আমি একজন আইটি চাকুরীজীবি
এ দেশের একেবারের শেষ প্রান্ত তেঁতুলিয়ায় ছোট্ট ছবির মতো গ্রাম কাজীপাড়া। সামনেই ভারতের সীমানা। আমরা শুনতে এসেছি একটি পাখির ডাক, দূর শহর থেকে। চারদিকে মানুষের কানাকানি, ওরা ঢাকা থেকে এসেছে। তারা হয়তো জানেন না তাদের ঘরেই আছে এক ভিআইপি অতিথি।
নাম তার 'শেখ ফরিদ'
পথ বহুদূর, ক্লান্তি যেন চেপে ধরে। ২৫ ঘণ্টার ভ্রমণ আর ৪ ঘণ্টার পাখি দেখা। বিশিষ্ট প্রাণিবিজ্ঞানী রেজা খান বললেন, 'এত কষ্টের পরও হতাশ হয়ে ফিরে এসেছি। খুঁজে পাইনি। ' এ রকম অভিজ্ঞতা আরও কয়েক বন্ধুর।
আমিও একবার চ্যালেঞ্জ নেব বলে ভেবেছি। কিন্তু সঙ্গী-সাথীর অভাবে তা হয়ে উঠি উঠি করেও হয় না। সুসংবাদ দিলেন মুনিরুল খান। তিনি জানালেন, কাজীপাড়ায় গেলেই পাব। ইনাম ভাই দলবল নিয়ে ছুট দিলেন।
আমাকেও বললেন; কিন্তু সে যাত্রায় ফেল মারলাম। ফিরে এসে তারা বললেন পাওয়া গেছে, তবে চোখের সামনে ছিল মাত্র তিন সেকেন্ড। কথাটার প্রমাণ পেলাম সামির ক্যামেরায়। তাও অস্পষ্ট একটি ছবি। আর তাতেই মহাখুশি ইনাম ভাই।
যাক তাও দেশি কারও ছবি হলো।
হঠাৎ করেই মহাকালের মহাযাত্রায় যাচ্ছি। উদ্দেশ্য পঞ্চগড়ের মাধুপাড়ায় সকালের সূর্যগ্রহণ দেখা। সেখান থেকে আমরা কাজীপাড়ায় যাব আসল উদ্দেশ্য হাসিল করতে। সঙ্গে দলছুট ক'জন বন্ধু।
সবাই ফটোগ্রাফার। পথটা এ দেশের একেবারের শেষ প্রান্ত তেঁতুলিয়া, ছোট্ট ছবির মতো একটি গ্রাম কাজীপাড়া। সামনেই ভারতের সীমানা। আমরা শুনতে এসেছি একটি পাখির ডাক, দূর শহর থেকে। কে দেখবে আগে আর কে তুলবে ছবি।
সেই মানুষটি যদি আমি হই, তাহলে যাত্রার সব ক্লান্তি যাবে চলে। চারদিকে মানুষের কানাকানি, ওরা ঢাকা থেকে এসেছে। ওদের এ গাঁয়ে কত কিছুরই তো আয়োজন হয়, জীবনের হোলিখেলায় অচেনা কত কিছুই তো থাকে। তারা হয়তো জানেন না তাদের ঘরেই আছে এক ভিআইপি অতিথি। নাম তার 'শেখ ফরিদ'।
শেষ বিকেলের দিকে রওনা হয়ে পরদিন বেলা ওঠার সময় মাধুপাড়ায় পৌঁছলাম। চারদিকে মানুষের কোলাহল। যে যার মতো ছুটে আসছে কী যেন দেখার জন্য। হঠাৎ করেই হাজারো মানুষের ভিড়ে মাধুপাড়া যেন অন্যরকম এক জনপদ। কী ধানক্ষেত, কী পাটক্ষেত।
এ গাঁয়ের মানুষের মধ্যে এক অজানা আতঙ্ক, কেবল তাদের মধ্যেই যেন ভর করছে ৪ মিনিটের রাত! সূর্যগ্রহণ উৎসব শেষে খুব দ্রুতই রওনা হলাম কাজীপাড়ার দিকে।
কাজীপাড়া ঢোকার আগেই একটি চা-বাগান। মাথায় কাপড় পেঁচিয়ে চটচট কচি পাতা তুলছে ক'জন মেয়ে। সেখান থেকেই চেয়ে দেখি দূর সীমান্তে উড়ে যাচ্ছে একদল হট্টিটি। এতকিছুর মধ্যেও কৃষকের ব্যস্ততার শেষ নেই।
জীবনের সচল চাকা ঘোরে, কৃষাণিরা উঠানে মাথায় বিলি দেয়। একঝাঁক শালিক মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়, কালা ফিঙে কৃষকের পিছু নেয় পোকা খেতে। সারারাত দীর্ঘ যাত্রা শেষে আমাদের পেট বলছে খাবার চাই। কিন্তু সে উপায় নেই। তারপরও উৎসাহের কমতি নেই।
সবাই পণ করল শেখ ফরিদকে দেখতে চাই, ছবি চাই, ভিডিও চাই।
উপজেলা অফিস পার হলেই কাজীপাড়া আর তেলিপাড়া। পাশেই বিডিআর ক্যাম্প। সীমান্তঘেঁষা গাঁয়ে ঢোকার আগে সীমান্তরক্ষীদের জানিয়ে যাওয়াই ভালো। তাই বিডিআর ক্যাম্পে গেলাম।
একটি পাখি দেখতে তেঁতুলিয়া এসেছি, এটি বিশ্বাসযোগ্য কথা নয়। তবু তারা বিশ্বাস করলেন।
গ্রাম পার হয়ে মাঠের প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াতেই আওয়াজ এলো-- ককর-ক্রি-কিক্রিট। সবাই চমকে গেল এখন হয়তো দেখা মিলবে শেখ ফরিদের। সামনের আখক্ষেত থেকে আবার আওয়াজ এলো, ককর-ক্রি-কিক্রিট।
বাহ্! অনেক পাখি আছে এখানে। এতকাল যাদের টিকির নাগাল পাইনি, আজ এখানে আসতে না আসতে তাদের ডুয়েট শুনতে পাচ্ছি। শেখ ফরিদের ডাক তীক্ষষ্ট; কিন্তু কর্কশ নয়, ককর-ক্রি-কিক্রিট। কাজীপাড়ার শিশুরা বলে, পান-বিড়ি-সিগ্রেট। কিন্তু সেদিন তাদের দেখা পেলাম না।
ডাকের রেকর্ড করা হলো। সারাদিন কতবার যে তার ডাক শুনলাম। এক ধরনের হতাশা জাগল সবার মনেই। রাতটা পর হলেই হাতে পাব মাত্র তিন ঘণ্টা। পাখির নাগাল না পেলে ফিরতে হবে খালি হাতে।
কেউ কেউ বললেন পাখির ছবি ছাড়া যাবেন না। আমার হাতে সময় কম, ইচ্ছা থাকলেও তাদের সঙ্গে থাকতে পারব না। তাই প্রার্থনা প্রথম সকালটাই যেন তার দেখা মেলে।
বলে রাখা ভালো, কাশ্মীর থেকে শুরু করে হিমালয়ের পাদদেশ ধরে নেপাল, ভুটান হয়ে ভারতের অরুণাচল প্রদেশ পর্যন্ত এই পাখির বসবাস। সমতলে একমাত্র বাংলাদেশেই এদের সর্বত্র দেখা যেত।
এখন বাংলাদেশের শেষপ্রান্তে হয়েছে এর শেষ ঠাঁই। জুন-জুলাই মাসে আখক্ষেতের জমিনে ডিম পেড়ে কোনোমতে বংশে বাতি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে তারা এ দেশে।
জানি না কেন কাজীপাড়া আর তেলিপাড়ার মানুষ এ পাখির নাম দিয়েছে শেখ ফরিদ। গাঁয়ের লোককে প্রশ্ন করেছি। বলতে পারেনি।
তারা এই পাখিকে চিরকাল শেখ ফরিদ নামেই চেনে। পাখিটির পোশাকি বাংলা নাম কালা তিতির। ইংরেজি নাম Black Francolin (ব্ল্যাক ফ্র্যাঙ্কোলিন) আর বৈজ্ঞানিক নাম Francolinus francolinus.
কফিল উদ্দিন মোল্যা
মোবাইল : ০১৭১৫৬০৬১৯২
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।