কত কিছু যে করতে চাই, তবুও কিছু করতে না পারার দায়ে মাথা খুঁটে মরি ।
কথা নাই বার্তা নাই, এই ভরদুপুরে একটা ভাত ঘুমের মাঝে এমন ডাকাডাকি আমার পছন্দ হল না। এত বিরক্ত হলাম, কে যে আসল! ধূরর। এদের ঘরে কী বউ ছেলে নাই, আমাকে এই সময়ে বিরক্ত করার মানে কী ! আমি মেজাজ খারাপ করে দরজা খুললাম। সোলায়মান সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন।
হাঁপাচ্ছেন। ঘেমে শার্ট ভিজিয়ে ফেলছেন। স্বাভাবিক ভাবেই আমার বিরক্তের মাত্রা আরও একটু বেড়ে গেল। আমি শুকনো মুখে বললাম, “বসুন”। উনি তাড়াতাড়ি আমার হাতে একটা ভারী ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “ ভাবছিলাম অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ হয়না, তাই আজকে দুপুরে একসাথে খেয়ে দুজনে গল্পগুজব করব।
”
মেজাজটা খুব সংযত রেখে বললাম, “ সোলায়মান সাহেব আমি খেয়ে ফেলেছি। আর আজকে আপনাকে খাওয়ানোর মত কিছু নেই। ”“ও কিছু নেই?”, বেচারা সোলায়মান সাহেব একটু হতাশ হলে বোধহয়। উনার স্ত্রীর রান্না কয়েকবার আমি খেয়েছি। ঠিক খেয়েছি বললে ভুল হবে, জোর করে খাওয়ানো হয়েছিল।
সম্ভবত রান্নাটা দিন কয়েক আগের ছিল। আর, যখন তখন গরম করে খেয়ে দেয়ে গরম অবস্থাতেই বোধহয় ফ্রীজে রাখা হত। মানে যা বোঝাতে চাচ্ছি, তা হল, এত অলস মানুষ আমি জীবনে দেখি নাই। আর সোলায়মান সাহেব একদম উলটা। সারাদিন এখান থেকে সেখানে।
কার মেয়ের বিয়ে তার জন্য বাবুর্চি লাগবে, কার পেটে অসুখ তার জন্য কবিরাজ লাগবে, কোন পীরের কোন এলাকায় আগমন এসব নিয়ে আর হাজার রকম ধান্ধা ফিকির নিয়ে উনি সারাদিনই ব্যস্ত থাকেন।
আমার হাতে ধরা ব্যাগটা দেখিয়ে বললেন ওটা খুলুন,”ওখানে কিছু পুরোনো জিনিস আছে। “ আমি একটু অবাকই হলাম। তবে কী সোলায়মান সাহেব আমার থেকে ধার নেয়া জিনিস গুলো ফেরত দেবন?
নাহ, ব্যগ খুলে দেখি কিছু পুরোনো হাড়। উনার দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলাইয় বললাম, “ আমি আগেই বলেছি সোলায়মান সাহেব, এসব মাতলামো আমার পছন্দ না।
আমাকে ভূত-প্রেত বিশ্বাস করানোর জন্য আপনি এভাবে পিছে লেগেছেন কেন? সেদিনই আমি আপনাকে বলেছি, যত যাই প্রমাণ দেখান, আমি এসব বিশ্বাস করিনা। ” উনি কাতর গলায় বললেন, “ আকাশ ভাই রাগ করেন কেন? ভূতে বিশ্বাস না করাটা অজ্ঞতা। এই হাড়গুলা এক প্রেতসাধকের থেকে নিয়ে এসেছে আমি। রাত বারোটায় এটা হাতে নিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে ভূতকে ডাকলেই ভূত আসে। হাড় নাড়াচাড়া করে।
শুধু আপনাকে বিশ্বাস করানোর জন্যই এনেছি। ”
“রাত বারোটায় কেন? আপনি বলতে চান ভূত ঘড়ি ব্যবহার করে? কী মনে হয়, ফাস্টট্র্যাক নাকি রয়্যালস? ভূতের হাতে কোনটা মানাবে? তাছাড়া পাঁচ ছয়টা হাত হলে ত সমস্যাই, তাই না? আপনার হাড় নিয়ে যান, প্লিজ। ”, সোলায়মান সাহেবকে জানিয়ে দিলাম। উনি আরও কাতর কণ্ঠে বললেন, “ ভাই অনেকে ভূত মানেনা, জ্বীন মানে। ঐ ত একই।
ঠিক না? এই কথা ধর্মেও লেখা আছে জানেন? ওয়ামা খালাকতুল জিন্না ওয়াল ইনসা ইন্না লিইয়াবুদুন। আপনি আজকে একবার শুধু ট্রাই করেন। ভূত না আসলে আমি নিজে ফেরত নিয়ে যাব এগুলো। আপনার সব টাকা দিয়ে যাব। ” এতক্ষণে মনে হল আসল কথা কিছুটা আন্দাজ করলাম।
উনাকে বললাম,” ভূত আসুক না আসুক, আপনাকে টাকা দেয়ার প্রশ্নই উঠেনা। এই হাড্ডিগুড্ডির জন্য ত নাই-ই। আপনি যে এগুলো বিক্রি করার জন্য এসেছেন আমি বুঝিনি, তাই এত সময় ব্যয় করলাম। ”
অতঃপর আরও কিছুক্ষণ মুলামুলি। অতঃপর যেমনটা হয়, উনার সাথে আমি কোনদিনই কথায় পারি না।
আর আজকে এই হাড্ডিগুড্ডির সেলসম্যান হিসেবেও উনার কাছে তাই আমার হার অনিবার্য ছিল। এগুলা যে সত্যিই মানুষের হাড় চোখের দেখায় সেটা নিশ্চিত হয়ে উনাকে এক হাজারটা টাকা দেয়া লাগল। উনি যদিও বারবার বললেন, কালকের মাঝে ভূত না আসলে সব টাকা ফেরত, কিন্তু উনার হাসির মাঝেই এমন কিছু ছিল, বুঝলাম যে, সে আশা দূরাশা।
হাড়গুলা ড্রেসিং টেবিলে রেখে ঘুম দিলাম। আসলে উনি যাবার পর শরীরটা এত অবসন্ন লাগছিল, তার উপর আবার হাজার টাকা বেরিয়ে গেল।
সব মিলিয়ে শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে গেলাম।
মনে হল, ঘুমের মাঝেই যেন হাঁটছি। কুয়াশার ভেতর আমিই যেন আমাকে ভয় দেখাচ্ছি। কতদিন পর কিছু আজেবাজে ভয়ের স্বপ্ন দেখলাম।
ঘুম থেকে উঠে দেখি অনেক রাত বুঝলাম না কিছু।
কী হল!! কী মনে হল ঘড়িতে তাকালাম, রাত বারোটা। একটু অবাকই হলাম। দুপুর তিনটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত ঘুমানোর কোন কারণই ছিল না আমার। মোবাইলে ভাইব্রেশন দেয়া ছিল, দেখি ওর কল আসছিল ১৪ বার। বেচারী নিশ্চয়ই ক্ষেপে আগুন।
ভাবছি এখন কলব্যাক করব নাকি সকালে। কারণ, এখন কথা বললে সারা রাত শুধু রাগ ঝাড়বে, কিন্তু সকালে এতক্ষণ সুযোগ পাবে না। এসব ভাবছিলাম, হঠাৎ মনে হল, একটা যেন খড় খড় শব্দ হল, এরপর দেখি মোবাইলটা বেজে উঠল। ওর কল। হাবিজাবি কথা, ব্যাখ্যা একটা দিলাম বটে, কিন্তু ঝাড়ি থেকে বাঁচতে পারলাম না।
বেশিক্ষণ কথা আলানো গেল না। নেটওয়ার্ক সমস্যা করছে কেন যেন। কখনও ত বাসার ভিতরে করে না, কিন্তু আজকে কেন যেন রেডিওর মত কথার ভিতরে অনেক খচ খচ আওয়াজ করছিল। কথাই বলা যাচ্ছিল না। তাই আর কথা বাড়াই নি বেশিক্ষণ।
কল কেটে দেবার পরেও মনে খচ খচ করতে লাগল, “ ও ঘরে কীসের শব্দ হল তখন?” রাতে আর উঠতে ইচ্ছা করছিল না। আবার শুয়ে পড়লাম।
একদম ভোরে ঘুম ভাঙ্গে। রাতে দেখি ও আবারও এত্তগুলো কল দিয়েছিল। ভাইব্রেশনে দিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম! আবারও ধরতে পারি নি।
আফসোস। সেলফোনে সময় দেখলাম। সাড়ে চারটা বাজে। আমার মাথা একদম পরিষ্কার কাজ করছে। মনে হচ্ছে যেন ভাসছি।
এমনিই কালকে রাতে আওয়াজের কথা মনে পড়ল। খুব দ্রুতই মাথার মাঝে ব্যাপারটা ধরা পড়ল। মোবাইলে কল আসলে তা স্পীকারের সামনে রাখলে যেমন খর খর শব্দ হয়, কালকে রাতে লিভিং রুমে তেমনটাই শুনেছিলাম। কিন্তু, ওখানে ত স্পীকার নেই, তবে?
কী মনে হতে ব্যাগটা খুললাম। বেশ কিছু হাড়।
মানুষের। পুরোনো। এসবে আমার কখনও ভয় ধরেনা। তবুও এই হাড়গুলোর মাঝে বিশেষ কী যেন কিছু ছিল। আমি বুঝলাম না।
কী মনে হতে, একটা হাড়ে বাড়ি দিলাম। বিজিবিজবিজ শব্দ হল। বুঝলাম না, এত হালকা বাড়িতে এত গম্ভীর আওয়াজ কেন! জোরে একটা বাড়ি দিলাম। আবার আওয়াজ হল। হঠাৎ করে ভয় পেয়ে গেলাম, একটা হাড়ে বাড়ি দিলে আসলে সবগুলো হাড় কাঁপছে।
আমি ভয়ে হাড়টা মাটিতে ফেলে দিলাম। কীভাবে যেন ব্যগটাও কাত হয়ে সবগুলো একই সাথে মাটিতে পড়ল। মনে হল, ব্যগটাকে যেন কেউ ধাক্কা দিয়ে উলটে দিল।
ঘামতে লাগলাম। একটা হাড় আবার উঠালাম।
উঠিয়ে ফেলে দিলাম। হাত থেকে পড়ে হাড়টা একটু লাফিয়ে উঠল। স্বাভাবিক ভাবেই ভারী জিনিস পড়লে যেমন হয়। কিন্তু, অস্বাভাবিক ব্যাপার হল, সবগুলো কেঁপে উঠল। আমি বুঝলাম না কী করব।
কার হাড় এগুলো?
কিছু না বুঝেই সকাল দশটায় নিজেকে আবিষ্কার করি অধ্যাপক মফিজুল হক স্যারের বাসায়। উনি একজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। আমার এক রকম আত্মীয় লাগেন। সব কাজ বাদ দিয়ে উনার কাছেই এসে পড়লাম।
“ স্যার, এই হাড়গুলা কীসের বলে মনে হয় আপনার? ”, হাড়গুলাকে স্যার আধাঘণ্টা পরীক্ষা করেছেন, এরপরেই উনাকে প্রশ্নটা জিগাসা করলাম।
“ আকাশ, তুমি এই জিনিস পাইছ কোথায়? এটা অনেকটাই মানুষের হাড়ের মতন, তাও মানুষের হাড় না ! মেরুদণ্ডের এই নিচের দিকের হাড়টা দেখ। এটা কী করে মানুষের হবে? পশুর হাড় হবার ত প্রশ্নই ওঠে না। যেই প্রাণীরই হাড়টা হোক না কেন, মানুষের শরীরের চাইতে তার দেহ অনেক অনেক নাজুক। এত বেশি নাজুক যে, আমার হিসেবে এই প্রাণির ত উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতাই থাকার কথা না। কারণ, এই হাড় সাপোর্ট দিতে পারবে না।
অথচ, এত অন্যান্য হাড়গুলো সাংঘাতিক শক্তিশালী। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা আরেকটু ঘাটতে হবে আমাকে। ”
© আকাশ_পাগলা
(বাকিটা আগামী কয়েক পর্বের জন্য রইল)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।