বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের একমাত্র নিদর্শন চর্যাপদ। তবে অসমীয়া ও উড়িয়া ভাষার সাথে অনেক মিল থাকায়, অসমীয়া এবং উড়িয়া ভাষারও আদি নিদর্শন হিসেবে দাবী করেন অনেক ভাষা পন্ডিত। একে চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, চর্যাগীতিকোষ বা চর্যাগীতি নামেও অভিহিত করা হয়। এটা আসলে একটা গানের সংকলন। বৌদ্ধ ধর্মমতে এর বিষয়বস্তু সাধন ভজনের তত্ত্ব প্রকাশ।
চর্যাপদের তিব্বতীয় ভাষার অনুবাদটি ‘Tibetan Buddhist Canon’ বা ‘তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ’ হিসেবে সংরক্ষিত।
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে নেপালের রয়েল লাইব্রেরী থেকে চর্যাপদ আবিষ্কার করেন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে এটি আধুনিক লিপিতে প্রকাশিত হয় ‘হাজার বছরের পুরাণ বাংলা ভাষার বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সম্পাদনায়। এর রচনাকাল সম্পর্কে মতভেদ আছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দে, ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ৯৫০ থেকে ১২৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এর পদগুলো রচিত হয়।
সুকুমার সেন সহ বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব পন্ডিতই ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে সমর্থন করেন।
চর্যাপদের কবির সংখ্যা ২৩, মতান্তরে ২৪। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত ‘Buddhist Mystic Songs’ গ্রন্থে ২৩ জন কবির নাম আছে। সুকুমার সেন ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (১ম খন্ড)’ গ্রন্থে ২৪ জন কবির কথা বলেছেন। চর্যাপদের কবিরা আসাম, বাংলা, উড়িষ্যা ও বিহার থেকে এসেছেন বলে ধারনা করা হয়।
চর্যাপদ ছিন্ন অবস্থায় পাওয়া যাওয়ায়, এতে কতটি পদ বা গান আছে তা নিয়েও মতভেদ দেখা দেয়। সুকুমার সেনের মতে এর পদের সংখ্যা ৫১, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ৫০টি। চর্যাপদের ২৪ নং (কাহ্নপা রচিত), ২৫ নং (তন্ত্রীপা রচিত) ও ৪৮ নং (কুক্কুরীপা রচিত) পদগুলো পাওয়া যায় নি। ২৩ নং (ভুসুকপা রচিত) পদটি পাওয়া গেছে ছিন্ন অবস্থায়।
সংস্কৃত টীকাকার মুনিদত্তের মতে চর্যাপদ ‘Twilight Language’; সংস্কৃত ‘সান্ধ্য ভাষা’ বা ‘আলো আঁধারী ভাষায়’ রচিত।
পরিবর্তীতে বিধুশেখর শাস্ত্রী বিভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের সাথে এর রচনারীতির সাযুজ্য থাকায় এর ভাষা ‘Intentional Lanuage’; সংস্কৃত ‘সন্ধ্যা ভাষা’ হিসেবে অভিহিত করেন। যে ভাষা সুনির্দিষ্ট রূপ পায় নি, যে ভাষার অর্থও একাধিক অর্থাৎ আলো আঁধারের মত, সেই ভাষাকেই পন্ডিতগন সান্ধ্য ভাষা বা সন্ধ্যা ভাষা বলে থাকেন।
চর্যাপদের প্রথম পদ লিখেছেন লুইপা। সর্বাধিক ১৩টি পদ (১২টি পদ পাওয়া গেছে) লিখেছেন কাহ্নপা, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮টি পদ লিখেছেন ভুসুকপা।
চর্যাপদের কবি ও তাঁদের পদের নম্বরঃ
লুইপা ১, ২৯ নং পদ
কুক্কুরীপা ২, ২০, ৪৮ নং পদ
বিরুপা ৩ নং পদ
গুন্ডরীপা ৪ নং পদ
চাটিল্লাপা ৫ নং পদ
ভুসুকপা ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩, ৪৯ নং পদ
কাহ্নপা ৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ২৪, ৩৬, ৪০, ৪২, ৪৫ নং পদ
কম্বালম্বরপা ৮ নং পদ
ডোম্বীপা ১৪ নং পদ
শান্তিপা ১৫, ২৬ নং পদ
মহীধরপা ১৬
বীণাপা ১৭
সরহপা ২২, ৩২, ৩৮, ৩৯ নং পদ
শবরপা ২৮, ৫০ নং পদ
আর্যদেবপা ৩১ নং পদ
ঢেগুনপা ৩৩ নং পদ
দারিকপা ৩৪ নং পদ
ভাদেপা ৩৫ নং পদ
তাড়কপা ৩৭ নং পদ
কঙ্কণপা ৪৪ নং পদ
জয়নন্দীপা ৪৬ নং পদ
ধর্মপা ৪৭ নং পদ
তন্ত্রীপা ২৫ নং পদ।
লুইপার লিখিত চর্যাপদের প্রথম পদ (ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পাঠ অনুসারে)
কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল
চঞ্চল চীএ পইঠা কাল। ।
দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ
লূই ভণই গুরু পূছঅ জাণ। ।
সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই
সুখ দূখেতেঁ নিচিত মরিঅই।
।
এড়িঅউ ছান্দ বান্ধ করণ কপটের আস
সূনু পাখ ভিড়ি লাহুরে পাস। ।
ভণইলূই আমহে ঝাণে দীঠা
ধমণ চবণ বেণি পিন্ডী বইঠা। ।
আধুনিক বাংলায় রুপান্তরঃ
কায়া তরুর মত পাঁচটি তার ডাল
চঞ্চল চিত্তে কাল প্রবেশ করেছে। ।
দৃঢ় করে নাও মহাসুখ পরিণাম
কবি লুই বলছে গুরুকে জিজ্ঞাস করে জান। ।
সমস্ত সমাধিতে কি করে
সুখ দুঃখে নিশ্চিত মরা।
।
এড়িয়ে যাওয়া যায় ছন্দ ও করণের পারিপাট্য
শূন্য পাখা পাশে চেপে ধর। ।
লুই বলছে আমি স্বপনে দেখেছি
ধমণ চমণ দুই পিঁড়িতে আমি বসে। ।
(ছন্দ=বাসনা, করণ=ইন্দ্রিয়চেতনা)
ধারনা করা হয়, ক্কুকুরীপা ছিলেন চর্যাপদের একমাত্র নারী কবি। তবে এ সম্পর্কে সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই। ক্কুকুরীপা রচিত অতিপরিচিত দুটি পদঃ
দিবসহি বহূড়ী কাউহি ডর ভাই
রাতি ভইলে কামরু জাই। । (২ নং পদ)
অর্থাৎ, দিনে বউটি কাকের ভয়ে ভীত হয়, কিন্তু রাত হলেই সে কামরূপ যায়।
ঢেগুনপার রচিত ৩৩ নং পদে আবহমান বাঙালির চিরায়ত দারিদ্র্যের ছবি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। যেমনঃ
টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী
হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী। ।
অর্থাৎ লোকশুন্য স্থানে প্রতিবেশীহীন আমার বাড়ি। হাঁড়িতে ভাত নেই, অথচ প্রেমিক এসে ভিড় করে।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ভুসুকপা ছিলেন পূর্বঙ্গের লোক। তাঁর রচিত ৪৯ নং পদে পদ্মা (পঁউআ) খালের নাম আছে, ‘বাঙ্গাল দেশ’ ও ‘বাঙ্গালী’র কথা আছে। তাঁর রচিত পদসমুহের মাঝে বাঙালি জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।
ভুসুকপা রচিত অতিপরিচিত একটি পদঃ
অপণা মাংসেঁ হরিণা বৈরী। ।
( ৬ নং পদ )
সুত্রঃ ড. সৌমিত্র শেখর, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা।
http://en.wikipedia.org
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।