সুকান্তর সঙ্গে সোনা
ভয়ে ছিটকে যাচ্ছিল সবাই। চাপা গুঞ্জন শুনে এগিয়ে যান সুকান্ত।
চৌমাথার পাশে অবাক দৃষ্টি নিয়ে বসে অদ্ভুতদর্শন এক ব্যক্তি। জরাগ্রস্ত বামনের মতো অনেকটা। শরীরের তুলনায় বেশ বড় মাথাটি।
কেউ কেউ বলছিলেন, ঠিক যেন ‘পা’ সিনেমার অরো।
বনগাঁর কোরারবাগানের সুকান্ত তাঁকে দেখতে পাননি। পারার কথাও নয়। কারণ, বছর ছয়েক আগে ডাকাতের কবলে পড়ে হারিয়েছেন দু’চোখ। কোলে তুলে মানুষটিকে ঘরে এনেছিলেন।
সেই থেকে তাঁর ঘরেই খেয়ে-পরে রয়েছেন জড়বুদ্ধি মানুষটি।
নানা জ়ায়গায় খোঁজ-খবরও চলেছে। কিন্তু অবলা মানুষটিকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারেননি এখনও। কেটে গিয়েছে মাস দেড়ক। অনেকে দেখতেও আসছেন।
অবাক হচ্ছেন।
আশ্রয়দাতা সুকান্ত দেখতে পান না। কিন্তু তাতে কী! যত্নআত্তির ত্রুটি নেই। সুকান্ত নিজেই সাবান মাখিয়ে তাঁকে স্নান করিয়েদেন। পাশে বসিয়ে খাওয়ান অচেনা অতিথিকে।
অবলা মানুষটাও যেন সব বোঝেন। সুকান্ত ছাড়া অন্য কারও কাছে ঘেঁষতে চান না। ঘরের কোণে পড়েছিল একটা লাঠি। তা দেখে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকেন। হাতে সেলাই, কপালে কাটা দাগ।
সুকান্ত বলেন, “লাঠি দিয়ে কেউ মেরেছিল বোধ হয়। তাই ভয়। ”
৮ই ফেব্রুয়ারি ঘরে এসেছেন সাড়ে তিন ফুটের মানুষটি। কেউ বলেন, ২০-২৫বছর তো হবেই। কেউ বলেন, মনে হচ্ছে, প্রোজেরিয়ায় আক্রান্ত।
তবে অন্য কোনও অসুবিধা নেই মানুষটার। শিশুর গোঙানির মতো তাঁর ভাষা বোঝা দুষ্কর। শব্দ বোঝা যদিও যায়, পরপর সাজ়ালে দুর্বোধ্য বাক্য হয়ে যায়। এতদিনে শুধু কিছু কথা উদ্ধার করতে পেরেছেন সুকান্তরা। যেমন -‘ভাইয়া'।
‘সাবানে হাত ধুয়ে'।
যিশুর ভক্তের মতো ক্রস চিহ্ন বুকে আঁকেন তিনি। খুব আনন্দ হলে দু’টি গানও গান। কথা বোঝা যায় না। সুরটা যেন, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ এবং ‘বলো বলো সবে’-র মতো।
একদিন, ‘এ ফর অ্যাপেল’ বলতেই তিনি বাড়ির একটি কুকুরকে দেখিয়ে বলেন, ‘ডি ফর ডগ'। তারপরে খাতা-কলম হাতে দিয়ে নিজের নাম লিখতে বলেন সুকান্ত। অনেক্ষণ সময় নিয়ে ইংরেজ়ি হরফে মানুষটি লেখেন -‘সোনা’ ।
তারপর থেকে এই পরিবারে তাঁর নাম সোনা। এমন সব সূত্র আর এলোমেলো কথার খেই ধরেই কখনও বাগদা, কখনও ভবানীপুরে ছোটাছুটি করেছেন সুকান্তেরা।
বিহারেও খোঁজ চালিয়েছেন। ব্যারাকপুরের এক পরিবারতো খবর পেয়ে এসে দেখেও গিয়েছেন। জানিয়েছেন, তাঁদেরও মানসিক ভারসাম্যহীন এক ছেলে হারিয়ে গিয়েছে। তবে ইনি নন। তারপর থেকে সোনার পরিবারের আর খোঁজ মেলেনি।
অভাবের সংসার সুকান্তবাবুরও। এক সময়ে মাছের ব্যবসা করতেন। ডায়মন্ড হারবার থেকে ফেরার পথে ডাকাতের কবলে পড়েন তিনি। গাড়ির কাঁচ ঢুকে চোখ দু’টি হারান। কপালের নীচে এখনও গভীর হিজিবিজি সেলাইয়ের দাগ।
এরপর গাছের চারা, বনসাই তৈরি করে বিক্রি শুরু করেন। স্ত্রী পম্পাদেবী গৃহশিক্ষিক। দুই ছেলেকে নিয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তাঁদেরও।
তবে বাড়িতে দু’বেলা পাত পড়ে অনেকগুলি। কুকুর, বিড়াল আর হরেক রকমের পাখির আলাদা আলাদা থালা, বাটি।
শব্দ আর হাতের স্পর্শেই সুকান্ত বলতে পারেন, কালুয়াটা আসেনি যে...।
সোনার পরিবারের খোঁজ মিললে? সুকান্ত বলেন, “নিজের বাড়ি বলে কথা। যেতে তো দিতেই হবে। ”
আর যদি খোঁজ না-মেলে। মিললেও যদি না নিয়ে যেতে চায়? সুকান্ত বলেন, “থাকবে।
চলে যাবে কষ্ট করে। কী বলিস সোনা?”
কী বোঝেন কে জানে! দৃষ্টিহীন সুকান্তের আরও কাছে ঘেঁষে বসেন মানুষটি। ।
-অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য- কলকাতা: আনন্দবাজার; ২৯/৩/১০।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।