প্রতিবছরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বাড়ছে। আর এই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের সিংহ ভাগই তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যন্ত্রপাতি ও প্রকৌশলসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি করছে বাংলাদেশ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১১ সালে দেশটি বাংলাদেশ থেকে ৪৮৭ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল, যা ২০১২ সালে ৮ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৪৯১ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। এর বিপরীতে দেশটি ২০১১ সালে বাংলাদেশে ১১৪ কোটি ৩৮ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, যা আবার ২০১২ সালে ব্যাপকভাবে কমে নেমে আসে ৫০ কোটি ১৯ লাখ ডলারে।
বিষয়টি এভাবে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশ থেকে বেশি পণ্য আমদানি করছে যুক্তরাষ্ট্র। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি মানে বাংলাদেশের রপ্তানি—এভাবে বিশ্লেষণ করলে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে এবং যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। তবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্য কোনো বাজার বা অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা পায় না। হালে বাংলাদেশকে দেওয়া জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স বা অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা) বাতিলের জন্য যে হুমকি দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ মোট রপ্তানির মাত্র ১ শতাংশ জিএসপি সুবিধা গ্রহণ করতে পারে, তার পরও এই জিএসপি বাতিল করা হলে তা বাংলাদেশ সম্পর্কে সারা বিশ্বে একটি নেতিবাচক বার্তা দেবে।
সে জন্যই এই জিএসপি অটুট রাখার জন্য সরকারের দিক থেকে দেনদরবার করা হচ্ছে।
তবে গত মাসে সাভারে রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনায় দুনিয়াজুড়ে যে নিন্দার ঝড় উঠেছে, তার জের ধরে আমেরিকা-ইউরোপের বাজারে বিদ্যমান সুবিধাগুলো অটুট থাকা হুমকির মুখে পড়েছে। ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে যে ইউরোপের বাজারে বিদ্যমান শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা বাতিল করা হতে পারে, যদি বাংলাদেশ শ্রমিকদের জীবনমান ও কর্মপরিবেশের যথেষ্ট উন্নতি না ঘটায়। অন্যদিকে মার্কিন গণমাধ্যমে গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, ওবামা প্রশাসন বাংলাদেশকে দেওয়া শুল্কছাড় বাতিল করতে পারে। অবশ্য এই শুল্কছাড় অল্প কিছু পণ্যে দেওয়া আছে, যেগুলোর মধ্যে আছে তামাক, গলফ খেলার সামগ্রী, সিরামিক ও মাথায় বাঁধার ফিতার মতো কিছু পণ্য।
এগুলো বাংলাদেশের মোট রপ্তানির সামান্য অংশ।
কিন্তু বাংলাদেশি পণ্য আমদানির ওপর যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই উচ্চ শুল্ক বহাল রেখেছে, যা নিয়ে প্রচুর তর্ক-বিতর্কও হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে আমদানি যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে এই শুল্ক আদায়ের পরিমাণ। ছয় বছরের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি বাড়িয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। একই সময়ে আমদানি করা পণ্যের বিপরীতে শুল্ক আদায় বেড়েছে প্রায় ৪৮ শতাংশ।
২০০৬ সালে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা পণ্যের পরিমাণ ছিল ৩২৭ কোটি ১৪ লাখ ডলার। একই বছর এই আমদানির বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ৪৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার জমা হয়েছে। অথচ ওই বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ছিল ৩৩ কোটি ডলার, অর্থাৎ ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানি করে যে আয় করেছে, তার দেড় গুণ বেশি আয় হয়েছে বাংলাদেশি পণ্য আমদানির বিপরীতে শুল্ক আদায় থেকে।
ছয় বছর পর এসে মূল চিত্রটি একই রকম আছে। ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্র ৪৯১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের বাংলাদেশি পণ্য আমদানি করেছে।
আর এই বছর আমদানি শুল্ক বাবদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোষাগারে জমা পড়েছে ৭৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে তিন বছর পর শত কোটি ডলারের শুল্ক আদায় হবে বাংলাদেশি পণ্য আমদানির বিপরীতে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রগ্রেসিভ ইকোনমির সংকলিত উপাত্ত থেকে দেখা যায়, ২০১২ সালে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। অবশ্য ২০১১ সালে এই হার ছিল ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ। আর সে বছর ৭৪ কোটি ৬০ লাখ ডলারের শুল্ক আদায় করা হয়েছিল বাংলাদেশি পণ্য আমদানির বিপরীতে।
যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট রাজস্ব আয়ের মাত্র ১ শতাংশ এখন আসে আমদানি শুল্ক থেকে। তার পরও বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো গরিব এবং উন্নয়নশীল দেশের পণ্য আমদানির বিপরীতে উচ্চহারে শুল্ক আদায় করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গত বছর এই দেশগুলো থেকে আমদানির বিপরীতে গড় শুল্ক হার ছিল যথাক্রমে ১৫ শতাংশ, ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ, ১১ দশমিক ৩ শতাংশ ও ১০ শতাংশ। অথচ একই সময়ে সৌদি আরব, ফ্রান্স ও ব্রাজিল থেকে পণ্য আমদানিতে গড়ে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ, শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ ও শূন্য দশমিক ১ শতাংশ হারে শুল্ক আদায় করা হয়েছে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) দোহা আলোচনা পর্ব অনিষ্পন্ন থাকায় বহুপক্ষীয় বৈশ্বিক বাণিজ্যব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে না।
বাস্তবে বাংলাদেশসহ অল্প কয়েকটি দেশ ছাড়া প্রায় সব দেশকেই বিভিন্নভাবে শুল্কমুক্ত ও শুল্কছাড়ের সুবিধা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।