আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শার্শায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি: ১৮ মাসে ২১ খুন

আপাতত কিছু বলবোনা

যশোরের শার্শা উপজেলায় সন্ত্রাসীদের হামলায় একের পর এক লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অশান্ত হয়ে উঠেছে এ জনপদ। ভয়ঙ্কর এ জনপদে বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, রাহাজানি, চুরি, ডাকাতি, হাতুড়ি পেটা, টেন্ডারবাজি আর বোমা হামলার ঘটনা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ১৮ মাসে এখানে খুন হয়েছে ২১ জন। সর্বশেষ, গত রোববার রাতে উপজেলা যুবলীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কামরুজ্জামান রতনকে জবাই করে হত্যার ঘটনা এ জনপদের মানুষকে আরো ভাবিয়ে তুলেছে।

যশোরের সীমান্তবর্তী উপজেলা শার্শা। এ উপজেলার ভেতরেই আন্তর্জাতিক স্থলবন্দর বেনাপোল। বেনাপোলের সাদিপুর, বড়আঁচড়া, দৌলতপুর, পুটখালি, ভুলট, কায়বা, রুদ্রপুর, গোগা, কাশীপুর, শালকোনা, শিকারপুর, বাহাদুরপুর, ধান্যখোলা ও রঘুনাথপুর শার্শার সীমান্তবর্তী গ্রাম। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে অবৈধভাবে যাতায়াতের অবাধ সুযোগ থাকায় শার্শার সীমান্তবর্তী এ গ্রামগুলো অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এখানে প্রতিনিয়ত ঘটে ভয়ঙ্কর সব অপরাধ।

খুন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, টেন্ডারবাজি, অপহরণ, ছিনতাই, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, বোমা হামলা ও চোরাচালানিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে। শার্শা উপজেলা ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে ৮টি ইউনিয়ন নিয়ে শার্শা ও ৩টি ইউনিয়ন নিয়ে বেনাপোল পোর্ট থানা গঠিত। এ দুই থানার মধ্যে যতগুলো গ্রাম রয়েছে তার মধ্যে ১৯টি গ্রাম ভারত সীমান্ত লাগোয়া। এ গ্রামগুলোর কারণেই এসব অঞ্চলের অপরাধ প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে।

কারণ, এসব গ্রামে রয়েছে এক বা একাধিক অবৈধ কর্মকাণ্ড পরিচালনার সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটের মদতদাতারা স্থানীয়ভাবে খুবই প্রভাবশালী। এদের সাথে স্থানীয় প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত এক শ্রেণীর দুর্বৃত্তচক্রের যোগাযোগও রয়েছে। ফলে এদের অবৈধ কর্মকাণ্ড ও দৌরাত্ম্য বন্ধ হওয়া তো দূরে থাক, বরং ক্রমেই বাড়ছে। উপজেলার বেনাপোল, নাভারণ, বাগআঁচড়া, সাদিপুর, বড়আঁচড়া, জামতলা, কাশীপুর, শিকারপুর এলাকায় মাদক দ্রব্যের হাট বসে প্রকাশ্যেই।

পুটখালি, ভুলট, গোগা ও কাশীপুর সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে অস্ত্র, গুলি, বিস্ফোরক দ্রব্য ও মাদক দ্রব্য আসছে। ভারত সীমান্ত অঞ্চলের তৈরি এসব অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য রাতের আঁধারে বাংলাদেশের চিহ্নিত সিন্ডিকেটের কাছে আসার পর হাত বদলের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাচার হচ্ছে। এসব অবৈধ অস্ত্রের কারণে সিন্ডিকেটের মধ্যে অবৈধ আয়ের ভাগাভাগি নিয়ে ঘটছে মারামারি ও খুনাখুনি। এক হিসাবে দেখা গেছে এ উপজেলায় গত ১৮ মাসে ২১ জন খুন হয়েছে। ধর্ষিত হয়েছে ১৫ জন।

বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে ২০টি। আর চোরাচালান, টেন্ডারবাজি ও অবৈধ টাকার ভাগাভাগি নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছে দুশতাধিক। সর্বশেষ, গত ১৬ মে শার্শার সাড়াতলা রাজনগর গ্রামের রশিদ সরকারের পুত্র যুবলীগ নেতা কামরুজ্জামান রতনকে (৩৭) পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে এলাকার একদল দুর্বৃত্ত। চোরাচালান ও রাজনৈতিক কোন্দলে তাকে হত্যা করা হয় বলে এলাকাবাসী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়। কামরুজ্জামান রতন ওই রাতে সাড়াতলা বাজার থেকে ব্যবসায়ী জয়নালের মোটরসাইকেল যোগে বাড়ির উদ্দ্যেশে রওনা হয়ে বাকুড়া ব্রিজের কাছে পৌঁছলে আগে থেকে ওঁৎ পেতে থাকা একদল দুর্বৃত্ত তার গাড়ি লক্ষ্য করে ২টি শক্তিশালি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাকে অপহরণ করে।

পরে ব্রিজের দক্ষিণ পার্শ্বের মাঠের মধ্যে নিয়ে জবাই করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় এজাহারভুক্ত আসামি ডিহি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল খালেক, আওয়ামী লীগ নেতা ইউপি সদস্য আব্দুল জলিল, আওয়ামী কর্মী গিয়াস উদ্দীন, শাহিন ও নয়নকে আটক করা হয়েছে। এর আগে ২৮ এপ্রিল রাতে বেনাপোল বলফিন্ডে বৈশাখী মেলায় একদল দুর্বৃত্তের ছোড়া বোমায় নিহত হয় সাদিপুর গ্রামের ইউসুফ আলির পুত্র জিয়া (৩০)। এ ঘটনায় বেনাপোল পোর্ট থানা পুলিশ ৬ জন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতাকে আটক করে জেল হাজতে প্রেরণ করেছে। চলতি বছরের ২৭ এপ্রিল শার্শার পিপড়াগাছি গ্রামে পিটিয়ে হত্যা করা হয় ২ সন্তানের জননী সাহিদা বেগমকে।

২৮ ফেব্রুয়ারি শার্শার নিজামপুর গ্রামের মোটরসাইকেল চালক নিজাম উদ্দিনকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। তার লাশ উদ্ধার করা হয় সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা উপজেলার সরুলিয়া গ্রামের একটি নার্সারি থেকে। ৩১ জানুয়ারি সকালে শার্শার হাড়িখালী আমবাগান থেকে অজ্ঞাত এক মহিলার (৩২) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১৬ জানুয়ারি বেনাপোলের বাহাদুরপুরের দুর্গাপুর সীমান্তের ২৬নং পিলারের কাছ থেকে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির (৪০) লাশ উদ্ধার করে শার্শা পুলিশ। ২০০৯ সালের ৭ ডিসেম্বর রাতে শার্শা উপজেলার লক্ষণপুর ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সভাপতি সলেমান আলীকে (৪০) লক্ষণপুর বাজারে একদল সন্ত্রাসী হাত-পায়ের রগ কেটে হত্যা করে।

১৯ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে বেনাপোল দিঘীরপাড় গ্রামে শরীফ খানের পুত্র শাহিনকে (৩০) পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হাত-পা বেঁধে গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করে তার স্ত্রী সপ্না ও প্রেমিক সোহবার। ১৬ আগস্ট শার্শার গোগা আমলাই গ্রামে পুকুরে ডুবিয়ে মারা হয় মুজাহিদ (২৮) নামে এক কলেজ ছাত্রকে। আপন চাচা ও চাচাতো ভাইরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ৯ জুলাই বেনাপোলের বালুণ্ডা রাজাপুর গ্রামের একটি ধান ক্ষেত থেকে অজ্ঞাত এক যুবকের (২২) গলায় গামছা জড়ানো লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। একই মাসের ১ জুলাই শার্শা উপজেলার কেরালখালি গ্রামের মোবাইল ব্যবসায়ী মিকাইল হোসেন টিটন (২০) নামের এক মোবাইল ব্যবসায়ীকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে একদল সন্ত্রাসীরা।

২৩ জুন রাতে বেনাপোল পোর্ট থানা পুলিশ বেনাপোলের পুটখালি সীমান্তের বাংলাদেশের ১৭নং মেইন পিলারের ২শ গজ ভেতর থেকে অজ্ঞাত (৩০) এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে। একই মাসের ১৫ জুন শার্শার গোগা কালিয়ানি গ্রামে স্বামীর হাতে খুন হয় গৃহবধু রেহেনা খাতুন। পরকীয়া প্রেমের কারণে এ খুনের ঘটনা ঘটে। ১৩ জুন বেনাপোলের কাগজপুকুর গ্রামের মাঠের পাটক্ষেত থেকে সাগর (১৫) নামের এক ভ্যান চালকের গলিত লাশ উদ্ধার করে বেনাপোল পোর্ট থানা পুলিশ। ১১ জুন শার্শার গোগা খড়ের মাঠ এলাকা থেকে অজ্ঞাত (৩০) এক যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।

১৮ মে বেনাপোলের বড়আঁচড়া গ্রামে স্বামী গলা টিপে হত্যা করে গৃহবধূ রেহেনাকে (২২)। কলেজ ছুটিতে বাড়ি এসে ৩ মে এক দল দুর্বৃত্তের হাতে খুন হয় শার্শার নিজামপুর গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা বদিয়ার রহমানের কলেজ পড়ুয়া পুত্র মেহেদি হাসান শিমুল (১৯)। ১০ মার্চ নিজ বাড়িতে খুন হয় শার্শার বাগআঁচড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বাবু। ৭ মার্চ উলাশী গ্রামের যশোর সরকারি এমএম কলেজের হিসাব বিজ্ঞানের দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্রী কুহেলী বেগম (২৩) এর লাশ পাওয়া যায় নিজ ঘরে পা বাঁধা এবং মুখের ভিতর রুমাল ভরা সিলিং ফ্যানের রডে ঝুলন্ত অবস্থায়। তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়।

২৭ ফেব্রুয়ারি ইরি ধানের জমিতে পানি দেয়াকে কেন্দ্র করে খুন হয় শার্শার অগ্রভুলট গ্রামের শিশু শাওন (৭)। ১৪ ফেব্রুয়ারি বেনাপোলের বাহাদুরপুর ধান্যখোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বারান্দা থেকে পুলিশ যুবলীগের কর্মী শওকত আলীর (৩৭) লাশ উদ্ধার করে। তাকে দুর্বৃত্তরা পিটিয়ে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখে। ১২ জানুয়ারি প্রেম ঘটিত ব্যাপার নিয়ে পরিকল্পিতভাবে জবাই করা হয় শার্শার গোগা ইউনিয়নের রুদ্রপুর গ্রামের হুমায়ন কবীর ঝন্টু (১৭) নামে এক কলেজ ছাত্রকে। একের পর এক ২১টি হত্যাকাণ্ড ঘটলেও কোনটির রহস্যের জট খোলেনি ১৮ মাসেও।

এসব হত্যাকাণ্ড ছাড়াও অসংখ্য লোকজনকে কুপিয়ে, হাতুড়ি পেটা ও মারপিট করে পঙ্গু করেছে সন্ত্রাসীরা। এদের হাত থেকে সাংবাদিকরাও রেহাই পায়নি। যার কারণেই এ জনপদের সাধারণ মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।