আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেফাস হৃদয় -- গল্প: এডগার এ্যলান পো, অনুবাদ : মোজাফফর হোসেন



বেফাস হৃদয় -- গল্প: এডগার এ্যলান পো অনুবাদ : মোজাফফর হোসেন [মার্কিন লেখক এডগার এ্যলান পো কবিতা লেখার পাশাপাশি বেশ কিছু অসাধারণ রহস্য-রোমাঞ্চ গল্প রচনা করে পাঠক হৃদয়ে পাকাপক্ত আসন গেড়ে নিয়েছেন। তাঁকে বলা হয় আধুনিক গোয়েন্দা গল্পের জনক। স্যার আর্থার কোনাল ডয়েলের রহস্য উপন্যাসের নায়ক শার্লক হোমস বলেছেন, ‘আমার গুরু এডগার এ্যলান পো সৃষ্ট চরিত্র মসিয়ে দু্যঁপি। ’শার্লে বোদলেয়ার ছিলেন এডগার এ্যলান পোর একনিষ্ঠ ভক্ত। তাঁর অনুবাদের মাধ্যমে পো ফ্রান্স তথা সমগ্র ইউরোপে ব্যপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

১৮০৯ সনের ১৯শে জানুয়ারী আমেরিকার বোস্টন শহরে জন্মগ্রহণ করেন এডগার এ্যলান পো এবং অল্প বয়সে বাবাকে হারান। বহু পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেন তিনি। মাত্র ৪০ বছর বয়সে ১৮৪৯ সনের ৭ই অক্টোবরে এডগার এ্যলান পোর জীবনাবসান ঘটে। ] সত্যি, অনেক বেশী ঘাবড়ে গিয়েছিলাম; খুব ভংঙ্করভাবে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু কেন, আপনার কি ধারণা আমার মাথা ঠিক নেই।

সেই ঘাবড়ে যাওয়া আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে আরো তীক্ষ্ণ করেছে; ধ্বংশ করে নি, ভোঁতাও করে নি। মোটের ওপর আমার শ্রবণ শক্তি ছিল অসাধারণ। আমি স্বর্গ এবং মর্ত্যের সব কিছুই শুনতে পেতাম। নরকের অনেক শব্দই শুনেছি আমি। কিভাবে? তবে, আমি কি উন্মাদ? মনোযোগ সহকারে শোনেন এবং দেখেন কত গুছিয়ে, কত শান্ত ভাবে আমি আপনাকে সমস্ত ঘটনাবলীর বিবরণ দিই।

আসলে এটা বলা কঠিন কত তাড়াতাড়ি উদ্দেশ্যটা আমার মাথায় বাসা বেঁধেছিল। তবে এটুকু বলতে পারি, মাথায় আসা মাত্রই আমার মগজের মধ্যে সেঁটে গিয়েছিল এবং সেই থেকে দিন-রাত আমাকে তাড়া করে বেড়াতো। বলবার মত কোন বিষয় সেখানে ছিল না। ছিল না বিশেষ কোন আবেগ। আমি বৃদ্ধ লোকটিকে ভালোবাসতাম।

সে কখনোই আমার ওপর কোন অবিচার করে নি, অপমানও করে নি । তার গুপ্ত ধনের ওপর আমার কোন লোভ ছিল না। আমার মনে হয় তার চোখটিই সমস্ত কিছুর জন্য দায়ী ছিল! হ্যাঁ, আমি হলফ্ করে বলতে পারি এ কথা! তার চোখ ছিল শকুনের মতন তীক্ষ্ণ, পর্দাটি ছিল ফেকাসে নিলাভ। যখনই চোখে চোখ পড়ত, আমার গা ঘিন ঘিন করতো, রক্ত যেত জমে; ফলে আস্তে আস্তে, অনেক ভেবে চিন্তে আমি ঠিক করেছিলাম বৃদ্ধ লোকটিকে মেরে এই বিভৎস চোখ দুটির হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করবো। এখন আপনারা আমাকে পাগল বললেও বলতে পারেন।

উন্মাদগ্রস্থ ব্যক্তিরা তাদের কাজ কর্ম সম্পর্কে অবগত থাকে না। কিন্তু আপনারা দেখে থাকবেন আমাকে-দেখে থাকবেন কত গুছিয়ে, কত সতর্কতার সাথে, কতটা দূরদৃষ্টি নিয়ে, কতটা ছলনার সাহায্যে আমি কাজটি করেছিলাম! আমি বৃদ্ধ লোকটির ওপর এতটা দয়া কখন প্রদর্শণ করিনি যতটা আমি তার ওপর করেছি যে সপ্তাহে তাকে আমি মারার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। প্রতিদিন রাতে- ঠিক মধ্যরাতে, আমি ছিটকিনি টেনে তার দরজা খুলতাম, আপনি ভাবতেই পারবেন না কতটা সাবধানে আমি কাজটি করতাম! এবং যখন আমার মাথা ঢুকানোর মত যথেষ্ট ফাঁক হয়ে যেত আমি অন্ধকার কক্ষে লণ্ঠন প্রবেশ করতাম। সব বন্ধ, একেবারে বন্ধ, যাতে করে বাইরে থেকে কোন আলো দেখা না যায়। এবং তারপর চট করে আমি আমার মাথাটা ভেতর ঢুকিয়ে দিতাম।

আপনি শুনে হাঁসবেন কতটা চতুরতার সাথে আমি ভিতরে ঢুকতাম! খুব সাবধানে পা ফেলতাম, খুবই সাবধানে যাতে করে বৃদ্ধ লোকটির ঘুমের ব্যঘাত না ঘটে। আমার এক ঘন্টা সময় লেগে যেত সব কিছু স্বাভাবিক করতে, ব্যস! এখন বলুন, একটা পাগল কি এই মুহূর্তে এতটা বিচক্ষণ হতে পারে? এবং তারপর যখন আমি সম্পূর্ন স্বাভাবিক হয়ে উঠতাম, খুব সতর্কতার সাথে লণ্ঠনটা বন্ধনমুক্ত করে ফেলতাম, খুবই সতর্কতার সাথে, যাতে করে একটা হালকা আলোকচ্ছটা শকুনরুপী চোখের ওপর গিয়ে পড়ে। সাত রাত ধরে আমি একই কাজ করেছিলাম; প্রতি বারই মধ্যরাতে। কিন্তু সবসময় চোখটিকে বন্ধ অবস্থায় দেখতে পেতাম; ফলে আমার পক্ষে তাকে খুন করা সম্ভব হত না, কারণ বৃদ্ধ লোকটি আমাকে বিক্ষুব্ধ করত না, বিক্ষুব্ধ করত তার ঐ জ্বালাতনময়ী চোখ। প্রতিদিন সকালে, সবকিছু স্বাভাবিক হলে, আমি বেশ সাহস সঞ্চার করে বেহায়ার মত তার চেম্বারে যেতাম, আন্তরিকতার সাথে তার নাম ধরে তার সাথে কথা বলতাম, এবং বুঝতে চেষ্টা করতাম গত রাতটি সে কেমন কাটিয়েছে।

এখন আপনারা বুঝতে পারছেন, সে খুবই বয়স্ক একজন মানুষ। আমি যে প্রতি রাতে ঠিক বার টার সময় তার রুমে যাই এ ব্যাপারে তার সন্দেহ করার কোন কারণ ছিল না। অষ্টম রাতে আমি দরজা খোলার ব্যপারে অন্যান্য রাতের থেকে অনেক বেশী সতর্ক ছিলাম। ঘড়ির কাটাও আমার থেকে বেশী জোরে নড়াচড়া করছিল। ঐ রাতের পূর্বে কখনো আমার নিজের শক্তি এবং বিচক্ষণতাকে এতটা তীব্রভাবে অনুভব করিনি।

আমি খুব কমই আমার বিজয়োল্লাসকে চেপে রাখতে পারতাম। আমি যে কুমতলব এঁটে রাতের অন্ধকারে চুপিসারে দরজা খুলে তার কাছে গিয়েছিলাম, তা সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি; এসব ভেবেই আমি মুরগীর ছানার মতন ডেকে উঠেছিলাম, এবং খুব সম্ভবত সে তা শুনতে পেয়েছিল; যার জন্য সে বিছানাতে নড়েচড়ে উঠেছিল , যেন সে চমকে গেছে। এখন আপনি ভেবে থাকবেন, আমি পিছিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু না। তার কক্ষটি ছিল পিচের মতন কালো, নিবির অন্ধকারে ঢাকা (কারণ চোরের ভয়ে জানালা পাল্লাগুলো টানা ছিল)।

আমি জানতাম সে দরজা খোলা দেখতে পাবে না। তাছাড়া আমি দরজার পাল্লাটা ভিড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমার মাথা ভেতরেই ছিল, লন্ঠন জ্বালাতে যাবো এমন সময় লণ্ঠনের গায়ে আঙুল পিচলিয়ে যাবার শব্দে বুড়ো বিছানা থেকে ধড়ফড়িয়ে লাফিয়ে উঠে বলে উঠল, “কে ওখানে?” এতকিছুর পরেও আমি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম। এক ঘন্টার মত আমি এক চুলও নড়িনি এবং বৃদ্ধের ঘুমানোর শব্দ শুনতে পাইনি। সে তখনো বিছানায় কান পেতে বসে দেয়ালে গুবরে-পোকার কাঠ কাটার শব্দ শুনছিল; যেমনটি আমি করেছি রাতের পর রাত।

কিছুক্ষণ পরে আমি হলকা গোঙানোর শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারলাম এটা তার মরণ ভয়ের আতঙ্ক। এটা কোন অসুখের গোঙানি নয়, নয় কোন কষ্টের; এটা ছিল অধিক ভয় পাওয়ার ফলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার শব্দ। এ শব্দটি আমার বেশ ভালো করেই চেনা। বহুরাতে, ঠিক মধ্যরাতে, যখন পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ে তখন এটা আমার বুক চিরে বেরিয়ে আসে।

বুঝতে পারছিলাম, মুরব্বি কেমন অনুভব করছিল। আমার তার জন্য করুণা হচ্ছিল যদিও ভেতরে ভেতরে বেশ তৃপ্তি অনুভব করছিলাম। আমি জানতাম সে প্রথম থেকেই ঘুমানোর ভান করে জেগে ছিল। তার ভয়গুলো ক্রমেই তার ওপর চড়াও হচ্ছিল। সে যারপরনায় চেষ্টা করছিল সবকিছু স্বভাবিক করতে, কিন্তু কিছুতেই পারছিল না।

সে নিজেকেই নিজে বলল,“চিমনি দিয়ে বাতাস ঢুকছে এছাড়া আর এটা তেমন কিছু না! এটা একটা ইঁদুরের মেঝের এপাশ থেকে ওপাশ যাওয়ার শব্দ,” কিম্বা, “এটা শুধুমাত্র একটা ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ। ” এগুলো বলে সে নিজেকে বুঝ দেয়ার চেষ্টা করছিল মাত্র কিন্তু কোনটাই কাজে আসল না। কেননা ততক্ষণে, মৃত্যু অন্ধকারকে আকড়ে তার সন্নিকটে এসে তাকে আষ্টেপিষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিল। কিছু একটার উপস্থিতি তার ভেতরকে বিষিয়ে দিচ্ছিল যদিও সে ঘরের ভেতর আমার অবস্থানকে টের পাওয়ার মতন তেমন কিছু দেখেওনি-শোনেওনি। তারপর আমি অনেক্ষণ ধৈর্য্য সহকারে অপেক্ষা করি।

সে তখনো ঘুমায়নি। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, লণ্ঠনের আলোটা হালকাভাবে বের করার, খুবই হালকাভাবে। আমি তাই করলাম যতক্ষণ না মাকড়োসার সুতার মত হালকা আলোকরশ্মী তার শকুনের মতন চোখের ওপর গিয়ে পড়ল। আপনি ভাবতেই পারবেন না কতটা চুপিসারে আমি কাজটি সেরেছিলাম। তার চোখ খোলা ছিল প্রসস্থভাবে।

তার চোখের দিকে তাকাতেই ক্রোধোম্মত্ত হয়ে পড়লাম। আমি পরিস্কারভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম, বিরক্তিকর নীলাভ চোখের ওপর খুব জঘন্য একটি পর্দা যা দেখে আমার হাড়ের মজ্জাগুলো ঠাণ্ডায় কাঁপতে শুরু করেছিল। আমি কিন্তু বৃদ্ধ লোকটির চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। তার ঐ জঘন্য জায়গাটি যেন আমার সমস্ত চেতনাকে গুম করে রেখেছিল। এখনো কি আমি আপনাদের বলিনি যে পাগলামীর জন্য যে ভুলগুলো হয় তা হল ইন্দ্রিয়গুলোর খুব বেশি তীব্র হওয়া? এখন আমি একটি চাপা-বিরক্তিকর শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম, এ ধরনের শব্দ সাধারণত ঘড়ি প্যাকেটে অথবা কাপড় দিয়ে মোড়ানো থাকলে শোনা যায়।

এ শব্দটিকেও আমার বেশ ভালো করেই চেনা। এটা ছিল বৃদ্ধ লোকটির হার্ট বিটের শব্দ। এটা আামার ক্রোধকে বাড়িয়ে দিচ্ছিল বহুগুণে, ড্রামের শব্দ যেমন করে সৈনিকদের সাহসকে বাড়িয়ে দেয়। এত কিছুর পরেও আমি সংযত ছিলাম এবং যতটা সম্ভব চুপচাপ থাকার চেষ্টা করছিলাম। আমার শ্বাস-প্রশ্বাস যেন থেমে আসছিল।

আমি লণ্ঠনটি খুব শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম এবং চেষ্টা করছিলাম আলোকরশ্মীটাকে যতটা সম্ভব তার চোখের ওপরে রাখার। ইতিমধ্যে হার্টবিটের নরকতুল্য শব্দটা অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। এটার শব্দ এবং গতি বেড়েই চলেছিল। বৃদ্ধ লোকটির ভয় হয়ত চূড়ান্ত পর্যায়ে উঠে পড়েছিল! আমি পূর্বেই আপনাকে বলেছি যে আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, আসলেই আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। এই নিশুতি রাতে, পৌড় বাড়ীর ভয়ংকর নিরবতাকে ভেদ করে আসা এই শব্দটি আমার ক্রোধকে করে তুলেছিল নিয়ন্ত্রণহীন।

কিছুক্ষণ পূর্বেও আমি যথেষ্ট সংযত ছিলাম। কিন্তু এখন হার্ট বিটটা যে গতিতে বেড়ে চলেছে তাতে আমার মনে হচ্ছে, খুব শ্রীঘ্রই তার বিস্ফোরণ ঘটবে। এখন আরো একটা উদ্বেগ কাজ করছে : আশে পাশের কেউ শব্দটি শুনে না ফেলে! আমি তীব্র চিৎকার দিয়ে লণ্ঠনটা উম্মুক্ত করে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলাম। সে একবার চেচিয়ে উঠল, শুধুমাত্র একবার। নিমিষে আমি তাকে মেঝেতে টেনে হিঁচড়ে নামালাম এবং ভারী বিছানার তোশকটা তার শরীরের ওপর ফেলে দিলাম।

আমার কাজের নিস্পত্তি ঘটার আনন্দ আমার চোখে মুখে ফুটে উঠল। তারপর অনেক সময় ধরে আমি আমার হার্ট বিটের চাপা শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। এটা আমাকে বিন্দু মাত্র ভাবিয়ে তোলেনি। জানতাম, দেয়ালের বাইরের কেউ এটা শুনতে পাবে না। অবশেষে এটা কমে আসলো।

বৃদ্ধ মরে পড়ে ছিল। আমি তোশকটা তার ওপর থেকে সরালাম এবং মৃত দেহটি পরীক্ষা করলাম। সে পাথরের মতন জমে গিয়েছিল। আমি আমার হাতটা তার বুকের ওপর রেখে তার হার্টবিটকে অনুধাবণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলাম। সে ততক্ষণে মরে ভূত হয়ে গিয়েছিল।

তার চোখটি আর আমাকে জ্বালাতে পারবে না। এখনও যদি আপনি আমাকে পাগল মনে করেন তবে আমার মৃত দেহ সরানোর বুদ্ধি ও কৌশলের বর্ণনা শুনে নিজের ভুল বুঝতে পারবেন। রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছিল বিধায় আমি নীরবে কিন্তু বেশ দ্রুততার সাথে কাজ সারছিলাম। প্রথমে আমি মৃত দেহের প্রতিটা অঙ্গকে পৃথক করলাম। মাথা কাটলাম, হাত কাটলাম, পা দুটো কাটলাম।

তারপর মেঝের পাটাতন থেকে তিনটা তক্তা ছাড়ালাম এবং দেহের প্রতিটা অঙ্গকে তক্তাগুলোর ওপরে সাজালাম। অত:পর তক্তাগুলোকে তাদের পূর্বের স্থানে এমন নিখুঁতভাবে সেঁটে দিলাম যে কারও সন্দেহ করার বিন্দু মাত্র অবকাশ রইল না। মেঝেতে ধুয়ে ফেলার মত রক্ত, নোংরা কিংবা এ জাতীয় কিছুই লেগে ছিল না। আমি এ ব্যপারে যথেষ্ট সচেতন ছিলাম। একটা পাত্রই এসবের জন্য যথেষ্ট ছিল, হাঃ হাঃ হাঃ ! ভোর চারটার দিকে আমার সকল পরিশ্রমের সমাপ্তি ঘটল।

তখনও মধ্যরাতের মত গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা ছিল চারপাশ। ঘন্টা বাজার সাথে সাথে সম্মুখ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল। আমি বেশ হালকা মেজাজে দরজা খোলার জন্য এগিয়ে গেলাম- এখন আমার ভয় পাবার কি আছে? তিনজন লোক প্রবেশ করল যারা বেশ ভদ্রভাবে নিজেদেরকে পুলিশের অফিসার হিসাবে পরিচিতি দিল। রাতের বেলায় প্রতিবেশীদের কয়েকজন নাকি একটা চিৎকারের শব্দ শুনতে পেয়ে তাদের খবর পাঠিয়েছে এবং সেই চিৎকারের তদন্ত করার জন্যই তাদের এখানে আসা। আমি হাসলাম, কেননা আমি এখন নির্ভার, আমার ভয় পাবার কি আছে? আমি ভদ্রলোকদের ওয়েলকাম জানালাম।

আমিই রাতে স্বপ্নের মধ্যে চিৎকারটি করেছিলাম, তাদেরকে বললাম। আরো বললাম যে বৃদ্ধ লোকটি দেশের বাইরে গেছে। আমি তাদেরকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে সার্চ করার আমন্ত্রণ জানিয়ে বললাম, ভালো করে খুঁজে দেখুন। আমি শেষ পর্যন্ত তাদেরকে ঐ কক্ষেও নিয়ে গেলাম। তার জিনিস-পত্র দেখালাম।

আমার অধিক আত্মবিশ্বাস দেখাতে তাদের অবসাদ ঘুচানোর ছলে কক্ষের ভেতর চেয়ার এনে দিলাম; এবং আমি নিজের চেয়ারটা বেশ সাহস নিয়ে যেখানে মৃতের দেহ শুইয়ে রাখা হয়েছে তার ওপর পেতে বসলাম। অফিসাররা আমার ব্যবহারে বেশ মুগ্ধ হল। আমি বেশ উৎসাহ সহকারে তাদের প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলাম এবং মাঝে মধ্যে তারা চলতি সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলছিল। কিন্তু অনতি-বিলম্বে, সবকিছু আমার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠল এবং তাদের চলে যাবার জন্য আমি মনে মনে প্রার্থনা করলাম। আমার মাথা ব্যথা করছিল এবং অদ্ভুত একটা শব্দ এসে আমার কানে বাড়ি মারছিল।

তাদের ওঠার কোন লক্ষণ দেখছিলাম না। এদিকে সেই অদ্ভুত শব্দটা বেড়েই চলেছিল এবং এটা ক্রমেই আরো অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। আমি এটা থেকে মুক্তি পাবার জন্য আরো সহজভাবে কথা বলছিলাম কিন্তু এটা বেড়েই চলেছিল এবং ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। একসময় অনুভব করলাম শব্দটির উৎস আমার কান না। কোন সন্দেহ নেই আমি আরো বেশি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, এবং উঁচু গলায় ঝড়ের বেগে কথা বলছিলাম।

শব্দটির গতি আরো বেড়ে গিয়েছিল, মনে হচ্ছিল কানের ভেতর কে যেনো ঢোল পেটাচ্ছে। আমি কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি হাঁপাতে শুরু করেছিলাম। এতকিছুর পরেও অফিসারেরা কিছুই টের পাচ্ছিল না। আমি আরো দ্রুত, আরো আগ্রহ নিয়ে কথা বলছিলাম; কিন্তু শব্দটা বেড়েই চলেছিল।

আমি উঠে দাঁড়ালাম, এবং খুবই তুচ্ছ বিষয়ে বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি করে তর্কাতর্কি শুরু করে দিলাম, শব্দটা কিন্তু বেড়েই চলেছিল। তারা যে কেন চলে যাচ্ছে না! আমি লম্বা লম্বা পা ফেলে মেঝের এদিক ওদিক পায়চারি করছিলাম; বোঝাতে চাচ্ছিলাম তাদের পর্যবেক্ষণ যথেষ্ট হয়েছে। শব্দটা বেড়েই চলেছে। হায় খোদা ! আমি এখন কি করবো? আমি এতটাই খেঁপে গিয়েছিলাম যে মুখ দিয়ে ফেনা উঠছিল এবং বার বার দিব্যি কাটছিলাম। আমি যে চেয়ারটিতে বসে ছিলাম সেটা মেঝের সাথে টানা হিচড়া করে একধরনের বিরক্তিকর শব্দ করছিলাম কিন্ত সেই শব্দটা এই শব্দটাকে ছাড়িয়ে আমার কানে এসে গুতা মারছিল।

শব্দটা বেড়েই চলেছিল। এতকিছুর পরেও তারা বেশ আয়েশ করে গল্প করছিল। তারা কি তবে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না ? এটা কি করে সম্ভব ? হায় খোদা! তারা বোধহয় শুনতে পাচ্ছে, বুঝতে পেরেছে সবই, তারা আমার ভয়টাকে নিয়ে উপহাস করছে! এসব সাত পাঁচ ভাবনা আমার মাথায় ভর করছিল। আমি যেকোন ভাবে এই নিদারুণ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি কামনা করছিলাম। তাদের উপহাস এবং ভণ্ডামি মার্কা হাসি আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না।

ইচ্ছে করছিল মরে যেতে অথবা চিৎকার দিয়ে সব বলে দিতে। ওহ্ আর পারছিলাম না, শব্দটা আমার কান ভেদ করে যেনো মাথার ভেতর ঢুকে পড়েছিল! “শয়তানেরা,” আমি চেচিয়ে বললাম, “আমার সাথে আর ছলচাতুরী করিস না! আমি! হ্যাঁ আমিই খুন করেছি! এইখানের তক্তা গুলো তুলে দেখ, ঠিক এইখানে! এটা তার ভয়ংকর হৃদপিন্ডের ধুক ধুক শব্দ!”

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।