আমাদের চারপাশে নিত্য ঘটে যাওয়া ছোট খাট ঘটনাগুলোও দিতে পারে অনেক অসাধারন শিক্ষা। অন্তর্দৃষ্টি মেলে দেখিনা আমাদের চারপাশে একটু তাকিয়ে...............
আজ ১২ই ভাদ্র জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যু বার্ষিকী, সকাল থেকে সব চ্যনেলে বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে। বুলেটের অন্তরে ঘুড়েফিরে একটা গানই বাজছে,
‘আমি চির তরে দূরে চলে যাবো
তবু আমারে দেবো না ভুলিতে’।
সত্যি, কেউ কি আমরা পেরেছি নজরুলকে ভুলতে? আমাদের থেকে বহু দূরে থেকেও তিনি আজ আমাদের সকলের অন্তরে। তাঁর বিদায়ের এই দিনে সকলের সাথে প্রকৃতিও যেন কাঁদছে, সেই ভোর থেকে অঝোরে বৃষ্টি ঝড়ছে।
তবে বৃষ্টির জন্য বুলেট ঘড়ে বন্দী নয়। ওর শরীরটা বেশ খারাপ, মনটা খারাপ তারও বেশি। কালকের তুলনায় জ্বর কিছুটা কমলেও শরীর অনেক বেশি দুর্বল, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না। গত রাতে সদরঘাট থেকে বরিশালগামী লঞ্চে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু দুপুরে ক্লাস থেকে ফিরেই বিছানায় পড়েছে, রাতে জ্বর ১০৪ ডিগ্রী পর্যন্ত উঠেছিলো।
শুয়ে শুয়ে তাই সারাদিন টেলিভিশন দেখেই কাটছে ওর। এতে করে নজরুলকে নিয়ে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখে মনটা আরও বেশি ভারাক্রান্ত হচ্ছে । পুরনো কিছু অনুভুতি, কিছু স্মৃতি ওকে আরও বেশি কাতর করে তুলছে। অনেক কষ্টে মনকে স্বান্তনা দিচ্ছে, ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। নিজের প্রথম ভালবাসা অন্যের হাত ধরে চলে যাবে আর সেই দৃশ্য আনন্দের সাথে উপভোগ করবে হৃদয় এতোটা কঠিন হয়ে পারেনি ওর ।
ওর যেতে না পারাটা তাই বুঝি একপ্রকার শাপে বর ই হল। মিতা দি ওর প্রথম ভালোলাগা। ভালবাসাও বটে, যদিও একতরফা। কেননা মিতা দি তো তার মনের কথা জানেনা। বুকের গভীরে জন্ম নেওয়া ভালো লাগাটা বেড়ে কখন যে ভালবাসায় পরিনত হয়েছে তা নিজেই বুঝতে পারেনি, মিতা দি’কে বলা তো দূরে থাক।
দীর্ঘদিন পরে, গত সপ্তাহে যখন সেলফোনে একটা কল আসার সাথে কোহিনূর নামটা ভেসে উঠলো ওর বুকের ভেতর কেমন যেন একটা দোলা লাগলো। ফোনটা রিসিভ করে, ‘হ্যালো, কোহিনূর? কেমন আছো তুমি? এতদিন পরে আমাকে মনে পড়লো তোমার? একদম ভুলেই গেছ আমায়, তাই না?’ অপর প্রান্ত থেকে উত্তর এলো, ‘ এই ত্যাঁদড়, কোথায় তোর কোহিনূর? আমি তোর মিতা দি। ’ বুলেট বলল ওহ দুঃখিত দিদি । আমার ফোনে কোহিনূর নামটা ভেসে উঠলো তো তাই। এর উত্তরে মিতা দি যা বলল তা শুনে বুলেট বিস্মিত না হয়ে পারলো না।
কোহিনূর তো লাল হীরে, আমি তো কালো, তুই কোহিনূরের অমর্যাদা কেন করলি? মিতা দি’র বুদ্ধিমত্তার কাছে বুলেট আরো একবার হার মানল, তবে আবেগ চেপে রাখতে পারলো না। বলল ‘কার দৃষ্টিতে তুমি কি, তা আমি জানিনা, আমার কাছে তুমি কোহিনূর। ’ বুলেট এই প্রথম আপনি থেকে তুমি সম্বোধন করলো? বুলেটের কণ্ঠের আবেগ ভরা অস্বাভাবিকতাও মৌমিতার উপলব্ধির বাইরে থাকল না। খুব স্বাভাবিক হেসে বলল, আমাকে আর পাম দিস না। আমি জানি, কালো মেয়েদের রঙটাই সবার চোখে পরে, গুনটা নয়।
বুলেট বলল, আমার চোখে তো তোমার গুন ছাড়া আর কিছুই পড়ে না। যেন খাঁটি হীরে, জ্বল জ্বল করছে। মৌমিতা বলে, তোর চোখে সমস্যা হয়েছে, ডাক্তার দেখা। বুলেট বলল, আমার না হয় সমস্যা হয়েছে, তাই বলে বাবা, মা, বুল্টি সবার একযোগে সমস্যা হল? মৌমিতা বলে, কেন তাঁদের কথা আসছে কেন? বুলেট বলল, বাবা সেদিন রাতে বলছিল কিনা, ‘মিতা খুব ভালো মেয়ে’। মা বলছিল, ‘ হ্যা, ওর মতো ভালো মেয়ে এখন দেখাই যায় না, ও যদি আমাদের বুলেটের থেকে বয়সে বড় না হত, তাহলে আমাদের ঘরের বউ করে রেখে দিতাম’।
বুল্টি ভেতর থেকে বলে উঠলো, ‘মাত্র তো দুই বছরের বড়, কি এমন সমস্যা তাতে’? মৌমিতা হেসে উঠলো, তাই বুঝি? আর তুই কি বললি? বুলেট বলে, বাবা মাকে আমি কিছু বলিনি, আগে তো তোমার সাথে কথা বলে নেই। মৌমিতা জানতে চায়, কি বলবি আমাকে? বুলেট বলে, তুমি বয়সে বড় তাতে আমার কোন সমস্যা নেই। আমার বউ হতে তোমার কোন আপত্তি আছে কি না তাই বল? মৌমিতা মজা করে উত্তর দেয়, ইস! রে আগে কেন বলিস নি? বড্ড বেশি দেরী হয়ে গেছে! আমি তোকে আমার বিয়ের নিমন্ত্রন দিতেই ফোন করেছি আজ। আগামী ১২ই ভাদ্র আমার বিয়ে, আসতে যেন ভুল হয় না। পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার মতো বুদ্ধি দুজনেরই আছে তাই এতক্ষনের কথোপকথনকে নিছক মজার করে নিলো ওরা।
বিয়েতে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করে তবেই ফোন রাখল মৌমিতা। আজ সেই বিয়ের দিনে বুলেট শরীরের সাথে নিজের মনের উপরও যে নিয়ন্ত্রন হারিয়েছে তা বেশ উপলব্ধি করতে পারছে। বার বার ওর মন শুধু বলছে , ‘এক দিন যে গান শুনিয়ে আমায় মুগ্ধ করেছিলে আজ সেই গানের বাস্তব প্রতিফলন ঘটিয়ে আমার থেকে দূরে চলে যাবে! আমার জীবনে স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে শুধু নজরুল মণ্ডিত সেই দিনটি’।
চুন ছাড়া পান যেমন তবলা ছাড়া গানও ঠিক তেমন, বহুকাল ধরে লোকমুখে প্রচলিত এ প্রবাদ যে একেবারে মিথ্যে নয় তার প্রমান বুলেট বহুবার পেয়েছে। স্কুলের যে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এলেই ওর কদর বেড়ে যায়।
মহরা শুরুর দিন থেকে চূড়ান্ত অনুষ্ঠান পর্যন্ত বুলেটের খেলাধুলা বন্ধ। তাতে করে ওর এতোটুকু কষ্ট নেই, কেননা এই ক’দিনে ও যে ভি আই পি যত্ন পায় খেলার মাঠে তার ছিটেফোঁটাও পায় না। তবলা যে খুব ভালো বাজায় তা ঠিক নয়, প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষাও নেই ওর তবলা বাদনে। ছোট বোন বুল্টি গান শেখে, ওর সাথে বাজাতে বাজাতে বায়েন হয়েছে আর কি। কাছাকাছি কোন দক্ষ তবলচি না থাকায় বুলেটের এতো কদর।
বিশেষ করে বাড়ির পাশের গার্লস স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সময় তো মাটিতে পা ই পড়ে না বুলেটের। কিন্তু ওর এই ভাবের বেলুনে আলপিনের খোঁচা মারতে বুল্টি’র জুড়ি নেই। গায়ে পড়ে মেয়েদের স্কুলে তবলা বাজাতে যায়, হ্যাংলা কোথাকার। বুল্টি’র এমন অপমানের সমুচিত জবাব দিতে বুলেটকে অপেক্ষা করতে হয়না। গার্লস স্কুলের দপ্তরি এসে যখন বুল্টি’র সামনেই ওকে বলে হেডস্যার তোমাকে আজ একটু তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে, বুলেট তখন বুল্টি’র দিকে তাকিয়ে বলে কি রে, কি বুঝলি? স্কুলের বায়া-তবলা ভালো বাজছেনা, তাই তোমাদেরটা আমি নিয়ে যাচ্ছি, তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো বলে দপ্তরি চলে যায়।
বুল্টি সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ে না, নেহাত আমাদের তবলা নিচ্ছে তাই তোকে একটু খাতির করে ডাকছে। বুলেটের ভাব তাতে কিছুই কমে না, পরিধেয় পোশাকের বাহার দেখেই তা বুঝে নেয় বুল্টি । সুগন্ধির তীব্র গন্ধ নাকে আসতেই বুল্টি বলে, জার তো একেবারে খালি করে ফেললি। যে ইঁদুর মরা গন্ধ লাগিয়েছিস তাতে করে মেয়েরা সব ছুটে পালাবে, মশা মাছি এসে তোর গায়ে বসবে। আর তোর তবলা বাদন শুনে এলাকার সব কাক আর কুকুর এসে জড়ো হবে, একটু সাবধানে থাকিস।
তোর আর আমাকে জ্ঞান দিতে হবেনা বলে বুলেট বেড়িয়ে যায়।
পরদিন বুল্টি’র বান্ধবী মলি এসে বলে , তোর দাদাভাই তো কিস্তি মাত করে দিলো রে! স্কুলের মেয়েরা তো ওর ফিদা হয়ে গেছে। ওর টানা টানা চোখে নাকি মন হারিয়ে যায়। ওর তবলা বাদন নাকি কারো কারো হৃদয়ে ছন্দ তোলে। এমন আরও অনেক কথোপকথনে বুল্টি’র কান ঝালাপালা হবার উপক্রম, আর ওদিকে জানালার পাশে দাড়িয়ে বুলেটের ভাবের বেলুন গ্যাসে পরিপূর্ণ হয়ে আকাশে পাড়ি জমায়।
ওদের দু’জনের অগোচরে ঘরের বাইরে বেড়িয়ে যায় বুলেট হাওয়ায় ভেসে। নিজের সম্পর্কে এমন সব কীর্তন শুনলে যে কোন ছেলেরই অবস্থা বিদিশা হওয়ার কথা। আর বুলেট তো সবে দ্বাদশ শ্রেনীর ছাত্র, বয়সটা যে ওড়ার। রাতে পড়ার টেবিলে ধ্যান ভঙ্গ হয় মাথার পেছনে ছোট বোনের হাতের ঠোকা খেয়ে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পেছনে তাকাতেই বুল্টি বলে, কি পড়ছিস? উত্তরে বুলেট বলল, আমি যা পড়ি না কেন তাতে তোর কি? মা পাশে দাড়িয়ে মুচকি হেসে বললেন, তাই বলে এক লাইন কতক্ষন ধরে পড়বি? বুলেট বুঝতে পারলো তাইতো, কতক্ষন ধরে ও শুধু পড়েই যাচ্ছে – ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক, আজ বসন্ত’।
বুল্টি বলে, মা দেখো তোমার ছেলের মনে এই অকালে বসন্ত এসেছে। অথচ তিনি নাকি কাল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আবৃতি করবেন। বুলেট বলে, শুধু আবৃতি করব না দেখবি প্রথম পুরস্কারও আনবো। বুল্টি বলে, মা তোমার আদরের শয়তান যে কি পুরস্কার আনবে তার নমুনা শোন- নিজের চর্চা রেখে গার্লস স্কুলে যায় তবলা বাজাতে। গিয়ে আবার মেয়েদের দিকে নাকি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
মেয়েরা ওর গরুর মত চোখ দেখে হাসাহাসি করে। আর ওর তবলা বাজানো শুনে সবাই বলে, তবলা বাজে না ঢোল বাজে? বুলেট ভালো করেই জানে বোনের সাথে ও কথায় পেরে উঠবে না। তাছাড়া ওকে বোকা বানাতেই যে মা’কে চুপি চুপি বুল্টি ডেকে এনেছে এ কথাও বুঝতে বাকি থাকে না। এমন নাকাল হবার পর তাই আর কথা না বাড়িয়ে শুধু বলে, যা এখন নিজের চরকায় তেল দে। কালকের জন্য গান চর্চা কর গিয়ে।
দু’জনের বাকযুদ্ধের নিরসন ঘটাতে মা বললেন, হ্যা এখন আর কাউকে কারো পেছনে লাগতে হবে না। যে যার নিজের বিষয়ে চর্চা কর। পরবর্তী দিন জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ উদযাপন উপলক্ষ্যে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জেলা পর্যায়ের চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা। বুলেট কলেজ শাখা থেকে নিজ থানায় আবৃতিতে প্রথম হয়েছে আর বুল্টি স্কুল শাখা থেকে নজরুল সঙ্গীতে প্রথম। সুতরাং জেলা পর্যায়ে এই দুই বিষয়ে নিজ থানার প্রতিনিধি দুই ভাইবোন।
মা চলে গেলে বুল্টি আবার বলতে লাগলো, ভালো করে ঝালাই করে নে। বুলেট বলে, এখন যা নিজেরটা ঝালিয়ে নে শেষবারের মতো। না হলে তো আবার ভোর বেলায় গলা চিল্লিয়ে পাড়া প্রতিবেশীর ঘুমের অকাল শ্রাদ্ধ করবি ।
যে কথা সেই কাজ, ভোরের আঁধার না কাটতেই শুরু হল বুল্টি’র গলা সাধা। এটা ওর চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য, পরীক্ষার ঠিক আগের রাতে পড়ার ধুম।
আর এ করেই আজ দশম শ্রেনী পর্যন্ত এসেছে খুঁড়িয়ে। গানের স্যার যেদিন বিকেলে আসবেন ঠিক সেদিন দুপুরের পর থেকে শুরু হয় ওর সারা সপ্তাহের অনুশীলন। ওর এই ধারা বুলেটের অতি পরিচিত। তাই ভোরের প্রিয় ঘুমটা আরও একটু মিষ্টি করতে কানে বালিশ চাপা দিলেও শেষ পর্যন্ত মধুর কোন স্বপ্ন দেখার সময় পায়নি। ‘দাদাভাই, ওঠ না আমার গানের সাথে একটু বাজাবি’ বুল্টি’র আব্দারের কণ্ঠে ঘুম ভাঙে বুলেটের।
গত রাতের কথা মনে পড়তেই বুলেট বলে, আমি তবলা বাজালে তা ঢোলের মতো বাজে। তুই যা আমাকে বিরক্ত করিস না, আমি বাজাতে পারব না। আর দেখি অনুষ্ঠানের সময় কে তোর সাথে বাজায়। বুল্টিও উত্তর দেয়, তুই ছাড়া যেন আর তবলচি নেই দুনিয়ায়? আর সত্যি যদি নাও থাকে, তোকে ডাকবো না মনে রাখিস। প্রয়োজনে তবলা ছাড়া গান গেয়েই জিতবো দেখিস।
বুলেট বলে, তুই আমার সাথে আর কথাই বলবি না, যা আমাকে ঘুমাতে দে। আবার কানে বালিশ চাপা দিয়ে ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে । কিছুক্ষনের মধ্যেই ষ্টীলের গ্লাস আর চামচের ঘণ্টা বাজতে থাকে বুলেটের কানের কাছে। তেলে বেগুনে রেগে উঠতেই বুল্টি টেবিলের ওপর একটা কাগজ রেখে দৌড়ে পালায়। কাগজে লেখা, ‘রান্না শেষ, স্নান সেরে তাড়াতাড়ি খেতে আসতে বলেছে মা।
’ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, তাইতো সময় হয়ে গেছে। জেলা সদরে পৌছতে বেশ সময় লাগবে, তাই আগেভাগেই বের হতে হবে। তাড়াহুড়ো করে স্নান সেরে খেতে বসতেই বুল্টি এসে ওর সাথে খেতে শুরু করলো। দাদাভাইয়ের সাথে না খেলে বুল্টি’র পেট ভরে না, এটাও ওর একটা বৈশিষ্ট্য। বুলেট ভেবেছিলো আজ হয়তো ব্যাতিক্রম ঘটবে।
কিন্তু না, ও বলল কিরে তুই আমার সাথে বসলি যে? বুল্টি মাকে বলে মা, ও আমাকে কথা বলতে নিষেধ করেছে, আমি ওর সাথে কথা বলছিনা। তাই বলে মাখা ভাত খাবো না তা তো বলিনি। তুমি বলে দাও, অযথা যেন আমার সাথে ঝামেলা না করে। ইতিমধ্যে বাবার আগমনে বিবাদ ভুলে বন্ধুসুলভ পরিবেশে নীরবে খাওয়া সেরে উঠে যায় দুজনই। বাবার সাথে সুবোধ বালক বালিকাদ্বয় জেলা সদরে পৌঁছে।
পাবলিক অডিটোরিয়াম আজ লোকে ভরপুর। জেলার সকল থানাধীন স্কুল, কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থীর আগমন তো বটে সাথে অভিভাবকদের উপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো। ভাগ্যিস আগেভাগেই এসে পৌঁছেছিলো ওরা, না হলে একেবারে পেছনের দিকে বসতে হত। লোক সমাগমে উৎসব উৎসব একটা আমেজ পাওয়া যাচ্ছে। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি, জেলা প্রশাসক এলে অনুষ্ঠান শুরু হল।
উপযুক্ত সময়ে বুলেটের ডাক পড়লে আত্মবিশ্বাসের সাথে মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ালো। আবৃতি শুরু করলো নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা-
বল বীর-
বল উন্নত মম শির!
দর্শক-শ্রোতা সারির সামনে থেকে এক মেয়ের ভ্রুকুটি বুলেটের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।
শির নেহারি আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির!
এবারে ওই মেয়ের মুখ ভেংচি ওর মনোযোগ ধরে টান দিলো। ও বুঝলো উদ্দেশ্য ভালো নয় মেয়ের। তাই বিষয়টিকে আর প্রশ্রয় না দিয়ে-
বল বীর-
বল মহা বিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি......
মেয়েটা একটা চোখ টিপে মুচকি হাসি দিতেই ওর খেয়াল হল আনমনে আবার কখন যে সেই মেয়ের চোখে চোখ পড়েছে ওর ।
হোঁচট খেতে খেতে বুলেট অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলো। কবিতা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঐ দিকে আর তাকায়নি। আবৃতি শেষে করতালিতে ফেটে পড়া সমাবেশের সারা বুলেটকে আন্দোলিত করলো না। বরং ও উপলব্ধি করলো, ওর কান দুটো গরম হয়ে গেছে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশেও ওর সমস্ত শরীর ঘামছে। পাশে এসে বসলে বাবা জানতে চাইলেন, তোর চোখ মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন? ঘাবড়ে গেলি নাকি এতো লোক দেখে? কাঁপা কাঁপা গলায় বুলেট বলল, কেন বাবা? আমার আবৃতি বুঝি খুব খারাপ হয়েছে? বাবা উত্তরে জানালেন, খারাপ না হলেও এর থেকে ভালো আবৃতি তুই করিস, এখন দেখা যাক বাকিরা কেমন করে।
বুল্টি কোন কথা না বললেও ওর চোখে মুখে উদ্বেগের স্পষ্ট ছাপ লক্ষ্য করলো বুলেট। আর একজনের আবৃতি শেষ হতেই জোহরের আযান দিলে নামাজ এবং মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য অনুষ্ঠানের বিরতি ঘোষিত হল। কেউ নামাজ পড়তে, কেউবা খেতে গেলে ভেতরটা অনেক ফাঁকা হয়ে গেছে। একটা সিট খালি দেখে মেয়েটা এসে বুলেটের পাশে বসলো। আমার এমন সর্বনাশ করতে পারলে তুমি? বুলেট চমকে তাকালো মেয়েটির দিকে।
তার মানে? আমি আপনার কি সর্বনাশ করলাম? বরং আপনি যা করেছেন তাতে করে সর্বনাশ তো আমার হয়েছে। আমি এতোটা খারাপ আবৃতি কখনো করিনি। মেয়েটি বলল, রেগে যেওনা। তুমি যা আবৃতি করেছো তাতেই ফাটিয়ে দিয়েছ। প্রথম স্থান অন্য কেউ নিতে পারছে না।
চেষ্টা করেছিলাম কৌশলে তোমাকে হারাতে, কিন্তু পারলাম না। আমিও তোমার এক প্রতিদ্বন্দ্বী, তবে তোমার মতো এতো ভালো আবৃতি করতে পারি না। তাও যদি ভিন্ন কবিতা হত, আমিও ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আবৃতি করব বলে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। কিন্তু তোমার পরে এখন আমার আবৃতি হাস্যকর লাগবে। তাই আমি আজ আর আবৃতি করছি না।
বুলেট এতক্ষণে ঘটনার মর্মোদ্ধারে সক্ষম হল। বুল্টি পাশে না থাকায় স্বভাবিক আলাপচারিতার ভরসা পেলো বুলেট। বাবার সাথে বুল্টি দুপুরের খাবার খেতে গেছে, বুলেট বসে বসে ব্যাগ পাহারা দিচ্ছে আর সিটের দখলদারিত্ব বজায় রাখছে। পরিচয় শেষে বুলেট জানতে পারলো মেয়েটি ওর মাসতুতো দিদি শিউলির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মৌমিতা। তার মানে আপনি সেই মিতা দি! বুলেটের বিস্ময় ভরা প্রশ্নের উত্তরে মৌমিতা বলে আমি কিন্তু তোমায় দেখেই চিনেছি, শিউলির কাছে তোমাদের ছবি দেখে দেখে চেহারাটা মুখস্ত হয়ে গেছে! বুলেট বলে, তার মানে আপনি জেনেশুনেই আমার সর্বনাশে মগ্ন হয়েছিলেন? মৌমিতা বলল, একটু বাজিয়ে দেখলাম।
মৌমিতা অন্য থানার এক কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। দুজন পরস্পরের সম্পর্কে অনেক শুনেছে শিউলির কাছে, তবে মুখোমুখি কখনো হয়নি ওরা। শিউলির কাছে তোমার অনেক প্রতিভার কথা শুনেছি, আজ প্রতক্ষ করলাম। মৌমিতা আরও যোগ করলো, তোমার নামের সাথে কাজের বেশ মিল আছে। সত্যি তুমি অসাধারন আবৃতি কর, বিদ্রোহী কবিতা আবৃতির জন্য কণ্ঠও তোমার একদম মানানসই।
আমিতো তোমার প্রতিভার প্রেমে পড়ে গেছি। ভাগ্যিস বয়সে তুমি আমার ছোট, তা না হলে হয়তো তোমার প্রেমেই হাবুডুবু খেতাম। মৌমিতার সাবলীল কথায় বুলেট ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। শিশুকাল থেকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পদচারনার বদৌলতে কথাবার্তায় বেশ পটু হলেও মৌমিতার এই কথা হজম করবে এতোটা পেকে উঠতে পারেনি এখনো বুলেট। ওর চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো।
মিতা দি, আমি কিন্তু লজ্জা পাচ্ছি। বুলেটের এই কথার জবাবে মৌমিতা বলল, তাই বুঝি? এবার তোমার চেহারাটা দেখার মতো হয়েছে, যা রেগে ছিলে এতক্ষণ আমার উপর। ইতিমধ্যে বাবা ও বুল্টি চলে এলে মৌমিতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় বুলেট। বিরতি শেষে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেলে বুলেটের আর খেতে যাওয়া হয়না। বুলেটের সাথে গল্পে মশগুল থেকে মৌমিতারও দুপুরে খাওয়া হয়নি।
শত অনুরোধ করেও কেউ আর মৌমিতাকে আবৃতি করতে রাজি করাতে পারলো না। ক্ষুধার যন্ত্রণায় পেটে যখন ছুঁচো ডন দিতে শুরু করলো তখন বুলেট বলল মিতা দি, আবৃতি যখন করবেন না চলুন খেয়ে আসি। মৌমিতা বলল, আমিও তোমাকে সেই কথাই বলতে যাচ্ছিলাম। খুব ক্ষুধা লেগেছে, চলো আবৃতি শেষ হতে হতে খেয়ে আসি।
ফিরে এসে তো বুলেটের চোখ ছানাবড়া।
বুল্টি গান গাইছে, তাও তবলা ছাড়া! নজরুল সঙ্গীতের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে! অনুশোচনায় দগ্ধ হতে লাগলো বুলেট নিজের ভুলের জন্য। ভাইবোন পরস্পরের পেছনে যতই লেগে থাক না কেন দুজন দুজনের সাফল্য নিয়ে যে কতোটা উদ্বিগ্ন তা ওরা দুজনই জানে। বুল্টি যদি আজ খারাপ করে তবে তার জন্য সম্পূর্ণভাবে বুলেট দায়ী। কেন যে এই সময়ে খেতে গেলো! বুলেটের কান্না এসে গেলো, আবার রাগও হচ্ছিলো এই ভেবে যে আয়োজকরাই বা কেমন? এত বড় আয়োজন অথচ একজন তবলচি যোগার করতে পারেনি? বুলেট চোখের জল ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে মঞ্চের কাছে চলে গেলো। তবলার কাছে যেতেই থমকে দাঁড়ালো বুল্টি’র গানের স্যারকে দেখে।
বুল্টি তাহলে স্যারকে আগে থেকেই বলে রেখেছিলো এখানে আসার জন্য? কিন্তু স্যার তবলা না বাজিয়ে পাশে বসে আছেন কেন? বিষয়টি বুঝতে পেরে স্যার বুলেটকে শান্ত হয়ে বসার ইশারা করলেন। জায়গায় গিয়ে বসে অডিটোরিয়ামের পিন পতন নিস্তব্ধতায় বুল্টি’র গান শুনতে লাগলো।
মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে বিদায় সন্ধ্যা বেলা,
আমি দাঁড়ায়ে রহিনু এ পাড়ে, তুমি ওপারে ভাসালে ভেলা।
সাত পাঁচ কোনোভাবে মেলাতে না পেরে বাবার কাছে বিষয়টি কি জানতে চাইলো, বাবা উত্তর দেবার আগেই করতালিতে ফেটে পড়লো অডিটোরিয়াম। বুল্টি মঞ্চ থেকে নামতে যাবে, প্রধান অতিথি (জেলা প্রশাসক) ওকে ডেকে থামালেন।
মামনি, তুমি আমাদের আর একটা নজরুল সঙ্গীত শোনাবে? বুল্টি একটু মিষ্টি হেসে আবার গিয়ে হারমনিয়ামে হাত রাখল, গানের স্যার উঠে এসে তবলায় হাত দিলেন। জেলা প্রশাসক বললেন, প্লিজ আপনি কিছু মনে করবেন না, আমি এবারও একদম খালি কণ্ঠে ওর গান শুনতে চাই। স্যার একটু মুচকি হেসে গরবে বুক ফুলিয়ে জায়গায় গিয়ে বসলেন। বুল্টি গাইতে শুরু করলো-
বঁধু মিটিলনা সাধ ভালোবাসিয়া তোমায়।
তাই আবার বাসিতে ভালো আসিব ধরায়।
।
গান শেষে জেলা প্রশাসক উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিতে লাগলেন। সমাবেশ জুড়ে হাততালির শব্দ ছাড়া আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বুলেট এতক্ষণে বুঝল যে, কোন তালকানার অপকর্ম নয় বরং একজন একনিষ্ঠ নজরুল ভক্তের বিশেষ অনুরোধে এই চুন ছাড়া পান খাওয়ার আয়োজন। বাবার কাছে জানতে পারলো প্রথমবার প্রতিযোগিতামূলক গান পরিবেশনের পরে ডি. সি. সাহেব এতোটাই মুগ্ধ হয়ে গেছেন যে ঐ একই গান বুল্টিকে দ্বিতীয়বার গাইতে অনুরোধ করলেন খালি গলায়।
বুলেট যেন হাঁফ ছেড়ে বাচল, আনন্দে ওর বুকটা ভরে গেলো। মৌমিতা এতো সময় মুগ্ধ নয়নে নির্বাক শ্রোতা হয়ে বসেছিল। এবার মুখ খুলে বলল, আমার চরম সৌভাগ্য যে বুল্টি’র আর আমার গ্রুপ আলাদা। তা না হলে আমার নজরুল সঙ্গীত পরিবেশনও বাদ দিতে হত। কারন আমি জেনেশুনে হার মানতে রাজি নই।
মৌমিতাকে হার মানতে হয়নি, প্রতিভার পরিচয় ওরও পেয়েছে সবাই। মৌমিতা ভেবেছিলো বুলেট হয়তো এবার বদলা নেবে। তাই গান গাইতে মঞ্চে উঠে প্রথমত অন্যদিকে তাকিয়ে গাইতে শুরু করলো-
আমি চির তরে দূরে চলে যাবো
তবু আমারে দেবো না ভুলিতে-----
মনের অজান্তেই ঘুরে ফিরে চোখ দুটো গিয়ে আটকে গেলো বুলেটের চোখে। কিন্তু কোন দুষ্টুমির লেশমাত্র নেই বুলেটের চোখে, আছে শুধু মুগ্ধতা। শুধু কি গান শুনে এতো নীরব বুলেট? মৌমিতার ভাসা ভাসা মায়াবী চোখে কখন যে ও হারিয়ে গেছে তা নিজেই টের পায়নি।
শ্যামলা বর্ণের এই মেয়েটিকে কালো বললেও ভুল কিছু হয়না। কিন্তু কি অসাধারন এক অদ্ভুত আকর্ষণ ঐ চেহারায়! প্রায় সারাটা দিন একসাথে থেকে এই শেষ বিকেলে এসে বুলেট মিতা দি’র রূপ লাবন্য উপলব্ধি করলো! একি নিজের দূরদৃষ্টির অভাব নাকি মনের সৌন্দর্য বোধের ঘাটতি বুঝে উঠে পারছে না বুলেট। তবে একটা সিদ্ধান্তে সে উপনীত হয়েছে যে, প্রতিভা মানুষের মনের সৌন্দর্যকে যেমন প্রস্ফুটিত করে পাশাপাশি বাহ্যিক সৌন্দর্যকেও করে আকর্ষণীয়। মিতা দি’কে কি উপাধিতে ভূষিত করবে তা বুঝে উঠতে পারছেনা- কৃষ্ণকলি, কৃষ্ণ সুন্দরী না কালো হীরে? গান শেষে পাশে এসে বসলে বুলেট মৌমিতাকে বলল, ইউ আর এ ডায়মন্ড। মৌমিতা বলল এ যে দেখছি পাকা জহুরী, হীরে দেখেই চিনে ফেলেছে! ডায়মন্ডের আগে ব্ল্যাকটা লাগালে না কেন? আমি মন খারাপ করতাম না, শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
মৌমিতার বুদ্ধিমত্তা এবং সাবলীলতা ওকে আরও বেশি মুগ্ধ করলো। এই মুগ্ধতার হ্রেস শেষ না হতেই প্রতিযোগিতার সকল পর্ব শেষে আসর এর আযান দিলো। আকর্ষণ ধরে রাখতে প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা এবং সাথে সাথে পুরস্কার বিতরন নামাজের বিরতি শেষে করা হবে বলে জানানো হল। বাবা গানের স্যারকে নিয়ে চা পান করতে গেলে বুল্টিও তাঁদের সঙ্গী হল। বুলেটও যেতে চাচ্ছিল কিন্তু মিতা দি’কে কোনোভাবে রাজি করাতে পারেনি।
আর মিতা দি’কে রেখে এই কিছুক্ষনের জন্যও বাইরে যেতে মন সায় দিলো না। বুলেট খেয়াল করলো বাবা বাইরে চলে যেতেই দুটো ছেলে এসে মিতা দি’র পাশের খালি সিটে বসে পড়লো। আচমকা ওদেরকে দেখে মিতা দি’র মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো, মনে হল সে যেন ঘাবড়ে গেছে। বুলেট ছেলে দুটোকে বলল, ভাইয়া এখানে তো আমাদের সাথের লোক বসেছে, ওঁরা একটু বাইরে গেছে। ওদের একজন উত্তর দিলো, তাঁরা এলে আমরা চলে যাবো।
ওদের কথায় যেন কেমন ঝাঁঝালো ভাব। বুলেট ভালো করে তাকিয়ে দেখল ছেলে দুটোকে। দেখেই বোঝা যায় বখাটে টাইপের অকর্মা দুটো, বয়স ২৩- ২৪ হবে। পাশের ছেলেটা মৌমিতাকে বলছে তোমার সাথে কথা আছে, একটু বাইরে চলো। মৌমিতা নির্বাক, কিংকর্তব্যবিমুঢ়।
বুলেট জানতে চাইলো ওঁরা কে? আপনার আত্মীয় কিংবা বন্ধু? মৌমিতা শুধু না সূচক মাথা ঝাঁকাল কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারলো না। বুলেট লক্ষ্য করলো মিতা দি ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছে। বুলেট উঠে গিয়ে ছেলে দুটোর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ভাই আপনাদের কিছু বলার থাকলে এখানেই বলুন না, বাইরে যেতে হবে কেন? একটা ছেলে বলে উঠলো, এই তুই কে রে? আমি ওর ছোট ভাই, বুলেটের সুদৃঢ় উত্তর। ছোট ভাই ছোট হয়ে থাক, বড়দের মাঝে নাক গলাতে আসিস না। যা, নিজের জায়গায় গিয়ে বস বলেই ছেলেটা বুলেটকে ধাক্কা দিলো।
ধাক্কা সামলাতে বুলেট পাশের সিটের ওপর বসে পড়লো। এদিকে ছেলেটা মিতা দি’র একটা হাত ধরে বলল, চলো বাইরে চলো। বুলেটের কি হতে কি হয়ে গেলো, উঠেই কষিয়ে এক ঘুষি নাক মুখ পেচিয়ে। মা গো, বলে ছেলেটা দুই হাতে মুখ ঢেকে মেঝেতে বসে পড়লো। আশেপাশের লোকগুলো এতক্ষন শুধু দেখছিল, কেউ কিছু বলছিল না।
এতক্ষণে দু একজন করে ছুটে আসতে লাগলো ওদিকে। বুলেট চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, আপনারা সবাই কি ভীতু কাপুরুষ? আপনাদের বিবেক বলে কিছু নেই? একটা মেয়েকে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে দুটো বখাটে অথচ কেউ কিছু বলছেন না! সামনে যারা বসে ছিল মৌমিতার সঙ্গী, সাথী, ক্লাসফ্রেন্ড এবং শিক্ষক সবাই ছুটে এলো। অবস্থা বেগতি বুঝতে পেরে সঙ্গী ছেলেটি বন্ধুকে রেখেই পালাচ্ছিলো। পেছন থেকে বুলেট জামার কলার টেনে ধরে বলল, চান্দু কই যাও? লোকজন জড় হয়ে দুটোকে ধরল। আহত ছেলেটা মুখ তুললে বুলেট নিজেই অবাক হয়ে গেলো।
সারা মুখ রক্তে ভিজে গেছে, নাকটা চীনাদের মতো অনেকটা থেবড়ে আছে। এতো শক্তি ওর গায়ে এলো কোত্থেকে নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না। ঘটনা শুনে জনতা যখন দুটোকে গণধোলাই দিতে উদ্যত ঠিক তখন জেলা প্রশাসক নামাজ শেষ করে ভেতরে প্রবেশ করলেন। সব শুনে বললেন, মাস্তানি সব জায়গায়? জেলে বসে এবার বুঝবে মেয়েদের উত্যক্ত করার কি মজা। তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য নির্দেশ দিলে দায়িত্বরত পুলিশ এসে হাতকড়া পড়িয়ে দুটোকে হাজতে নিয়ে গেলো।
আচ্ছা ঐটার মুখের মানচিত্রটার অমন করুন অবস্থা করলো কে? জেলা প্রশাসকের এই প্রশ্নে সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেলো। বুলেটের গা শীতল হয়ে গেলো, কেসে ফেঁসে গেলো নাতো? কাঁপা কাঁপা গলায় বুলেট উত্তর দিলো, স্যার চোখের সামনে এমন অন্যায় দেখে নিজেকে সামলাতে পারিনি। মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিলো বলেই মেরে দিয়েছি। স্যার এবারের মতো ক্ষমা করে দিন, আর এমনটা হবে না। জেলা প্রশাসক বললেন তোমার নামটা যেন কি, বুলেট না? হ্যা স্যার, বুলেটের সভয়ে উত্তর।
আর হবেনা মানে? শুধু বিদ্রোহী কবিতা আবৃতি করলেই কি নামের প্রতি সুবিচার হবে? অন্তরে বিদ্রোহ লালন করতে হবে সর্বদা অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তবে ঘুষিটা আর একটু আস্তে মারলেও চলত। বাবা এসে কখন যে পেছনে দাঁড়িয়েছে বুলেট তা লক্ষ্য করেনি। জেলা প্রশাসক নিজের আসনে গিয়ে বসলে বুলেটও নিজের আসনের দিকে এগোতেই বাবাকে দেখল নির্বাক তাকিয়ে আছে ওর মুখের দিকে। বুলেট ভাবল বাবা অন্তত ওকে বকা দেবেন, কিন্তু বাবা কিছুই বললেন না।
সবাই নিজ নিজ আসনে বসলো, শুরু হল ফলাফল ঘোষণা সাথে পুরস্কার বিতরনি ।
হঠাৎ করে তুই কেন এতো রেগে গেলি? মৌমিতা জানতে চাইলে বুলেট একটু দ্বিধায় পরে গেলো। তুমি থেকে তুই সম্বোধন কি ওর ওপর নাখোশ হবার লক্ষন নাকি অধিকার বোধ? বুলেট কোন উত্তর দিলো না। মৌমিতা আবার প্রশ্ন করলো, কাকে মেরেছিস তুই জানিস? আমি তো আপনাকে জিগ্যেস করেছি, আপনি বললেন আপনার কেউ নয় তাই আর জানার প্রয়োজন বোধ করিনি। বুলেট আরও বলল, আমি শুধু অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি মাত্র।
মৌমিতা বলল তাই বলে এভাবে নাক মুখ ফাটিয়ে দিবি? তোকে দেখে তো মনে হয় না তোর গায়ে এতো শক্তি, ওরকম ধারী একটা ছেলেকে এক ঘুষিতে ধরাশায়ী করে দিলি! কিন্তু ও কে তা যদি জানতি তাহলে অমন কাণ্ডটা ঘটাতে সাহস পেতি না। বুলেট বলল, তাহলে তো না জেনে ভালই করেছি। মৌমিতা বলল, ও আমাদের থানার অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী কাজলের ছোট ভাই বাদল। বাইক নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোড়ে , মোড়ে মোড়ে আড্ডা দেয় আর মেয়েদের দেখলে উত্যক্ত করে। সুন্দরী মেয়ে দেখলে তো কথাই নেই, তার পেছনে সারাক্ষন লেগেই থাকে।
কিন্তু ওর ভাইয়ের ভয়ে ওকে কেউ কিছু বলে না। আমার পেছনে লেগেছে বেশ কিছুদিন হল। বুলেট এতক্ষণে পরিবেশ হাল্কা করার মতো একটা ক্ল্যু খুজে পেলো। তার মানে আপনি যে সুন্দরী তা নিজেই স্বীকার করলেন? মৌমিতা হেসে দিয়ে বলল, যা, আমি তা বললাম কখন? কেন এই যে বললেন সুন্দরীদের পেছনেই নাকি ও লেগে থাকে, আপনার পেছনেও লেগেছে। পাকামো করতে হবে না আর, ওঠ তাড়াতাড়ি যা পুরস্কার নিয়ে আয়।
মৌমিতা’র কথায় বুলেট মঞ্চের দিকে কর্ণপাত করলো, তাইতো ওর নাম ডাকছে। ‘কবিতা আবৃতি, কলেজ শাখা, প্রথম স্থান – অনিরুদ্ধ স্বদেশ বুলেট’। শুনেই দাদাভাই! বলে বুল্টি বুলেটকে জড়িয়ে ধরল। দুই ভাইবোনের এই অন্তরের টান দেখে কে বলবে গতকাল থেকে দুজনের সাপে নেউলে অবস্থা । এর পর এলো বুল্টি’র পালা, ‘নজরুল সঙ্গীত, স্কুল শাখা, প্রথম স্থান – অনন্যা হৃদি বুল্টি’।
শঙ্কা মুক্ত বুলেট হুড়রে বলে বুল্টিকে জড়িয়ে ধরল। মৌমিতা পাশ থেকে মুগ্ধ হয়ে ভাইবোনের আবেগ আর উল্লাস উপভোগ করছে। ওদের খুশির হ্রেস কাটতে না কাটতেই ‘‘নজরুল সঙ্গীত, কলেজ শাখা, প্রথম স্থান –মৌমিতা চৌধুরী । ’ বুলেট মৌমিতার কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফিস ফিস করে বলল, অনেক কষ্টে আবেগটাকে প্রশমন করলাম, আপাতত শুধু অভিনন্দন। বুলেটের এই কথা শুনে মৌমিতা দু হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, সমস্যা কি আয়।
না আজ থাক, বলে বুলেট চোখের ইশারায় পাশে বসে থাকা বাবার উপস্থিতি স্মরন করিয়ে দিলো । পুরস্কার বিতরন শেষে জেলা প্রশাসকের সাথে বিজয়ীদের ফটো সেশন চলছে। জেলা প্রশাসক বুল্টি আর বুলেটকে কাছে ডেকে বললেন, তোমাদের দুজনের তো দেখছি নামেও মিল আবার চেহারায় দেখছি আরও বেশি মিল। তোমরা কি আপন ভাইবোন? দুজনই একসাথে উত্তর দিলো, হ্যা। তোমাদের সাথে অভিভাবক কেউ এসেছেন? হ্যা, বাবা এসেছেন বলে ওরা বাবার দিকে দেখাল।
বাবাও সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালেন। জেলা প্রশাসক বললেন আরে বন্ধু তুমি? এরা তোমার ছেলে মেয়ে? ছাত্রজীবনে এই জেলা প্রশাসক এবং ওদের বাবা দুজন বিশেষ বন্ধু ছিলেন। জেলা প্রশাসক এতো লোকের মাঝে এতক্ষন খেয়াল করতে পারেননি আর ওদের বাবা ঠিক এই মুহূর্তের প্রতিক্ষায় ছিলেন। জেলা প্রশাসক বললেন, এমন রত্ন কোথায় পেলে? ওদের বাবার বিনম্র উত্তর, “ঈশ্বরই দিয়েছেন, বাকিটা তোমাদের আশীর্বাদ”। রত্ন তো তুমি সাথে করে নিয়ে যাবে, আমি একটা ছবি তুলে রাখি এই বলে জেলা প্রশাসক দু’জনের কাঁধে দুই হাত রাখলেন।
বললেন এমন সুযোগ তো আর বার বার আসে না, বিদ্রোহ আর প্রেম একই সাথে। পেছন থেকে মৌমিতা বলে উঠলো-
“মম এক হাতে বাঁকা বাশের বাঁশরি আর হাতে রন তুর্য। ”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।