সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............
শ্রদ্ধাঞ্জলি হচ্ছে বলি!
মহান একুশের ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি যথারীতি অজস্র ফুলেল শ্রদ্ধাঞ্জলি দেয়া হয়েছে। আমি লক্ষ করে দেখেছি বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই শ্রদ্ধাঞ্জলি বানান ভুল লেখা হয়েছে। এমনকি আজ অন্তত ৮ টা বাংলা দৈনিক পত্রিকায় দেখেছি সেখানে বেশ কয়েকটা পত্রিকায় শ্রদ্ধাঞ্জলি বানান ভুল লেখা হয়েছে। কিছুদিন আগে একজন জাতীয় নেতার মৃত্যুবার্ষিকীতে ঢাকার দেয়ালে অনেক পোস্টার পড়েছিল। লক্ষ্য করেছি, পত্র-পত্রিকায় ক্রোড়পত্রও প্রকাশিত হয়েছে।
প্রায় সর্বত্রই উক্ত নেতার প্রতি "শ্রদ্ধাঞ্জলি" নিবেদন করা হয়েছে। একটি রাজনৈতিক দলের নেতার প্রতি নিবেদন করা এই "শ্রদ্ধাঞ্জলি" যে অশুদ্ধ, তা বোঝার মতো কেউ যদি তাঁদের মধ্যে না থাকেন, তা শুধু লজ্জাকর নয়, মর্মান্তিক বেদনার ব্যাপারও। কারণ অনেক অর্থ ব্যয় করে চার-রঙা বিশাল পোস্টার ছাপানোর মধ্যে নিঃসন্দেহে আবেগের পরিচয় আছে, কিন্তু সেই আবেগকে ধারণ করছে যে মৌল শব্দটি, তা যদি ভুল হয়, তবে শ্রদ্ধা নিবেদনকারী ব্যক্তিদের আন্তরিকতা সম্পর্কে সন্দেহ জাগতে পারে। কারণ, অসচেতন শ্রদ্ধা কাউকে গৌরবান্বিত করে না। প্রকৃত শ্রদ্ধা ব্যক্তির আত্মমর্যাদাবোধ, চিন্তার উৎকর্ষ ও সামাজিক দায়বদ্ধতার ফসল।
এ-ধরনের নিবেদন প্রযত্ন-প্রসূত হওয়া স্বাভাবিক। বহু বছর ধরে নানা মাধ্যমে অনেক মানুষ জানাতে চেষ্টা করছেন যে, সংস্কৃত শব্দ"অঞ্জলি", যার অর্থ "মিলিত করতলদ্বয়", রূপকার্থে যা বিনয়ের প্রকাশক, অন্য কোনও শব্দের সাহচর্যে এর কোনও পরিবর্তন সাধিত হয় না। এ বিষয় নিয়ে ছড়াও লেখা হয়েছে, যা অনেক শিশুও জানে :
"অঞ্জলি"তে হ্রস্ব ই-কার
অবশ্য তা করবে স্বীকার
গীতাঞ্জলি শ্রদ্ধাঞ্জলি
হ্রস্ব ই-কার হয় সকলই"।
সুতরাং সংস্কৃত সন্ধির নিয়ম অনুযায়ী শ্রদ্ধা + অঞ্জলি = শ্রদ্ধাঞ্জলি, কখনোই "শ্রদ্ধাঞ্জলী" নয়। আমরা যদি কাউকে শ্রদ্ধা নিবেদন করি তা যেন প্রাণের ভেতর থেকে উত্থিত হয়।
তাতে যেন আমাদের সচেতনতা ও সক্রিয়তার পরিচয় থাকে। তা না-হলে শ্রদ্ধার অঞ্জলি গলা কাটা বলির পাঁঠার মতো তড়পাতে থাকে, যা কখনও আমাদের কাম্য হতে পারে না। এজন্যই জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, "মানুষের ভাষা তার অনুভূতিদেশ থেকে আলো/ না পেলে নিছক ক্রিয়া বিশেষণ এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল/ জ্ঞানের নিকট থেকে ঢের দূরে থাকে। " আমরা চাই ব্যবহৃত শব্দ যেন অন্তরের বিশুদ্ধ অনুভূতিকে প্রকাশ করে, তা যেন আশ্রয়হীন শব্দের কঙ্কালে পরিণত না হয়।
বানান নিয়ে নানান ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা চোখে পড়ে।
অনেকে রসিকতা করে বলেন, "বানান? যেভাবে খুশি বানান!" কিন্তু এর ফল কি ভালো হতে পারে? অনেকে "ভুল" শব্দটিকে "ভূল" লিখে ভুল করেন। তখন মনে হয়, "ভুল সবি ভুল, এই জীবনের পাতায় পাতায়, যা লেখা সে ভুল। "
সামান্য সচেতন হলে যদি আমরা কিছু ভুলকে এড়াতে পারি, কেন এড়াব না? বুকের তাজা রক্ত দিয়ে যে জাতি মাতৃভাষার প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রমাণ করেছে, তাদের কাছে এটা তেমন কঠিন কোনও কাজ নয়। জীবনানন্দ তো আমাদের জানিয়েই গিয়েছেন, "ভাষা তার জ্ঞান চায়, জ্ঞান তার প্রেম। ।
ঢের সমুদ্রের বালি/ পাতালের কালি ঝেড়ে হয়ে পড়ে বিষণ্ণ মহৎ"।
বানানের সমতা বিধানের জন্য দীর্ঘকাল যাবৎ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পণ্ডিতবর্গের সহায়তায় কিছু নিয়ম-রীতি প্রবর্তন করেছেন। খুব ভালো হত, এসব যদি তাঁদের সকলের অনুমোদন লাভ করত। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে এসব ব্যাপারে এখনও তাঁদের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। আগে বাড়ি গাড়ি শাড়ি প্রভৃতি বানানে দীর্ঘ ই-কার ব্যবহৃত হত।
কিন্তু পণ্ডিতবর্গ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তৎসম ছাড়া অন্য শব্দে দীর্ঘস্বর ব্যবহৃত হবে না। তা তদ্ভব (অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষা থেকে পরিবর্তিত হয়ে আসা), দেশি বা বিদেশি যা-ই হোক না কেন। তাই এখন গাড়ী বাড়ী দাদী না লেখাই বিধেয়। কিন্তু দীর্ঘদিনের অভ্যাসকেই অনেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, শুদ্ধতাকে নয়। উক্ত নিয়মটি স্ত্রীবাচক, জাতিবাচক ইত্যাদি শব্দের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
এটা মেনে চললে ফরাসী, জাপানী, জার্মানী, ইরানী না লিখে ফরাসি, জাপানি, জার্মানি ও ইরানি লিখতে হবে। কিন্তু হচ্ছেটা কী? আমরা দু-রকম বানানই লিখিত হতে দেখছি। এর ফলে হযবরল অবস্থা সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। তা-ই হয়েছে।
"কি" ও "কী" নিয়েও সমস্যা তৈরি ( "তৈরী" নয়, কারণ, এটি ফারসি শব্দ) হয়েছে।
এর প্রথমটি প্রশ্নসূচক অব্যয়, অন্যটি প্রশ্নসূচক সর্বনাম। এইসব পরিভাষার ব্যবহার দেখলে ব্যাকরণ-ভীতু লোকজন ভয় পেয়ে যেতে পারেন। কিন্তু এগুলোকে চেনার সহজ উপায়ও কিছু আছে। যেমন, "তুমি কি আজকের পত্রিকা পড়েছ?" এর জবাব হয় "হ্যাঁ" বা "না"। এটি প্রশ্নবোধক অব্যয়।
আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি, যে প্রশ্নের জবাব "হ্যাঁ" বা "না" ছাড়া অন্য কিছু হয় না, তা সব সময় হ্রস্ব ই-কার দিয়ে লিখতে হবে, অর্থাৎ "কি"। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, "তুমি কী করছ?" বুঝতে পারি, উদ্দিষ্ট ব্যক্তি কিছু একটা কাজ করছে, সেই কাজটির বিবরণ জানতে চাওয়া হচ্ছে। এর উত্তর "হ্যাঁ" বা "না" নয়, অন্য কিছু। এর জবাব হতে পারে "পত্রিকা পড়ছি", বা "নাস্তা করছি" বা "কবিতা লিখছি"। এটি প্রশ্নবোধক সর্বনাম।
অর্থাৎ যে প্রশ্নের উত্তর "হ্যাঁ" বা "না" নয়, বরং একটি বিবরণ দাবি করে, তা সব সময় দীর্ঘ ই-কার দিয়ে লিখতে হবে। । "কী"।
এর বাইরেও একটি "কী" আছে। আকাশে সুগোল চাঁদ দেখে আমরা চিৎকার করে উঠি, "কী সুন্দর!" এটি একটি অবস্থার বিবরণ।
আনন্দ বা বিস্ময়সূচক। কোনও দুর্ঘটনার বিবরণ পড়ে যদি কেউ বলে ওঠে "ইস, কী মর্মান্তিক!" এর মধ্যেও আছে একটি অনাকাঙিক্ষত ও দুঃখজনক ঘটনার বিবরণ। যেহেতু কোনও বিশেষ অবস্থাকে বর্ণনা করছে, তাই "কী" উভয় ক্ষেত্রেই বিশেষণ। এই বিশেষণটি লিখতে হবে দীর্ঘ ই-কার দিয়ে। ।
"কী"।
অঃটঃ পাঠক, আপনারা যারা কস্ট করে আমার লেখা পড়েন-তারা সবাই জানেন-আমি প্রচুর পরিমান বানান ভুল লিখি। এখনো আমি নিয়মিত ভুল বানান লিখি। এটা আমার চলতি অভ্যাস। আজ অন্যের ভুল ধরতেগিয়েই ব্যাকরণ ঘাটাঘাটি করে এই লেখা! আমি ব্লগে ভুল করতে পারি-তা পাঠক ক্ষমা সুন্দর দৃস্টিতেই দেখেন।
কিন্তু রাস্ট্রীয়/জাতীয় পর্যায়ে এমন একটা প্রচলিত ভুল মেনেনিতে কস্ট হয়। কারন, যারা ভাষার জন্য প্রান দিয়েছেন-তাঁদের সম্মান জানাতে চাই শুদ্ধ ভাবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।