আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শোষিতের শিক্ষাতত্ত্ব: পাওলো ফ্রেইরে - ১

আদর্শটাকে আপাতত তালাবন্ধ করে রেখেছি

অনুবাদকের নোট পাওলো ফ্রেইরের নিজস্ব ভূমিকা বা মূল অধ্যায় দিয়ে শুরু না করে প্রথমেই অনুবাদকের নোট দেওয়ার প্রয়োজন পড়ল কেন, তা খোলাসা করা দরকার। শিক্ষাক্ষেত্রে বেশ কয়েক বছর কাজ করার সুবাদে অনুবাদকের উপলব্ধি হচ্ছে- পাওলো ফ্রেইরের নাম শিক্ষাকার্যক্রমে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের কাছে যতটুকু পরিচিত, ঠিক ততটুকুই অপরিচিত তাঁর কাজকর্ম-লেখালেখি-চিন্তনপ্রক্রিয়া। এর কারণ মূলত দুটো: প্রথমত, পর্তুগীজ ভাষায় লিখেছেন বলে পাওলো ফ্রেইরের বই সহজলভ্য নয়; বেশ কয়েকটি বইয়ের পর্তুগিজ থেকে ইংরেজি অনুবাদ করা হয়েছে কিন্তু বাংলায় সেই অনুবাদ পাওয়া দুরূহ এবং দ্বিতীয়ত, তাঁর লেখার বিষয়বস্তু ও প্রকাশভঙ্গি কিছুটা জটিল, দুরূহ। শিক্ষা নিয়ে আমরা যেভাবে প্রচলিত পন্থায় চিন্তাভাবনা করে অভ্যস্ত, ফ্রেইরে সে পথে না হেঁটে একটু অন্যপথে শিক্ষার নানা দিক, বিশেষ করে শিক্ষাপ্রক্রিয়া কীভাবে মানুষের স্বাধীনতা ও সচেতনায়নের সাথে সম্পর্কিত, সেই বিষয়গুলোই ব্যাখ্যা করেছেন বেশি। ফলে যারা শিক্ষার তাত্ত্বিক দিকগুলো সম্পর্কে খুব একটা অবহিত নন; কিংবা শিক্ষা যে মানবমুক্তি ও সমাজকাঠামোর নানা অংশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত- সেই উপলব্ধি যাদের মধ্যে ভাসাভাসাভাবে বিদ্যমান অথচ কোনো না কোনোভাবে শিক্ষার নানা কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের কাছে প্রথম ধাক্কায় ফ্রেইরের লেখা অপরিচিত বা শিক্ষার সঙ্গে আপাত-সম্পর্কহীন কথাবার্তা বলে মনে হতে পারে।

যারা শিক্ষাবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক দিকগুলো সম্পর্কে পড়ালেখা করে এসেছেন তাঁদের কাছেও যে ফ্রেইরে একেবারে সহজেই প্রতিভাত, তাও কিন্তু নয়! মোট কথা, ফ্রেইরে সমাজ-রাষ্ট্র ও শিক্ষার নানা সম্পর্কের সূত্র ধরে যে সমস্ত কথাবার্তা বলেছেন, সেগুলো প্রচলিত অর্থে শিক্ষার সঙ্গে অনেকক্ষেত্রেই মেলান যায় না; কিন্তু শিক্ষাকে অর্থবহ করতে হলে এ বিষয়গুলো জানা জরুরি। নানা দেশে নানা ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। বর্তমানে সব দেশেই শিক্ষা মূলত মানুষের কিছু 'দক্ষতা' বিকাশের একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে; যদিও পূর্বতন আমলে বিশেষ করে কয়েকশ বছর আগেকার শিক্ষা শুধু ‘দক্ষতাকেন্দ্রিক’ই ছিল না, ‘বোধ’ সৃষ্টির প্রয়াসও সেই শিক্ষায় বিদ্যমান ছিল। ফ্রেইরে বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা মানুষের এমন একটি ক্ষেত্র যার মাধ্যমে মানুষ নিজের সচেতনায়নের মাধ্যমে বৈষম্যহীন নতুন পৃথিবীর জন্ম দিতে সক্ষম। কিন্তু জ্ঞান সবসময়ই বিশেষ একটি শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় জ্ঞানের প্রয়োগ, জ্ঞান অর্জনে মানুষের প্রবেশাধিকার এবং জ্ঞানের রাজ্যকে বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে নিপীড়িত মানুষরা এগুলোর প্রকৃত আস্বাদ থেকে বঞ্চিত।

এই বইতে ফ্রেইরে এসব বিষয় নিয়েই কথা বলেছেন। তিনি মানুষের স্বাধীনতা-ভীতি, সংলাপের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রক্রিয়া সৃষ্টি ও জনগণের সঙ্গে নেতৃবৃন্দের পারস্পরিক যোগাযোগ এবং সচেতনায়ন ও সাংস্কৃতিক চেতনা বিনির্মাণের মাধ্যমে নতুন সমাজ গঠনের ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। যারা এসব বিষয় নিয়ে পড়তে চান, ভাবতে চান-- তাঁদের কাছে এই বইটি অবশ্যপাঠ্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে এই বইয়ের বক্তব্য এবং বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ফ্রেইরের মধ্যেও বেশ কিছু দ্বিধা রয়েছে। তিনি নিজেই মনে করেন, এই বইয়ের বক্তব্য অনেকের মনে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে; বিশেষ করে মার্ক্সবাদী ও খ্রিস্টান শাসকবর্গ তাঁর বইয়ের বক্তব্য গ্রহণের ক্ষেত্রে রক্ষণশীল মনোভাবের পরিচয় দিতে পারেন।

তাছাড়া কিছু কিছু চিন্তাভাবনা তিনি পরবর্তী সময়ে বদলানোর আভাসও দিয়েছিলেন-- যদিও সেটা আর করা হয়ে ওঠে নি। একটি বিষয় পরিষ্কার যে, ফ্রেইরের এই বইটি প্রকাশের সময় খুব কম মানুষই বইটিকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতে পেরেছে। একটা সময় পর আস্তে আস্তে বইটি গ্রহণযোগ্যতা (প্রয়োগের ক্ষেত্রে না হলেও অন্তত চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে) পেতে থাকে এবং বর্তমানে শিক্ষাসেক্টরে একে ক্ল্যাসিক্যাল সংযোজন হিসেবে অনেকে মনে করেন। ফ্রেইরের চিন্তাভাবনার সূত্রকে ব্যবহার করে বর্তমান বাংলাদেশেও অনেকে কাজ করছেন-- ব্যক্তিগত কিংবা সামষ্টিক পর্যায়ে। সব মিলিয়ে যত দিন যাচ্ছে, মানুষের চিন্তনপ্রক্রিয়ায় ফ্রেইরে আস্তে আস্তে জায়গা করে নিচ্ছেন।

যে কারণেই এই বইটি সব চিন্তক, বিশেষ করে যারা শিক্ষা ও সমাজ পরিবর্তন নিয়ে ভাবেন, তাঁদের পড়া দরকার। বলা দরকার, অনুবাদক নিজেও ফ্রেইরের এই বইয়ের সব বক্তব্যের অনুসারী নন, কিন্তু সেটা অন্য আলোচনার বিষয়। ফ্রেইরের লেখার সঙ্গে অনুবাদকের পরিচয় স্নাতক পর্যায়ে পড়ালেখার সময়। তুলনামূলক শিক্ষার একটি কোর্সে ফ্রেইরে শিক্ষার প্রচলিত ‘ব্যাংকিং ব্যবস্থা’কে যে সমালোচনা করেছিলেন, সেটি শিক্ষকের জবানিতে শোনার পর থেকে ফ্রেইরের কাজ সম্পর্কে অনুবাদকের আগ্রহ জন্মে। কিন্তু বইয়ের অপ্রতুলতা এবং বই হাতে পাওয়ার পর ইংরেজি ভাষায় জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার দরুণ বইটি অনেক দিন পড়া হয়ে উঠে নি এবং এক পর্যায়ে হারিয়ে যায়।

বছর তিনেক আগে মূল পর্তুগিজ ভাষা থেকে মিরা বার্গমান রামোস কর্তৃক ইংরেজিতে অনুদিত বইটি জোগাড় করে পড়ার পাশাপাশি অনুবাদে রত হন। অনুবাদক নিশ্চিত নন, পর্তুগিজ ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ এবং সেই ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদে লেখকের মূল বক্তব্যের কতটুকু হেরফের ঘটেছে; কিন্তু অনুবাদক এক্ষেত্রে ইংরেজি অনুবাদের মূলানুগ থাকার চেষ্টা করেছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে লেখকের ব্যাখ্যার পাশাপাশি অনুবাদকের দেয়া টিকা-টিপ্পনি সংযোজন করা হয়েছে সঙ্গতকারণেই। তারপরও কোথাও কোথাও ভুল থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়; কেউ দেখিয়ে দিলে অনতিবিলম্বেই তা সংশোধন করা হবে। লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পাওলো ফ্রেইরে ১৯২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরে ব্রাজিলের রেসিফ শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৭৫ বছর বয়সে ১৯৯৭ সালের ২ মে তারিখে মারা যান।

তিনি মূলত জাঁ-পল সার্ত্র, এরিক ফ্রম, লুইস আলথুসার, হার্বাট মার্কুস, কার্ল মার্কসের চিন্তা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন যার ছাপ পাওয়া যায় তাঁর লেখনীতে। তিনি ব্রাজিলের সাও পাওলো শহরের শিক্ষাসচিব ছিলেন এবং পরবর্তীকালে তিনি পন্টিফিক্যাল ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব সাও পাওলোতে অধ্যাপনায় যুক্ত হন। তিনি ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক জুরি বোর্ডেরও সদস্য ছিলেন এবং ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার ২৯টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া তিনি সেন্টার ফর দি স্টাডি অব ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সোসাল চেঞ্জ-এর ফেলো এবং হার্ভার্ড সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন এডুকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর অতিথি অধ্যাপক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি জেনেভাস্থ অফিস অব দি ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চেস-এর উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন। তিনি চিলির ইউনেস্কোর ইনস্টিটিউট অব রিচার্স অ্যান্ড ট্রেনিং ইন এগ্রোরিয়ান রিফর্ম-এর উপদেষ্টা ছিলেন এবং একই দেশের চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

এছাড়া তিনি ব্রাজিলে বয়স্ক শিক্ষার জাতীয় পরিকল্পনার সাধারণ সমন্বয়কও ছিলেন। তিনি নানা বিষয়ে পনেরটি বই প্রকাশ করেছেন যার মধ্যে এই বইটি আঠারটিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে Pedagogy of the oppressed বইটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।