সে চোখ খোলে, কান খাড়া করে, ধীর শ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পায়, ডান পাশের উপরের বার্থ থেকে নাকের শব্দ বাঙ্ময় হয়ে ওঠে, মনে হয় কোন দূর থেকে ভেসে আসছে এ আওয়াজ। এর মধ্যে মেয়েটি একবার কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখ খুলে আবার ফিরে গেছে ঘুমের ভেতর। বাইরে এখনো নগর সচল। ট্রেনের গতি এখন ৮০ কি.মি/ ঘন্টা। হঠাৎ তার মনে হয় মেয়েটি এত নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে কি করে? তবে কি শাদা জুলফি সত্যি সত্যি কেউ।
বাবা,কিংবা আত্মীয়, কে জানে। আবারো মনে হয়, বাবা কি? উদাসীন ধরণের হয়না অনেকে? হতে পারে, আবার নাও পারে। অয়ন শাদা জুলফিকে জিজ্ঞেস করতে যায়, কিন্তু সে শোনে নাসিকা গর্জন। জ্যোস্নার তরঙ্গ সাপের মতো একেবেঁকে যায়, কোথায় একটা বোমা কি পটকা ফাটে। অন্য কোনো কামরা কিংবা বাইরে থেকে একটি গানের কলি সিলেবিক হয়ে ওঠে।
কিন্তু মেয়েটা বিছানায় শোয় না কেন? পরক্ষণে মনে হয় হয়তো এটাই মেয়েটির অভ্যাস।
তার মনে একটি দূরাশা জাগে। তার মনে হয় মেয়েটিও জানে সে তাকে দেখছে, কামনা করছে। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে মেয়েটি ঘুমোচ্ছে না, ভান করে আছে। মেয়েটিও চাইছে, কিন্তু কি চাইছে।
কামরায় আরো দু'জন পুরুষের উপস্থিতিতে সে কি চাইতে পারে? না, এ তার কষ্ট কল্পনা। একবার ভাবে সে কি ওপাশে গিয়ে মেয়েটির পাশে বসবে? কিন্তু মেয়েটি যদি না চায়, যদি চিৎকার করে ওঠে ? না, এই রিস্ক নেয়া যাবে না। তবে যদি এরকম হয় সামনে কোনো ষ্টেশনে নেমে যায় অপর দুই যাত্রী তাহলে ট্রেন মানে এই কেবিন একদম ফাঁকা হয়ে যাবে। তখন, তখন কী হবে? কী হবে তা তার নিজের মতো কল্পনা করে সে উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
তার মনে পড়ে বাসর রাতে তরুণী বধূটিকে দেখতে দেখতে হঠাৎই তার ঘুম পেয়ে গিয়েছিল।
তরুণী বধূটি হাতে মাথা গুঁজে শক্ত হয়ে বসেছিল। চোখ মেলে সে দেখতে পেয়েছিল স্ত্রীর নোয়ানো মাথা, শাদা ঘাড়। নিদ্রা-পরবর্তী অনিশ্চয়তার ভাবটা কেটে গিয়েছিল তার, আর শরীর বেয়ে যেন খেলে গিয়েছিল এক উষ্ণ স্রোত, বাস্তবের এক শিহরিত অনুভব। স্ত্রীকে নাম ধরে জোরে ডাকতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু তা না করে মৃদু হেসে বাঁ হাতে ভর দিয়ে একটুখানি উঁচু হয়েছিল সে। তারপর কোনো কথা না বলে সহসাই জড়িয়ে ধরেছিল নীলাকে।
নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার সংক্ষিপ্ত ও ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল নীলা। কিন্তু জীবন্ত, সজাগ ও সক্রিয় শরীরের উষ্ণতার কাছে সে ক্রমশই পরাজিত হয়ে পড়েছিল। তার শরীরের প্রতিটি অংশ এক বাধ্য যন্ত্রের মতো সাড়া দিতে শুরু করেছিল।
শাদা জুলফি আর এপাশের তরুণ দু'জনেই তার কল্পনাকে সত্যি করে পরবর্তী ষ্টেশনে নেমে গেলে তার বিস্ময় ও উল্লাস চূড়াস্পর্শী হলো। একটা পাশব ও জান্তব আকাঙ্ক্ষা ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সবকিছু তছনছ করে দিতে চাইছে।
তার সামনে লুটানো এই জলজ্যান্ত পুষ্পময় সৌন্দর্যকে বিস্রস্ত করে দেবার প্রবল ইচ্ছা বাস্তব হয়ে উঠতে চাইছে।
ঠিক এ সময় মেয়েটি চোখ খুললো ধীরে ধীরে। কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে জ্যোস্নার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর মুখ ফিরিয়ে তাকেই জিজ্ঞেস করলো,' ট্রেনটি এখন কোথায়?'সে তাড়াতাড়ি স্টেশনের নাম বললো।
-আহ! আমি তাহলে আমার স্টেশন ফেলে এসেছি!
-সে ক্ষেত্রে আপনি সর্বশেষ স্টেশনে যেতে পারেন এবং সেটাই সবদিক থেকে ভালো হবে।
খুব ভোরেই পৌঁছাবে এই ট্রেন। ভোরেই ফিরতি ট্রেন পেয়ে যাবেন আবার।
মেয়েটি মুখ ঢেকে অসহায়ের মতো বসে রইলো। বাতাসে এখন শেষ রাতের ঠান্ডার আমেজ। মাঝে মাঝে ঘুম এসে ঝাপটা দিচ্ছে চোখে, তবু কি এক নেশায় ঘুম তাড়িয়ে সজাগ থাকার চেষ্টা করছে সে।
সহসা সে নাকি তার ভেতর থেকে কে যেন বলে বসলো, 'আমার সাথে একাকী সময় কাটাতে আপনার ভরসা হচ্ছে তো?
মুখ থেকে হাত সরিয়ে মেয়েটি চকিতে থাকালো। তারপার হেসে ফেলে বললো, হচ্ছে।
-কেন?
-মুখ দেখলে বোঝা যায়। এবং আপনাকে দেখেই বোঝা যায়।
- কিবোঝা যায়।
-আপনার উপর নির্ভর করা যায়।
-কিন্তু আপনি জানেন না আমি মোটেই ভাল লোক নই, আর সব সময় মুখ দেখে মানুষ চেনা যায় না।
-মেয়েদের আলাদা একটা চোখ থাকে।
-থাকে কি?
-হ্যাঁ, থাকে। মেয়েরা অনেক কিছুই বুঝতে পারে, তবে স্বভাবগতভাবেই চাপা থাকে, ব্যক্ত হয় না।
অয়ন খানিকটা দমে যায়। তার ভেতরের ইচ্ছেটা, তার কুমতলবটা কী মেয়েটা টের পেয়েছে। ভাবতেই তার হাত-পা হঠাৎ করেই ঠান্ডা হয়ে আসে। তার এতোক্ষণের সমস্ত সাহস ও উত্তেজনা কেমন যেন তিথিয়ে আসে। এবং বলা নেই কওয়া নেই তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার সামনে এসে দাঁরায় নীলা আর তার পাঁচ বছরের মেয়ে কথা।
সে আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে, তার সারা মুখে বিনবিনে ঘাম জমে ওঠে।
ট্রেন ছুটছে। অয়ন কোনো রকমে বলে, 'আপনার নামটা কিন্তু জানা হয়নি। অবশ্য আপনার আপত্তি.....
-নিলীমা।
-শুধুই নিলীমা?
-নিলীমা আজাদ।
আমার বাবার নাম আবুল কালাম আজাদ।
ট্রেনটা কোনো একটা ষ্টেশনে থেমেছে। চারপাশ শব্দহীন, নিস্তব্ধ। কিছু উদ্বাস্তু নারী পুরুষের হঠাৎ চলাফেরা ছাড়া কোনো কোলাহল নেই। বৃষ্টি উধাও, হালকা কুয়াশার ভেটর খানিকটা ওস ঝরছে।
সিগন্যালগুলো
লাল ালো বাঘের চোখের মতো জ্বলছে। তিন নম্বর লািন জুড়ে শুয়ে আছে বিশাল মাল গাড়ি। জানালা ফেলে দিয়ে আবারো তাকাল অয়ন নিলীমার দিকে।
সাময়িক বিহ্বলতা কাটিয়ে সে আবারো পুরনো অয়ন। তার চোখে-মুখে আবারো মুগ্ধতা, এক দৃষ=টিতে তাকিয়ে থাকে সে।
নিলীমার মধ্যেও কেমন পরিবর্তন ও শৈথিল্য দেখতে পায়। ইচ্ছায় কি অনিচ্ছায় তার ওড়না ঝরে পড়ে মেঝেয়। পোশাকের ভেতরে প্রকট হয়ে ওঠা তার স্তন দুটি জ্বালা ধরিয়ে দেয় তার চোখে।
একটা ঘটনা ঘটতে ঘটতেও অনেক সময় ঘটেনা। কত ধরণের মোড় নিয়ে কত রকমের পরিণতি পেতে পারে তা কি সব সময় জানা যায়? অয়নও জানে না।
তবু সে সাহসের সাথে ধীরে ধীরে খানিকটা ঝুননকে মেয়েটির হাতের উপর তার হাত রাখে। স্পর্শের সাথে সাথে তার সমস্ত শরীরে শিহরণ বয়ে গেলেও নিলীমার মধ্যে কোনো চাঞ্চল্য কিংবা প্রত্যাখ্যান কোনোটাই দেখা যায় না, বরং তার ঠোঁটে একটি দুর্বোধ্য হাসি ঝুলে থাকে।
-সত্যি আপনি না থাকলে কি যে হতো।
-আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন। এতো আমার কর্তব্য।
- এই কর্তব্যটা ক'জন বোঝে?
-কেউ কেউ তো বোঝে। আপনার মতো এ রকম সুন্দরী...
হঠাৎ নিলীমা চুপ হয়ে যায়। কোনো কথা বলে না। মনে হয় হঠাৎই খুব চিন্তামগ্ন হয়ে পড়েছে। সে ভালো করে তাকিয়ে দেখে নিলীমার চোখ দুটি ক্রমশ লাল হয়ে উঠছে।
নিলীমালাল চোখে অয়নের দিকে তাকায়। বলে,'আমরা এখন শুধুই দুজন।
-হ্যাঁ, কেন?
নিলীমা জবাব দেয় না। হাত বাড়িয়ে বলে, 'আমাকে জড়িয়ে ধরুন। '
আবারো নিভে যায় অয়ন।
এতোক্ষণ সে যা চাইছিল মনে মনে তাই সরাসরি চাইছে নিলীমা। তার উল্লসিত হওয়ার কথা। অথচ সে নিভে যাচ্ছে। এতক্ষণ যাকে অজেয় মনে হয়েছিল হঠাৎ-ই তাকে খুব সহজলভ্য
মনে হচ্ছে, তাই কি? নাকি তার অবচেতনে কোনো রক্ষণশীলতা কিংবা ভয় লুকিয়ে আছে যা তাকে মাঝে মাঝেই নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এতই নিভৃতি এতই সুরক্ষিত দুজনের মধ্যেই সীমাব্দ্ধ থাকবে সবকিছু তবু কেন ভয়, সে এর ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না।
হঠাৎই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, 'আপনি এসব স্বজ্ঞানে বলছেন?'
আবার সেই দুর্বোধ্য হাসি। বললো, 'আপনার কি মনে হয় আমাকে, মাতাল? শুনুন প্রথম থেকেই ঘুমের ভান করে আপনাকে আমি ষ্টাডি করেছি। আপনার উদ্দেশ্য বুঝতে আমার কষ্ট হয়নি। আপনার মতো পুরুষ মানুষকে বুঝতে আমার খুব একটা বেগ পেতে হয় না। তবে আপনার শুনতে যতই খারাপ লাগুক অধিকাংশ পুরুষের মতোই আপনি কাপুরুষ।
পুরুষেরা তাদের কাপুরুষত্ব ঢাকার জন্যই জোর খাটায়, রেপ করে। "
-এসব আপনি খি বলছেন?
-কেন খারাপ লাগছে?
সহসা নিলীমা উঠে দাঁড়ায়। দু'হাত বাড়িয়ে এগোতে থাকে। জ্যোৎস্নায়, তরঙ্গায়িত আলোয় সবকিছু কেমন জাদুকরী হয়ে ওঠে। অয়ন ঘামতে থাকে।
তার কানের কাছে নীলার কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে, 'এই কী হচ্ছে! সাবধান!'
নিলীমা লাল চোখে তাকায়। বলে, 'আপনি তো পুরুষই। নাকি? পুরুষেরা যুবতী শরীরে প্রলুব্ধ হয় না এ আমি বিশ্বাস করি না। যদি না হয় তবে তার কোনো সমস্যা আছে। হয় হোমো না হয় নপুংসক।
জানেন এই ট্রেনে গভীর রাতে আমার একাধিক অভিজ্ঞতা হয়েছে। পুরুষেরা শেষ পর্যন্ত খাদকই। তারা আমাকে ধর্ষণ করে তৃপ্ত হয়েছে। কিন্তু তারা জানে না আমি জোর করেই ধর্ষিত হয়েছি। এক অর্থে আমিই ধর্ষণ করেছি তাদের।
-এ তো পাগলের কান্ড, রীতিমত পাগলামী!
- ছিলাম। তবে বাবা বড় ডাক্তার দেখিয়েছেন মানে সাইক্রিয়াটিস্ট।
বলেছেন ভালো হয়ে যাব আমি।
গা গুলিয়ে উঠলো অয়নের। পেটের ভেতর কি যেন একটা পাক খাচ্ছে।
এক লাফে ট্রেন থেকে বেরিয়ে যাবার ইচ্ছেটাকে প্রাণপণে সংবরণ করলো সে।
একটা নীল মাছি এসে ঢুকেছে কোন ফাঁকে। তার ডানার ফরফর আওয়াজের সাথে উপরে ঝুলন্ত পাখার আওয়াজ হঠাৎ বিকট হয়ে উঠলো। সে তাকিয়ে দেখলো নিলীমার চোখ লালচে থেকে ভয়ঙকর লাল হয়ে উঠেছে। অথচ এসব কিছুর তোয়াক্কা না করে তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে রাতের ট্রেন, 'তূর্ণা নিশীথা।
' হয়তো কোনো নরকের পানে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।