আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাষ্ট্রীয়ভাবে আজও উপেক্ষিত

দেশকে ভালবাসা

রাষ্ট্রীয়ভাবে আজও উপেক্ষিত রবীন্দ্রনাথ আজিজুল পারভেজবাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে পেঁৗছে দেওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাদেশে উপেক্ষিত হচ্ছেন নানাভাবে। স্বাধীনতার পর বিস্ময়-প্রতিভা রবীন্দ্রনাথের গানকে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দেওয়া হলেও রবীন্দ্রচর্চার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। শান্তিনিকেতনের আদলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বপ্ন এখনো আলোর মুখ দেখেনি। বাঙালি সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব সর্বব্যাপী। পাকিস্তান আমলে শাসকগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক মানসিকতা থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রতি বৈরী মনোভাব বজায় রেখেছিল।

১৯৬১ সালে শাসকগোষ্ঠী রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনে বাধা দেয়। কিন্তু সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সাড়ম্বরে তা উদ্যাপন করে বাঙালিরা। ওই ঘটনার মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় ছায়ানট। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় এবং তারপর বেতার টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় পশ্চিমবঙ্গ থেকে বই আমদানি।

শাসকগোষ্ঠী চেষ্টা চালায় রবীন্দ্রনাথের বিকল্প হিসেবে উর্দুভাষী কবি ইকবাল ও কাজী নজরুল ইসলামকে দাঁড় করাতে। রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ার জন্য তখন রাজপথে আন্দোলন হয়। ষাটের দশকের বাংলাদেশ আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার প্রতীক ও অনুপ্রেরণায় পরিণত হন। মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণাও দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের গান। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে রবীন্দ্রবিরোধিতার বাধা অপসারিত হয়।

'আমার সোনার বাংলা' গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাহাত্তরে কলকাতায় দেওয়া ভাষণে শান্তিনিকেতনের আদলে বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। কিন্তু তিনি তা করে যেতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আবারও সাম্প্রদায়িক মানসিকতা ফিরে আসে। তবে এর পরও স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয়ভাবে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের রীতি চালু হয়।

রুটিনওয়ার্ক হিসেবে পরবর্তী সরকারগুলোও তা অনুসরণ করে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে রবীন্দ্রচর্চা প্রসারিত হয়নি। গবেষক গোলাম মুর্শিদের ভাষ্য, 'রবীন্দ্রনাথের গানকে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দেওয়া হলেও তাঁর নামে এখন পর্যন্ত একটা উল্লেখযোগ্য রাস্তার নামকরণ করা হলো না। একটা প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠল না। অথচ সিপাই থেকে সিপাহশালার পর্যন্ত কত জানা-অজানা লোকের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সড়ক থেকে শুরু করে বিমানবন্দর পর্যন্ত তৈরি হলো।

' রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনাগুলোর একটি ছাড়া বাকিগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মযহারুল ইসলাম তাঁর জীবদ্দশায় উত্তরবঙ্গের রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত শাহজাদপুরে 'রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালান। তবে তা বাস্তবায়িত হয়নি। সুলভে রবীন্দ্রসাহিত্য প্রকাশেরও কোনো উদ্যোগ নেই। অবশ্য প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পাঠ্যক্রমে রবীন্দ্রসাহিত্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আগে থেকেই।

বেসরকারি উদ্যোগে দেশে অবশ্য রবীন্দ্রচর্চা প্রসার লাভ করেছে। ওয়াহিদুল হকের নেতৃত্বে ছায়ানট ও রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের প্রচেষ্টায় সারা দেশে রবীন্দ্রসংগীত চর্চা ব্যাপকতা লাভ করে। ভাষাসৈনিক প্রাবন্ধিক ডা. আহমদ রফিকের প্রচেষ্টায় ১৯৮৯ সালে 'রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র' নামে একটি ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এ সংগঠনের উদ্যোগে রবীন্দ্রগ্রন্থাগার গড়ে ওঠে এবং 'রবীন্দ্রচর্চা' নামে একটি বুলেটিনও প্রকাশিত হতো। ঢাকার উত্তরায় 'রবীন্দ্র সরণি' আর ধানমণ্ডির লেকপাড়ের 'রবীন্দ্র সরোবর মুক্তমঞ্চ' নামকরণ হয়েছে বেসরকারি উদ্যোগে।

কিন্তু রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বেতার বা টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার সময় আগের চেয়ে বাড়েনি। রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী তপন মাহমুদ জানান, পাকিস্তান আমলে টেলিভিশনে সপ্তাহে দুটি রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠান হতো। অনুষ্ঠানের সময়সীমা ছিল ১৫ থেকে ২৫ মিনিট। তখন তালিকভুক্ত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীর সংখ্যা ছিল ৪০ থেকে ৫০। এখন বিটিভির সামগ্রিক অনুষ্ঠানের সময়সীমা বেড়েছে।

তালিকাভুক্ত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে হাজার জনের মতো। কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার সময়সীমা বাড়েনি। আগে যেখানে একজন শিল্পী দুই থেকে তিন মাসে অন্তত একটি অনুষ্ঠানে গাওয়ার সুযোগ পেতেন, সেখানে এখন দুই-তিন বছরেও একটি গান গাওয়ার সুযোগ আসে না। রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে দেশে কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকলেও রবীন্দ্রবিরোধিতা পুরোপুরি লোপ পায়নি। কোনো কোনো মহল থেকে 'হিন্দু রবীন্দ্রনাথের' গানকে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা না দেওয়ার মতো দাবি উচ্চারিত হতেও শোনা গেছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে কবিগুরুর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে উদ্যাপন করার বিষয়ে সমঝোতা হয়। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর প্রশ্ন, সমঝোতায় নজরুলের জন্মবার্ষিকী পালনের প্রসঙ্গ নেই কেন? এখানে স্মরণযোগ্য, জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনেস্কো আগামী বছর বিশ্বব্যাপী কবিগুরুর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। বরেণ্য শিল্পী কলিম শরাফীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সংস্থা এ বছর রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্যাপন উপলক্ষে ১০ দফা দাবি তুলেছে। তারা সরকারি উদ্যোগে রবীন্দ্র গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, রবীন্দ্রনাথের নামে রাজধানীর প্রধানতম সড়কের নামকরণ এবং রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত স্থান তথা শাহজাদপুরের কুঠিবাড়ী, নওগাঁর পতিসর ও খুলনার দক্ষিণডিহির স্থাপনাগুলো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সংরক্ষণ করার দাবি জানিয়েছে।

কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়ী সরকারি উদ্যোগে সংস্কার ও সংরক্ষণের নামে অবাঞ্ছিত সরকারি স্থাপনা নির্মাণের সমালোচনাও করেছে সংস্থাটি। স্বাধীনতার চার দশক পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমী রবীন্দ্রচর্চা উৎসাহিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রবর্তন করেছে 'রবীন্দ্র পুরস্কার'। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে আজ শনিবার প্রথমবারের মতো এ পুরস্কার প্রদান করা হবে। এবার পুরস্কার পাচ্ছেন কলিম শরাফী ও সন্জীদা খাতুন।

বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, বরীন্দ্রচর্চার জন্য স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা জরুরি। বঙ্গবন্ধুর কলকাতা ঘোষণার আলোকে শিলাইদহে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজাদপুরে এর ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে পারে সরকার। রবীন্দ্র গবেষক আহমদ রফিক জানান, 'রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র' থেকে তাঁরা বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রবীন্দ্রচেয়ার প্রতিষ্ঠা করা এবং সরকারি উদ্যোগে রবীন্দ্র ইনস্টিটিউট বা একাডেমী প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সব সরকারপ্রধান রবীন্দ্রজয়ন্তীর বক্তৃতায় স্বীকার করেন, 'রবীন্দ্রনাথ আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এখনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কোনো রাবীন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়নি।

'

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।