মা ডেকে কন, `খোকন-মণি! গপ্প তুমি জান?
কও তো দেখি বাপ!'
কাঁথার বাহির হয়ে তখন জোর দিয়ে এক লাফ
বল্লে খোকন, `গপ্প জানি, জানি আমি গানও!'
বলেই ক্ষুদে তানসেন সে তান জুড়ে জোর দিল-
`একদা এক হাড়ের গলায় বাঘ ফুটিয়াছিল!'
কাজী নজরুল ইসলামের ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থের `খোকার গপ্প বলা' কবিতার শুরুটা এভাবে। তিনি আমাদের জাতীয় কবি। তাঁর মেধা-প্রতিভা-সৃষ্টি অতুলনীয়। এককথায় তাঁর সামগ্রিক জীবন ও কর্ম ছিল বিস্ময়কর। কবিতা, গান, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে তিনি সোনা ফলিয়েছেন।
তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক বাঙালি। যেমন লিখেছেন ইসলামি গান, গজল, হামদ, নাত তেমনি লিখেছেন শ্যামাসংগীত।
বিদ্রোহী কবি খ্যাত নজরুলের শিশুসাহিত্য পড়ে ছোটদের ভালো লাগে। তাদের বেশ আকর্ষণ করে কবির মজার মজার ছড়া-কবিতা। তারা হেসে খেলে লুটোপুটি খায়।
তারা নেচে গেয়ে মজা করে। যেমন-
ভোর হোলো
দোর খোলো
খুকুমণি ওঠ রে!
ঐ ডাকে
যুঁই শাখে
ফুল-খুকি ছোট রে
খুকু মণি ওঠ রে!
রবি মামা
দেয় হামা
গায়ে রাঙা জামা ঐ,
দারোয়ান
গায় গান
শোনো ঐ, `রামা হৈ!'...
কিংবা যখন পড়ে-
আমি হব সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুম-বাগে
উঠব আমি ডাকি!
সুয্যি মামা জাগার আগে
উঠব আমি জেগে,
হয় নি সকাল, ঘুমো এখন,
মা বলবেন রেগে। ...
মনে পড়ে `লিচু-চোর' কবিতার কথা! একটু পড়া যাক, কী বলো-
বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস্ করলে তাড়া
বলি থাম্, একটু দাঁড়া!
পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গ্যে যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,
ও বাবা, মড়াৎ করে
পড়েছি সড়াৎ জোরে!
পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,
সে ছিল গাছের আড়েই...
এভাবে এগিয়ে যায় গল্প। সেই সঙ্গে পাঠকের মনের চোখে ভাসে পুরো দৃশ্যটি। আরেকটু ওপরের শ্রেণীতে উঠে তারা পড়ে শিহরিত হয়, আলোড়িত হয়।
সেই সঙ্গে কচি মনে জাগে সংকল্প-
থাকব না ক বদ্ধ ঘরে
দেখব এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে। ...
কেমন করে বীর ডুবুরি
সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে,
কেমন করে দুঃসাহসী
চলছে উড়ে স্বর্গপানে। ...
পাতাল ফেড়ে নামব আমি
উঠব আমি আকাশ ফুঁড়ে,
বিশ্বজগৎ দেখব আমি
আপন হাতের মুঠোয় পুরে।
আবার যখন `অভিযান' কবিতাটি পড়া হয় তখন বিপদ-বাধা তুচ্ছ করে এগিয়ে চলার প্রেরণা পায় খুদে পাঠক-
নতুন পথের যাত্রা-পথিক
চালাও অভিযান!
উচ্চকণ্ঠে উচ্চার আজ-
`মানুষ মহীয়ান'
চারদিকে আজ ভীরুর মেলা
খেল্বি কে আর নতুন খেলা?
জোয়ার জলে ভাসিয়ে ভেলা
বাইবি কি উজান?
পাতাল ফেড়ে চলবি মাতাল
স্বর্গে দিবি টান । ।
মা শব্দটি আমাদের কত চেনা। তিনি আমাদের সবচেয়ে আপন। সন্তানের জন্য তিনি কত না কষ্ট করেন। সন্তানও মায়ের প্রতি অনুভব করে গভীর মমতা। কবির `মা' কবিতার কয়েক স্তবক পড়া যাক।
যেখানেতে দেখি যাহা
মা-এর মতন আহা
একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই
মায়ের মতন এত
আদর সোহাগ সে তো
আর কোনখানে কেহ পাইবে না ভাই।
হেরিলে মায়ের মুখ
দূরে যায় সব দুখ,
মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান,
মায়ের শীতল কোলে
সকল যাতনা ভোলে
কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান। ...
এভাবে আনন্দময় শৈশব পেরোয় বাঙালি শিশু-কিশোর। পড়তে পড়তে তারা চারপাশের পরিবেশ-প্রতিবেশ চেনে। তারপর পরিচিত হয় কবির সঙ্গে।
কবির গানের সঙ্গে। দুখু মিয়ার সঙ্গে। যিনি মক্তবের শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, মাজারের খাদেম হিসেবে ছোটবেলায় নজর কাড়েন। যিনি রানিগঞ্জে বাবুর্চি করেন; আসানসোলে রুটির দোকানে কাজ করেন; সপ্তম শ্রেণীতে ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাইস্কুল থেকে পালানো; অষ্টমে শিয়ারশোল হাইস্কুলে ভর্তি; দশমে নাম লেখান ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনে। এরপর সৈনিক জীবন শেষে কবির নতুন যুগ, নতুন অধ্যায়।
কবির জন্ম পশ্চিমবঙ্গের (ভারত) বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে। তখন ছিল ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬। বাবা কাজী ফকির আহমদ। মা জাহেদা খাতুন। কবি মৃত্যুবরণ করেন ১৩৮৩ সালের ১২ ভাদ্র।
বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদসংলগ্ন কবরস্থানে তাঁকে কবর দেওয়া হয়।
আমরা তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।