শৈশব বা কৈশর এ স্বপ্ন নিয়ে বড় হইনাই এমন ছেলে/মেয়ে খুজে পাওয়া দুস্কর। আর আমার মত যাদের শৈশব বা কৈশর দুরন্তপনার মাঝে কেটেছে তাদের তো স্বপ্নের বালাই নেই। বাবার চাকরীর সুবাদে ৩/৪বছর পর পর বিভিন্ন নতুন নতুন জায়গায় বদলী, নতুন পরিবেশ, নতুন স্কুল, বন্ধু বান্ধব আর নতুন নতুন স্বপ্ন যা একেকটা অধ্যায়। স্বপ্নের ছোট একটা উদাহরন দেই – তখন ক্লাস থ্রী বা ফোর এ পড়ি। তখন স্বপ্ন ছিল বাসের ড্রাইভার হব ।
খেতে বসে টেবিলে ভাতের থালা দিয়ে কত ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ি চালিয়েছি তার ইওত্তা নেই । গাড়ি চালিয়ে মানুষকে সাহায্য করা, বিনা ভাড়ায় মানুষ কে বিভিন্ন জায়গায় নামিয়ে দেয়া, দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানো এগুলা ছিল নিত্য নৈম্যত্তিক স্বপ্নের মধ্যে অন্তর্গত । এমন ও দিন গেছে যে ভাত কি খাব, থালা নিয়ে ২/৩ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে পার করে দিয়েছি । আর আমার কল্পনার সংগী ছিল আমার ২বন্ধু যাদের সাথে অনবরত কথা বলে যেতাম । ২/৩ ঘন্টা স্বপ্নের মাঝে বিচরন, কল্পনার বন্ধুদের সাথে কথা বলা সব কিছুর বিনিময় দিতে মা জননী একটুও কার্পন্য করত না ।
ভাতের থালা নিয়ে গাড়ি চালানো ও ২/৩ ধন্টা বসে থাকার শাস্তি স্বরুপ পর্দা ঝুলানোর ডান্ডা বা কাঠের স্কেল দিয়ে কিছু উত্তম মধ্যম জুটে যেত । বাবা মাঝে মধ্যে পাশ থেকে বলতেন "আরও একটু বেশী করে দাও" ।
রুদ্র না থেমেই দ্রুতই কথা বলে যাচ্ছে । আমি সাথে সাথে চলে গেলাম ফ্যাশব্যাকে । বলেই চলেছে রুদ্র ।
ওর চোখ-মুখ কেমন যেন জলজল করছে, মনে হচ্ছে ও একাই কথা বলে যাচ্ছে, আমি ওর সামনে নেই । ভাবলাম ওকে আজ থামানো ঠিক হবেনা…ও বলতে থাকল…
দুরন্ত শৈশব, উচ্ছল কৈশর
ক্লাস সেভেন/ এইট/ নাইন এ উঠার পর তো নিজেকে রাজা মনে হতে হত । সারাদিন বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা, গান, আর খেলাধুলা । ক্রিকেট, ফুটবল এর প্রতি এত নেশা বাড়ল যে রাত জেগে খেলা দেখা, পেপার কাটিং সংগ্রহ করা, পেপার এর কুইজ এ অংশ নেয়া এগুলাতেই অনেক সময় ব্যয় হয়ে যেত, পড়াশুনা করবো কখন? তবে এগুলার জন্য বাসা থেকে কোনদিন ও একটি কথাও শুনতে হয়নি । শুধু পড়ার বেলায়ই তারা ছিলেন সিদ্ধহস্ত ।
বাবা'র হাতে শেষ মার খেয়েছি ক্লাস এইট এ আর মা'র হাতে ক্লাস নাইন এ । টেন এ উঠার পর মোটামুটি সিরিয়াস । বাবা একসময় সামরিক বাহিনীতে ছিলেন তাই তার একটা স্বপ্ন ছিল আমিও যেন ওই লাইনে যাই । আমাকেও ওই জীবনটা অনেক টানত কিন্তু কেন জানি কোনদিন ও এপ্লাই করা হয়নাই । যাহোক পাইলট হবার স্বপ্ন এখানেই খ্যান্ত ।
অনার্স শেষে ১বার সিগন্যালস কোর এ এ্যাপ্লাই করছিলাম কিন্তু ঘানার মুদ্রার নাম কি বা এলসাল্ভাদর এর রাজধানীর নাম কি এই টাইপের প্রশ্নর উত্তর ফাকা ছিল তাই হয়তো ওরা ভেবেছে আমাকে দিয়ে ফাইটার চালনা সম্ভব না । টুকটাক পড়াশুনা আর ছন্নছাড়া ভাবেই দিন কেটে যেত জেমস এর গান গেয়ে গেয়ে---
“তোমাদের মাঝে কি কেউ আছে
বন্ধু আমার…
তোমাদের মাঝে কি কেউ আছে
পথ ভোলা…
তবে বন্ধু নৌকা ভেড়াও…মুছিয়ে দেবো দুঃখ সবার…”
রুদ্র একটু থেমে দম নিল । ঢকঢক করে ১গ্লাস পানি খেল, তারাহুড়ায় সার্ট ভিজিয়ে ফেলল । আবার বলতে শুরু করলো…
উচ্চমাধ্যমিক এ উচ্ছলতা আর বেড়ে গেল । যেহেতু কোয়ার্টার এ থাকতাম তাই সেখানে আরো অনেক পরিবার থাকতো ।
খেলাধুলা করার মত ছেলের অভাব হতনা চাই সেটা সকাল, বিকাল বা রাত হোক । বাড়ি গুলান ছিল বাংলো টাইপ । সামনে ছিল বিশাল বারান্দা । সেখানে চলত আমাদের ম্যাচ । উচ্চমাধ্যমিক এ কোন প্রাইভেট পড়িনি বিধায় নিজেকে একটু খাটতে হত ।
বিকালে চলত খেলাধুলা, সন্ধ্যায় ঘুম, রাতে পড়াশুনা এটাই ছিল তখনকার জীবন । এরপর জীবনের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় জীবন । দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল । আজও স্বপ্নের মাঝে আমার প্রিয় ক্যাম্পাসে হেঁটে বেড়াই…বন্ধু আড্ডা গান…
সুন্দর মিথ্যার সাথে ভালোবাসার ফানুশ
দুরন্ত শৈশব, উচ্ছল কৈশর এর পরে প্রায় ১বছর বেকার থাকার পরে শুরু হল ছকে বাধা কামলা জীবন । বেকার জীবনের কাহিনী লিখতে গেলে আরেকটা গল্প হয়ে যাবে সো সেটা আরেকদিন বলবো।
কামলা জীবন যাকে বলে কর্পোরেট কামলা । ভদ্র ভাষায় শিক্ষিত কামলা । সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭ টা অফিস । যাতায়াতে জ্যামের কারনে আর ৩/৪ ঘন্টা জীবন থেকে নষ্ট । এর মাঝে পেয়েছি শ্রেষ্ঠ কিছু বন্ধু, যাদের কাছে বিনা কারনেই ছুটে যাওয়া যায় ।
অধরা ভালোবাসার সন্ধান দিতেই হয়তো তার আগমন হঠাৎ করেই, আমাকে ভালোবাসা শিখাতেই হয়তো তার আলোর ঝলকানি…বেকার জীবনের শেষ দিকে তার সাথে পরিচয় । কিন্তু নিয়তি তাকে দূরে ঠেলে দিবে বলেই হয়তো আমার চাকরি হয়ে গেল ঢাকার বাইরে । আমি চলে গেলাম । যাবার পথে মনে হচ্ছিল আমি আমার সব কিছুই ফেলে যাচ্ছি । পরিচয়ের কিছুদিন পরে এক সন্ধ্যায় ওর প্রতিউত্তরে জানিয়েছিলাম---
“এই নিঝুম রাতে একা আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে
শুধু চিৎকার করে বলে চাই তোমায় আমি…
ভালোবাসি…শুধু তোমায় ভালোবাসি…”
স্থানের দুরত্ব আস্তে আস্তে মনের দুরত্ব বাড়াতে থাকে ।
আমি রুদ্র তখন রুদ্র হয়ে উঠি । ওকে জানিয়ে দেই তোমাকে ছাড়া আমার চলবেনা । ও এটা বুঝে হয়তো আঘাতের পরিমান বাড়াতে থাকে । আমি রুদ্র, অশান্ত হয়ে উঠি । ঢাকায় ফিরে আসি ।
কিন্তু পানি অনেকদুর গড়িয়েছে…আমি আবার শুরু থেকে শুরু করতে চেষ্টা করি কিন্তু যে নিজেই পালিয়ে থাকতে চায় তাকে খুজে বের করে কার সাধ্য । শুরু হয় ওর সুন্দর মিথ্যা । এত সুন্দর মানুষ এত সুন্দর করে কিভাবে মিথ্যা বলে কেউ ওকে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেনা । মাঝে মাঝে ভাবতাম এগুলো কি ওর দ্বারা সম্ভব !!! কিন্তু ও আস্তে আস্তে সব অসম্ভব কেই সম্ভব করতে থাকে । ক্রমেই মিথ্যা, অবিশ্বাস বাড়তে থাকে ।
একটা সময় মনে হয় আমি আলেয়ার পিছনে ছুটে চলেছি । আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে শুরু করি । যে সম্পর্কের কোন সংঙ্ঙ্গা নেই, যে সম্পর্কের কোন গন্তব্য নেয়, যে ট্রেন উদ্দেশ্যহীন ভাবে ছুটে চলেছে সে পথের যাত্রী হয়ে শুধু কষ্টই পাওয়া যায়, গন্তব্যে পৌছান যায়না । যেই আমি বন্ধু, আড্ডা, গানে মেতে থাকতাম সেই আমি নিজের মধ্যে লুকিয়ে যেতে থাকি। বেশী মানুষ দেখতেই বিরক্ত লাগতে থাকে ।
আর আলোতে চরম অভক্তি । আমি অন্ধকারের মানুষ ।
“রেল লাইন বহে সমান্তরাল…বহে সমান্তরাল…”
এক সময় আমি আমার বন্ধুদের বলতাম কারও লাইফ হেল করতে হলে তাকে ২টা জিনিসের যেকোন ১টা করিয়ে দাও, তাহলেও হল । এক নম্বর হল তাকে কোন নির্বাচনে দাড়া করিয়ে দাও অথবা প্রেম করিয়ে দাও । তাহলেই হল ।
আমি মনে হয় দ্বিতীয় কার্যকারনে ফেসে গেছি, ওকে আমি মুক্ত করে দিয়েছি বলেই হো হো করে হেসে উঠলো রুদ্র ।
“আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি
আমায় আর কান্নার ভয় দেখিয়ে কোন লাভ নেই…
আমি অগ্নিগিরির কাছে জ্বলতে শিখেছি
আমায় আর জ্বালানোর ভয় দেখিয়ে কোন লাভ নেই…। । ”
এতক্ষন ওকে যত উত্তেজিত মনে হচ্ছিল এখন ওকে পুরাপুরি শান্ত লাগছে । ও আমার বলতে শুরু করলো...
জানো, বৃষ্টির মাঝে ভেজার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল কেউ চোখের অশ্রু দেখেনা ।
সেদিন অর কাছ থেকে আঘাতটা খুব বেশী ছিল । আমার মনের মত আকাশটাও মেঘলা ছিলো, গুমোট একটা ভাব ছিল, থম ধরে ছিল । বেড় হয়ে গেলাম বাসা থেকে, রিক্সা নিলাম । আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আকাশও বুঝি তার কষ্টগুলোকে ঝমঝম কে বৃষ্টির ধারায় নামিয়ে দিল…সেই সাথে আমার চোখেও অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামলো…আজ আমার হৃদয় হারানোর দিন, রক্তক্ষরণ তো একটু হবেই । ঝুম বৃষ্টি, যে যেখানে পারছে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় নিচ্ছে আর আমি হুড খুলে রিক্সায় বসে আছি, মনের রক্তক্ষরণ গড়িয়ে পড়ছে চোখ দিয়ে ।
রিক্সাওয়ালা ভাই আমার কান্ড-কারখানায় বড়ই মুগ্ধ । সে উলটা ঘুরে আমারে প্রশ্ন করে “মামা আপ্নে আসলে যাইবেন কই?? সে দেখি মিটি মিটি হাসছে । ” হৃদয়ের রক্তক্ষরণে এততাই আহত যে আমি কোন কথাই বলতে পারছিলাম না…বৃষ্টির কারনে সে চোখের পানি বুঝতে পারছেনা । তাকে কোন ভাবে বললাম “তোমার যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে যাও মামা” । ।
বৃষ্টির মাঝে আমি চল্লাম অজানার পথে…
“মাতাল করা হাওয়া এই
ব্যথায় ভরা মন…
তোমার আকাঁ ছবি মনে
মুছবেনা কখন…
সাত রঙ্গে রাঙ্গিয়ে তুমি হবেনা তো আর
সংগী মোর……। ।
রুদ্র হঠাৎ উঠে গান গাইতে গাইতে আমার সামনে থেকে চলে যাচ্ছিল । এতক্ষনে আমি সম্বিত ফিরে পেলাম আর অনুভব করলাম গাল বেয়ে কিছু একটা গড়িয়ে পড়ছে…
কোন সে ডোরে বাধিয়া মোরে
গুড্ডি বানাইয়া রাখিলা উড়ায়...
শন শন করিয়া যাই গান গাহিয়া
দিও না বন্ধু তুমি নাটাই ছাড়িয়া...
পাগল ও হয়ে কালা যাব যে মরিয়া...
বন্ধু রে .....
তুমি বাস কি না তা আমি জানি না...
ভালবাস কিনা তাও আমি জানি না...
আমারি কাজ আমি করিয়া যে যাব...
চিন্তা হতে আমি চিতানলে যাব...
বন্ধু রে......
আমি রুদ্রর উদ্দেশ্যহীন পথের দিকে চেয়ে নির্বাক বসে রইলাম…
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।