্ধ হয়ে যান পুরোপুরি। নতুন সংসার শুরুর পর থেকে বেচারা স্ত্রীটি পরিচিতদের বাড়ী বাড়ী গিয়ে হাত পাতা শুরু করেছিলেন।
মূক বলে মুখের কাজ হাতেই সাড়া যায়। এতে লজ্জা অনেক কম লাগে।
একমাত্র ছেলে হাসেম আগে বাপের সাথে যোগানদারের কাজ করত। এখন সে পূর্ণাঙ্গ মিস্ত্রি। যতক্ষণ বাসায় থাকে ততক্ষণ শুধু বউয়ের সাথে ঝগড়া করে।
বৌমা ঠিকা ঝি, পান্না খালাদের বাসায় কাজ করে। আট বছরের নাতিটা টুকটুক করে স্কুলে যায়। হরুন মিস্ত্রি’র ভাত কাপড়ের টানাটানি চললেও পান বিড়ির অভাব পূরণ করত চাচা মিয়া। তাও যে পুরোপুরি নিঃস্বার্থ ভাবে করত তা নয়, সেও নিঃসঙ্গ। ক্রেতা এলে পান সিগারেট এগিয়ে দেয়া ছাড়া আর তেমন কোন কাজ ছিল না তার।
বিড়ির দোকানটা সময় কাটানোর জন্যেই দেয়া। ঘর চলে মেয়ের জামাই’র পকেট থেকে। মিস্ত্রি দিনের বেশীর ভাগ সময় দোকানের সামনে গাছের গুড়িটার উপর বসে গুনগুন করে পুরনো হিন্দি গানের সুর ভাঁজে। কয়েকমাস হয় ছেলের সাথে কথাবার্তা বন্ধ। ঘটনার শুরু সামান্য বিড়ি থেকে।
এক রাতে ছেলে ঢুলতে ঢুলতে বাসায় ফিরে হুলস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে দেয়। বৌমা যখন রক্তাক্ত দাঁতের দিকে তাকিয়ে শরীর কাঁপিয়ে নিশব্দে কাঁদছিল, নাতিটা তখন দাদার পাশে ঘুমের ভান করে পড়েছিল। হাসেম গজগজ করতে করতে জড়ানো গলায় বলতে থাকে, চাচা মিয়া সবার সামনে বাকী পাওনা চেয়ে তাকে নাকি হেনস্থা করেছে। বউমা অবাক, কারণ সংসারের কোন কিছূই সে চাচা’র দোকান থেকে বাকি করে না। এই কথা শুনে ছেলে আরো তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে।
তার সাফ কথা, ওসব পান-বিড়ির পয়সা সে আর যোগাতে পারবে না। সংসারের প্রয়োজনীয় খরচা যোগাতে গিয়ে এমনিতেই তাকে হিমশিম খেতে হয়, তার উপর যতসব উটকো খরচ। বৌমার এহেন অত্যাচারিত হওয়ার জন্য নিজেকেই দোষী বলে মনে করে মিস্ত্রি। তারপর, নাতির সামনে বৌমাকে এভাবে রক্তাক্ত হতে দেখে লজ্জায় ঘর ছাড়ে। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে পরদিন সকাল বেলা সস্ত্রীক স্কুল কমিটি’র দারস্থ হয়।
তারপর, তারপর গাছতলায় পুরনো সংসার নতুন করে শুরু করা। নতুন সংসারটি অবশ্য বেশীদিন টেকেনি। বছর খানেকের মাথায় বোবা স্ত্রীটি হারুন মিস্ত্রিকে একা করে দিয়ে চলে যায় চিরতরে।
ইদানিং মিস্ত্রির চোখ দিয়ে প্রায় পানি গড়ায়। সুমন বলল, ‘ডাক্তর দেখান, নইলে চোখ যাইবো।
’ যদিও সে ঠিকই জানে মিস্ত্রি’র চোখের চাইতে মনের সমস্যাই বেশী। সুমনের বাবা দোকানের সামনে দরজার কাছে বসা। সে ছেলেকে নির্দেশ দেয় বকবক না করে ভাল ভাবে দাঁড়ি কামাতে। বাবার ধমকে সুমন হাসে। হরুন মিস্ত্রি সুমনকে জিজ্ঞেস করে, কেন সে বুড়ো বাবাকে দোকানে এনে বসিয়ে রাখে? সুমন মুখ দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
হারুন মিস্ত্রি নাক কোঁচকায়, ব্যাটা বোধ হয় আজ দাঁত মাজেনি। সুমনের বাবা তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘বউমা খুব ভালা’। সুমন ঝামটে ওঠে, সময় মত খাওয়াটাও যে দিতে পারে না তার জন্য এত দরদ দেখানোর কোন মানে হয় না। তার মুখ দিয়ে আগুনের হলকা বের হতে থাকে, ‘বাবু.. বউয়ের জ্বালায় বাপরে দোকানত আনি রাখি’। সে বকবক করতেই থাকে, ‘জমিদারের মাইয়া..।
’ মিস্ত্রি শার্ট খুলে হাতটা ওপরে তুলে ধরে। ছেলেটা বড় ভাল, তার কাছ থেকে টাকা নিতে চায় না। কাজ শেষ করে আড়মোড়া ভাঙ্গে সুমন। পাশের খদ্দেরের গালটা কেটে গেছে। তিনি ‘ওফ্’ করে উঠলেন।
সুমন এগিয়ে গিয়ে নবিশ নাপিতটির গালে সজোরে একটা চড় কষায়। তারপর খদ্দেরের কাটা স্থানে এ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে দিয়ে আগের জায়গায় ফিরে আসে। এসে দেখে মিস্ত্রি আগের মতই চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। চোখের কোণে পানি নিয়ে স্থির চেয়ে আছে সামনের আয়নার দিকে। কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করেও যখন কোন সাড়া পাওয়া যায় না, তখন গায়ে হাত দিয়ে ঝাঁকুনি দিতেই ঢলে পড়ে মিস্ত্রি।
ভাল ভাবে পরখ করে দেখার পর সুমনের মুখ দিয়ে আরো একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। এবার তার দুর্গন্ধযুক্ত প্রশ্বাস মিস্ত্রি’র ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে বিন্দুমাত্র স্পর্ষ্শ করে না আর।
পূব পাড়ার কাজটি তখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। বাইরের দেয়ালের এককোণে সিমেন্ট লাগানোর সময় মাত্র পাঁচ ফুট উঁচু মাচা থেকে পড়ে গিয়েছিল হাসেম। বয়সে পেয়ে বসেছে তাকে।
আগের মত খাটতে পারে না আর। দুর্ঘটনায় পা দু’টি অক্ষত থাকলেও ডান পায়ে কি যেন হয়েছে। খুব একটা জোর পাওয়া যায় না। দেড় মাস পঙ্গু হাসপাতালে কাটিয়ে আজ ঘরে ফিরবে হাসেম। সকালের দিকে জোয়ান ছেলেটি তাকে হাসপাতাল থেকে আনতে গেছে।
বউমা একহাতে আমাকে ধরে ছোট্ট রান্না ঘরের পিঁড়িতে আনমনা হয়ে বসে আছে। দরজায় কড়া নড়ার শব্দ পাওয়া যায়। ওরা এল বুঝি। বউমা কপাট খুলে দেখতে পায়, হাসেম তার ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বউমা তার শশুর মশায়ের সামনে যেভাবে বাড়িয়ে ধরেছিল, এখনও ঠিক তেমনি ভাবে তার স্বামীর সামনে বাড়িয়ে দেয় আমাকে।
হাসেম চমকে বউমার দিকে তাকায়। বউমা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। একদিন যে হাত আমাকে ঘাড় ধরে বাইরে ছুঁড়ে মেরেছিল, সেই হাতটি ছেলের কাঁধ হতে ছুটে এসে লাজুক ভাবে আমার বাঁকানো কাঁধে আশ্রয় খুঁজতে থাকে। সতেরটি বছর সঙ্গী হীন থাকার পর, আমার কাঁধে আরো একজনের ভার তুলে নিই আমি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।