আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ব্রক্ষ্মপুত্র নদের তিব্বত অংশে বাঁধ নির্মাণ করবে চীন : মরুভূমিতে রূপান্তরিত হবে বাংলাদেশ

বাঙালিত্ব

ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের একটি বড় অংশ মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। আমাদের পদ্মা ও এর শাখানদীগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। ভারত ইতোমধ্যে বরাক নদীর টিপাইমুখে পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণকাজ শুরু করেছে। এখন চীন তিব্বতে তথা ব্রহ্মপুত্রের উজানে বিশ্বের বৃহত্তম পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্খাপনের কাজে তোড়জোড় শুরু করেছে। চীন এ কাজে হাত দিলে ভারতও বসে থাকবে না।

ফলে ব্রহ্মপুত্রকে ঘিরে চীন ও ভারত বাঁধ নির্মাণের প্রতিযোগিতায় নামবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গঙ্গা অববাহিকায় ফারাক্কা, ব্রহ্মপুত্রে চীনের বৃহত্তম পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র আর মেঘনা-সুরমায় টিপাইমুখ ড্যাম নির্মিত হতে যাচ্ছে। ত্রিমুখী পানি আগ্রাসনের শিকার হয়ে বাংলাদেশের তিনটি নদী অববাহিকার সবগুলোতেই স্বাভাবিক প্রবাহ রুদ্ধ হবে, বাংলাদেশের পুরো নদী ব্যবস্খাপনা বদলে যাবে। বাংলাদেশের জীবন-জীবিকা, প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর নেমে আসবে বিপর্যয়। এ বাঁধ নির্মাণ হলে ভারত কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ইতিমধ্যে ভারতের বিভিন্ন অনলাইন ফোরামে এর বিরোধিতা করে আলোচনা হচ্ছে। তিব্বতে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর ড্যাম নির্মাণের পরিকল্পনা চীনের দীর্ঘ দিনের। ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকার এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, এখন তারা বিষয়টি নিয়ে তোড়জোড় শুরু করেছে। তিব্বতের মানস সরোবরে উৎপন্ন এই নদ বাংলাদেশের কুড়িগ্রামে প্রবেশ করেছে। এখানে এই নদের প্রশস্ততা ১১ কিলোমিটার, যা সারা বিশ্বে অদ্বিতীয়।

দুই হাজার ৮৯৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদের বাংলাদেশ অংশ ২৭৭ কিলোমিটার। এর ফলে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার সাথে সংযুক্ত ২১টি নদীর ওপর এর প্রভাব পড়বে। এসব নদী দিয়ে যে বিপুল পলি প্রবাহিত হয়ে জমিকে উর্বর করে তা কমে যাবে। মৎস্যপ্রজননও হুমকির মুখে পড়বে। ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর চীনের এই পরিকল্পনার আগেই ভারত বরাক নদীর উজানে টিপাইমুখে পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু করে দিয়েছে।

এই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হলে বাংলাদেশের সুরমা, কুশিয়ারা ও মেঘনা নদীর পানিপ্রবাহের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। অর্থাৎ মেঘনা অববাহিকায়ও পানির প্রবাহ স্বাভাবিক থাকছে না। বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন টিপাইমুখ পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে ভারত পানি আটকে রেখে কিছু দিন পরপর ছাড়বে। ফলে হাওরাঞ্চলের কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে। এ ছাড়া ফুলের তলে একটি ব্যারাজ নির্মাণের পরিকল্পনাও ভারতের আছে।

এই ব্যারাজ নির্মাণ হলে দক্ষিণাঞ্চলের মতো সিলেট অঞ্চলেও পানি সঙ্কট দেখা দেবে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে গঙ্গা বা পদ্মা নদীতে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নেই। এর ফলে বাংলাদেশের উত্তর-দক্ষিণাঞ্চল শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য থাকে। পদ্মার পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের ৬০টি নদী মরে গেছে। বাংলাদেশের উজানে প্রধান তিনটি অববাহিকার নদী নিয়ে ভারত ও চীনের বহুমুখী পরিকল্পনায় বাংলাদেশের পরিবেশ, প্রকৃতি ও খাদ্যনিরাপত্তার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।

এই তিন অববাহিকার কোনো কোনো অঞ্চলে যেমন হঠাৎ করে বন্যা দেখা দেবে তেমনি নদীর পানিতে পলির প্রবাহ কমে যাবে। আবার কোথাও কোথাও পানিশূন্যতার কারণে মরুকরণও দেখা দেবে। ব্রহ্মপুত্রের উজানে চীনের বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি অনেক দিন ধরেই আলোচিত হচ্ছে। চীনা সরকার বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনার কথাটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও বিষয়টি নিয়ে এখন সেখানে প্রকাশ্যেই আলোচনা হচ্ছে। চীনা পানি বিদ্যুৎ প্রকৌশল বিভাগের সহকারী সাধারণ সম্পাদক ঝাং বোটিং গার্ডিয়ানকে এই প্রকল্পের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, ইয়ারলাঙ সাঙপুর (ব্রহ্মপুত্রের তিব্বতীয় নাম) বাঁকে বিশাল বাঁধ দেয়া হলে তা বিশ্বের জন্য কল্যাণকর হবে।

তিনি অবশ্য এ কথাও স্বীকার করেন, এতে করে এই নদের ভাটির দেশ তথা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আতঙ্কও সৃষ্টি হতে পারে! ঝাং বলেন, এই ড্যাম বছরে ২০০ মিলিয়ন টন কার্বন বাঁচাবে। আমরা বৃহত্তম কার্বন নি:সরণ হন্সাসকারী প্রকল্প বাদ দিতে পারি না। সমগ্র পৃথিবীর স্বার্থেই, যেখানে যেখানে পানিসম্পদের উন্নয়ন করা সম্ভব, সেখানে সেই উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতেই হবে। বিজ্ঞানী ঝাং বলেন, ব্রহ্মপুত্রের সবচেয়ে বড় বাঁকটির পানিসম্পদ ব্যবহার করা হবে চূড়ান্ত লক্ষ্য। তিনি জানান, এখানে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে, তা ১০০ মিলিয়ন টন কয়লার সমপরিমাণ।

এটা দক্ষিণ চীন সাগরের সব তেল ও গ্যাসের যোগফলের সমান। চীনের একটি সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, চীনা সরকার সেখানে ৩৮ গিগাওয়াটের একটি পানি বিদ্যুৎ প্লান্ট নির্মাণের কথা ভাবছে। ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশনীতিবিষয়ক তিব্বতীয় বিশেষজ্ঞ তাশি সারিং জানান, নদটির ওপর চীন যে ২৮টি ড্যাম নির্মাণের পরিকল্পনা করছে বা বাস্তবায়ন করছে, এই বিশাল স্খাপনা তারই অংশ। সারিং চীনা সংবাদপত্র ও পানি বিদ্যুৎ প্রকৌশলসংক্রান্ত ওয়েবসাইটগুলো থেকে প্রাপ্ত এসব প্রকল্পের একটি মানচিত্রও প্রকাশ করেন। এসব মানচিত্রের ভিত্তিতে সারিং জানান, চীনের বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর জন্য বৃহত্তম ড্যামটি নির্মাণই হবে দেশটির পরবর্তী সবচেয়ে বড় লক্ষ্য।

সারিংয়ের প্রকাশিত মানচিত্রগুলোর একটির উৎস চীনা সরকারের ড্যাম নির্মাণকাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্খা হাইড্রোর ওয়েবসাইট। প্রকল্পটির বিপুল ব্যয়, কারিগরি সমস্যা ও রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতার জন্য চীনা সরকার এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির চূড়ান্ত অনুমোদন করেনি। তবে অনেক চীনা পানি বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বিশ্বের অন্যতম প্রত্যন্ত অঞ্চলটির পানিসম্পদ উন্নয়নে ভারতের সাথে পাল্লা দিতে এটাই সবচেয়ে ফলপ্রসূ উদ্যোগ। হিমালয় থেকে নেমে আসা এই নদ তিব্বত থেকে ভারত ও বাংলাদেশের বন্যাপ্রবণ এলাকা দিয়ে বয়ে গেছে। পৃথিবীর নদীগুলোর মধ্যে আফিন্সকার দেশ কঙ্গোয় ইনগা জলপ্রপাতে সৃষ্ট কঙ্গো ও ব্রহ্মপুত্র সবচেয়ে বেশি পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

কিন্তু বন্ধুর পরিবেশ, অনেক উঁচুতে অবস্খান এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে পানিসম্পর্কিত সঙ্ঘাতের আশঙ্কায় ব্রহ্মপুত্রের ওপর বাঁধ দেয়াটা অসম্ভব বিবেচিত হয়ে আসছিল। কিন্তু চীন প্রযুক্তিগতভাবে এখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বিশেষ করে তিব্বতে রেলপথ নির্মাণে তারা অনেক বাধা অতিক্রম করে সাহসী হয়ে উঠেছে। এখন ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে তারা প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে যেকোনো সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার কাজে নেমেছে। চলতি বছরের প্রথম দিকে চায়না হাইড্রো পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটিং গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার ইয়ান ঝিইয়ং চায়না এনার্জি নিউজকে বলেছিলেন, ‘ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর ড্যাম নির্মাণের প্রধান প্রধান কারিগরি সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে।

’ তিনি অবশ্য এ ব্যাপারে সাক্ষাৎকার দিতে ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকার অনুরোধে রাজি হননি এই বলে যে, এটা খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। সারিং মনে করেন, চীন ব্রহ্মপুত্রে অনেকগুলো বাঁধ দিতে যাচ্ছে। এসব বাঁধের বৃহত্তমটি নির্মিত হবে মতুও (তিব্বতিদের কাছে স্খানটি মেটোগ নামে পরিচিত) কিংবা দাদুকিয়ায়। নদটি ভারতে প্রবেশের আগে মতুওতে ২০০০ মিটারের একটি জলপ্রপাতের সৃষ্টি করেছে। এখানকার পানির সুবিধা কাজে লাগাতে চীনা সরকার অনেকগুলো টানেল, পাইপলাইন, জলাধার, টারবাইন বসানোর পরিকল্পনা করছে।

চীনা বিজ্ঞানী ঝাং গার্ডিয়ানের সাথে সাক্ষাৎকারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, এই সম্পদ কাজে লাগাতে দেরি হলে ভারতের সাথে সঙ্ঘাত বেধে যেতে পারে। উল্লেখ্য, দেশ দু’টি তিব্বতের বিতর্কিত ভূমি নিয়ে প্রায়ই সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন, মতুওতে আমাদেরকে যত দ্রুত সম্ভব একটি পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। কারণ আমাদের সবচেয়ে বড় নীতি হলো ভারতীয় আগ্রাসন থেকে আমাদের ভূখণ্ড রক্ষা করা ও কার্বন নি:সরণ হন্সাসে চীনা সামর্থ্য বাড়ানো। তবে প্রস্তাবিত এই বাঁধ নির্মাণ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হতে পারে।

তিব্বতিরা মেটোগকে পবিত্র অঞ্চল মনে করে। আর পরিবেশবাদীরা ভূমিকম্পপ্রবণ ও ভূতাত্ত্বিকভাবে ভঙ্গুর এই অঞ্চলে বড় আকারের কোনো বাঁধ নির্মাণের তীব্র বিরোধী। ইন্টারন্যাশনাল রিভার্সের পিটার বসহার্ড জানান, তিব্বতি মালভূমিতে বড় কোনো বাঁধ নির্মাণ হবে ভূ-প্রকৌশলের দিক থেকে একটি বিশাল ও নজিরবিহীন অভিজ্ঞতা। ইয়ারলাঙ সাঙপুর গতিতে বাধা দিলে তা তিব্বতি মালভূমির ভঙ্গুর প্রতিবেশের জন্য ভয়াবহ হতে পরে। তা ছাড়া এতে করে আসাম ও বাংলাদেশের উর্বর বন্যাপ্রবণ এলাকায় এই নদের পলিপ্রবাহেও বাধা দেয়া হবে।

এটাও হতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ। চীনের বাঁধ নির্মাণের ফলে ভারতও দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই নদের ওপর পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়তে পারে। ভারতের পরিবেশমন্ত্রী জয়রাম রমেশ গার্ডিয়ানকে জানান, (ব্রহ্মপুত্র নদে) পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ভারতকে আরো আগ্রাসী মনোভাবের পরিচয় দেয়া উচিত। এতে করে (চীনের সাথে) আলোচনায় আমাদের অবস্খান অনেক ভালো জায়গায় থাকবে। পানি সম্পর্কিত সঙ্ঘাত হন্সাসের লক্ষ্যে দেশ দু’টি সাঙপু-ব্রহ্মপুত্র নদে পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের তথ্য পরস্পরকে অবগত করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে।

ভারতীয় মিডিয়া আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, চীন এই বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রের পানি সরিয়ে নিয়ে ভারতকে বঞ্চিত করতে পারে। তবে সারিং এ আশঙ্কা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, মেটোগের প্রকল্পটি হবে পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পানি প্রত্যাহারের নয়। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র বিশাল বাঁক থেকে পানি সরিয়ে নেয়ার ধারণাকে সমর্থন করে না http://www.ibnewsonline.com/bangla/news/383

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।