বামন কাহিনী ঃ
একদা কোন এক গাঁয়ে এক বামন (খর্বাকার) যুবক ছিল। তার শৈশবের বন্ধুরা দেহ-মনে বেড়ে উঠলো। তার মানসিক গঠনের বিকাশ হলেও দেহের আকৃতিতে সেই শৈশবেই পরে রইলো। আর এই কারণে তাকে বন্ধুদের নিকট হতে প্রায়সই নানা উপহাস বাক্য শুনতে হতো। সেই সকল উপহাস বাক্যের মাঝে তার নিকট সবচেয়ে অপমান করছিল ,'' ব্যাটা , তুই তো এখন মায়ের সাথে ঘুমাস।
''
এই অসহনীয় উপহাস থেকে নিষ্কৃতি পেতে বামন যুবকটি একদিন তার বাবার কাছে আবদার ধরল,''বাবা, তুমি নতুন যে ঘর টি তুলেছ, ওটা আমাকে দিতে হবে। '' ছেলের আবদার শুনে বাবা বললেন, '' তুই নিজের ঘর চাস?! কিন্তু তুই তো এত খাট (ছোট) যে নিজ ঘরের 'খিল' দিতে পারবি না। রাতে চোর এসে সব কিছু নিয়ে যাবে। ''
বাবার কথায় বামন যুবকটির দৈহিক বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করল। আর সেই জন্য নানা হুজুরের পানি পড়া , কবিরাজের ঔষধ আর দূর-দূরান্তের মাজারের তাবিজ-করজ ব্যবহার করল।
কিছুতেই কোন ফল হল না। শেষে এক সাধক তান্ত্রিকের সন্ধান পাওয়া গেল। সাধু বাবা বলেন, ' যাদু মন্ত্র কিছুই নয়। তোমার দেহের ভিতরে এক স্থানে একটি ' জট' পাকিয়ে আছে। কিছু নির্দিষ্ট নিয়মে যোগব্যাম যদি করতে পার, তবে সেই জট খুলে যাবে আর তোমার দেহ তরতর করে বেড়ে উঠবে।
সেই যোগ ব্যাম করতে হবে খোলা আকাশের নিচে;খুব ভোরে সূর্যের আগমন আভায় যখন সমগ্র চরাচর জেগে উঠে ঠিক সেই মুহূর্তে। আর এক বছর যদি তুমি নিয়ম মেনে যোগ সাধনা করতে পার তবেই তোমার বামনত্ব থেকে মুক্তি ঘটবে। '' কিন্তু ভোরের ঘুমের আলস্য আর শীত কাতরতায় বামন যুবকটির পক্ষে সেই যোগ ব্যাম করা হয়ে উঠে না। শেষে সে সাধুর পরামর্শ বাদ দিয়ে এক সহজ বুদ্ধি বেড় করলো।
বামন যুবকটি ডেকে আনলো রাজমিস্ত্রী।
নতুন ঘরের প্রমান আকারের দরজা টি বন্ধ করে দিয়ে তৈরি করলো তার দেহের মাপে একটি ৩ (তিন) ফুট উচ্চতার দরজা ।
বাংলাদেশের বার্ষিকক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) এর সকলের জানা কাহিনী ঃ
গত ১ মে ২০১০ দৈনিক কালেরকন্ঠ ও দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় আগামী অর্থ বৎসরের (২০১০-২০১১) জন্য বাংলাদেশ সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এবং চলমান অর্থ বৎসরের (২০০৯-২০১০) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির হালনাগাদ চিত্র তুলে ধরা হযেছে।
২০১০-২০১১ অর্থবৎসরের জন্য ৪০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে সরকার আসন্ন জাতীয় বাজেট তৈরি করা হচ্ছে। ....... গত ২০০৯-২০১০ অর্থ বৎসের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের মূল বরাদ্দ ছিল ৩০ হাজার ৫০০ কোটি। প্রকল্প সমূহের বাস্তবায়ন অগ্রগিত সন্তোষজনক না হওয়ায় বতর্মানে খর্বিত আকারে ২০০৯-২০১০ অর্থ বৎসরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ২৮ হাজার ৫০০ কোটিতে দাড়িয়েছে।
( দৈনিক কালেরকন্ঠ)
পরিকল্পণা মন্ত্রানালয়ের বাস্তবায়ণ পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ ( আইএমইডি) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রনালয় ও বিভাগ জুলাই (২০০৯) থেকে মার্চ (২০১০) পর্যন্ত নয় মাসে মূল এডিপির ৪৪ ভাগ বা সংশোধিত এডিপির ৪৮ ভাগ অর্থাৎ ১৩ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা ব্যয় করতে সক্ষম হযেছ। এ অবস্থায় সংশোধিত এডিপি বরাদ্দ শেষ করতে হলে আগামী তিন (৩) মাসে সরকারকে ব্যয় করতে হবে ১৪ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। (দৈনিক ইত্তেফাক)
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির এই দুরাবস্থার কাহিনী সংবাদ মাধ্যমের প্রতি বছর পাঠ করে সচেতন নাগরিক মাত্র একটি বদ্ধ মূল ধরণা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক যে, 'দেশের উন্নয়নে সরকারের যত সদিচ্ছা থাকুক না কেন; প্রতি বৎসের বার্ষিক উন্নয়ন প্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়েছে মূলত ঃ মাঠ পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অদক্ষতা - অলসতা আর দৃর্নীতি আকাঙ্খার কারণে। জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ সেক্টরের আমার বিগত কয়েক বৎসর কাজ কার অভিজ্ঞতায় প্রচলিত ধারণার বৃত্ত ভেঙ্গে ক্রমে প্রকৃত স্থবিরতার চক্রটি আমার নিকট স্পষ্ট হয়ে উঠছে ।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এক বামন কাহিনীঃ
লেখাটির কেন বামন কাহিনী দিয়ে শুরু করলাম তা নিচের বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রনারয়ের অধীনস্ত পেট্রোবাংলার বিগত ২০০৮-২০০৯ অর্থ বৎসরের বার্র্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন অগ্রগিত পর্যালোচনা সভার দুইটি কার্যপত্রাংশে স্পষ্ট হযে উঠবে।
'২৮-৫-২০০৯ তারিখে অনুষ্ঠিত পেট্রোবাংলার উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের এপ্রিল ২০০৯ পর্যন্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভার কার্যবিবরনী ' তে বলা হয়............
''২০০৮-২০০৯ অর্থ বৎসেরর এডিপিতে পেট্রোবাংলার ২৩ টি প্রকল্পের জন্য মোট ৭৮১.০৯ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। উক্ত বরাদ্দের বিপরীতে এপ্রিল ২০০৯ পর্যন্ত ( ১০ মাসে) মোট ব্যয় হয়েছে ৮৭.০৫ কোটি টাকা। উক্ত ব্যয় মোট বরাদ্দের ১১.১৫%। ''
লক্ষ্য করুন মাত্র ২ (দুই) মাস পরে ২০০৮-২০০৯ অর্থ বৎসরের শেষে অনুরূপ সভায় কী বলা হচ্ছে !!!'১৯-৭-২০০৯ তারিখে অনুষ্ঠিত পেট্রোবাংলার উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের জুন ২০০৯ পর্যন্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভার কার্যবিবরনী ' তে বলা হয়..................
''২০০৮-২০০৯ অর্থ বৎসেরর আরএডিপিতে পেট্রোবাংলার ২৩ টি প্রকল্পের জন্য মোট ১৮০.৩৯ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। উক্ত বরাদ্দের বিপরীতে জুন ২০০৯ পর্যন্ত ( ১২ মাসে) মোট ব্যয় হয়েছে ১৯৬.২৪ কোটি টাকা।
উক্ত ব্যয় মোট বরাদ্দের ১০৮.৭৯%। ''
অমনোয়োগি পাঠক মাত্র চমকে উঠবেন যে, মাত্র ২ মাস সময়ে অগ্রগিত (১০৮.৭৯% - ১১.১৫% ) = ৯৭.৬৪ % বৃদ্ধি পেল কিভাবে?! এও কী সম্ভব!!!!!!!!!!!!!!!! সম্ভব তখনই যখন গল্পের সেই বামনের মত নিজ অসামর্থতার সাথে খাপ খাইয়ে প্রতি বৎসরই অনেকটা চুপচাপ বার্ষিক উন্নয় কর্মসূচি কে ছোট করে আনা হয়.... অর্জন (অগ্রগতি!) কে বড় করে দেখাবার জন্য।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রনয়ণ এক বিরাট ধাপ্পা বাজি ঃ
যেখানে ২০০৯-২০১০ অর্থ বৎসরের ৯ মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অগ্রগতি মাত্র ৪৪% ; সেখানে আসন্ন ২০১০-২০১১ অর্থ বৎসরের জন্য ব্যয় বরাদ্দ পর্ববর্তী গৎসরের চেয়েও ১০ হাজার কোটি বৃদ্ধি করে ৪০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিপুল বার্ষিক উন্নয়স কর্মসূচি প্রনয়ণ করা হচ্ছে । দৈনিক কালের কন্ঠের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ,কিভাবে মন্ত্রী- সাংসদের চাপ ও রাজনৈতিক বিবেচনায় আসন্ন অর্থ বৎসরের বিপুল উন্নয়ন বাজেট হতে যাচ্ছে। আমাদের দেশে ক্ষমতাসীনরা সকল কালে জনগণ কে মিথ্যা আশ্বাসে প্রতারিত করতে যত টুকু সচেষ্ট , তার বিন্দু মাত্র অঙ্গিকার বাস্তবায়নের পরিলক্ষিত হয় না।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের মূল সংকট অনুসন্ধান ঃ
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের মূল সংকট অনুসন্ধানের প্রারম্ভে আমি কিভাবে একটি উন্নয়ন প্রকল্প অর্থের সংস্থান হয় সে সম্পর্কে আলোকপাত করব।
যে কোন প্রকল্প বাস্তবায়নের মূল কথা এর অর্থের সংস্থান। ধরুন , ' ক' একটি অনুমোদিত প্রকল্প, যার মেয়াদ কাল তিন (৩) অর্থ বৎসর। ভাবার কারণ নেই যে, প্রকল্পের শুরুতেই 'ক' প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের কাছে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ সবটুকু চলে যায়। প্রকল্প পরিচালক অর্থ বৎসরের শুরুর আগেই জানান আসন্ন অর্থ বৎসরে তার প্রকল্পের জন্য কত বরাদ্দ প্রয়োজন।
সে আলোক কে প্রকল্পের জন্য অনুমোদিত হয় নির্দিষ্ট অর্থ বৎসরের বাজেট বরাদ্দ।
বার্ষিক বরাদ্দের সব টুকু কিন্তু প্রকল্প পরিচালকের হাতে অর্থ বৎসরের শুরুতে চলে আসে না। বাজেট অনুমোদন প্রাপ্তির পর প্রকল্প পরিচালক 'জুলাই- সেপ্টেম্বর', 'অক্টোবর-ডিসেম্বর', ' জানুয়ারি-মার্চ' ও ' এপ্রিল-জুন' ৪ (চার) প্রান্তিকের বাস্তবায়ন কর্মসূচির ভিত্তিতে বাজেট বরাদ্দ প্রস্তাব কে ভাগ করে এবং স্ব স্ব মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রনালয়ে একটি প্রান্তিক (৩ মাস) এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড় প্রস্তাব প্রেরণ করে। এবং ৩ মাস -৩ মাস করে এই অর্থ দাপে ধাপে অবমুক্ত হয়। এই বিধান টির বাস্তব চিত্রটা এবার দেখি।
২০০৯-২০১০ অর্থ বৎসর সরকারের অগ্রধিকার প্রাপ্ত জ্বালানী ও খিনজ সম্পদ বিভাগের ১ টি প্রকল্পের অর্থ অবমুক্তি প্রক্রিয়ায় দেখা যায়........................
১ ম প্রান্তিক ('জুলাই- সেপ্টেম্বর') এ বাস্তবায়ন যোগ্য কাজের অর্থ ছাড়/ অবমুক্ত হয়েছে ২৮ আগস্ট ২০০৯।
২য় প্রান্তিক 'অক্টোবর-ডিসেম্বর' এ বাস্তবায়ন যোগ্য কাজের অর্থ ছাড়/ অবমুক্ত হয়েছে ৬ ডিসেম্বর ২০০৯ ও ২১ ডিসেম্বর ২০০৯।
৩ য় প্রান্তিক (' জানুয়ারি-মার্চ') ও ৪ র্থ প্রান্তিক (' এপ্রিল-জুন' ) মে মাস শুরু হয়ে গেলেও এখনও অবমুক্ত হয় নি।
বিগত অর্থ বৎসর গুলোতে দেখা গিযেছে যে, প্রকল্পের অনুকূলে ৩ য় প্রান্তিক (' জানুয়ারি-মার্চ') ও ৪ র্থ প্রান্তিক (' এপ্রিল-জুন' ) এর অর্থ ছাড় হতে জুন মাসের মাঝামাঝি হযে যায়। আর শেষ সময়ে অর্থ অবমুক্ত হওয়াতে তড়িঘড়ি অর্থ ব্যয়ে একদিকে থাকে অস্বচ্ছতা-দুনীর্তির সুয়োগ আর অপর দিকে গুনগত মান নিশ্চিত করাও হযে উঠে অসম্ভব।
আবার সময়ের অভাবে বার্ষিব উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবাযনে ব্যর্থ হয়ে অনেকে অব্যয়িত অর্থ বিধি মোতাকেক ৩০ জুনের পর ফেরত পাঠান।
এখানেই মাঠ পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে দায়িত্ব প্রাপ্তরা বড় অসহায়। র্তীর্থে কাকের মত বষে থকতে হয় প্রকল্পের প্রতি প্রান্তিক অর্থ ছাড়ের প্রত্যাশায়। নষ্ট হয় প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বাভাবিক গতি।
শেষ কথা ঃ
লোক দেখানো বিপুল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির পরিবর্তে ক্ষুদ্র - সাধ্য মাত্রার মধ্য গৃহিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিই পারে প্রকৃত জাতীয় অগ্রগিত নিশ্চিৎ করতে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।