আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'ভারতীয়' নয়, 'বিদেশী' ছবি আমদানি হোক

সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...

ভারতীয় ছবি আমদানি নিয়ে চলচ্চিত্রাঙ্গনে বিতর্ক চলছে। সরকার ভারতীয় ছবি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়ে আবার দুই দিনের মাথায় তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। যারা বিতর্ক করছেন তাদের একপক্ষ ভারতীয় ছবি আমদানি করার পক্ষে, এঁরা মূলত প্রদর্শক, সোজা কথায় হল মালিক। আরেক পক্ষ এর বিরোধিতা করছে, এঁরা হলেন পরিচালক-প্রযোজক। ফেসবুক ও ব্লগেও বিতর্ক চলছেন, এতে অংশ নিচ্ছেন তরুণ চলচ্চিত্রকর্মী থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রেপ্রেমীরা।

সরকার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করলেও বিতর্কটা শেষ হয়ে যাচ্ছে না। এটা চলতে পারে, বিষয়গুলো আরও পরিস্কারভাবে উপলব্ধি করার জন্য এটা জরুরি। আমার বিবেচনায়, সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে, নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদেশী ছবি (কেবলই ভারতীয় বা হিন্দি নয়) আমাদের দেশে আমদানি করা যেতে পারে। চীনে বছরে ২০টি বিদেশী ছবি আমদানি হয়, সেন্সরপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় সেসব ছবিকে যেতে হয়। মালয়েশিয়ায় দেখেছি একই সিনেপ্লেক্সে পাশাপাশি ইংরেজি, চীনা, হিন্দি, তামিল ও মালয়ভাষী ছবি পাশাপাশি প্রদর্শিত হচ্ছে।

আমার এই অবস্থানকে পরিস্কার করার আগে একটা প্রেক্ষাপট বর্ণনা করা দরকার। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হবার কয়েকদিন পরে পাকিস্তান সরকার ভারতীয় চলচ্চিত্র এদেশে নিষিদ্ধ করে। আবার ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার উর্দু বা পাকিস্তানি ছবিকে নিষিদ্ধ করে। কিন্তু নিষিদ্ধ করার আগ পর্যন্ত বহুজনপ্রিয় ভারতীয় বাংলা ছবির দাপটের পরও যেমন আমাদের বাংলা ছবি ব্যবসা করেছে, এফডিসি থেকে নির্মিত চকোরি-চান্দা-তালাশ ইত্যাদি উর্দুভাষী ছবি পশ্চিম পাকিস্তানেও ব্যবসা করেছে। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে একটি ‘প্রটেকটেড’ পরিবেশে, চ্যালেঞ্জবিহীন, যা-খুশি-নির্মাণ-করি-ব্যবসা-হবে মানসিকতার কারণে আমাদের মূলধারার ছবির মান আর আগায় নি।

হ্যাঁ, ব্যবসা হয়েছে ততদিন, যতদিন না ভিসিআর-কেবল টেলিভিশনের চ্যালেঞ্জ আসেনি। তার আগ পর্যন্ত মানুষের দৈনন্দিন বা সাপ্তাহিক বিনোদন তো একটাই ছিল -- প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে সিনেমা দেখা। এখন মানুষ বিনোদনের অনেক অপশন পেয়ে গেল, বিনোদনের জন্য তাকে আর প্রেক্ষাগৃহে যেতে হয়না। আবার দুয়েকবার গিয়ে তারা দেখে যে, ঘরে বসে গ্ল্যামারাস হিন্দি আর দুর্ধর্ষ ইংরেজি ছবি দেখে দেখে তাদের যে-চোখ তৈরী হয়েছে তার কাছে বাংলা ছবি বড্ড পানসে। সরকার ইন্ডাস্ট্রিকে প্রটেকশন দিতে পারে, কিন্তু দর্শক স্বাধীন, তার তো বাংলা সিনেমাকে প্রটেকশন দেয়ার দায়িত্ব নেই।

এবার ভারতীয় ছবি আমদানির পক্ষে-বিপক্ষে যারা যে-যুক্তিগুলো দিচ্ছেন সেগুলো বিবেচনা করে দেখা যাক। গত ২২ এপ্রিল, ২০১০ তারিখে প্রথম আলোর 'আনন্দ' পাতায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে অভিনেতা-নির্মাতা রাজ্জাক বলেছেন, ‘ভারতীয় হিন্দি চলচ্চিত্র আমাদের দেশে আসা মানে, আমাদের নিজস্ব যে সংস্কৃতি আছে, সেটুকুও শেষ হয়ে যাওয়া। ’ এই অভিযোগ অনেক পুরনো কিন্তু এখন অকার্যকর। কেবল টিভি, ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথাকথিত ‘অপসংস্কৃতি’র যে-প্রবাহ, তা দেড় দশক ধরে চলছে -- আমরা ভেসে যাইনি। বরং বিশ্বায়নের বার্তার সঙ্গে প্রতিদিন মোকাবেলা করে আমরা টিকে আছি।

লোকজ ধাঁচের গান-কাহিনী নিয়ে ‘মনপুরা’ লড়াই করছে। অভিনেতা-নির্মাতা আলমগীর বলেছেন, ‘এদেশে বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভিত্তিপ্রস্তর গড়ে এফডিসি নির্মাণ করেছিলেন, সেটাও আর থাকবে না। ’ এফডিসির অবস্থা এখনই বেশ করুণ, এফডিসির সুযোগ-সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহার এখন চলচ্চিত্র-নির্মাতারা করছেন না, করছেন বিজ্ঞাপননির্মাতারা। একসময় প্রায় একশ ছবি নির্মিত হতো এদেশে, এখন হয় ৪৫টা। নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘পাকিস্তানে ভারতীয় ছবি প্রদর্শনের ফলে সে দেশের চলচ্চিত্রশিল্প রুগ্ণ হয়ে গেছে।

’ ভারতের মহাপ্রতিপক্ষ পাকিস্তানে ভারতীয় ছবি প্রেক্ষাগৃহে চলছে, কিন্তু সেটাই চলচ্চিত্রশিল্প রুগ্ণ হয়ে পড়ার প্রধান কারণ নয়। এর অনেক আগে, জিয়াউল হক সরকারের গৃহীত নীতিমালার কারণেই পাকিস্তানের চলচ্চিত্রশিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছিল। জিয়াউল হক যেবছর শাসনভার হাতে নেন, সেই ১৯৭৯ সালে পাকিস্তানে ৯৮টি ছবি নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু পরের বছরেই সেই সংখ্যা ৫৮তে নেমে আসে। জিয়া সরকারের সময় ধর্মীয় উন্মাদনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে যার প্রথম কোপ পড়ে চলচ্চিত্রশিল্পের ওপর।

পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম ঢালাওভাবে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমাদানি সমর্থন করেননা। তবে তিনি মনে করেন, ‘দুই দেশের মধ্যে একটা বিনিময়চুক্তি থাকলো, তার মধ্যে একটি হচ্ছে আমাদের দেশ থেকে তারা বাংলা ছবি নেবে, আমরাও তাদের দেশ থেকে বাংলা ছবি আনতে পারি। হয়তো সেখানে বছরে কয়েকটি হিন্দি ভালো ছবি আসতে পারে। ’ এই প্রস্তাবটি আমার কাছে অপেক্ষাকৃত ভালো মনে হয়েছে। আমদানির প্রসঙ্গে রফতানির বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।

এখানে একটা বৈষম্য থাকবে অবশ্য, মান ও সংখ্যার বিবেচনায় ভারতীয় ছবিই বেশি আসবে (ধরা যাক বছরে ১৫টি) এবং আমাদের ছবি কম যাবে (হয়তো বছরে ৫টি)। বলা দরকার অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ২০০৭ সাল নাগাদ, ভারতীয় প্রেক্ষাগৃহে মাটির ময়নার মুক্তি দিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে আমাদের ছবির চাহিদা আছে। আর কেবল ভারতীয় কেন, ইংরেজি ছাড়া অন্যভাষী (যেমন ইরানি) ছবি আরও ১০টি আসতে পারে। আর প্রেক্ষাগৃহগুলোতে শতকরা কতভাগ বিদেশী ছবি চলবে, তারও একটা নীতিমালা থাকতে হবে।

প্রদর্শক সফদর আলী ভুঁইয়া বলেছেন, ‘সরকার যদি নিয়ম করে দেয় শতকরা ৫০ ভাগ স্থানীয় ছবি প্রদর্শন করতে হবে, আমরা তা করবো। ’ মাঝখান দিয়ে সিনেমা হলগুলোর সংস্কার হবে, সবগুলো বিভাগীয় শহরে সিনেপ্লেক্স স্থাপনের যে সময়ের দাবি, তাও পূর্ণ হতে পারে। কারণ বিদেশী ছবিগুলো বর্তমান প্রেক্ষাগৃহ-অবকাঠামোয় প্রদর্শন প্রায় অসম্ভব। প্রেক্ষাগৃহের বড় পর্দায় নানা দেশের, নানান স্বাদের চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ পাওয়া আমার কাছে একটি নাগরিক অধিকার। এই অধিকার কেবল ভারতীয় ছবি আমদানির কারণে চলচ্চিত্র-শিল্পের ধ্বংস বা উন্নয়নের বিতর্কে বন্দি থাকেনা।

তবে আমদানিকৃত এইসব নানাবিধ বিদেশী ছবির দাপটে, বর্তমানে যারা ছবি নির্মাণ করছেন, তারা আসলেই বিপদে পড়বেন। তাদের ছবি মন্দাদশা থেকে বন্ধদশায় পৌঁছাবে। কিন্তু বিদেশী ছবি না আসলেই বা কী? বছরের পর বছর তারা কীইবা আমাদের উপহার দিয়ে চলেছেন? একইরকম সাধারণমানের কাহিনী, অতি দুর্বল চলচ্চিত্র টেকনিক দিয়ে আর কতদিন সংস্কৃতির ধারক-বাহকের তকমা গায়ে ঘুরবেন? বরং এই হুমকির মুখে তারা আরও প্রস্তুতি নিয়ে, অবশিষ্ট মেধা প্রয়োগ করে, সুনির্মিত চলচ্চিত্র নির্মাণে সচেষ্ট হবেন। যেসব স্বাধীন চলচ্চিত্রগুলো মাঝে মাঝে বিদেশ থেকে সাফল্য বয়ে নিয়ে আসছিল, তা বন্ধ হবেনা। বরং মূলধারার চলচ্চিত্রকারদের নিজের দিকে ফিরে তাকাবার একটা বাধ্যবাধকতা চলে আসবে।

অধিকন্তু আমাদের দরকার একঝাঁক নতুন নির্মাতা, যারা নতুন সময়ে নতুন চলচ্চিত্র-ভাবনা নিয়ে সিনেমা বানাতে আসবেন। নব্বই দশক নাগাদ যখন বলিউডের দাপট বাড়ছিল, তখন পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্রব্যবসা মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা একটা পর্যায় পেরিয়ে আজ আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১০টির মতো সাম্প্রতিক ছবি পরপর দেখলাম। এরমধ্যে ঋতুপর্ণ ঘোষ ও অঞ্জন দত্ত ছাড়া বাকি সব ছবির পরিচালকই অচেনা ছিল।

কিন্তু সার্বিকভাবে তাদের চলচ্চিত্রের ভাষা বদলে গেছে, কাহিনী বৈচিত্র্যময় ও আধুনিক, মিজ-অঁ-সেন-এ মেধার প্রয়োগ দেখা গেল। কেবল নিছক বিনোদন নয়, সময়কে ধরার প্রচেষ্টা ছবিগুলোতে স্পষ্ট। আমাদের জন্যও দরকার একটা বড় চ্যালেঞ্জ, যার চাবুকে বিক্ষত হয়ে আবার উঠে দাঁড়ানোর প্রত্যয় জাগতে পারে মনে। বিদেশী ছবি আমদানি সেই অর্থে ইতিবাচকই হবে আমাদের জন্য। তবে বলা দরকার, বিদেশী ছবি মানে কেবল ভারতীয় নয়, আর ভারতীয় মানে কেবল হিন্দি নয়।

আর সরকারের উদ্যোগে কেবল আমদানি নয়, রফতানির বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.