আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আচার্যের কাছে খোলা চিঠি

আনু মুহাম্মদ, নাসিম আখতার হোসাইন, মানস চৌধুরী, শরমিন্দ নীলোর্মি, সাঈদ ফেরদৌস, মির্জা তাসলিমা, স্বাধীন সেন, রায়হান রাইন, মাসউদ ইমরান, সায়েমা খাতুন, মাহমুদুল সুমন, নাসরিন খন্দকার, রায়হান শরীফ, হিমেল বরকত, সুমন সাজ্জাদ, নওরীন তাবাচ্ছুম, সাহিদ সুমন ও পারভীন জলী:a:
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি বিদ্যায়তন, যার রয়েছে সুদীর্ঘ সংগ্রামী ঐতিহ্য। ইতিপূর্বে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সব ধরনের অন্যায়, নিপীড়ন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিবাদী ভূমিকা জারি রেখেছেন। কিন্তু বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজ করছে একেবারেই ভিন্ন এক পরিস্থিতি। যে সংকট এখানে প্রকট আকার ধারণ করেছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অভিভাবক হিসেবে তা নিরসনে আপনার আশু উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
আপনি অবগত আছেন, বিগত পদত্যাগী উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরের দীর্ঘ তিন বছরের অন্যায়, অনিয়ম, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপরে দীর্ঘমেয়াদি নিপীড়নের অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় ‘শিক্ষকসমাজ’ নামে শিক্ষকদের আন্দোলনের একটি সমষ্টি তৈরি হয়।

এর আগে পদত্যাগী উপাচার্যের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মদদ দেওয়ার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন। শিক্ষকসমাজের ধারাবাহিক আন্দোলনের একপর্যায়ে বিগত উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করা হয়। আপনি আরও জানেন যে তৎকালীন মহামান্য আচার্যের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের কারণেই ওই অনির্বাচিত ও স্বৈরাচারী উপাচার্য পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তাঁর পদত্যাগের পরবর্তী সময়ে মহামান্য আচার্য বর্তমান উপাচার্যকে নিয়োগ প্রদান করেন। বর্তমান উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ অনুসরণ করে একপর্যায়ে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন দেন এবং নির্বাচিত উপাচার্য হিসেবে সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হন।


তবে, বর্তমান উপাচার্য তাঁর পদ গ্রহণের পরে বেশ কিছু বিষয়ে হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পদত্যাগী উপাচার্যের অন্যায় ও অনিয়মের ফলে সৃষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিপূরণে যথাযথ ও কার্যকর তৎপরতা তিনি দেখাতে পারেননি। পাশাপাশি, বিগত উপাচার্যের অনুসারী শিক্ষকদের নানামুখী ধ্বংসাত্মক তৎপরতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে ওঠে। বর্তমান উপাচার্য সঠিক সময়ে সঠিক উদ্যোগ না নিয়ে, বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর বিভিন্নমুখী স্বার্থের কাছে সমর্পিত হতে থাকেন। এ ছাড়া তাঁর অনাবশ্যক লাগামহীন কথা বিশ্ববিদ্যালয়ে অসন্তোষ তৈরি করে।


উপর্যুক্ত পরিপ্রেক্ষিত বিচার করলেও আমরা মনে করি, এই মুহূর্তে বর্তমান উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি করে যে আন্দোলন চলছে, তার নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও একাডেমিক ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। আপনি অবগত আছেন যে দুই মাসের বেশি সময় ধরে আমাদের সহকর্মীদের একটি গোষ্ঠী উপাচার্যের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপন করে আন্দোলন করছে। এই শিক্ষকেরা একপর্যায়ে উপাচার্য মহোদয়কে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন এবং তাঁর পদত্যাগের দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছেন। সম্প্রতি আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা ধর্মঘটের কর্মসূচি পালন করছিলেন এবং এই কর্মসূচি পালনকালে উপাচার্য মহোদয় প্রশাসনিক ভবনে তাঁর অফিসে গেলে তাঁরা তাঁকে অবরুদ্ধ করে ফেলেন এবং শান্তিপূর্ণ সর্বাত্মক ধর্মঘট কর্মসূচি পূর্বঘোষণা ছাড়াই উপাচার্যকে অবরোধের কর্মসূচিতে পরিণত হয়। এই পরিস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়কে সহিংসতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

এ সংঘাত ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট করাসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎকণ্ঠার জন্ম দিচ্ছে। তাই আমরা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
আমরা বলতে চাই, চলমান আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল, কেননা শিক্ষক সমিতি উপাচার্যের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো উত্থাপন করেছে, তা সমাধানে যথাযথ সময় দেওয়া হয়নি, আন্দোলনেআকস্মিকভাবেই পদত্যাগের দাবি হাজির করা হয়েছে এবং কঠোর কর্মসূচি শুরু করা হয়েছে। শিক্ষক সমিতিকে আমরা অনুুরোধ করেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার প্রতিবিধান, ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষাসহ কিছু ন্যায়সংগত দাবি পূরণের জন্য যেন তারা উপাচার্যকে তিন মাস সময় দেয় এবং ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে ধর্মঘটের মতো কর্মসূচিসমূহ প্রত্যাহার করে। কিন্তু শিক্ষক সমিতি তা করেনি।

উপরন্তু মহামান্য আদালতের নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে সাধারণ শিক্ষক ফোরাম নাম নিয়ে একই গোষ্ঠী বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করে ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি দিয়ে চলেছে। আমরা মনে করি, এটি আইনের ফাঁক খোঁজার চাতুর্য ছাড়া আর কিছু নয়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে চলমান আন্দোলন সম্পর্কে আমাদের পর্যবেক্ষণসমূহ তাই আপনার সমীপে উপস্থাপন করছি।
প্রথমত, আন্দোলনটি গোষ্ঠীস্বার্থে এবং ক্ষমতা পাওয়া না-পাওয়াকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হওয়ায় আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নয়ন নয়। ফলে ক্ষমতার লোভের রাজনীতি স্বাভাবিকভাবেই সহিংসতার দিকেই ধাবিত হচ্ছে এবং আন্দোলনকারীরা আলোচনার পথও রুদ্ধ করে দিয়েছেন।


দ্বিতীয়ত, পদত্যাগী সাবেক উপাচার্যের অনুসারী শিক্ষকেরা সাবেক উপাচার্যকে পুনর্বাসন করার বাসনা থেকেই নিজেদের হারানো ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে মরিয়া হয়েছে উঠেছেন বলে প্রতীয়মান হয়। অন্যদিকে, তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন এমন কিছু শিক্ষক, যাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য মাঠে রয়েছেন। এ ছাড়া যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ও বিচিত্র ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ, উপাচার্যকে চাপে রেখে স্বার্থ হাসিলের অপকৌশল। উপাচার্য বাইরের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছেন—এই বয়ান প্রচলিত করার প্রচেষ্টা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ তো নয়ই, বরং এটি একধরনের সাম্প্রদায়িকতা। এ কথাও বলা জরুরি, বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতায় পার্টিজান রাজনীতি ছাড়া উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সম্ভব নয়।

আমরা এই পদ্ধতির সমালোচনা অনেক দিন থেকেই করে আসছি।
তৃতীয়ত, উপাচার্যের বিরুদ্ধে যে অভিযোগই উত্থাপিত হোক না কেন, তদন্ত সাপেক্ষে তার প্রতিবিধান হওয়া আবশ্যক। আমরা উল্লেখ করতে চাই, বিগত পদত্যাগী উপাচার্যের পুঞ্জীভূত অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে শিক্ষকসমাজের আন্দোলনটি একটি অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ ছিল। সেই আন্দোলনের সঙ্গে নৈতিক, রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক দিক থেকে বর্তমান আন্দোলন কোনোভাবেই তুলনীয় নয়। তাই আমরা মনে করি, বিনা তদন্তে, বিনা বিচারে বিভিন্ন অভিযোগে বর্তমান উপাচার্যকে কথায় কথায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা, তথা পদত্যাগে বাধ্য করার চেষ্টা করা অগণতান্ত্রিক এবং অন্যায় চর্চা।


চতুর্থত, শিক্ষকদের বর্তমান আন্দোলনের অযৌক্তিকতা দৃষ্টে মহামান্য আদালত কয়েকজন শিক্ষক ও একজন শিক্ষার্থীর রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যে রায় দিয়েছেন, আন্দোলনকারীরা তাঁদের সমষ্টির নাম তাৎক্ষণিকভাবে পরিবর্তন করে ওই একই প্রক্রিয়ায় আন্দোলন অব্যাহত রেখে আর প্রকারান্তরে বলপ্রয়োগের সংস্কৃতি চালু করে প্রশাসনিক অচলাবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে সেই রায়ের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছেন।
পঞ্চমত, যৌক্তিক কারণ ছাড়াই একটি আন্দোলনের মাধ্যমে আন্দোলনকারীরা ক্যাম্পাসের শিক্ষার পরিবেশকে বিঘ্নিত করছেন। চলমান অচলাবস্থার কারণে নিয়মিত ক্লাসসমূহ যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি এমফিল, পিএইচডি ভর্তির কার্যক্রম, একাডেমিক কাউন্সিলসহ সিনেট সিন্ডিকেটের সভাসমূহও হতে পারছে না। এমনকি আসন্ন ভর্তি পরীক্ষার ব্যাপারেও কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা যাচ্ছে না। ফলে সমূহ ক্ষতি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের।


এমন একটি পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশের স্বার্থে চলমান সংকট নিরসনে আপনার কাছে কার্যকর উদ্যোগ কামনা করছি। তবে সেই উদ্যোগ যাতে কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়, সেই অনুরোধও রাখছি। আমরা মনে করি, উপাচার্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা যেতে পারে। একই সঙ্গে তদন্ত চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, প্রশাসনিকসহ সব কার্যক্রম যাতে নির্বিঘ্নে চলতে পারে, তার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সবিনয় অনুরোধ করছি। অতি দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফিরে আসুক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।


লেখকগণ: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।