বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
বৈদিক যুগের প্রাচীন ভারতের অবন্তী রাজ্যের রাজধানী ছিল উজ্জয়িনী নগর । নগরটি
স্বচ্ছতোয়া বেত্রাবতী নদীর তীরে গড়িয়া উঠিয়াছিল । তৎকালীন যুগে বেত্রাবতী নদীর দক্ষিণ তীরে সুবিশাল এক আম্রকুঞ্জ ছিল; তাহার অভ্যন্তরে উজ্জয়িনী নগরের ধনিক শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্রর শ্বেতপাথরের প্রকান্ড অট্টালিকা।
অসংখ্য সুসজ্জ্বিত কক্ষ, অলংকৃত অলিন্দ, সিঁড়ি ও স্তম্ভ সম্বলিত অট্টালিকাটি অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। অহোরাত্র অট্টালিকাময় অসংখ্য দাসদাসী ব্যস্তসমস্ত হইয়া ছুটিতেছে; বর্হিদ্বারের সম্মুখে গম্ভীরদর্শন প্রহরী বলরাম কৃপাণ লইয়া সর্বক্ষণ আরক্ত চক্ষে দাঁড়াইয়া আছে, প্রস্তরময় অভ্যন্তরীণ প্রাঙ্গনে বলিষ্ট শ্বেতবর্ণের অশ্ব সংযুক্ত ঝলমলে রথ, তাহার সম্মুখে সুবেশী সারথী- সারথীর নাম স্মারক এবং (এক্ষণে বলিয়া রাখিতেছি যে অন্তরালে থাকিয়া সারথী স্মারক এই উপাখ্যানে নির্ধারক এক ভূমিকা পালন করিবে। )
শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্রর মধ্যবয়েসী স্ত্রীটি অত্যন্ত পৃথলা। তাহার নাম চন্দনবালা; অতি ধর্মশীলা
চন্দনবালা প্রত্যহ ধ্যান-দান করেন, পূজা-অর্চনা করেন; নিয়মিত তীর্থ দর্শনে যাইতে না পারিলেও ধবল পূর্ণিমার তিথিতে পূণ্যবতী বেত্রাবতীর স্বচ্ছতোয়া জলে অবগাহন করিয়া সংসারক্লিষ্ট শোকতাপ হরণ করেন, ধর্মীয় কৃত্যাদি পালন করেন।
শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্র ও চন্দনবালার একটি পুত্র ও একটি কন্যা।
শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্র বৃদ্ধ হইয়াছেন, তাহার জ্যেষ্ঠ পুত্র জয়ন্ত সম্প্রতি শ্রেষ্ঠীর আসনে আসীন হইয়াছে। অত্যন্ত করিৎকর্ম যুবক সে-অর্থশাস্ত্রের কূটকৌশল প্রয়োগ করিয়া পৈত্রিক ধন ও ধান্য যৎপরনাস্তি বৃদ্ধি করিয়া চলিয়াছে।
শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্র ও চন্দনবালার কন্যার নাম পূর্ণা ।
এবং এই উপাখ্যানটি তাহাকে লইয়াই।
দীর্ঘাঙ্গি, তপ্তকাঞ্চনবর্ণা পূর্ণা অত্যন্ত রুপবতী।
তাহার দেহতনুটি নম্র এবং অনন্ত যৌবন লাবণ্যে সমস্তক্ষণ উচ্ছ্বলিত হইয়া থাকে । পূর্ণা যুগপৎ গুণবতীও বটে- আর এই কারণেই পূর্ণা আজও অনূঢ়া রহিয়া গেল কিনা এই লইয়া অবন্তী রাজ্যে কানাঘুঁষা চলিতেছে। অবন্তী রাজ্যে পূর্ণার যোগ্য পাত্র কোথায়? যাহা হউক। পূর্ণা কী এক অজ্ঞাত কারণে বিবাহের সকল প্রস্তাব ফিরাইয়া দেয়। এই কারণে শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্র ও চন্দনবালার দুশ্চিন্তার অন্ত নাই।
বিবাহযোগ্যা কন্যার দায় লইয়া তাহাদের উদ্বেগময় দিন ও নির্ঘূম রাত্রি অতিবাহিত হইতেছে।
দিন কতক হইল এক অরুণ কান্তি তরুণ যোগী আসিয়া বেত্রাবতীর তীরের আম্রকুঞ্জে আশ্রয় নিয়াছে। তরুণটির পোশাক-পরিচ্ছদ সাধারণ পথিকের ন্যায় হইলেও তাহার আচারআচরণ সন্ন্যাসীর মতোই বটে। সুদর্শন তরুণটি নির্জন আম্রকুঞ্জে পদ্মাসনে বসিয়া যোগসাধনা করে।
শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্রর স্ত্রী চন্দনবালা সে সংবাদ শুনিয়াছেন।
তিনি চঞ্চল হইয়া উঠিয়া দাসী মল্লি¬কার মাধ্যমে প্রত্যহ রুপার থালায় তরুণের নিকটে দুধ, ফলমূলাদি ও মিষ্টান্ন পাঠাইয়া দেন। তরুণটি কৃতজ্ঞ হইয়া কিছু খায়, কিছু-বাঅভূক্ত পড়িয়া থাকে।
একদিন প্রভাতে সবার অলক্ষে চন্দনবালা স্বয়ং তরুণ সমীপে উপস্থিত হইয়া শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়া আসিয়াছে। সে তাহার কন্যাসম্পর্কিত যাবতীয় দুশ্চিন্তার কথা জানাইয়া আসিয়াছে। চন্দনবালাকে ‘মা’ বলিয়া সম্বধন করিয়া তরুণ পূর্ণা-সমস্যার আশু নিষ্পত্তি হইয়া যাইবে বলিয়া অভয় দিয়াছে।
পূর্ণাও আম্রকুঞ্জের নবাগত তরুণের যোগসাধনার কথা শুনিয়াছে। সে কৌতূহলী হইয়া উঠিয়াছে। নব্যসন্ন্যাসীর নিষ্কাম ধ্যানের কারণে পূর্ণার মনে কৌতূহলে উদ্রেক ঘটিয়াছিল। পূর্ণা ঠিক করিল সে তরুণ সন্ন্যাসীর নিকটে যাইবে এবং জিজ্ঞাসা করিবে নিষ্কাম হইয়া থাকা সম্ভব কি না। কেননা কামের বশেই যে নারী কূলটা হয়, দ্বিচারিণী হয়; সমাজের ধিক্কার লাভ করে।
পূর্ণাও অবন্তী রাজ্যে শ্রেষ্ঠী পিতার সম্মান ধূলায় লুটাইতে বসিয়াছে-নবাগত তরুণ নিষ্কাম সন্ন্যাসব্রত লইয়া থাকে কি করিয়া। এই সমস্ত ভাবিয়া সে বিষম অস্থির হইয়া উঠিয়া।
রাত্রি নির্জন হইলে পূর্ণা সকলের চক্ষু ফাঁকি দিয়া ঘুমন্ত অট্টালিকা হইতে নামিয়া আসিয়া আম্রকুঞ্জের দিকে যাইতে লাগিল। তাহার বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করিবার আবশ্যক ছিল না, কেননা রাত্রীকালীন অভিসার তাহার পক্ষে নূতন কিছু নয় । রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে সারথী স্মারক সোমরসে সিদ্ধি মিশাইয়া দ্বারপাল বলরাম কে তাহা পান করাইয়া তাহাকে অচেতন করিয়া দেয়।
তাহার পর পূর্ণার সহিত আম্রবনের অভ্যন্তরে একটি পরিত্যক্ত ভাঙা দেউলে মিলিত হইয়া প্রণয়ে লিপ্ত হয়। বৎসর খানেক হইল এইরূপ দুই অসম পক্ষের গোপন প্রণয় চলিতেছে। ঘটনাটি শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্র কিংবা তাহার জ্যেষ্ঠ পুত্র জয়ন্তর কানে না পৌঁছাইলেও তাহা লইয়া প্রাসাদের নারীসমাজে নিষিদ্ধ প্রণয় লইয়া কানাঘুঁষা চলে। চন্দনবালা নিভৃতে কান্নাকাটি করিয়া অস্থির, অথচ, স্বামী কিংবা পুত্রকে সব কথা খুলিয়া বলিয়া সারথী স্মারক কে যে তাড়াইয়া দিবে- সে সাহস চন্দনবালার নাই।
পূর্ণা শুষ্ক আম্রপত্র পায়ে দলিয়া মুচকি হাসিয়া নূতন এক অভিসারে যাইতেছিল।
আষাঢ় মাস। তথাপি আকাশে মেঘ জমিয়া ছিল না, বরং আকাশ পূর্ণিমার আলোয় অতিশয় উজ্জ্বল হইয়া ছিল। বেত্রাবতীর জলে সিক্ত হইয়া আম্রকুঞ্জে মৃদুমন্দ বাতাস বহিতেছিল, পাতার সরসর শব্দ হইতেছিল, পাতার আড়াল হইতে কী এক পাখির পাখসাটের শব্দ পাওয়া যাইতেছিল।
পূর্ণা লঘু পায়ে হাঁটিয়া আসিয়া ধ্যানমগ্ন তরুণের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল । বনপুষ্পের সুগন্ধ তীব্র হইয়া উঠিল।
তরুণ চোখ মেলিল, তরুণীকে দেখিল; পূর্ণিমার আলোয় পূর্ণার দীর্ঘাঙ্গী তনুটি তাহার মনে পরম বিস্ময়ের সৃষ্টি করিল।
পূর্ণা বলিল, আমি পূর্ণশ্রী। বলিয়া খানিকক্ষণ নীরব থাকে। তাহার পর নীরবতা ভাঙিয়া আপনমনে বলে, কেহ কেহ আমাকে পূর্বা বলিয়াও ডাকে। তবে আমি মনে মনে আমার একখানি নাম দিয়াছি।
অঞ্জনা।
তরুণ খানিকক্ষণ নীরব থাকে। অঞ্জনা তাহার এক নিকট আত্বীয়ার নাম, যাহাকে ফেলিয়া সে গৃহিত্যাগ করিয়াছে। তরুণ অলখে দীর্ঘশ্বাস ফেলিল, পূর্ণশ্রী তাহা জানিতে পারিল না। আম্রকুঞ্জটি বেত্রবতী নদীর পাশে বলিয়া অকস্মাৎ ছুটিয়া আসা বাতাসে পত্রালি বিশ্রস্ত হইয়া উঠিল।
আম্রকাননময় আষাঢ়ী রাত্রির পারদ রঙা আলোক আরও গাঢ় হইয়া উঠিয়াছে। পত্রালির আড়াল হইতে একখানি ঘুমহীন পুরুষ ময়ূর উড়াল দেয়, একখানি ক্ষুধার্ত খরগোশ সহসা আমলকীর গন্ধে সচকিত হইয়া উঠে। নিকটস্থ হরীতকী গাছের শীর্ষডালে একখানি নির্লিপ্ত প্যাঁচা বসিয়া পূর্ণাদের দেখিতেছে।
তুমি আমার নিকট কেন আসিয়াছ? তরুণের কন্ঠস্বর ক্ষাণিক রুক্ষ ঠেকিল।
পূর্ণা ঈষৎ হাসিয়া কহিল, আমি তোমার ধ্যান ভাঙিব বলিয়া আসিয়াছি।
এই ক্ষণে তরুণ সামান্য বিচলিত হইয়া উঠিল। এই নিরিবিলি আম্রকাননটি তাহার ভারি পছন্দ হইয়াছে। উপরোন্ত, জীব আহার ব্যতীত টিকিয়া থাকিতে পারে না। শ্রেষ্ঠীর সহৃদয়া স্ত্রী প্রত্যহ তাহার আহারের ব্যবস্থা করেন। এইখানে সুন্দরী তরুণী আসিয়াছে, সে বারংবার আসিবে; পরিশেষে সঙ্কট তৈরি করিবে।
আম্রকুঞ্জের নিরিবিলি সাধনার স্থানটি আর নির্জন হইয়া থাকিবে না। তাহাকে এখান হইতে চলিয়া যাইতে হইবে। এইসব ভাবিয়া তরুণ বিষন্ন বোধ করিল। তথাপি সে জিজ্ঞাসা করিল, তুমি আমার ধ্যান ভাঙ্গাইবে কেন?
তুমি অহোরাত্র ধ্যান করিলে আমার ঈর্ষা হয় যে।
কেন? আমি ধ্যান করিলে তোমার ঈর্ষা হইবে?
তুমি ধ্যান লইয়া থাক, সংসারের প্রেম লইয়া থাক না।
সন্ন্যাসী তো ধ্যান লইয়াই থাকিবে।
কেন? সে কি পুরুষ নয়?
পুরুষ ঠিকই - তবে সে জিতেন্দ্রিয়। সন্ন্যাসী যোগবলে আপন ইন্দ্রিয়াদি জয় করিতে পারে।
পূর্ণা শ্বাস টানিল। তাহার পর কহিল, আমি এই কথাটিই বুঝিতে চাই।
পুরুষ কি করিয়া জিতেন্দ্রিয় হইতে পারে-তাহার কামাগ্নি হইতে সংসারের নিষ্পাপ বালিকাগনও বাঁচিতে পারে না। বলিতে বলিতে পূর্ণা বাকরুদ্ধ হইয়া আসিল। বুঝিবা তাহার বালিকাবেলার কোনও ঘটনা স্মরণ হয়; সম্ভবত সে পিতার অট্টালিকাটি ঘৃনা করে। অট্টালিকাটি একদিন সে আগুনে পোড়াইয়া দিবে, ভন্ড পুরুষের মুখোশ সে উম্মোচন করিয়া দিবে। নব্যসন্ন্যাসী তরুণ হইলেও সংসারাভিক্ত।
সে পূর্ণশ্রীর জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা অনুমান করিতে । তাহার হৃদয়ে করুণার উদ্রেক হয়। সহসা সে ঈষৎ অস্থির হইয়া উঠিয়া বলিল, পুরুষের কামাগ্নি হইতে সংসারের নিষ্পাপ বালিকাগনও বাঁচিতে পারে না বটে তবে ইহাই শেষ কথা নয়। আর্যাবর্ত্মের নানা স্থানে নিষ্পাপ বালিকাগনকে মাতৃজ্ঞানে আরাধনা করা হয়। এই আরাধনার অধিকাংশই পুরুষের কৃত্য।
বুঝিলাম। পূর্ণা বলিল। তোমার নাম জানিতে পারি কি?
আমার নাম রজত।
কী সুন্দর নাম। কে রাখিয়াছে?
আমার মা।
তোমার মায়ের নাম?
অন্নপূর্ণা।
তিনি বাঁচিয়া আছেন কি?
না। নাই। রজত মাথা নাড়িয়া কহিল ।
ওহ্ , তোমার মাতৃবিয়োগ ঘটিয়াছে?
রজত মাথা নাড়িল।
ইহাই কি তোমার সংসারত্যাগের কারণ?
রজত নিশ্চুপ হইয়া থাকে। এই ক্ষণে তাহার কত কথা যে মনে পড়িল। মৎস্য রাজ্যের রাজধানী বৈরাট নগরের উপান্তে তাহার জন্ম; পিতা সোমভট্ট ছিলেন সুবর্ণবণিক। তিনি রজতের বাল্যকালেই দেহ রাখিয়াছিলেন। রজতের মা অন্নপূর্না ছিলেন অত্যন্ত মমতাময়ী,
বাল্যকাল হইতেই রজত ছিল আবেগপ্রবণ, খেয়ালি ও তাহার জ্ঞানতৃষ্ণা ছিল প্রবল -সে প্রকৃতির গূঢ় রহস্য জানিতে চায়।
ইহা তাহার মা অন্নপূর্না জানিতেন। মায়ের অকস্মাৎ মৃত্যু হইল- বড়দা সায়ন সংসারের দায়িত্ম লইল। সায়ন সম্পন্ন বণিক, সার্থবাহের দল লইয়া দূরদূরান্তে চলিয়া যায়; সায়ন-এর স্ত্রীর নাম অঞ্জনা-সুন্দরী, লাস্যময়ী; ...বানিজ্যকালে সায়ন দূর রাজ্যে থাকাকালীন শূন্য বাড়িতে অঞ্জনা তাহার রুপযৌবন লইয়া আগ্রাসী হইয়া উঠে। রজত যে তাহা উপভোগ করে নাই, তাহা নয়; উদ্দাম নারীর ঘাম-শরীর ছুঁইয়া তৃপ্তি মিটাইয়াছে -তবে শ্রীঘ্রই ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে ...তাহার হৃদয়ে সুদূরের ডাক-তাহা সে জানিতে চায় ...সে বৎসর খানেক হইল সংসার ত্যাগ করিয়া পথিক সাজিয়া পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে ...এই সমস্ত গূহ্যকথা সে পূণ্যশ্রীকে বলিতে পারে না। মাতৃবিয়োগের কারণে সংসার ত্যাগ করে নাই।
তাহার জ্ঞানতৃষ্ণা প্রবল-সে প্রকৃতির গূঢ় রহস্য জানিতে চায়।
রজত বলিল, আমি জানি কেন তুমি আমার ধ্যান ভাঙ্গাইতে চাও।
কেন শুনি?
রজত বয়েসে নবীন। এখনও পরিপূর্ণ অর্থে সন্ন্যাসব্রত গ্রহন করে নাই। সে তাহার স্বল্পকালীন বাত্যজীবনে বৈশালীর এক সাধুর মুখে যাহা শুনিয়াছিল তাহাই পূর্ণাকে বলিল।
বলিল, নারী পুরুষের ধ্যান ভাঙ্গাইতে চায়- কারণ যাহাতে পুরুষ ধ্যান করিয়া প্রকৃতির গূঢ় রহস্য না জানিতে পারের। প্রকৃতির কর্ত্রী হইলেন একজন নারীহৃদয়; প্রাচীন গ্রন্থাদিতে তাহাকে ‘পরমমধ্যা’ বলা হইয়াছে। তিনি সহসা নিজেকে প্রকাশিত করিবেন না, পরমমধ্যা অন্তরালেই থাকিবেন। সংসারের নিরাসক্ত পুরুষ তাহাকে জানিতে চায়। সহসা নিজেকে প্রকাশিত করিবেন না।
এই কারণে নারীহৃদয় ‘পরমমধ্যা’ নারী হইয়া নারীর অভ্যন্তরে বাস করিয়া মায়াজাল বিস্তার করিয়া ধ্যান ভাঙ্গাইতে চায়। ইহাকে লীলাতত্ত্ব বলে।
পূর্ণা এইসব তত্ত্বাদি জানে না। তবে সে এই সমস্ত শুনিয়া কেমন অবশ বোধ করে, তাহার শরীর কাঁপিয়া উঠে- প্রাচীন একটি জ্যোস্নার বনে সে ঘামে ভিজিয়া যাইতে থাকে। নিকটস্থ বেত্রাবতী নদী হইতে শীতল বাতাস আসিয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরে।
তাহার শীত শীত করে। সে বুঝিতে পারে প্রেম ও কাম বাদেও জগতে আরও অনেক বিষয়াদি বুঝিবার অপেক্ষায় আছে।
পূর্ণার সহসা স্মরণ হইল সারথী স্মারক পূর্ণার সহিত মিলনের আকাঙ্খায় আম্রবনের গহীন অভ্যন্তরে একটি পরিত্যক্ত ভাঙা দেউলে অপেক্ষা করিয়া আছে। রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে সে সোমরসে সিদ্ধি মিশাইয়া দ্বারপাল বলরাম কে তাহা পান করাইয়া অচেতন করিয়া রাখিবে। এই সমস্ত ভাবিয়া পূর্ণা শিহরিত হইয়া উঠিয়া পায়ে পায়ে ফিরিয়া যাইতে থাকে।
পূর্ণা চলিয়া গেলে রজত দীর্ঘশ্বাস ফেলিল। সে পূর্ণাকে যতই লীলাতত্ত্ব বোঝাক না কেন সে পূর্ণার রুপ যৌবন দেখিয়া চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। সে বুঝিতে পারিল সন্ন্যাসব্রত অত্যন্ত কঠিন, ইহার সবার ললাটের লিখন নয়। বস্তুত রজত এখনও পরিপূর্ন ভাবে সন্ন্যাসব্রত গ্রহন করে নাই - জীবনের গভীর তাৎপর্য লইয়া একান্ত নির্জনে ভাবিতেছে মাত্র।
পরের দিন প্রভাতে শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্রর স্ত্রী চন্দনবালা রজতের নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
বলিলেন, বৎস, তুমি সন্ন্যাসব্রত গ্রহন করিলেও বয়েসে আমার ছোট হইবে।
হাঁ। রজত মাথা নাড়িল।
চন্দনবালা বলিলেন, তোমার কাছে আমার একটি নিবেদন আছে।
বলুন মা।
চন্দনবালা বলিলেন, আমি তোমার ভিতরে এক প্রকার অস্থিরতা লক্ষ করিয়াছি। আমার কেন যেন মনে হয় সন্ন্যাসব্রত ঠিক তোমার জন্য নহে।
রজত নীরব থাকে।
চন্দনবালা বলিলেন, সন্ন্যাসব্রত তোমার জীবনের লক্ষ না হইলে তুমি গৃহীজীবনে ফিরিয়া যাইতে পার। তোমরা সুবর্ণবণিক।
পারিবারিক ব্যবসায় ফিরিয়া গেলেও পার।
রজত নীরব থাকে।
চন্দনবালা এইবার অত্যন্ত আবেগমথিত কন্ঠে বলিলেন, আমি আমার কন্যাকে তোমার নিকট অর্পন করিতে চাই। এই বিষয়ে তোমার কি মত?
এই কথায় রজতের হৃদয়খানি দুলিয়া উঠিল। সে প্রতূষ্যের নি®প্রাণ আলোকে গাছপালার ফাঁকে শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্রর শ্বেতপাথরের দ্বিতল অট্টালিকাখানি এক পলক দেখিয়া নিল।
গৃহহীন ছন্নছাড়ার জীবনে অত্যধিক কষ্ঠ। পক্ষান্তরে শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্রর অট্টালিকাখানি অত্যন্ত মনোরম ও শীতল। সে অট্টালিকায় বাস করিলে পূর্ণশ্রীর প্রেম যেমন পাইবে, দাসী মল্লিকার সেবাও পাইবে। এই সমস্ত ভাবিয়া রজত বলিল, মা, আপনার কন্যা পূর্ণশ্রী কে আমি বিবাহ করিতে সম্মত আছি। কিন্তু-
কিন্তু?
শ্রেষ্ঠী সম্মত হইবেন তো? আমি অর্বাচিন।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আমার স্বামী অর্থব হইয়াছেন, তাহার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীন হইয়া গিয়াছে। আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র জয়ন্ত এ সংসারে কর্তা। জয়ন্ত সস্ত্রীক শ্বশুরালয় বৈশালী গিয়াছে। মৎস্য রাজ্যের রাজধানী বৈরাট নগরের উচ্চবংশে তোমার জন্ম। তোমার পিতা সোমভট্ট ছিলেন সুবর্ণবণিক।
সে বিবাহে আপত্তি করিবে না। সে উজ্জয়িনী ফিরিায়া আসিলে বিবাহের দিনক্ষণ স্থির করিব।
রজত নীরব থাকিল।
বিবাহ রাত্রের পূর্বেই পূর্না নিরুদিষ্ট হইল। তাহার পূর্বে একখানি পত্র লিখিয়া গিয়াছে।
সে পত্রে পূর্ণা লিখিয়াছে, প্রত্যেকে আমায় রুপবতী বলিল, গুণবতী বলিল। প্রত্যেকে আমার রুপই দেখিল, গুণই দেখিল ... কিন্তু আমার মনের গভীরে যে গভীর সন্ন্যাস বাসা বাঁধিয়াছে তাহার বৃত্তান্ত কেহই লইল না। হায়, আমি সন্ন্যাস লইব, সন্ন্যাসিনী হইব। আমি গৃহত্যাগ করিলাম।
পত্রের বৃত্তান্ত শুনিয়া চন্দনবালা চাপাস্বরে বলিলেন, পাষাণী পত্রেও ছলনা করিল।
বলিয়া পুত্রের দিকে জ্বলন্ত চক্ষে চাহিলেন। যেন সমস্ত সর্বনাশ সেই করিয়াছে।
জয়ন্ত গম্ভীর হইয়া থাকিল।
শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্র অশ্র“সিক্ত হইয়া ছিলেন, তিনি বলিলেন, হায়, কত সাধ ছিল আমৃত্যু কন্যার সান্নিধ্য পাইব। মানবের প্রকৃত সরূপ কে চিনিতে পারে?
জয়ন্তর স্ত্রী সুমিত্রা দাসী মল্লিকার সহিত কী লইয়া কানাকানি করিল, হাসিল, কটাক্ষ করিয়া একে অন্যের দিকে চাহিল।
সব শুনিয়া রজত অত্যন্ত বিমর্ষ হইয়া পড়িল। তাহার পর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে চন্দনবালা কে বলিল, মা, পূর্ণা সন্ন্যাস নিয়াছে। আর্যাবর্ত্মের পথে পথে ঘুরিতেছে। আমি পূর্ণার সন্ধানে চলিলাম।
চন্দনবালা পাথর হইয়া ছিলেন।
তিনি কোনওরুপ মন্তব্য করিলেন না। তিনি আপন ভাগ্যের কথা ভাবিতে ছিলেন। এইবার শ্রেষ্ঠী পরিবারের সৌভাগ্যের দীপটি নিভিয়া যাইবে।
রজত বলিল, আমি পূর্ণাকে খুঁজিব। তাহাকে ফিরাইয়া লইয়া আসিব।
চন্দনবালা নিরুত্তর রহিলেন।
তথাপি রজত বলিল, মা, আপনি আমাকে আর্শীবাদ করুন। আমি পূর্ণার সন্ধানে যাইতেছি।
বলিয়া রজত পূর্ণাকে খুঁজিতে শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্রর অট্টালিকা ত্যাগ করিয়াছিল।
তাহার পর হাজার বছর অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে।
রজত কি পূর্ণাকে খুঁজিয়া পাইয়াছিল?
এই উপাখ্যানের লেখক তাহা কিছুমাত্র বলিতে পারে না। তবে পূর্ণার নিরুদ্দেশ হইবার পরে শ্রেষ্ঠী মহেন্দ্রর রথের সারথী স্মারকও যে গা ঢাকা দিয়াছিল তাহা ফাঁস হইয়া পড়িয়াছিল ...
উৎসর্গ: কবি শিরীষ ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।