হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি নাকি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ছিলেন সেই বিতর্ক ওঠা উচিৎ, যেহেতু উনি আমাদের জাতীয় কবি। সুতরাং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিকদের জাতীয়তার প্রশ্নে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলির যে বিতর্ক সেই বিতর্কের সমাধানে কবির স্মরণ নেয়া উচিৎ। নাইলে তারে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কওয়াটা কথার কথা হইয়া যায়। যেই জাতীয়তাবাদী চেতনা বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পেছনে ভুমিকা রেখেছে তাতে কাজী নজরুলের বিশেষ ভুমিকা আছে। তিনি সরাসরি জাত ও জাতির মধ্যে তুলনামুলক প্রশ্ন তুলেছেন।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের সামনে আসল চ্যালেঞ্জ হিসাবে হাজির করছেন 'আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রান?'। এই দেশে এককালে জাতের কোন কমতি ছিলনা। সেই জাত বিরোধীতার নানান চ্যালেঞ্জ নিয়া হাজির হইছেন বহু কবি, দার্শনিক। ইসলামও এই দেশে হাজির হইছিলো জাতের বিরোধীতায়, মানুষ জাত মুক্ত হইতে মুসলমান হইছে। কিন্তু পরে মুসলমান শব্দটাই একটা জাত হিশাবে পরিচয় পাইছে, আশরাফ মুসলমান সমাজের হিশাব কিঞ্চিত আলাদা।
এই কথার প্রমাণ বিভিন্ন ব্রিটিশ নথিপত্রে পাওয়া যায়। এতো এতো জাতের হিশাব লালন কখনো মানেন নাই। তাই তিনি বলেছিলেন - জাতের কিরূপ দেখলাম না। অর্থাৎ জাতের বাস্তব অস্তিত্ব তিনি অস্বিকার করেছেন। কিন্তু লালন জাত ভিন্ন অন্য কোন পরিচয়ও দাঁড়া করাইতে চান নাই, মানুষ পরিচয় বাদে।
লালন বাঙলার আদ্যিকালের জাত প্রশ্নের মোকাবেলা করেছেন, উপনিবেশ বিরোধীতা করে জাতি তৈয়ার করার রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তার মোকাবেলা করতে হয়নাই। কিন্তু নজরুল এইটা করেছেন। তাই তিনি জাতের সাথে জাতির তুলনামূলক প্রশ্ন এনেছেন। আমাদের নেতাদের কোন পরিচয়কে মূখ্য ধরে রাজনীতি করা উচিৎ, স্বাধীনতা সংগ্রাম করা উচিৎ? জাত নাকি জাতি? এই দেশে যদিও বহু জাত ছিল সেই সময়ে মুসলিম এবং হিন্দু এই দুই জাতের মধ্যে লড়াই তুঙ্গে ছিলো। বহু জাত মুক্ত হয়ে এইদেশের কিছু মানুষ মুসলমান হইছিলো মধ্যযুগে, আর বহু জাত মুক্ত হয়ে আরো বহু মানুষ হিন্দু হইলো ইসলাম, বৈষ্ণববাদ আর ব্রিটিশ শিক্ষা ও সাহচার্যের বদৌলতে।
কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দেখা গেলো যে এই দুই জাত পরস্পর দুশমন হইয়া দাঁড়াইছে। নজরুলের এই দুশমনিতে ব্যাপক আপত্তি। তাই তিনি বলেছেন 'হিন্দু না ওরা মুসলিম, ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন? কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার। মায়ের সন্তান, আমার মায়ের সন্তান। কে এই মা? এই মা'এর একটা মানচিত্র নজরুলের মাথায় ছিলো কি? অথবা এই মায়ের সন্তানদের কোন জাতীয় নাম তার মাথায় ছিল কি? নজরুল বলেছেন,
"কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙ্গালীর খুনে লাল হ’ল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার"।
কবি 'বাঙালি'র কথা বলেছেন। কিন্তু তার মানে তারে এখন 'বাঙালি জাতীয়তাবাদী' বলতে হবে বিষয়টা এমন না। তিনি কিভাবে বাঙালি শব্দটা ব্যাবহার করেছেন সেটা দেখতে হবে। কবি পলাশীর দিগন্তে তাকাতে বলেছেন। বলেছেন বাঙালির রক্তের গঙ্গায় পুরা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ডুবে গেছে।
আবার এই বাঙালির রক্তেই ভারতের স্বাধীনতার সূর্য উঠবে। 'আমাদের' শব্দটা ব্যাবহার করে তিনি নিজেকে বাঙালি বলেই পরিচয় দিয়েছেন, অর্থাৎ জাতের বদলে জাতি হয়ে ওঠার প্রশ্নে বাঙালি জাতীয়তার চিন্তা তার মধ্যে ছিলো। কিন্তু উনি শুধু বাঙালির স্বাধীনতা চান নাই, গোটা ভারতের সকল মানুষেরই স্বাধীনতা চেয়েছেন। এবং তিনি ভবিষ্যতবানী করেছেন যে বাঙালির রক্তেই এই ভারতবর্ষের সকল মানুষ স্বাধীন হবে। ব্রিটিশ আমলে বাঙালিরাই সংগ্রাম করেছে কিন্তু ভারতমুক্তির প্রশ্নে তারা 'জাতে'র রাজনীতির কাছে হেরে গেছে।
কাজী নজরুল ইসলামের কথা তারা শোনে নাই। তাই 'জাতে'র প্রশ্নে পাঞ্জাব ও বাঙলাকে দুই টুকরো করা হয়েছে। এটা সেসময় হিন্দু মুসলিম দুই জাতেরই বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদ যেমন মুসলমানদের মধ্যে হুসেইন শহীদ সোহরোওয়ার্দী এবং হিন্দুদের মধ্যে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ভাই শরৎ চন্দ্র বসু উল্লেখযোগ্য। তারা স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলা রাষ্ট্র চাইছিলেন। সার্বভৌম 'সোসালিস্ট রিপাবলিক ওফ বেঙ্গল'এর কথাও উঠেছিলো।
কিন্তু জাত ও জাতির লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জাতই জিতেছিলো, এই জয় পরাজয় নিশ্চিৎ হইছিলো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও দাঙ্গা হাঙ্গামার মধ্য দিয়া। প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ডেভেলপমেন্ট হয়নাই।
কিন্তু নজরুলের ভবিষ্যৎবানী বৃথা যায় নাই। দেখা গেলোযে বাঙালি আবার রক্ত দেয়া শুরু করলো। আগের চেয়ে বেশি ৫২, ৬৯ রক্তে লাল করে সে একাত্ত্বরে রক্তের গঙ্গা বানাইলো।
সেই গঙ্গায় বাংলাদেশের সূর্য উঠলো। কবি তাই বাংলাদেশে এসেছিলেন। পশ্চিম বাঙলায় জন্ম নিলেও কবি বাংলাদেশেই মৃত্যু বেছেনিলেন। কারন এই বাংলাদেশ তার স্বপ্নের জাতীয় রাষ্ট্র, যেই বাংলাদেশ থেকে গোটা ভারতবর্ষের তাবৎ গণমানুষের স্বাধীনতার সূর্য উঠবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বাংলাদেশে এই সূর্যের কিঞ্চিত আভা একসময় ভারতের আসাম, নাগাল্যান্ড, কাস্মির সহ বহু মুক্তিকামী জাতি দেখেছিলোও বটে।
কিন্তু সেই সূর্য আর উদয় হইলোনা। কারন আমরা আবারো জাতি বনাম জাতের তর্কে ফিরা গেছি। বাঙালি জাতীয়তা বনাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কুতর্ক তৈয়ার করেছি। কিন্তু আমাদের জাতীয় কবি এই রাষ্ট্রের জাতীয়তা বলতে জাত পাত সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত জাতীয়তার কথা বলেছেন, বলেছেন রক্তক্ষয়ী সংগ্রামী ও বিপ্লবী জাতীয়তাবাদের কথা। যে জাতীয়তাবাদ শুধু বাঙালি না, ভারতের সকল জাতিসত্ত্বার মুক্তির কথা বলে, স্বাধীনতার কথা বলে।
কিন্তু সেই যোগ্যতা আমরা অর্জন করতে পারিনাই। কারন আমরা এখনো প্রশ্ন তুলি লাশ টা কার? শাহবাগী না হেফাজতির? নাস্তিক না আস্তিকের? আমরা এখনো নিজেদের জাতীয় কবিরে আকড়ে ধরে বলতে পারিনা, এই লাশ আমার মায়ের সন্তানের, আমার ভাইয়ের। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।