আমরা সবাই সবার
দেশের টেলিকম সেক্টরে এখন রীতিমতো তুঘলকি কাণ্ড চলছে। প্রধানত দেশীয় অর্থায়নে গড়ে ওঠা পিএসটিএন বা ল্যান্ডফোন কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে চলছে একের পর এক অভিযান। এর ফলে একদিকে যেমন বিপুলসংখ্যক গ্রাহক বিনা কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন, তেমনি অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে পিএসটিএন কোম্পানিগুলো। বড় ধরনের আর্থিক ও ব্যবসায়িক ক্ষতিও গুনতে হচ্ছে তাদের।
গ্রাহক ভোগান্তি নিয়ে মিডিয়া সোচ্চার হওয়ার পর বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) জিয়া আহমেদ সোমবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মঙ্গলবার থেকে বন্ধ করে দেয়া চারটি পিএসটিএন কোম্পানি আবার চালু করার অনুমতি দেয়া হবে।
তবে আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে হঠাত্ সার্ভিস বন্ধ করে দেয়ায় কোম্পানিগুলো যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তা কীভাবে পুষিয়ে দেয়া হবে তা তিনি বলেননি। এরই মধ্যে পিএসটিএন কোম্পানিগুলো দাবি করেছে, বিটিআরসি যে কায়দায় কোম্পানিগুলো বন্ধ করেছে, তাতে এসব টেলিকম প্রতিষ্ঠান পুনরায় চালু করতে লাখ লাখ ডলার ব্যয়ের পাশাপাশি এক সপ্তাহের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠেছে, বিশেষ কাউকে সুবিধা পাইয়ে দিতেই কি বিটিআরসি এসব অভিযান পরিচালনা করছে?
জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে অভিযানের মাধ্যমে ভিওআইপির অবৈধ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ হবে কিনা তা নিয়েও দ্বিমত রয়েছে। তাই গ্রাহকদের জিম্মি করে পরিচালিত এ অভিযানের যৌক্তিকতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। হাইকোর্ট গতকাল পিপলসটেলের দায়ের করা রিটের প্রেক্ষিতে বিটিআরটিসিকে কারণ দর্শাতে বলেছে।
পিপলসটেলের মেইন সুইচ বন্ধ করা কেন অবৈধ ঘোষণা হবে না তার কারণ দর্শাতে বিটিআরসির প্রতি রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
উল্লেখ্য, ভিওআইপির অবৈধ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে এনে সরকারের রাজস্ব বাড়াতে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) পাঁচটি পিএসটিএন কোম্পানির মূল সুইচরুম বন্ধ করে দেয়ার পাশাপাশি ২১টি ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের লিঙ্ক বন্ধ করে দেয়। একদিকে জাতীয় সংসদের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি গত ক’দিন ধরে বারবার বলে আসছেন, র্যাব-পুলিশ আর ধরপাকড় চালিয়ে ভিওআইপির অবৈধ ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব নয়। তিনি গ্রাহক ভোগান্তির বিরোধিতা করে ভিওআইপি প্রযুক্তিকে উন্মুক্ত করে দেয়ার পক্ষে বেশ জোরাল বক্তব্য রাখছেন। অন্যদিকে বিটিআরসি দেশীয় বিনিয়োগে গড়ে ওঠা পিএসটিএন কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে চালাচ্ছে নির্মম অভিযান।
তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, কাউকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দিতে এ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে কিনা।
টেলিকম বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আগামীতে ভারতীয় টেলিকম কোম্পানি ভারতী এয়ারটেল বাংলাদেশে তাদের অপারেশন শুরু করতে যাচ্ছে। এয়ারটেল বাংলার পথচলা সহজ করে দিতেই এ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে বলে ব্যাপক গুঞ্জন রয়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তি হচ্ছে, এয়ারটেল বাংলাকে নির্ধারিত ট্যাক্স দেয়া থেকে বাঁচিয়ে দিতে বিটিআরসি আইনেও পরিবর্তন এনেছে এবং তা করেছে ভারতীয় এ টেলিকম অপারেটরটির লাইসেন্স হস্তান্তর ফি মওকুফ করে দেয়ার পর। ২০ জানুয়ারি ওয়ারিদের শেয়ার হস্তান্তর নিয়ে ১১৫ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি নিয়ে সংসদীয় কমিটিও প্রশ্ন তুলেছিল।
তখন মিডিয়ায় বলা হয়েছে, ওয়ারিদ টেলিকমের ৭০ শতাংশ শেয়ার হস্তান্তরে সরকারের ১১৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা (এক কোটি ৬৫ লাখ ডলার) ক্ষতির বিষয়ে বিটিআরসির ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি সংসদীয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।
প্রশ্নটি ওঠার আরেকটি কারণ হচ্ছে, একই খাতে একাধিক কোম্পানি থেকে শত কোটি টাকা আদায়ের ব্যাপারটি কিভাবে ফয়সালা করা হবে, সে ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি বিটিআরসি। বিষয়টি এখনও ঝুলে আছে। বিটিআরসি তাদের এ উদ্যোগের পেছনে এফডিআই বা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের সুবিধার পক্ষে সাফাই গাইলেও প্রশ্নটি একেবারে দূর হয়নি। এয়ারটেল বাংলার নিবন্ধন নিয়েও আইন না মানার অভিযোগ রয়েছে।
যদিও বিটিআরসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, টেলিকম আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করেই তা করা হয়েছে।
ভিওআইপির অবৈধ ব্যবহারের অভিযোগে এর আগে দেশের মোবাইল কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালিত হয়েছে। ওই সময় তাদের শুধু জরিমানা করা হয়েছিল। তাদের সার্ভিস বন্ধ করা হয়নি। কিন্তু দেশীয় অর্থায়নে গড়ে ওঠা পিএসটিএন কোম্পানিগুলোকে সেই সুযোগ দেয়া হয়নি।
তাদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পাশাপাশি সার্ভিস বন্ধ করে তাদেরকে অর্থনৈতিক দিক থেকে চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। পিএসটিএন ও মোবাইল কোম্পানিগুলোর ব্যাপারে দ্বিমুখী নীতি অনুসরণ নিয়ে গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি বিটিআরসি।
ন্যাশনাল ফোনে অভিযান : অবশেষে গতকাল বিটিআরসি অভিযান চালিয়েছে ন্যাশনাল ফোনের বিরুদ্ধে। চারটি পিএসটিএনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পর প্রশ্ন উঠেছিল ন্যাশনাল ফোনের বিরুদ্ধে ভিওআইপির অবৈধ ব্যবহারের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে কেন অভিযান চালানো হয়নি। অভিযোগ ছিল, বিটিআরসির এক শীর্ষ কর্মকর্তা ন্যাশনাল ফোনের শীর্ষ কর্মকর্তার ব্যাচমেট এবং তাদের মধ্যে যোগসাজশ রয়েছে।
ন্যাশনাল ফোনের সেই কর্মকর্তাটি বিটিআরসি চেয়ারম্যানের নামে চাঁদাবাজি করে মিডিয়ায় শিরোনাম হয়েছিলেন। আরও অভিযোগ রয়েছে, ন্যাশনাল টেলিকমের গ্রাহক সংখ্যা নগণ্য কিন্তু কল টার্মিনেশন অস্বাভাবিক বেশি। যে মুহূর্তে বিটিআরসি চারটি পিএসটিএনের সার্ভিস আবার চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে মুহূর্তে ন্যাশনাল ফোনের বিরুদ্ধে পরিচালিত এ অভিযানকে আইওয়াশ বলছেন অনেকে।
ন্যাশনাল ফোনের কার্যক্রম বন্ধ করা হয় গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়। র্যাবের সহযোগিতায় বিটিআরসি মহাখালী তিতুমীর কলেজের বিপরীতে ব্যাংক এশিয়া ভবনের পঞ্চমতলায় অবস্থিত ন্যাশনাল ফোনের প্রধান সুইচরুম বন্ধ করে দেয়।
এ সময় ন্যাশনাল ফোনের কাউকে পাওয়া যায়নি। দরজায় কোনো তালাও ছিল না। দরজার ওপরে ন্যাশনাল ফোন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কম্পিউটার কম্পোজ করা একটি নোটিশে লেখা ছিল—প্রিয় পরিদর্শকবৃন্দ, আমাদের এখানে কোনো অবৈধ ভিওআইপি নেই। আমাদের হয়রানি না করার জন্য দরজা খোলা রেখেই চলে গেলাম।
View this link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।