অফিসের একটা মজার ব্যপার দেখলে বেশ হাসি পায়। ব্যপারটা কাকতালীয হতে পারে, কিন্তু কয়েক বছর থেকে দেখে আসছে। ঘটনাগুলো ঠিক একইরকম ঘটে যাচ্ছে। ব্যপারটা হল, জেনির অফিসের কোন মেয়ে যখন কনসিভ করে তখন কয়েকজন একসাথে করে। শুধু তা নয়, মেয়ে কলিগরা যখন মা হবার সুখবরটা পায়, ছেলে কলিগরাও তখন বাবা হবার সুখবরটা পায়।
এরমানে কাছাকাছি সময়ে এই প্রতিষ্ঠানের পরিবারগুলোতে কয়েকটি শিশু একসাথে পৃথিবীর আলো দেখে। তারা একসাথে বড় হয়, খেলাধুলা করে। জেনি বলে, এরা অমুক গ্রুপের বেবী, ওরা তমুক গ্রুপের।
আজ তানিয়া আপুর কনসিভ করার খবরটা পেল। গেল মাসে স্বপ্না আপুর সে কি ভয়াবহ সময় গেল।
কনসিভ করার পর মাস না ঘুরতেই মিস ক্যারেজের কালো থাবা বসাতে চেয়েছিল। শেষমেষ অবশ্য বিপদ ঠেকানো গেছে। টানা তিন মাস বেডরেস্টে থাকতে হবে। এই নিয়ে এই গ্রুপে ভাবীরা মিলে চারজন হল। মিজান ভাই আর শফিক ভাই হলেন বাকী দু'জন।
চারজনই একসাথে জয়েন করেছেন, জেনিদের বছর তিনেকের সিনিয়র ওরা।
খবরটা কানে যেতেই একটা প্রবল ভয় মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, একে একে সবাই মা হয়ে গেল। বিয়ের চার বছর পার হয়ে গেল, আজো শিশু এলোনা তার আর ফয়সালের ঘরে। এই সন্তান না হবার অজুহাতে ফয়সাল তার সাথে ঝামেলা বাঁধিয়ে বসে আছে।
সব পুরুষ যা করে তাই আরকি। তাবিজ কবচ পানি পড়া কিছুই বাকী রাখে নি। শাশুড়িতো হজ্জ করার সময় মরিয়ম ফুল নিয়ে এলেন, সে ফুল ধোয়া পানি ও খেয়েছে জেনি নীরবে। ফয়সালকে কিছুতেই বোঝাতে পারেনি, বিজ্ঞান এর কাছে পানি পড়া ঝাড় ফুঁক কিছুই না। তাদের একজন ভাল ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।
জেনি বায়োলজিক্যাল সায়েন্স পড়েছে। অনেক আধুনিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা মেয়ে, তাবিজ কবচ এসব একদম সহ্য করতে পারে না। ফয়সালকে কোনভাবেই বোঝাতে না পেরে, এখন ওরা সেপারশনে আছে।
আজ তানিয়া আপুর মা হবার সম্ভাবনার খবরটা শুনেই মনে হল, মেঘে মেঘে বেলা চলে যাচ্ছে। কাজের কাজ কিছুই হল না।
তার মন বলে উঠল, মা হতে হবে। এখনা তারা আইনত স্বামী স্ত্রী কাজেই জেনি মনস্হির করেই ফেলল, মা হতে হবে।
সবকিছু যেন অলৌকিক কাকতালীয় ভাবে হতে লাগল। অফিসে কাজের ভীষণ চাপ সেদিন, একটা রিপোর্ট আজই দিতে হবে। এর মধ্যেই বড়পার ফেন, সিকদার মেডিক্যালে থাইল্যান্ড থেকে একজন ডাক্তার এসেছেন।
সব মিলিয়ে ৩০ জন রোগী দেখেন তিনি। ওখানে একটা মাত্র সীট খালি আছে, আজই কনফার্ম করে আসতে হবে। ফোনে করা যাবে না, স্বশরীরে যেতে হবে। বসকে বুঝিয়ে ছুটিনেয় সেদিন জেনি। বাসা থেকে গত কয়েক মাসে করা রিপোর্ট আল্ট্রাসোনোগ্রাম গুলো নিয়ে গুলশান পৌঁছতে বেলা বারোটা।
বাংলাদেশের ডাক্তাররা রিপোর্টগুলো দেখলেন। আরো কিছু পরীক্ষা করে বললেন আপনার সব তো বেশ ভাল আছে।
পরদিন ডাক্তারের সাথে ভিজিট। সেই দুপুর থেকে অপেক্ষা। শেষে রেজিষ্ট্রেশন করাতে জেনির সিরিয়ালও শেষে।
অপেক্ষা করতে করতে শেষপর্যন্ত ডাক্তারের সাথে সাক্ষাত। ডাক্তার শুনলেন গতকাল যারা জেনির পরীক্ষা করেছিলেন তাদের কাছে হিস্ট্রি, জেনিও খুলে বলল তার কি সমস্যা। ডাক্তার যা বললেন তা হল, "তোমার স্বাস্থ্য দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি অনেক ফিট একটা মেয়ে। এবং অন্য ডাক্তাররা ও জানালো তোমার কোন সমস্যা নেই। তুমি শুধু একটু ওজন কমাও, বেশী ওজন হরমোন সিক্রেশনে বাধা দেয়।
আশা করি বাকি অষুধ গুলো খেলেই তুমি মা হয়ে যাবে। "
ডাক্তারের একতুড়িতে সব ভয় উড়িয়ে দেয়া কথা শুনে জেনি হেসে ফেলল। সে বলল, "এত সহজ! ঠিক আছে, আমাকে যা বললে, আমি সব করবো। "হাসিমুখে চেম্বার থেকে কেড়িয়ে এল জেনি। এবং সাথে সাথে তার মন এও জানালো, মা হওয়াটা এখন শুধু সময়ের ব্যপার।
ডাক্তারের কথামতন দুমাসের মধ্যেই মা হবার আভাস পেল জেনি। সবাই বলত, তুমি মা হলেই দেখবে ফয়সাল একদম ঠিক হয়ে যাবে। জেনি স্বপ্না আপুর মতন মিসক্যারেজ এর রিস্কে যেতে চায়না তাই ডাক্তারের কথামতন শুরুর দিকে বেডরেষ্টে থাকলো । ফয়সাল আব্দার করলো তার কাছে যেয়ে থাকতে হবে। মানিকগঞ্জে থেকে মাসে মাসে ঢাকায় ডাক্তার দেখানো কঠিন, তাছাড়া কদিন পর তার অফিস শুরু হবে।
এসব ফয়সাল শুনতে চাইল না। গ্রামেও নাকি ভাল ডাক্তার আছে! এখন থেকে আর অফিস না গেলেও বা কি হয় এমন কথাও বলল। জেনি কিছু বলে না। সে জানে তাকে মা হতে হবে, এই পরিকল্পনার শুরু সে করেছিল। তাই অনাগত এই সন্তানের প্রতি তার দায় দায়িত্ব অনেকখানি।
প্রতি মাসে শিশুটির বেড়ে ওঠা উপভোগ করে জেনি। অনেকগুলো বই কিনেছে। কি কি খেতে হবে তার একটা লিস্ট বানিয়েছে। বাবুটা কোন সময় কেমন আচরন করে বই পড়ে পড়ে সব মুখস্থ ওর। ফয়সাল একদিনও জেনিকে দেখতে আসে না।
জেনি ফয়সালকে বলে, "বাবুটার এখন কথা শুনবার সময় হয়েছে। তুমি ওর কাছে এস, এসে ওর সাথে কথা বল। " ফয়সাল কিছুই বলে না। ফোনটা রেখে দেয়। দুচোখ ভেসে যায় জেনির।
পরমুহূর্তেই মনে হয়, সে কাঁদলে তো বাবুটাও কাঁদবে! সাথে সাথে বাবুটাকে আশ্বস্ত করে, "না সোনা, এইতো মা কাঁদি না। এখন মায়ের মন ভাল। " বাবুটার ডেভেলপমেন্ট কিছুই দেখল না ফয়সাল, তাই যে বইটা জেনি পড়ে সেটা ফটোকপি করে কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিল ওর কাছে।
একা, একদম একা, দিনরাত্রি পার করে মা হবার সময়টুকু এগিয়ে আসে। জেনি বা ফয়সাল কারো পরিবার পরিজনই জানতে পারে না, যে ফয়সাল এতগুলো মাস একদিনও অন্তসত্বা জেনিকে একটিবারের জন্য আর দেখতে আসেনি।
সেই যে তারা প্রথম ডাক্তারের কাছে গেল সেদিনটি ছাড়া। কারণ জেনি সবাইকে বলতো প্রতি সপ্তাহে ফয়সাল আসে, ছুটির দিন থেকে আবার চলে যায়। তার মনে এখনো আশা, সন্তানের মুখটা দেখলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ছুটির দিনে অন্য কারো ওর বাড়িতে আসাটা নানা কায়দায় এড়িয়ে যায়। অবশ্য জেনির অফিস কোয়ার্টারে খবরটা গোপন থাকে না।
নির্দিষ্ট সময়ে মায়ের বাড়ী থেকে হাসপাতালে ভর্তি হয় জেনি। ফয়সালকে ফোন করে। "এবার তো তুমি এস!" আকুতি জানায় জেনি। "সবার কাছে আমি কত ছোট হয়ে যাব। " ফয়সাল জানায় "আমিএকটি ট্রেনিং এ আছি।
পরে ফোন দেবো। " সারাদিন আর ফোন দেয়না ফয়সাল। ফ্লুইড কম থাকায় ডাক্তার সিজারিয়ান সেকশন করার পক্ষে রায় দেন। বন্ড দেবার জন্যও ফয়সালকে পাওয়া যায় না। জেনি বড়পাকে বন্ড দিতে বলে।
পড়ন্ত বিকেলে সিজারিয়ান টেবিলে পরম আকাঙ্খিত মুহূর্তের প্রতীক্ষায় কান পাতে জেনি। সে জানে তার অনেক বড় একটি চাওয়া স্রষ্টা পূরণ করেছেন। মূঢ়ের মতন ফয়সাল যার স্বাদ গন্ধ কিছুই পেল না। মা হবার পরম আনন্দে ফয়সালের সমস্ত অপমানকে তার তুচ্ছ করতে ইচ্ছে হয়। করুণা হয় ফয়সালের জন্য।
সে আজ মা হয়েছে, শুরু থেকে শেষ অবধি যার প্রতিটা পদক্ষেপে শুধু তার একার অবদান। এ অর্জন শুধু তার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।