একাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম কাব্য তথা সাহিত্য নিদর্শন। চর্যাপদ শুধু বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শনই না, বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনযুগেরও একমাত্র নিদর্শন। নব্য ভারতীয় আর্যভাষারও প্রাচীনতম রচনা এটি। চর্যাপদ মূলতঃ গানের সংকলন। চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে।
একেক জন একেকভাবে এর রচনাকাল নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন, আর তাই একেক জনের মতও হয়েছে একেক রকম। সবার মতামত বিশ্লেষণ করে আধুনিক গবেষকরা মেনে নিয়েছেন, খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত এই গীতিপদাবলি, রচয়িতারা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ। এর মূল বিষয়বস্তু- বৌদ্ধ ধর্ম মতে সাধনভজনের তত্ত্ব প্রকাশ। বৌদ্ধ ধর্মের গূঢ় অর্থ সাংকেতিক রূপের আশ্রয়ে ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যেই তাঁরা পদগুলি রচনা করেছিলেন। বাংলা সাধন সংগীতের শাখাটির সূত্রপাতও এই চর্যাপদ থেকেই হয়।
এই বিবেচনায় এটি ধর্মগ্রন্থজাতীয় রচনা। একই সঙ্গে সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্রাবলি এই পদগুলিতে উজ্জ্বল। এর সাহিত্যগুণ আজও চিত্তাকর্ষক। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থশালা থেকে চর্যার একটি খণ্ডিত পুঁথি উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে চর্যাপদের সঙ্গে বাংলা ভাষার অনস্বীকার্য যোগসূত্র বৈজ্ঞানিক যুক্তিসহ প্রতিষ্ঠিত করেন।
চর্যার প্রধান কবিগণ হলেন লুইপাদ, কাহ্নপাদ, ভুসুকুপাদ, শবরপাদ প্রমুখ।
আমাদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে- প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ আর আধুনিক যুগ। এরমধ্যে প্রাচীন যুগ হলো শুধুই চর্যাপদকে নিয়ে। সেসময়ের আর কোনো বই-ই এখনো পাওয়া যায় নি। পাওয়া যাবে, তেমন সম্ভাবনাও আর নেই।
আর কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় নি বলে মনে করা যায় না, সে যুগে বাংলায় আর কিছু-ই লেখা হয় নি। হয়তো লেখা হয়েছিল, নানা কারণে সেগুলো হয়তো হারিয়ে গেছে।
এই অঞ্চলে এক সময় বৌদ্ধধর্ম খুবই বিস্তৃত হয়েছিল। আমাদের দেশের সোমপুর বিহার, আনন্দ বিহার, এগুলো সবই ছিল বৌদ্ধ বিহার। দেশের অধিকাংশ মানুষও ছিল বৌদ্ধ।
তখন দেশের রাজারাও ছিল বৌদ্ধঃ পাল রাজারা। পরে পালদের হারিয়ে সেন রাজবংশ রাজত্ব শুরু করলে বৌদ্ধরা পালিয়ে যেতে থাকে। কারন সেন রাজারা হিন্দু ছিলেন। বিধর্মী রাজাদের প্রতি একটা ভয় ছিল, সেই মধ্যযুগে যারা রাজধর্মের অনুসারী নয়, তাদের একটু-আধটু অত্যাচারের মুখে পড়তে হতো। তারপরে সেন রাজারাও মুসলমানদের কাছে হেরে গেলেন।
ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর লক্ষণ সেনকে হারিয়ে এই অঞ্চলে মুসলমান রাজত্ব শুরু করলো। সবমিলিয়ে এই অঞ্চল থেকে বৌদ্ধধর্ম একরকম হারিয়েই গেল।
কিন্তু কথা হলো, বাঙালিরা প্রথমে ছিল মূলত বৌদ্ধ। তাই উনিশ শতকে যখন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, বাঙালির ইতিহাস লেখা শুরু হতে লাগলো, তখন বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস নিয়েও গবেষণা শুরু হয়ে গেল। অনেকেই প্রাচীন বৌদ্ধ গান, দোহা- এসব খুঁজতে শুরু করলো নেপালে- তিব্বতে গিয়ে।
এসব গানগুলো ছিল মূলত সংস্কৃত বা তিব্বতী ভাষায় লেখা।
সম্ভবত প্রথম এ কাজে নেপাল যান রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র। তিনি বৌদ্ধ ধর্ম আর বৌদ্ধ সাহিত্যের অনেকগুলো পুঁথিও আবিষ্কার করেন। পরে সেগুলোর একটা তালিকাও প্রকাশ করেন ১৮৮২ সালে। তার এসব কাজ দেখে উৎসাহিত হন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
১৮৯৭-৯৮ সালে দুবার নেপালে যান তিনি। তৃতীয় এবং শেষবার যান ১৯০৭ সালে। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয়বার নেপাল ভ্রমণকালে তিনি নেপালের রাজদরবারের লাইব্রেরিতে খুঁজে পান চারটি প্রাচীন পুঁথি; ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’, সরোজবজের ‘দোহাকোষ’, কৃষ্ণাচার্যের ‘দোহাকোষ’ আর ‘ডাকার্ণব’। চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরহপাদের দোহা এবং অদ্বয় বজ্রের সংস্কৃত সহজাম্নায় পঞ্জিকা, কৃষ্ণাচার্য বা কাহ্নপাদের দোহা, আচার্যপাদের সংস্কৃত মেখলা নামক টীকা ও আগেই আবিষ্কৃত ডাকার্ণব পুঁথি একত্রে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে (শ্রাবণ, ১৩২৩ বঙ্গাব্দ) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা বৌদ্ধগান ও দোঁহা শিরোনামে সম্পাদকীয় ভূমিকাসহ প্রকাশ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মোট ৪৬টি পূর্ণাঙ্গ ও একটি খণ্ডিত পদ পেয়েছিলেন।
পুঁথিটির মধ্যে কয়েকটি পাতা ছেঁড়া ছিল। প্রবোধচন্দ্র বাগচী চর্যার যে তিব্বতি অনুবাদ সংগ্রহ করেন তাতে আরও চারটি পদের অনুবাদসহ ওই খণ্ডপদটির অনুবাদও পাওয়া যায়। মূল পুঁথির পদের সংখ্যা ছিল ৫১। মূল তিব্বতি অনুবাদের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, মূল পুঁথির নাম চর্যাগীতিকোষ এবং এতে ১০০টি পদ ছিল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুঁথিটি চর্যাগীতিকোষ থেকে নির্বাচিত পুঁথিসমূহের সমূল টীকাভাষ্য।
১৯১৬ সালে এই বই প্রকাশের পরপরই দেশে -বিদেশে একদম সাড়া পড়ে যায়। এতো পুরনো ভাষার বই আগে আবিষ্কৃত হয় নি। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বললেন, এর ভাষা বাংলা। কিন্তু তা প্রমাণ করা জরুলি হয়ে পরে। কারন ওদিকে মৈথিলিভাষী, উড়িয়াভাষী, অসমিয়াভাষীরাও একে নিজ নিজ ভাষায় রচিত বলে দাবি করতে থাকেন।
এমনকি হিন্দি, ভোজপুরিয়া, মগহি ভাষাভাষীর লোকেরাও একে তাদের ভাষায় রচিত বলে দাবি করতে থাকেন। এভাবেই চর্যাপদকে ঘিরে সবচেয়ে জনপ্রিয় বিতর্কটা শুরু হয়ে যায় - চর্যাপদ কোন ভাষায় রচিত? আর সত্যি বলতে কী, এই বিতর্কটা এখনো চলছে। তবে এটা সত্যি, চর্যাপদ অবশ্যই বাংলা ভাষায় রচিত। আবিষ্কৃত পুঁথিতে চর্যা-পদাবলির যে নাম পাওয়া যায় সেটি হলো 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়'। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থে এই নামটিই ব্যবহার করেছেন।
কিন্তু আবিষ্কৃত পুঁথিটি যেহেতু মূল পুঁথি নয়, মূল পুঁথির নকলমাত্র এবং মূল পুঁথিটি (তিব্বতি পুঁথি) যেহেতু এপর্যন্ত অনাবিষ্কৃত, সেই কারণে পরবর্তীকালে চর্যা-পদাবলির প্রকৃত নাম নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। মহামহোপাধ্যায় বিধুশেখর শাস্ত্রী ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে চর্যার প্রথম পদের সংস্কৃত টীকাটি (শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্যচর্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মল গিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম। । ) উদ্ধৃত করে শ্লোকাংশের 'আশ্চর্যচর্যাচয়' কথাটিকে গ্রন্থনাম হিসাবে গ্রহণ করার প্রস্তাব রাখেন।
তাঁর মতে, 'আশ্চর্যচর্যাচয়' কথাটিই নেপালী পুঁথি নকলকারীর ভুলবশত 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়' হয়েছে। তবে এই মতের যথার্থতা বিষয়ে আচার্য অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সন্দেহ প্রকাশ করেন। প্রবোধচন্দ্র বাগচী ওই একই সূত্র ধরে চর্যা-পুঁথির নাম 'চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়' রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু আচার্য অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই মত খণ্ডন করে লিখেছেন, "'আশ্চর্যচর্যাচয়' নামটিও অযুক্তিযুক্ত নয়। কিন্তু 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়' ও 'আশ্চর্যচর্যাচয়', দুই নামকে মিলিয়ে 'চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়' নামটি গ্রহণ করা যায় না।
কারণ এই 'জোরকলম' শব্দটি আধুনিক পণ্ডিতজনের পরিকল্পিত। ” আধুনিক গবেষকগণ তেঙ্গুর গ্রন্থমালা (Bastan-hgyar) থেকে অনুমান করেন মূল পুঁথিটির নাম ছিল চর্যাগীতিকোষ এবং তার সংস্কৃত টীকাটি 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়' — অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই মত গ্রহণ করেছেন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।