আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার খেয়ালী প্রেমিকা

বিকট
আমি আর আমার প্রেমিকা। আমরা শহরের কেন্দ্রস্থলের এক নয়নাভিরাম হ্রদের পাশে বসে প্রেমময় মুহূর্তগুলো উপভোগ করছি। আমার প্রেমিকা! অভিমানী, কিন্তু কঠোর। একটুতেই তার চোখে জল এসে যায় আবার অনেক কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে পারে সে, অনায়াসে। আমি তার থেকে অল্প দূরত্বে বসে।

তার হাতে আমার হাত মুঠোবদ্ধ। "কটা বাজে?" অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পরে তার মুখে কথা ফোটে। "কেন, চলে যাবার কি খুব তাড়া?" উত্তরে সে কিছু বলেনা। স্মিত হাসে। ওর হাসির নানাবিধ অর্থ আছে।

আমার বিভ্রান্ত লাগে। তাই আবার জিজ্ঞেস করি, "কি, চলে যেতে চাইছো?" "না, তা কেন? আমি কি আর চলে যেতে পারি! আর যাবোইবা কোথায় বল! যেখানেই যাই, তুমি ঠিকঠিক খুঁজে নেবে জানি তো!" আমি স্বস্তি বোধ করি তার কথায়। ফুরফুরে মনে ধূমপান শুরু করে দিই। আমি ধুমপান করতে থাকি। ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ছেঁয়ে যায় হ্রদ সংলগ্ন এলাকা।

চারিদিক কেমন অস্পষ্ট আর ধূসর হতে থাকে। পাশে বসে থাকা প্রেমিকার মুখও যেন খুঁজে পাইনা আমি। বড্ড বিপন্ন বোধ করি। চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করে, কিন্তু আমি জানি সে হারাবেনা কোথাও। স্বাভাবিক কন্ঠেই সুধোই, "আছো তো?" "আছি" "ধোঁয়ায় অস্বস্তি লাগছে? এই তো শেষ প্রায়....." "না, আমার অস্বস্তি লাগছেনা।

" "তুমি অনেক বদলে গেছ, আগে কত হম্বিতম্বি করতে এ নিয়ে! আর এখন ভ্রুক্ষেপই করছনা" আবারও সে হেসে ওঠে। সেই হাসি। নানারকম অর্থ যার। ধোঁয়ার কূন্ডলী সরে গেলে আবার সে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এর মধ্যে একটু সাজগোজও করে নিয়েছে মনে হয়!! "কি ব্যাপার, হঠাৎ এত গয়নাগাটি? "এই তো একটু!" সে লাজুক হাসে।

"কোথাও যাবে নাকি?" "কি কতক্ষণ থেকে শুধু যাবার কথা জানতে চাচ্ছো! কোথাও যাবোনা বুঝলে? এই, এইখানেই থাকবো" "না সেটাতো জানি, কোথায় আর যাবে, এমনিই জিজ্ঞাসা করছিলাম আর কি" আমি, আর আমার প্রেমিকা আমরা নয়নাভিরাম এক হ্রদের পাশে বসে প্রেমময় মুহূর্তগুলো উপভোগ করতে থাকি। যখন সাঁঝ নেমে আসে, অন্ধকার টুঁটি চেপে ধরে হ্রদসংলগ্ন এলাকার প্রাণোচ্ছল তরুণ তরুণী, মুখরা বাদামওয়ালা ছোকড়া, বা মিষ্টি চেহারার শিশু ফুলবিক্রেতাদের, তখন এখানকার নিরাপত্তাকর্মীরা তৎপর হয়ে ওঠে সবাইকে এ জায়গা থেকে সরিয়ে দিতে। বিভিন্নরকম অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে প্রস্তুতি নেয় আক্রমণের। তাদের বিশেষ লক্ষ্যবস্তু হল প্রেমিকযুগলেরা। তারা রণ হুংকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে জোড়ায় জোড়ায় বসে থাকা নর-নারীদের ওপর।

ওদের ভীমমূর্তি আর ভীতিকর আচরণ দেখে কেউ দৌড়ে পালায়, অনেককেই অবশ্য বিযুক্ত করতে বেশ বেগ পেতে হয় তাদের। শেষ পর্যন্ত না পেরে তারা তাদের বুকে বল্লম ঢুকিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। এখানে পড়ে থাকে মৃত ভালবাসা। এখানে শুয়ে কাৎরায় অসহায়, আহত ভালবাসা। এখান থেকে পালিয়ে ,অবশেষে হারিয়ে যায় ভালবাসা.. নিধনজজ্ঞ শেষ করে সোল্লাসে ফিরে যায় নিরাপত্তাকর্মীরা।

"আচ্ছা, ওরা এরকম করল কেন বলত? এই নিরাপত্তাকর্মীগুলো একদম গোঁয়াড় আর পশু যেন একেকটা" আমি বলি। "ঠিকই তো আছে!" সে আবারও স্মিত হেসে অস্ফুট কিন্তু দৃপ্ত স্বরে বলে। "কি ঠিক আছে? ওদের এধরনের আচরণ সমর্থন করছ, নাকি ঠিক আছে বলতে বোঝাচ্ছ যত যাই হোক, আমরা ঠিকই থাকবো, এটা? দ্বিতীয়টাইতো, তাই না?" সে কোন উত্তর দেয়না। অবশ্য যে প্রশ্নের উত্তর প্রশ্নকারী জানেই, সেটার জবাব দিয়ে আর কি হবে! আমি আমার প্রেমিকার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। সে বড্ড মেয়েলী, আর খেয়ালি।

এরই মধ্যে আবার কি মনে করে গয়নাগুলো খুলে ফেলেছে। এখন তাকে সুখী গৃহিনীর মত দেখাচ্ছে, যে এইমাত্র গৃহস্থালীর দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্পন্ন করে এসে তৃপ্ত মনে পান চিবুচ্ছে। আমি তাকে বললামও সে কথা। "পান কোথায় পেলে এখানে, এই নির্জন প্রান্তরে?" "আমার কাছে তো সবসময়ই থাকে এসব। পানের ডালা,সুপোরী.." "আর কি কি থাকে?" "বাসার সবগুলো ঘরের চাবি, বিলের কাগজপত্র, যাবতীয় ফর্দ, আরো টুকিটাকি যা যা.." "কোন বাসার" "কোন বাসার আবার! আমার নিজের বাসার!" "তুমি খুব কল্পণাপ্রবণ, যা এখনও হয়নি তা নিয়েই কত কিছু ভাবতে শুরু করেছ! রীতিমত প্রস্তুতিও নিচ্ছ এখন থেকেই!" আমি তার ছেলেমানুষী কর্মকান্ড দেখে আমোদ পাই।

"তুমিও খুব কল্পনাপ্রবণ" সে বলে। সে হাসে আবারও। এই অন্ধকারে বসে থাকতে আমার আর ভালো লাগেনা। সামনে হ্রদের পানিতে পূর্ণচাঁদের ছায়া পড়ে চকমক করছে। আমার ইচ্ছে করে ওকে নিয়ে নৌবিহারে বের হতে।

"যাবে নাকি?" "আমি তো চলে গেছি সেই কবেই!" "হেঁয়ালী ছাড়ো তো! চল অন্ধকারে বসে না থেকে নৌকোয় করে ঘুরে বেড়াই। চমৎকার সময় কাটবে" আমি তার হাত ধরতে যাই। কিন্তু অন্ধকারে কিছুতেই তার হাতজোড়া খুঁজে পাইনা আমি। এবার সে বেশ শব্দ করেই হেসে ওঠে। এই হাসিটা আমার কাছে দুর্বোধ্য লাগেনা আর আগের মত।

মনে হয়, আমি কি যেন বুঝে ফেলেছি, কিন্তু কি বুঝেছি ওটা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করেনা আমার। বাজে চিন্তা মাথায় না স্থান না দেয়াই ভালো। আম প্রানপণে খুঁজে ফিরি তার হাত। পাইনা কোনভাবেই। স্পর্শবিজ্ঞানের একসময়কার তুখোড় ছাত্র আমি, এখন সব বেমালুম ভুলে বসে আছি! "তোমার হাত কোথায়! খুঁজে পাচ্ছিনা কেন! একটু বাড়িয়ে দাওনা কষ্ট করে!!" "দেখো, কোথায় কার কাছে কেমনভাবে আছে।

পারলে খুঁজে বের কর প্রেমিক বীর আমার! তোমার জন্যে যথেষ্ঠ কষ্টসাধ্যই হবে মনে হয় ব্যাপারটা" আবার কি সব হেঁয়ালী বকছে! আমি হাল ছেড়ে দিই। এই অন্ধকারে তাকে, বা তার হাতকে খুঁজে পাওয়াটা দূরুহ ব্যাপার। অন্ধকারের প্রবল নিস্তব্ধতায় লীন হয়ে গেছে তার হৃৎস্পন্দন। আমি শোনার চেষ্টা করি, কিন্তু পারিনা। আমি আলোর উৎস খুঁজে ফিরি।

সবাই চলে গেছে, সব বাতি নিভিয়ে দিয়ে। কিন্তু আমি জানি, কিছু না কিছু পাওয়া যাবেই। এই রাত্তিরেও অনেকসময় মাছ ধরার উদ্দেশ্যে ছোট নৌকোগুলো বের হয় আলো জ্বালিয়ে। আমি হ্রদের দিকে তাকিয়ে আকূল খুঁজতে থাকি, এবং পেয়েও যাই। দূর থেকে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে একটি নৌকো।

আমি হাঁক ছাড়ি তাদের উদ্দেশ্যে, "এই যে, এদিকে এদিকে!" তারা আমার কথা শুনতে পেয়ে দ্রুত ছুটে আসতে থাকে। আমি এতক্ষণকার অন্ধকার এবং খেয়ালী প্রেমিকার হেঁয়ালী থেকে সম্ভাব্য মুক্তির আনন্দে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ি। "একটু পর আমরা চমৎকার একটা নৌবিহারে বের হব" নৌকাটি এগিয়ে আসছে। "তাই কি" সে যেন বিদ্রুপ ছুড়ে দেয় আমার দিকে। আমার রোমান্টিকতা সম্পর্কে তার অহেতুক সন্দেহ আমাকে কিছুটা হতাশ করে।

"তা নয় তো কি! এই তো এসে গেছে ওরা, চল উঠি" নৌকাটি হ্রদের কিনারে এসে পৌঁছোয়। আমার প্রেমিকা বেশ উৎফুল্ল হয়ে ওঠে তা দেখে। "উঠে এসো" ওখান থেকে ভারী পুরুষালী কন্ঠে কেউ আহবান জানায়। আমার প্রেমিকা এক ছুটে চলে যায় সেখানে। আমি তার রোমান্টিক চঞ্চলতা দেখে পুলকিত বোধ করি।

ধীরে সুস্থ্যে ওঠার উপক্রম করি, কিন্তু সে কি! নৌকোটা তাকে নিয়ে তীরবেগে ছুটতে শুরু করেছে। ঢেউ এবং বাতাস দুটোই অনুকূলে হওয়াতে দ্রুত আমার কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। "এই, একটু দাঁড়াও, আমি তো রয়েই গেছি!" ওদের কান্ডজ্ঞানহীন আচরণ দেখে বিরক্তি লাগে আমার রীতিমত। কিন্তু ওরা আমার কথা শোনেনা। অথবা শুনতে পায়না, বা চায়না।

আসলে আমারই ভুল হয়েছিলো। মাছ ধরার নৌকোয় উঠতে চাওয়া ঠিক হয়নি। এই নৌকোগুলো ইদানীং খুব নিষ্ঠুর শিকারী মেজাজের হয়ে গেছে। প্রমোদভ্রমণের নৌকো আর মাছশিকারী নৌকোগুলোর পার্থক্য দেরীতে বোঝার জন্যে আমি আমার বোকামিকে তিরস্কার করি মনে মনে। নাকি আমি সবসময় এমনতর বোকাই ছিলাম! আমি চেয়ে থাকি দূরে।

শিকারী নৌকোর কাছাকাছি একটা বড়সড় আলোকসজ্জিত বজরা জাতীয় নৌকো সন্নিবিষ্ট হচ্ছে। আমার প্রেমিকাকে ওরা বড় নৌকাটায় নিয়ে যায়। সেখানে উৎসব শুরু হয়। উচ্চস্বরে বিজাতীয় ভাষার গানের আওয়াজ আর অনেক মানুষের উচ্ছসিত কলরব শোনা যায়। আমার ইচ্ছে করে সাঁতরে চলে যেতে ওখানে।

কিন্তু আমি যে সাঁতার শিখিনি! একসময় এই বিশাল হ্রদের অনুকূল ঢেউ আর বাতাসে অপসৃয়মান হতে থাকে নৌকোগুলো, শব্দগুলো, সঙ্গীত আর উৎসব......
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।